জ্বলদর্চি

চা বাগানের ময়না সোরেন/ সৌমিত্র চৌধুরী

চা বাগানের ময়না সোরেন 
সৌমিত্র চৌধুরী  


কুয়াশায় ঢাকা চারপাশ। বাতাস বইছে ধীরে। গাছের ডালে ছোট পাতা গুলো কাঁপছে। বড় গাছের পাতা গুলো টুপটাপ ঝরে পড়ছে। মঞ্জিরি গাছের উঁচু ডালে একটা ফিঙে ডেকে উঠল টুটি টাই টুটি টাই। পাখির ডাকটা বাতাসে ভর করে ছড়িয়ে পড়ল অনেক দূরে। শান্ত সকাল। মঞ্জিরি শাল কাঠচাঁপা গাছের নিচে জমে আছে অনেক শুকনো পাতা। ওগুলো কুড়িয়ে নিয়ে যায় কুলি মহল্লার লোক। পাতা গুলো জ্বালিয়ে রান্না করে। 
 চা বাগানের ভিতর ছোট একফালি জায়গায় শ্রমিকদের আস্তানা। বাগানের লোকেরা বলে কুলি মহল্লা। সকালের কুয়াশা মাখা অল্প আলোয় কুলি মহল্লার ময়না সোরেন ঝাঁট দিয়ে ঝরা পাতা গুলো শিরীষ গাছের নীচে জড়ো করছিল। জায়গাটা নির্জন। আজ সোমবার। চারদিক একদম নিঝুম। বাগানের ছোট ছেলে-মেয়েরা ইস্কুলে গেছে তো! 
রবিবার বা স্কুল ছুটির দিন অনেকে এখানে খেলতে আসে। ময়না সোমবার আসে। অন্য দিনও আসে। স্কুলে তো পড়ে না! ওকে ভর্তি করা হয়নি। ওর বাবা শিবু সোরেন বলেছে, ‘স্কুলে পড়তে অনেক টাকা লাগে।’
 মানুষটা বাসের খালাসি। আর ময়নার মা চা বাগানের ঠিকা লেবার। গাছ থেকে চা-পাতা তোলে। সাড়া বছর কাজ পায় না। যখন পায়, মন লাগিয়ে কাজ করে। আর ময়না মন খারাপ করে বসে থাকে। স্কুলে যাবার জন্য জেদ ধরতে পারে না। অনেক টাকা লাগে তো স্কুলে পড়তে! কুলি মহল্লায় খেলার সঙ্গিও তেমন পায় না। 
আজকেও মন খারাপ করে বসে ছিল। একটু পরে ঝাঁটা হাতে নিয়ে মহল্লার বাইরে এল। অনেক দিনই এরকম করে। ওর মা খুশী হয়। 
মহল্লা থেকে একটু এগিয়ে উঁচু ঢিবি। ওখানে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘোরালে চারদিকে চা-গাছ। যতদূর চোখ যায়, সবুজ আর সবুজ। ‘সবুজ সমুদ্দুর’ কুলি মহল্লার সর্দার চাচা বলে।   

