জ্বলদর্চি

সুখচর /পুলককান্তি কর

চিত্র- শুভম দাস 

সুখচর

পুলককান্তি কর

বাইরের ছায়ান্ধকার গাছটার দিকে চেয়ে লামডিঙ এর কথা খুব মনে পড়ল অভিজ্ঞানবাবুর। শীর্ষেন্দুর অনেককটা গল্পে লামডিঙ  নিজেই একজন নায়ক। এ এরকম একটা স্বপ্নের জায়গা যেখানে কোনও দুঃখ নেই, কষ্ট নেই – যেখানে এক সাথে শরীরির সাথে অশরীরি মিলেমিশে থাকে- সেরকম দেশে একবার যেতে পারলে ভালো ভালো হত। সেখানকার অনন্ত জোৎস্নায় ডুব দিয়ে রাতগুলোকে আর একটু স্বপ্নিল, আর একটু মায়াময় করে নিলে ভালো হত। বার্ধক্য জনিত অনিদ্রা নিয়ে আজকাল ছটফট করতে করতে জীবন সম্পর্কে বড় অনীহা জাগে।

ষাট বছরে অবসর নিয়ে অভিজ্ঞান এই গ্রামটিতে এসে জায়গা কিনে ঘরবাড়ী বানিয়েছিলেন- সুমনার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না এখানে আসার। ছেলে বড় হয়ে বিদেশে প্রতিষ্ঠিত, সুতরাং স্কুল কলেজের প্রয়োজন নেই - সে না হয় মানাই যায়- কিন্তু নিদেনপক্ষে হাসপাতাল, নার্সিংহোমের সুযোগ সুবিধা না থাকলে বুড়ো বয়সে মানুষ কোথায় যাবে- এই চিন্তা তো যে কোন বুদ্ধিমান মানুষের বিচার্য হবে! সারাজীবনে অভিজ্ঞানবাবু সংসারের কোনও বিষয়ে নিজের পৌরুষ ফলিয়েছেন- এই অপবাদ তাঁর অতি বড় শত্রুতেও দেবে না- কিন্তু এই বিষয়টায় তিনি এমন গোঁ ধরে রইলেন যে সুমনাকে নিরস্ত হতে হল। সুমনা অভিজ্ঞানের সাথে এক অফিসেই চাকরী করতেন, তাঁর আর্থিক কোনও অবলম্বন দরকার ছিল এমনও নয়- তবু এই সিদ্ধান্ত নিয়ে মনোমালিন্য এমন জায়গায় পৌঁছলো যে হয় এই গ্রামে তাঁকে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নিতে হত,  নইলে অন্য কোথাও বা বৃদ্ধবাসে নিজের ব্যবস্থা করতে হত। অভিজ্ঞানের এখানে আসা্র যুক্তি কারো কাছেই পরিষ্কার ছিলা না- না এখানে পৈতৃক ভিটে, আত্মীয়ের বাড়ী আছে- না আছে জায়গার কৌলিন্য। এমনও নয় যে এখানে অসম্ভব সুন্দর নৈসর্গিক দৃশ্য আছে। গ্রাম থেকে অন্তত সাত কিলোমিটার দূরে একটি খালের মতো জলধারা আছে- নামেই নদী- গ্রীষ্মকালে তাতে আগাছা ভর্তি চর জেগে থাকে। তবে গ্রামটির নামটা  বেশ। তালগড়! বোধহয় এককালে এখানে অনেক তালগাছ ছিল। এখনও আছে। অভিজ্ঞান বাবুর সীমানার মধ্যেই তিনটে তালগাছ- একটা আবার বারোমাসী। এতে সারা বছর তাল ফলে - তবে সুমনার রান্নাবান্নার প্রতি কোনও কালেই আসক্তি ছিল না- সুতরাং এমনকি জন্মাষ্টমীতেও  বাড়ীতে তালের বড়া বা পিঠে হয়না কোনওদিন।

