জ্বলদর্চি

গল্প ধারাবাহিক। বাসুদেব গুপ্ত /দখলদারী পর্ব ৩

গল্প ধারাবাহিক। বাসুদেব গুপ্ত

দখলদারী পর্ব ৩ 
 
ফ্রিজের ভিতর সাত দিনের খাবার প্যাক করে রাখা, প্রতিটি বাটি খুলে খুলে দেখা হয়। ফুলকপির ঝোল, ভেন্ডি ভাজা, ডিমের কারী, না, মাংস জাতীয় কোন পদার্থ সেখান থেকে বেরোয় না। চারটে কোকের বোতল ছিল, আমুদে আদেশ দেন উস্কো খোলো।
খোলার জন্য আবার বোতল খোলার চাবি লাগে, সেটা মীনাক্ষী জানে, দীপঙ্কর খুঁজে পায় না, শেষে বলে, কোকের বোতল খুলবেন কেন? 
-কারণ ওতে ব্লাড থাকতে পারে। বেশি চালাকি করার চেষ্টা করবেন না। খুঁজুন। 
ডাইনিং টেবিলে একটা বেড়াল বসে চোখ পিটপিট করে দেখছিল, একজন পুলিশ তাকে হ্যাট হ্যাট করতে সে আড়মোড়া ভেঙ্গে ওঠে আর ওর নীচে থেকে বেরিয়ে আসে কোকের চাবি। 
খোলা হয়, শোঁকা হয়, শেষে সবাই মিলে সেটাকে পান করা হয়, খোলাই যখন হয়েছে নষ্ট করে কি লাভ এই যুক্তিতে।
সবশেষে আদেশ হয়,
কলকাতা থেকে কোথাও যাবেন না, আপনাকে কল করলে থানায় চলে আসবেন। চালাকি করবেন না। 
চালাকি করব কেন? আমার স্ত্রী হারিয়ে গেছে আমার কষ্টটা আপনার বুঝছেন না, দীপঙ্কর একটু ঝাঁঝিয়ে ওঠে, 
আমুদেবাবু খানিকক্ষণ স্থির দৃষ্টি তে ওর দিকে তাকান, তখন বোঝা যায় পুলিশে ছুঁলে কেন আশী ঘা লোকে বলে। তারপর বলেন, আমি বুঝি। আমার স্ত্রীকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ওয়াগন ব্রেকারের দল। আপনি একা নন। বেশি ভাববেন না, আমরা দেখছি। 
 দেখছি তো দেখছি, কিছুই খবর আসে না, দিন কেটে যায়। দীপঙ্কর দুবার নিজে থেকেই থানায় যায়, ওনারা বলেন, খোঁজ চলছে, আপনার স্ত্রীর ছবি সব জায়গায় পাঠিয়েছি, সব থানায়, হাসপাতালে, খবর পেলেই জানাবো। 

একটা করে দিন যায়, আশা একটু একটু কমতে থাকে। খালি বাড়িটা মনে হয় হাঁ করে ওকে খেতে আসে, মাথার মধ্যে গোলমাল হয়, অফিসে উলটো পালটা কাজ করে, ম্যানেজারের সঙ্গে ঝগড়া হয়ে যায়।
ফলে দীপঙ্করকে সাস্পেন্ড করা হয় এক মাসের জন্য। স্ত্রী নেই তো কি হয়েছে, ইন্টারন্যাশনাল ক্লায়েন্ট অত বুঝবে না, উসকা কাম চাহিয়ে। নো ইন ডিসিপ্লিন উইল বি এলাওড ইন আওয়ার অফিস। 
তারপর আবার মনের মধ্যে বাজতে থাকে সেই জলতরঙ্গ। কি লাভ? আমি তো কিছু ত্রুটি রাখিনি। কাউকে ঠকাই নি, একবার তাড়াহুড়োতে বাসের টিকিট না কেটে নেমে যাওয়া ছাড়া তো কিছু মনে পড়ে না। মীনাক্ষীকে ভাল বেসেছি যতটা সামর্থ্য। ওর ভাইএর চাকরির জন্য তদ্বির করেছি। অফিসের কাজ বাড়ি এনেও করেছি, যাতে ক্লায়েন্ট খুসি থাকে। তবু কোথায় চলে গেল।