🍂

কুলি মহল্লার বড়রা ফিরে আসবে সেই দুপুরে। বেশীর ভাগ মানুষই চা বাগানে কাজ করে। অনেক রকম কাজ। পুরনো চা গাছ গুলো তুলে ফেলা। গাছের নিচের মাটি আলগা করে দেওয়া। মেশিন চালিয়ে চা-গাছে জল দেওয়া। চা তৈরির ফ্যাকটরিতেও কাজ করে মহিলা পুরুষ অনেকে। তবে গাছ থেকে চা-পাতা তুলবার কাজটা মেয়েরাই বেশী করে। 
চা-পাতা তোলা কাজটা সহজ নয়। যেমন তেমন পাতা ছিঁড়লে হবে না। চা গাছের অনেক ডালপালা। গাছগুলো আসলে বড়। পাতা তুলে নেওয়া হয় বলে উপর দিকে বাড়তে পারে না। বেশ কায়দা করে গাছের ডাল থেকে পাতা তুলতে হয়। গাছের ডালের আগা থেকে তুলতে হয় দুটি পাতা একটা কুঁড়ি। কাজটাকে বলে প্লাকিং। দ্রুত পাতা তুলে নিয়ে পিঠে ঝোলান ঝুড়ির মধ্যে দু’হাত উঁচু করে ফেলে দেয়। দেখে মনে হয় খুব সহজ কিন্তু গাছের ক্ষতি না করে তাড়াতাড়ি পাতা তুলে ব্যাগ ভর্তি করা বেশ কঠিন কাজ। 
ময়নার মা খুব তাড়াতাড়ি পাতা তুলতে পারে। বাগানের ঠিকাদার, কেরানিবাবু সবাই ওর কাজের তারিফ করে। ময়নাও কাজকর্মে নিপুন। ছোট্ট হাত দিয়ে অনেক কাজ করে। আজ যেমন নিচু হয়ে পাতা গুলো ঝাঁট দিয়ে এক জায়গায় জড়ো করে বস্তায় ভরছিল। 
এই জায়গাটা বাগানের মধ্যে কিন্তু চা-গাছ লাগানো হয়নি। নিচু জায়গা। বৃষ্টি পড়লে জল জমে যায়। চা গাছের গোড়ায় জল জমলে সেগুলো আর বাঁচে না। তাই এখানে চা-গাছ না লাগিয়ে অন্য গাছ লাগানো হয়েছে। শাল সেগুন গুলমোহর মঞ্জিরি। গাছ গুলোর পাশ দিয়ে কয়েকটা কাঁচা নালা। মানে ড্রেন। বর্ষা কালে বৃষ্টির জল ড্রেন দিয়ে বেরিয়ে এসে এখানে জমা হয়। তখন জায়গাটা জলে থৈ থৈ করে। সাবধানে পা ফেলতে হয়। জলে সাপও থাকে। 
এখন শীতকাল। জায়গাটা খটখটে। শুকনো। সাপখোপ নেই। কোমর বেঁকিয়ে শুকনো পাতা গুলো বস্তায় ভরতে ভরতে ড্রেনটার দিকে চোখ পড়ল ময়নার। সঙ্গে সঙ্গেই কপালে ভাঁজ। ঘাস পাতার আড়ালে গোল মত ওটা কি! বুকটা ধক্‌ করে উঠল। নালার মধ্যে জিনিষটা এল কী করে?
পাতা ভর্তি দুটো বস্তা অনেকটা দূরে টেনে নিয়ে গেল ময়না। ওখান থেকেই গোল চোখ করে তাকিয়ে আছে। উলের গোলার মত একটা জিনিষ। ছোট্ট একটা বল। ওটা কি তুলে নেব? একা একা খেলা যাবে। ভাবছে ময়না। দু’পা এগিয়েও গেল। হঠাৎ মনে পড়ে গেল বাবার কথা। ‘কোথাও ব্যাগ, বল পরে থাকলে হাত দিবি না কিন্তু! বড়দের কাউকে গিয়ে বলবি।’
কাকে বলবো? আশেপাশে লোকজন নেই। কুলি মহল্লায় এই সময় কেউ থাকে না। ভাবতে ভাবতে চারদিকে ঘাড় ঘোরাল ময়না।
নির্জন বাগান। একটা পাখি ডাকল, টুট টাট টায়। একটু পরেই দূর থেকে শব্দ ভেসে এল, ঢিক ঢিক ঢিক। মোটরসাইকেলের আওয়াজ। বুঝতে পারল ময়না। বাগানের ডাগটার। আগে সাইকেল নিয়ে ক্রিং ক্রিং আওয়াজ করে চলত। এখন ভটভটি হাঁকিয়ে চলে। 
কাছে আসতেই চিৎকার করল ময়না, ‘ডাগটারবাবু…।’ 
প্রথমবার শুনতে পায়নি। পরে আরেকবার চিৎকার করতেই ডাক্তারবাবু ঘাড় ঘুরালেন। মোটরসাইকেলটা চালিয়ে নিয়ে কাছে এসে বললেন, ‘কী হয়েছে রে! কোন সাপ-টাপ নাকি?’ 