🍂

এক ছেলে সৌমিত্র গতকালই এসেছে প্রায় সাত বছর পরে। অবশ্য সুমনারই তাড়নায়। উদ্দেশ্য অভিজ্ঞান উইল করবেন, সেই সংক্রান্ত আলোচনা বা পরমার্শ। অবশ্য এতে সুমনার যে খুব বেশী সায় ছিল তা নয়, তিনি অনেকটা বাহকের কাজ করেছেন। অভিজ্ঞানের বক্তব্য পৌঁছে দিয়েছেন, সেই নিয়ে কয়েকবার তাড়াও দিয়েছেন; কিন্তু এই আলোচনায় তিনি আগাগোড়াই অনুপস্থিত ছিলেন। রাতে খাওয়াদাওয়া শেষ করে অভিজ্ঞান যখন এই বাড়ী সহ কুড়িকাঠা বাস্তুজমি ছেলের নামে উহল করে দিতে চাইলেন, ছেলে স্পষ্টই জানালো তার পক্ষে এসে এই বাড়ীর দখল নেওয়া সম্ভব নয়। অভিজ্ঞানের কাছে ব্যাপারটা যে খুব অপ্রত্যাশিত ছিল এমন নয়, ছেলে মায়ের ধারা পেতেই পারে, তবু একবার জিজ্ঞাসা করলেন কারনটা কি খোলাসা করে বলবি বাবু? 

- এই ধ্যাদ্ধেড়ে গোবিন্দপুরে এসে আমার পড়তায় পোষাবে না বাপি। যাতায়াতের খরচ উঠবে না। আমি এত দূরে এসে এ সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য কাঠখড় পোড়াতে পারবো না। তুমি অন্য ব্যবস্থা কর।

অভিজ্ঞানকেও যেন আজ তিক্ত কথা শোনার ইচ্ছেয় পেয়েছে। তিনি বললেন, আমাদের মধ্যে শেষ জন যে বেঁচে থাকবে- তার শ্রাদ্ধ-শান্তিতে তো তুই আসবি নাকি? তোকে আলাদা করে এর জন্য কে আসতে বলছে?

- ভবিষ্যতের কথা তো বলা যায় না বাপি। প্র্যাকটিকাল হওয়া ভালো। একবার আসার প্ল্যান করলে আমাকে তিন মাসের হ্যাপা পোয়াতে হয়। তখন কোথায় কখন থাকবো, তার ঠিক কি!

এরপর আর কথা চলেনা। অভিজ্ঞান বললেন - আর অস্থাবর সম্পতি?' 

- তা চাইলে তোমরা আগেই ব্যবস্থা করতে পারো। মায়ের ব্যাঙ্কের পাশবইয়ে আমার নাম তো আছেই। আমি অটোমেটিক্যালি ওটা অপারেট করতে পারবো বাকী সোনাদানা, মা দু-একটা নিজের জন্য রেখে আর সব অতসীকে দিয়ে দিতে পারে!

-তা সেটা মাকে বলে দ্যাখ।

- আমি বলতে যাবো কেন বাপি? আমি এসব নেওয়ার জন্য মোটেই ব্যাকুল নই। তুমি এসব কথা তুললে বলেই কথাগুলো বললাম। ঈশ্বরের আশীর্বাদে আমার এইটুকু না পেলে কিছু আটকাবে না। 

সৌমিত্র আজই চলে গেল কলকাতায়। ওখানে শ্বশুর- বাড়ীতে কদিন থেকে আমেরিকা ফিরে যাবে। অতসী সঙ্গে আসেনি- নাতি-নাতনীদের নাকি কী সব পরীক্ষা। আজ আবার এই নিয়ে সুমনার সাথে বাক্য বিনিময় করতে হবে ভেবেই মনটা বিষন্ন হয়ে গেল অভিজ্ঞানের।

রাতে খাবার টেবিলে সুমনা বললেন, 'কী হল, বাবু রাজী হল?’

- না ।

- জানতামই তো। মিছিমিছি ছেলেটাকে এই জন্য এতদূরে টেনে আনা! বুড়ো বয়সে যতসব ভীমরতি! 

