পঞ্চান্নতম পর্ব
আবীর ভট্টাচার্য
‘মাঘের সূর্য উত্তরায়ণে পার হয়ে এলো চলি’... সেই কোন ছোটবেলায় পড়া সঞ্চয়িতার ‘বোধন’ কবিতার চরণ কয়টি এমন সব দিনে অকারণেই গুণগুণ করে মনে। তখনও উত্তরায়ণ,দক্ষিণায়ণ বোধ জন্মায়নি,বাবার মুখে শোনা মহাভারতের ভীষ্মের ইচ্ছামৃত্যুর সঙ্গে পরে শেখা ভৌগলিক বোধকে জড়াতে ইচ্ছেও হয়নি। শুধু যখনই শীত শেষের বিবাগী হাওয়া ঈশান থেকে নৈঋতে হু হু বয়ে যায়, কবিতার চরণগুলি মনে মনে আওড়ায় অহনা।
ঋতুর নিয়মেই দিন ক্রমে বড়ো হতে শুরু করেছে,গাছে গাছে পাতাঝরার বিন্যাস। মাঝরাতে মাঝে মধ্যে লেপ সরিয়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়,পায়ের তলা ঘামে।ভোরের বেলা চাদর জড়াতে হলেও দুপুর রোদে তাতের ঝাওল,নুন-লঙ্কা মাখানো টোপাকূলের গন্ধ মসলা বড়ির গন্ধ ছাপিয়ে উঠোনের রোদে গা শেঁকছে।এমন সব অলস বেলায় অহনার মন ঘরে টেকেনা। দৈনন্দিন কাজকর্ম, খাওয়া দাওয়ার শেষে,ছেলেকে পিসিমার কাছে ঘুম পাড়িয়ে, নিরালা দুপুরের অবসরে সে খানিক পুকুরপাড়ে এসে বসে। কখনও জলে চরা পিসিমার হাঁসগুলির পেছনে ঢিল ছোঁড়ে, কখনও ঝরে পড়া কাঁঠাল পাতায় বসে থাকা ফড়িংটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে তাকিয়ে এলোমেলো কতো কি মনে করে…কখনও জলঢোঁড়া সাপ শুকনো পাতার ওপর দিয়ে সরসর চলে যায়, পুকুরের কোনাকুনি গোসাপ জল পারাপার করে।ওপারের মাঠ থেকে উতল দখিনা হাওয়া ছুটে এসে তার ঘোমটা খসিয়ে দেয়।চমকে উঠে ঘরের বৌ,খিড়কি বন্ধ করে ঘরে আসে।উঠোনে জরতে দেওয়া দু-একটি কূল মুখে ফেলে সকালে দেওয়া বড়ির তারজালিগুলো পড়ন্ত রোদের দিকে টেনে দেয়। বারান্দার চৌপায়ায় পড়ে থাকা সকালের একলা কাগজটা খানিক উল্টে পাল্টে পড়ে, কখনও পিসিমার ঘরে গিয়ে ছেলের পাশে গিয়ে ঘুমোয়, কখনও বা পায়ে পায়ে বড়ো জ্যাঠামশায়ের ঘরে ঢুকে তাঁর বইয়ের আলমারীর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়,হাত বুলিয়ে বুলিয়ে তাদের সঙ্গে চলে অকথিত বিশ্রম্ভালাপ।
সেদিনও তেমনই আলমারীর পাল্লাটা খুলতেই কেমন যেন একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে লাগলো। অনেক দিন খোলা হয়নি কাজের চাপে বা বেখেয়ালে, তাই খানিক অভিমান হয়েছে বুঝি!
🍂
‘বই বলে কি ওরা মানুষ নয়!’
-পিসিমার বলা কথাগুলো মনে পড়তে আনমনে হেসে উঠলো তরুণী,বইগুলোর গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে মনে পড়ে, পিসিমা সুস্থ থাকাকালীন পড়ুন বা না পড়ুন,মাঝেমধ্যেই বইগুলো ওলটপালট করে মুছে সাজাতেন,তাকের কোনে কোনে কর্পূর দিতেন,গল্প বলতেন। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায়,অনেক দিন ওদের যত্ন আত্তি হয়নি।
নাঃ কাল সময় করে অবশ্যই রোদে দিয়ে মুছে তুলে রাখবে সে, পিসিমার মতো কর্পূরও দেবে কোনে কোনে!... ভাবতে ভাবতেই তার মনে এলো বাবার কথা,না দেখা জ্যাঠামশাইয়ের কথা,বইয়ের সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্বের কথা।
বাইরে তখন আমড়া গাছে দুষ্টু শালিখদের ভীড়,ডাহুক-মা তার ছানাদের নিয়ে পোকামাকড় খুঁজতে বেরিয়েছে, দূরের কোন গাছ থেকে কুবো পাখি একটানা কুব-কুব করে ডেকে যাচ্ছে…এমনই নিস্তরঙ্গ অলস দুপুরে স্মৃতি হাতড়ানো তরুণীর হাত এসে থামলো কার্ডবোর্ড বাঁধানো একটা বিশালদেহী লালরঙা পুস্তিকার গায়ে।সাবধানে তাক থেকে টেনে,পাতা উল্টিয়ে চেয়ে দেখল,
মহাভারত!