‘না, ও টা কী একবার দেখেন তো!’ 
মোটরসাইকেল দাড় করিয়ে গোল বস্তুটা দেখতে লাগলেন ডাক্তার। চোখ টানটান। খানিক পরে বলে উঠলেন, ‘মাই গড! ওটা তো বোমা! বাগানেও বদমাশ ছেলেরা ঢুকে পড়ল! কী হবে…?’
ময়নার অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে আবার বলে উঠলেন, ‘এখনই তো স্কুলের ছেলেরা ফিরবে। ফুটবল নিয়ে মাঠে ঝাঁপ দেবে। বোমাটা ফেটে গেলে! ম মহা সর্বনাশ!’ 
একটু থেমে আবার, ‘বড় বিপদ! কী যে করি? দাঁড়া, থানায় ফোন করি। ম্যানেজারকেও জানাতে হবে।’
একটু পরেই দুজন পুলিশ সাইকেল চালিয়ে চলে এল। বলটা দেখে খানিক দূরে সরে গেল। একটা পাথরের উপর দাঁড়িয়ে ফোন করল কোথাও। কিছুক্ষণ পরে পৌঁছে গেল অন্য রকম একটা পুলিশের জীপ। শরীর মুখ ঢাকা এক পুলিশ এসে বলটা একটা যন্ত্র দিয়ে তুলে জল ভরা বালতিতে চুবিয়ে দিল। 
ম্যানেজার চলে এসেছেন। ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘আমার আসতে দেরী হয়ে গেল।’ 
‘ঠিক আছে স্যার’, ডাক্তার বললেন। তারপর ময়নার দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘এই এই মেয়েটা। আজ বাঁচিয়ে দিল।’ 
ম্যানেজার ময়নার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বুদ্ধি আছে তো! তুই স্কুলে পড়িস?’
‘পড়ি না। টাকা মিললে তো পড়বো।’  
লোকজনের কথাবার্তা আর পুলিশ-গাড়ির আওয়াজ ছড়িয়ে পড়েছে বাগানে। ময়নার মা, অন্য কিছু মজদূর, ওদের সর্দারও কাজ ফেলে ছুটে এসেছে। ম্যানেজারকে প্রথম দেখছে ওরা। ম্যানেজার, বাগানের ভগবান। তার মুখেমুখে কথা বলছে ময়না! ওর মা, মেয়ের দিকে কটমট করে তাকিয়ে। ফিসফিস করে বলল, ‘মুখ নিচু করে থাক্‌। কথা বলিস না।’ 
ম্যানেজার ঠোট অল্প ফাঁক করে মুচকি হাসলেন। বললেন, ‘ঠিক আছে।’ একটু থেমে আবার, ‘এই মেয়ে, কাল থেকে ইস্কুলে যাবি। টাকা আমি দেব।’ 
ময়নার মা দু’হাত মাথায় ঠেকিয়ে বলল, ‘আমার মেয়ে ওটা। বয়স আট বছর।’ ওদের সর্দার বলল, ‘মাথায় খুব বুদ্ধি মেয়ের। পড়া লিখা শিখলে একদিন জরুর মাষ্টার বনে যাবে।’  
‘বড় হয়ে কী হবি তুই?’ ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন। হাসল ময়না। অস্ফুটে কিছু একটা বলল। শোনা গেল না।
ডাক্তার বললেন, ‘জোর সে বল।’
মুখ তুলে গলায় জোড় এনে ময়না বলল, ‘ডাগটারবাবু’।  
হেসে উঠল সবাই। গাছের মগ ডালে শিশ দিল একটা হলুদ-ঠোঁট ময়না পাখি। তিরতির বাতাস বইছে। ছোট পাতা গুলো কাঁপল। কুয়াশা ভেদ করে এতক্ষণে রোদ উঠেছে। ঝলমল করে উঠল চারদিক। 

লেখক পরিচিতিঃ ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী। ভূতপূর্ব বিভাগীয় প্রধান ও এমেরিটাস মেডিক্যাল স্যায়েন্টিস্ট, চিত্তরঞ্জন জাতীয় কর্কট রোগ গবেষণা সংস্থাণ, কলকাতা।


Post a Comment

2 Comments

  1. ভাল গল্প। অভিনন্দন জানাই।

    ReplyDelete
  2. ভাল গল্প। অভিনন্দন জানাই।

    ReplyDelete