 আজকাল এসব কথায় অভিজ্ঞানের উত্তর করারও উদ্যম আসে না। তিনি একমনে রুটি চিবোতে লাগলেন। সুমনা বললেন, 'তা কী করবে ঠিক করলে?' 

- কিসের? 

- কী বলছি বোঝনা? এই জায়গা জমির কী ব্যবস্থা হবে ?

- যা হয় হোক। আমি আগে মরলে তুমি পাবে, তুমি মরলে যে দখল করবে তার! 

- এই জন্যেই লোকে কলকাতায় জায়গাজমি কেনে । সেসব জায়গায় বাড়ী থাকলে তো সেটা অ্যাসেট হতো। এখানে তো বার্ডেন! আমি জানি তুমি ইচ্ছে করেই এসব করছো, যাতে বাবু এটা নিতে অস্বীকার করে! 

অভিজ্ঞান খানিকটা হতভম্বের মতো তাকিয়ে বললেন, ‘মানে? ও না নিতে চাইলে আমার লাভ?’

- ওটাই তো খেলা! লোকে জানলো না, কিন্তু তুমি মনে মনে জানলে - কেমন জব্দ করতে পারলে তুমি কায়দা করে! 

-কী আবোল তাবোল বকছ সুমনা?

- তুমি সত্যি করে বলো তো, বাবু যদি তোমার নিজের ছেলে হত, তাহলে কি তুমি অজ পাড়াগাঁয়ে নিজের পি. এফ এর সব টাকা উড়িয়ে দিতে পারতে ?

- আমি বাবুর প্রতি কোন কর্তব্যটা করিনি সুমনা? ওর লেখাপড়া, দামী দামী টিউশন, হোস্টেল খরচ- সত্যি করে বলোতো - তুমি তোমার মাইনের একটাকাও ওর পিছনে দিয়েছ কখনো ?

- তুমি কি চেয়েছো? আর তাছাড়া বাবুর সব দায়িত্ব নেবে - এই প্রতিশ্রুতি দিয়েই তো তুমি আমায় বিয়ে করেছিলে!

- ঠিক তাই! আমি সেই প্রতিশ্রুতি কি পূরণ করিনি?  তুমি ভালো করে জানো,  বাবু ছিল বলেই আমি আর দ্বিতীয় সন্তানের জন্য কখনো তোমাকে বলিনি!

- ওটা তোমার মহানুভবতা নয়, কুঁড়েমি। তোমার মতো গেঁতো মানুষকে আমি চিনি না! আবার কে ঝামেলা করবে, আবার এত এত খরচ- এসব ভেবেই  তুমি আরেকটা নাওনি। আমাকে তুমি এই নিয়ে খোঁটা দিতে পারবে না অভি, এতে আমার কোনও আপত্তি ছিল না।

এর পর আর কথা চলতে পারে না। অভিজ্ঞান একটু চুপ থেকে বললেন, ‘ওঃ- এর মধ্যে তুমি আমার ভালো কিছু দেখলে না। বাঃ, বাঃ! আমি ঝামেলার ভয়ে সন্তান নিইনি? তোমাকে বিয়ে করার পেছনেও আমার কোনও মহৎ ইচ্ছা ছিলনা! বাঃ বাঃ !

- ছিল নাই তো! আমি কি জলে পড়েছিলাম নাকি? চাকরি করতাম।বাপের বাড়ীতে আশ্রয়েরও অভাব ছিল না। তুমি এমন কি মহৎ কাজ করেছো?

 - একজন স্বামী পরিত্যক্তা যুবতী মেয়েকে বিয়ে করেছি- ছোট বাচ্চা আছে জেনেও- এর মধ্যে তুমি কোনও ভালো দেখ না?