-কালীপ্রসন্ন সিংহ।
ইনি কে!...ইনি কে!...একটু ভাবতেই মনে ভেসে উঠলো, সেই সময়,সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নবীন কুমার, আর্যপুত্র…দুরন্ত কিশোরীবেলা,মায়ের চোখ এড়িয়ে বয়সের আগেই দেশে ধারাবাহিক ভাবে বেরোনো সেই অসাধারণ উপন্যাসটি গোগ্রাসে পড়ে ফেলা…নায়ক তো ছিলেন তিনিই…লিখতে লিখতেই মারা গিয়েছিলেন সেই অমিত প্রতিভাধর তরুণটি…উপন্যাসটি তো তাঁকে ঘিরেই!... সেই লেখকের লেখা বিখ্যাত সেই বই এটি! এতোদিন চোখে পড়েনি কেন!
বাবার বাড়িতে রাজশেখর বসুর মহাভারত দেখেছে সে, দেখেছে মনুসংহিতাও,এমন কি বুদ্ধদেব বসুর লেখা অতি বিখ্যাত ‘মহাভারতের কথা’ বইটি খানিক পড়েওছে নিজে। কিন্তু কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারত!এতো দূর্মুল্য!
ঈশ্!বাবাকে তো বলাই হো’লনা!,’দেখ বাবা, আমার শ্বশুর বাড়িতেও কিন্তু তোমার মতো অনেক দামী দামী বই আছে, তোমার মতো এগুলিও তো আমার সম্পদ।আগলে রাখবো,পারলে পড়বোও সব’…
ধীরে ধীরে আঙ্গুল চলতে লাগলো, তদানুসারী চোখও…কবেকার কোন যুগন্ধর কলমের ছোঁওয়ায় বহুল প্রকাশিত আখ্যানগুলি পূনর্নিমিত হতে লাগলো একালের কোন অর্বাচীনা তরুণীর মনে…তৎকালীন উত্তর কলকাতার বরাহনগরে অবস্থিত সারস্বতাশ্রম নামের কোন প্রাসাদোপম অট্টালিকার কোন এক প্রায়ান্ধাকার কক্ষের সেজবাতির সম্মুখে অসীম স্মৃতিধর কোন কায়স্থ কূলতিলক ব্রাহ্মণসদৃশ খাগ-কলমে লিখে চলেছেন,
“নারায়ণ ও নরোত্তম নর এবং দেবী সরস্বতীকে নমস্কার করিয়া জয় উচ্চারণ করিবে।
কোন সময়ে নৈমিষারণ্যে, কুলপতি শৌনক দ্বাদশ বার্ষিক যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। একদা মহর্ষিগণ দৈনন্দিন কৰ্ম্ম সমাধান করত, সকলে সমবেত হইয়া কথা- প্রসঙ্গে সুখে অধ্যাসীন হইয়া আছেন, ইত্যবসরে লোম-" হর্ষণপুত্র পৌরাণিক সৌতি অতি বিনীত ভাবে তথায়…”
আশেপাশে চক্রবৎ ঘূর্ণায়মান তৎকাল,লোকহিতৈষনা, জনকল্যাণ,বিদ্যোৎসাধিনী সভা,রানী ভিক্টোরিয়া, বিদ্যাসাগর, বিধবাবিবাহ,শরৎকুমারী, কুসুমকুমারী,গঙ্গাপ্রসাদ…ছায়ার মতো, মায়ায় মতো কাছে আসছে,দূরে যাচ্ছে।অথচ ভ্রূক্ষেপহীন তিনি আধুনিক ব্যাসের মতোই লিখে চলেছেন বাংলাভাষায় প্রথম অনুদিত ও সম্পাদিত, ১৮৫৮ থেকে ১৮৬৬ এর ভিতরে প্রকাশিত আঠারো পর্বের সেই সুবৃহৎ ভারত কথা…
ভাবতে ভাবতেই দিনের আলোটুকু ঢলে পড়ে পুকুরপাড়ের নারকেল গাছের মাথায়।বাবুর ঘুম থেকে ওঠার সময় হোল।তার আগে পিসিমার হাঁস গুলিকে খাঁচায় পুরতে হবে…
পরম মমতায় আঁচল দিয়ে পুরনো বইটি মুছে তরুণী চললে পুকুরপাড়ে,
-’আ…চৈ…চৈ…চৈ!
জীবন তাকে ডাকছে!সেও জীবনকে…
অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে আবার মনে পড়লো বাবার কথা,বাবা বলতেন,
-’মা রে! রবীন্দ্রনাথ আর রান্নাঘর একেবারেই একসাথে মেলেনা। একমাত্র বাঙালী মেয়েরাই হয়তো এটা মিলোতে পারে…’
-’পারে তো,পারেই তো বাবা। আমিও মেলাবো,মিলিয়ে দেখাবো তোমায় কোনদিন’...
‘বলতে বলতে পুকুরে ডুব দিয়ে দ্রুত গা-কাপড় ধুয়ে তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বালতে এগোয় সে,
“জীবনে জীবন যোগ করা
0 Comments