-বিয়ের আগেই কিন্তু আমি তোমাকে পরিষ্কার বলে দিয়েছিলাম অভি, তুমি কিন্তু আমাকে দয়া দেখাতে বিয়ে করো না।

- দয়া তো আমি দেখাই নি। 

- দেখাচ্ছ নাতো কী করছো? মুখে বলছনা, অথচ সেটাই তো দাবী করছো। আর তাছাড়া আমাকে স্বামী পরিত্যক্তা বলছো কেন? আমার স্বামী মোটেই আমাকে ছেড়ে যায়নি, আমিই তাকে ত্যাগ করে এসেছি। 

অভিজ্ঞানের চাকরির জায়গায় সুমনা যখন জয়েন করেছিলেন, তখনই তিনি বিবাহ বিচ্ছিন্না । আলাপ পরিচয় গাঢ় হওয়ার পরে আগের স্বামীকে ত্যাগ করার বহু কারণ বহুবার তিনি শুনেছেন। শোনাটা যদিও একপাক্ষিক তবু দেহের টানে হোক বা মনের টানে সুমনার পক্ষ  নিতেই তাঁর ইচ্ছে করতো এবং সুমনাকে বিয়ে করলে তিনি যে তাকে তুলোর বাক্সে আলতো করে আগলে রাখবেন এমনও স্বপ্ন নিজে দেখতেন এবং দেখাতেনও। তিনি নিজে যদিও এমন কিছু মনে করতে পারেন না- যাতে তিনি অযথা দখলদারি করেছেন বা সুমনাকে এবং বাবুকে কোনওভাবে জেনে বুঝে আঘাত করেছেন। অথচ সুমনার আচরণ তাঁকে প্রতি মুহূর্তে ক্ষুব্ধ করে, কষ্ট দেয়। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমার মধ্যে তুমি যখন ভালো কিছুই দেখনা, তবে আমাকেও ত্যাগ করতে পারতে।’

- তাতে তোমার কী লাভ হত? অরেকটা বিয়ে করাও তো তোমার দমে কুলোত না।

- তুমি সেই জন্য দয়া করে আছো নাকি?

-কিছুটা তো তাই। আর তাছাড়া তোমাকে বিয়ে করার সময় নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম - এবার পরিস্থিতি যাই হোক না কেন শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করব বিয়েটা টিকিয়ে রাখার। নইলে কে আর সাধ করে এই গাঁয়ে এসে দিন কাটায়! একটু বিকেলে কোথাও বেরোবো সে উপায় নেই- সিনেমা-থিয়েটার নেই, শপিংমল নেই - দিনে আঠারো ঘণ্টা কেউ টিভি গিলে বাঁচে?

  কলকাতায়  অভিজ্ঞানরা থাকতেন কুঁদঘাটে। তিনি মনে করতে পারেন না শনি রবি বা ছুটির দিনে সুমনা কোনদিন ঘরে থাকতেন বলে। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে পার্টি নয় সিনেমা লেগেই থাকতো তাঁর। বাবু পড়াশোনায় ভালো ছিল। নিজে নিজেরটা বুঝে নিত। আর যেটুকু অতিরিক্ত- যেমন ছোটবেলায় কোনও পড়া বুঝিয়ে দেওয়া, টিউশনে নিয়ে যাওয়া সব অভিজ্ঞানই করতেন। ক্লাস টেনের পর থেকে ওকে বিশেষ একটা সময় দিতে হতো না। সাইকেল নিয়ে নিজে নিজেই  স্কুলে কিংবা টিউশন পড়তে যেত। একবারেই জয়েন এন্ট্রান্স। তখন থেকে হোস্টেলে। পাস করে চাকরি সূত্রে ব্যাঙ্গালোর- সেখান থেকে বিদেশ। সুতরাং সেদিক থেকে সুমনার পক্ষে তালগড় এসে মানিয়ে নেওয়া যে কঠিন- এটা বোঝা যায়। কিন্তু অভিজ্ঞান সুমানাকে এখানে আসার জন্য জোরাজুরি করেছেন, এমনও নয়। তিনি সুমনাকে বৃদ্ধাবাসের অপশন দিয়েছিলেন, সুমনা নেননি। অভিজ্ঞানকে এখানে জমি কেনা কিংবা বাড়ি বানানোর কথায় সমানে বিরোধিতা করেছেন, কিন্তু এখানে আসাটা অস্বীকার করেননি।

সুমনা পরিষ্কার এবং কড়া গলায় বললেন- জায়গা জমির একটা ঠিকঠাক উইল করে রেখে যাও বাপু, তুমি মরলে আমি এর ঝক্কি ঝামেলা সইতে পারবো না। আর তাছাড়া তুমি যদি আগে যাও- আমি গিয়ে কলকাতায় বৃদ্ধাবাসে থাকবো। দু-একটা জায়গা আমি দেখে এসেছি, কয়েকটা খোঁজখবরও নিয়েছি - সুতরাং তখন বাবুকেই এসব ঝামেলা পোয়াতে হবে। সেসব বার্ডেন ওর জন্য রেখে যেও না।

- ওর বার্ডেন নেয়ার কোনো প্রশ্নই আসছে না সুমনা, ও পরিষ্কার বলে দিয়েছে, আমি বা তুমি মারা গেলে ওর পক্ষে আসা অনিশ্চিত। সুতরাং ওর থেকে বেশি কিছু আশা রেখো না।

- আমি কারোর কাছে কিছু আশা রাখি না অভি। ছেলের কাছেও না। যেমন বাপ ছেলেও তো তেমনি হবে!

       অভিজ্ঞান বুঝলেন না কোন বাপের কথা ইঙ্গিত করলেন সুমনা। রক্তসূত্রে নাকি পালন সূত্রে? তিনি বাবুর কথায় কিছুটা হলেও কষ্ট পেয়েছিলেন, কিন্তু সুমনার ব্যবহারে অবাক হলেন আরও বেশি। লোকে বলে নাড়ীর টান! মা এতখানি নির্বিকার হয়? যেন কোনও কিছুই তাঁকে ছোঁয় না!

সুমনা অভিজ্ঞানের চোখের দিকে চেয়ে বললেন, ‘একটা কথা সত্যি বলবে অভি? ‘

- বল!

- তুমি বাবুকে পছন্দ করো না, না?

- আমার ওর প্রতি ব্যবহার, দায়িত্ব-কর্তব্য দেখে কি তোমার তাই মনে হয়?

- শোনো অভি, যে নিজের নয় - তাকে তুমি নিজের মত ভালবাসবে এ দাবি আমি করি না, সুতরাং বিশ্বাসই বা করব কোত্থেকে? লোকে তোমার দায়িত্ব ও কর্তব্য দেখে নিশ্চয়ই বাহবা দেবে,  কিন্তু আমি বুঝি সেসব লোক দেখানো- সত্যি নয়!

- তুমি বেশি বোঝো! 

- তা তো বুঝিই! এই একটা হিসেব আমি ভালো পারি অভি। আর বাবুও কোথাও এই ফাঁকিটা বোঝে! নইলে তুমি তার প্রতি এত কিছু করার পরও সে তোমার মূল্য দেয়নি। এটা আমি সাপোর্ট অবশ্যই করছি না- এতটা স্পষ্ট করে নিজের অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার দরকার তার ছিল না- তবু...

- তুমি তো তার মা। তোমার সাথে তার রক্তের সম্পর্ক। তোমার প্রতিই বা তার কী ভালোবাসা আছে? তুমি তার বাবার কাছে তাকে ফেলে আসোনি, একটা নিজের পরিচয়ের ব্যবস্থা করেছ,  মাথার ওপর আশ্রয়ের ব্যবস্থা তো করেছ!

- আমি শুধু তাকে জন্ম দিয়েছি অভি। সেই সম্পর্কে কেউ নিজের হয়ে যায় না। আমি তাকে কোনদিনও নিজের মনে করিনি, সুতরাং সেও মনে করবে না এটাই স্বাভাবিক। আমার এই নিয়ে কোনও খেদ নেই। আমি নিজের কাছে পরিষ্কার।

প্রায় তিরিশ বছরের দাম্পত্য ওঁদের। সুমনার বহু কিছুই অভিজ্ঞানের অস্পষ্ট লাগতো । প্রথম দিকে বহু কিছু জানতেও চাইতেন। কিন্তু আজকের এই কথা যেন তাঁর কাছে স্বপ্নেরও অতীত ছিল। তিনি খানিকটা হতবাক হয়ে বললেন, ‘কিন্তু তুমি বাবুকে নিজের মনে করোনি কেন? ও তো তোমারি গর্ভের সন্তান!’

      সুমনা খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। বললেন, ' অভি তোমার কাছে আমার একটা অপরাধ আছে, আমি একটি কথা তোমায় গোপন করেছি। কেন যে করেছি আমি তা নিজেই জানিনা-’

- কি কথা?

- বাবু সমীরের ছেলে নয়।

- সে কী! খানিকটা যেন আর্তনাদ করে উঠলেন অভিজ্ঞান। 

- হ্যাঁ, তুমি ঠিকই শুনছো। 

- তবে কার ছেলে? 

- অরিত্র! সমীরের মাসতুতো ভাই।

- বল কী?

- তোমাকে তো আগেই বলেছি, বাবা-মা প্রায় জোর করে আমায় বিয়ে দিয়েছিলেন সমীরের সাথে। সমীর যে খারাপ ছেলে- তা নয়। তবে কী জানো, কখনো কখনো কাউকে যেন কিছুতেই ভালো লাগে না- তার শত ভালো সত্বেও না। সমীরকে আমার কোন ভাবেই ভালো লাগতো না। মনের মধ্যে একটা শূন্যতা ছিলই। অরিত্র ওরই বয়সী। মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ী আসতো -বিশেষ করে সমীর না থাকলে। আমাদের মধ্যে বেশ একটা সুসম্পর্ক ছিল- কিন্তু তুমি বিশ্বাস করলে করতে পারো- আমার তার প্রতি কোনও দৈহিক আকর্ষণ ছিল না।  একদিন দুপুরবেলা অরিত্র প্রায় জোর করেই আমার সাথে সম্পর্ক করে- আমি সাধ্যমত বাধা দিয়েছিলাম, লাভ হয়নি।

- সমীর কি একথা জানতো? 

- না তাকে বলিনি,  যখন বুঝেছিলাম পেটে বাচ্চা এসে গেছে তখনই এটা ওটা ওষুধ খেয়ে অ্যাবরশন করতে চেয়েছিলাম- লাভ হয়নি। সমীর যখন জানতে পারলো ওদের বাড়িতে খুশির ধূম। আমি আর কিছু বলতে পারিনি। 

-তাহলে তুমি সমীরকে  ছেড়ে এলে কেন?  যে সব কথা আমাকে ওর বিরুদ্ধে বলেছ, সবই কি মিথ্যে?

- তুমি ভালো করেই জানো অভি, আমি মিথ্যা কথা বলি না। আমি একটা সত্য গোপন করেছি শুধু। 

- সত্যটা মারাত্মক, আর তাকে গোপন করতে যাওয়াটা আরও মারাত্মক সুমনা! 

- সে কথা আমি স্বীকার করি। কিন্তু সমীরের বিরুদ্ধে আমি যা বলেছি সেগুলো মিথ্যা নয়। সেগুলোও ছেড়ে আসার জন্য যথেষ্ট কারণ ছিল। তবে অরিত্র এখানে অনুঘটকের কাজ করেছে।

- কেন? সে কি সব কথা বলে দেওয়ার জন্য ব্ল্যাকমেইল করতো? 

- না। অরিত্র সম্ভবত জানে না- এটি তারই সন্তান। জানার কথাও না। সত্যটা কেবল মা’ই বোঝে। তবে অরিত্র ওই ঘটনার পরেও মাঝে মাঝে এসে জোর করতো- আমার সেটা একদমই পছন্দ ছিল না। 

- কিন্তু তুমি আমাকে কেন এসব আগে বলো নি?

- সেটা ভেবে আমি আজও অবাক হই অভি। তুমি যখন আমাকে প্রথম দেখ, তোমার আমার প্রতি এতটাই মুগ্ধতা ছিল যে আমি যদি এই ঘটনা বলতাম- তুমি আরো বেশি সহানুভূতিশীল হয়ে আমার দিকে এগোতে। আর তাছাড়া তোমার প্রতি আমার তখন এমন কোনও আকর্ষণ ছিল না যে - তুমি না বললে আমার কিছু আসতো যেত!  

অভিজ্ঞান বড় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। একথা তাঁর থেকে বেশি কে জানে! তিনি এই তিরিশ বছরে সুমনার চোখে তাঁর প্রতি এমন কিছু দেখেননি যে তাতে মনে হয় তিনি ওঁকে ভালোবাসেন। তিনি একজন সাধারণ ছাপোসা মানুষ, সিনেমার হিরো সুলভ তাঁর অন্য কোন গুণ নেই, কবি সাহিত্যিকও নন। কিন্তু তিনি তো বহুবছর সুমনাকে ভালোবাসতেন,  নিবিড় করে পেতে চাইতেন। অথচ বারবার সুমনা অন্য কোনও টানে অন্য কোনও আকর্ষণে পা পিছলেছেন অন্য সম্পর্কে। এবং এসব যে তিনি অভিজ্ঞানকে গোপন করেছেন, এমনও নয়। অভিজ্ঞান চুপ করে শুনেছেন, দেখেছেন, মন খারাপও করেছেন- কিন্তু মুখে কিছু বলেননি। এখন অভিজ্ঞানকে দেখে যেন কিছুটা মায়া হল সুমনার। বললেন, ' এতে তুমি বা এত মুষড়ে পড়লে কেন অভি?  ছেলে সমীরের না হয়ে অরিত্রের হলে তোমার কি কিছু যায় আসে? অভ্র কিংবা নীলেশের সাথে তো আমার এর থেকে বেশি ঘনঘটা ছিল। তখন তো তুমি কিছু বলনি! 

- তুমি আজই বা আমার কাছে একথা বললে কেন সুমনা? 

- আসলে জানো, আমি এ কথা বলার জন্য তিরিশ বছর অপেক্ষা করেছি একটা প্রসঙ্গ পাবো বলে। তোমার কাছে এ কথা না বলার আমার কোন কারণই ছিল না, তবু বলতে পারিনি- এটা আমায় খুব পীড়া দিত। আজ ভারমুক্ত হলাম। তুমি তালগড়ে জায়গা কিনেছিলে বলেই হয়তো এই সুযোগটা এল। বাবুও তোমার উইল মানতে অস্বীকার করল- আর কথায় কথায় এসব কথা এল। এর জন্য থ্যাংকস।

-  তুমি কি এই জন্যই তালগড়ে আমার সাথে থাকতে এসেছে সুমনা? তুমি কি জানতে এমন পরিস্থিতি হবে?

 মৃদু হাসলেন সুমনা। বললেন - না। এখানে আসার কারণ এটা নয়। 

- তবে?

- আসলে আমি জানি অভি, দীর্ঘদিন তুমিও আমায় ভালোবাসো না। এতে তোমার দোষ নেই। অথচ তুমি ভালোমানুষি দেখানোর কোন সুযোগ ছাড় না। দায়িত্ব-কর্তব্য সবই পালন করো। বাবুর জন্য করেছ, আমার জন্যও করেছ। আমি তোমাদের ছেড়ে পার্টি করেছি,  সিনেমা গেছি, মলে গেছি- তুমি একদমই পছন্দ করতে না। আমিও লক্ষী বউয়ের মত তোমার পছন্দ মেনে ঘর করবো- এমনটা ছিলাম না। তুমি আমার থেকে মনে মনে পরিত্রাণ চাইছিলে- তুমি জানতে এই অজ পাড়াগাঁয়ে ঘর বানালে আমি এসে থাকবো না- দূরে দূরে থাকা হবে- অথচ বন্ধু-বান্ধব, ছেলে, শ্বশুরবাড়ি- কেউ ভাববে না এটা সেপারেশন-  পলিটিক্যালি তুমি কারেক্ট থাকতে পারবে।

-  তুমি কি সেই ইচ্ছেয় ভেটো দিতে এখানে এসে থাকলে সুমনা?    

     সুমনা উঠে মুখ হাত ধুলেন। টেবিল থেকে খাবার-দাবার তুলে ফ্রিজে ভরে রাখলেন অবশেষ টুকু। অভিজ্ঞান একটু অপেক্ষা করে বললেন, - উত্তরটা দিলে না যে! 

- ওটা থাক! অতটা হজম হবে না তোমার! 

- এতটা যখন হজম হয়েছে, বাকিটাও হবে। বলে ফেল, আর হয়তো এমন সময় আসবে না।

- বেশ। শোনো তবে। তুমি যখন এখানে ঘর বানানোর জন্য মন স্থির করলে- তখন তোমার দুটো ভাবনা ছিল- এক- আমি এখানে এসে থাকবো না, দুই- যদি থাকি তবে বেশ জব্দ হয়ে থাকব। সারা জীবন তুমি আমাকে মল-পার্টি থেকে দূরে সরাতে পারোনি- এখানে থাকলে আমি সেই সব পারবো না- সেটা তোমার জন্য একটা আত্মশ্লাঘার বিষয় হবে!

- সবই যখন তুমি বোঝ, তবে এলে কেন?

- অভি তোমার একা বেঁচে থাকার আনন্দকে ভেটো দেবো বলে নিজের ভালোলাগাকে বিসর্জন দিয়ে এই এঁদো গলিতে এসে পচে মরবো- এতটা অবিবেচক নিশ্চয়ই তুমি আমাকে মনে করো না। আর তাছাড়া তোমাকে সেভাবে ভালো না বাসলেও তোমার প্রতি আমার কোন হিংসে বা প্রতিহিংসা নেই যে তোমার এইটুকু আনন্দ আমি দিতে পারি না!

- তবে?

- তবে ওই দ্বিতীয়টাই! আমি সারা জীবন তোমাকে তেমন কিছু দিতে পারিনি অভি। তুমি যাই হও, যেমনই হও- তুমি আমার বা বাবুর জন্য অনেক করেছ। নিজেকে বঞ্চিত করে অনেক দায়িত্ব পালন করেছ, অনেক কিছু মেনেও নিয়েছ! আমি স্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারিনি ঠিক, কিন্তু আমি অকৃতজ্ঞ নই। আমি কোথাও ভেবেছি- আমি জব্দ হয়ে আছি- তুমি এই ভেবে বাকি জীবনটা আনন্দ পাও, খুশি থাকো। 

  অভিজ্ঞান উঠে হাত মুখ ধুলেন। মুখে একটু  মৌরি জোয়ান ফেলে এসে দাঁড়ালেন বারান্দায়। সামনে দুটো তালগাছ-  সব গাছ ছাড়িয়ে নির্বিচার দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে শিউলি গাছ। তাতে টুপটাপ শিশির পড়ছে। ম্লান চাঁদটা উঁকি মারছে শিরীষ গাছের কোণে। চারিদিকে ম ম করছে ফুলের গন্ধ, বাতাসে হিমের টান। পেয়ারা গাছটার পাশে যেন একটা ছায়া মনে হল! ওটা কি জীবন লাল? যে কেবল দুঃখী থাকতে ভালোবাসে! যে চাঁদ উঠলে দুঃখ পায়, পাখি তাকালে দুঃখ পায়, ভালো খাবার খেলে দুঃখ পায়, স্বপ্ন দেখলে দুঃখ পায়। চারপাশে বড় দুঃখ। অভিজ্ঞানের নিজেকে বড় দুঃখী লাগে। তালগড় কে লামডিঙ বানানোর কোন উপায় যদি জানা থাকতো তাঁর।

Post a Comment

0 Comments