🍂

কি লাভ। মীনাক্ষী মরে গেলেও এর থেকে… ভেবেও ও শিউরে ওঠে। পা ঠান্ডা লাগে, মাথা থেকে মনে হয় একটা হল্কা বেরিয়ে আসে। কিন্তু এই অনিশ্চয়তা আর সহ্য হয় না। 
কি লাভ? 
দড়িটা বালতি তোলার জন্য চেয়েছিল, বালতির থেকে ওর ওজন যে অনেক বেশি মনে আসে নি।
মীনু ওর দিকে তাকিয়ে বলে কি হচ্ছিল? ন্যাকামো?
দীপঙ্কর ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়, বোঝার কি আছে, সবই তো পরিষ্কার, মীনু বুঝছে না? এক্টুও অনুশোচনা হচ্ছে না ওর? কোথায় ছিল এত দিন? ওর খুব রাগ হয়। ব্যাপারটা চুকে গেলেই বোধহয় ভালো হত। এখন এই অশোকবন থেকে ফেরা সীতার জেরার মুখে পড়তে হত না 
দীপঙ্কর বলে চা খাবে? চা বানাই? লিকার না দুধ?
একজন সদ্য সুইসাইড সারভাইভার হিসেবে এর থেকে বেশি আতিথেয়েতা ওর মাথায় আসে না। 
মীনু কোথায় ছিল? ধীরে ধীরে খবর বেরোতে থাকে…
মীনু গিয়েছিল রাস্তায়। যে কোনও দিন বিয়ের পর একলা বেরোতেই চায় নি সে গেল রাস্তায়? কি করল? আর তারপর ছিলো কোথায়?
-রাত ১২টা ঠিক যখন স্বাধীনতা দিবসের ঘড়ির প্রথম ঘণ্টা বাজতে চলেছে, তখন হঠাৎ কারা এসে ঢিল, বোতল, চানাচুরের ঠোঙ্গা পচা টমাটো ছুড়তে শুরু করে দেয় 
-সেটা তো শুনেছি, সেখানে তুমিও ছিলে? 
-হ্যাঁ ছিলাম, ফুটপাথের এক কোণে একটা হকারের মালপত্রের ত্রিপল দিয়ে ঢাকা ছিল, সেখানে গিয়ে আমি লুকিয়ে পড়ি। ছোটাছূটি আর্তনাদ, কেউ কেউ কেঁদে ফেলে, কেউ বক্তৃতা দিতে শুরু করে দেয়, আমি শুনছি সব, কিছু বুঝতে পারছি না এবার কি করব।
দীপঙ্কর সহানুভূতিতে মীনাক্ষির হাতে হাত রাখে, বলে তারপর?
-প্রায় দু ঘণ্টা কেটে গেছে। এর মধ্যে পুলিশের গাড়ীর হর্ন, অনেক লোকের স্লোগান, প্রচুর বাপ মা তুলে গালাগালি, এসব আসতে আসতে থেমে যায়, সব চুপচাপ। 
-তারপর আমি আসতে আসতে গুঁড়ি মেরে বেরোই, হাতে একটা পোস্টার, তাতে লেখা অত্যাচারী সরকার, বিচার হওয়া দরকার।
-রাত তখন দুটো, কালো পীচের রাস্তা চার দিকে থেকে চারমাথায় এসে থেমে গেছে, আমার ফোনটাও কোথায় পড়ে গেছে, বেশ কিছু চটি, আর লাঠি আর পোস্টার এদিক ওদিক ছিটিয়ে, কেউ কোত্থাও নেই। একলা সেই চৌমাথায় দাঁড়িয়ে কতক্ষণ কে জানে?
-তারপর? 
-তারপর ঘষ করে একটা জিপ এসে নামে, আর তা থেকে নামে দুজন মেয়ে পুলিশ আর একজন অফিসার। 
-এখান থেকে আন্দোলন করছেন? তাও একলা। তিনজন হেসে গড়িয়ে পড়ে। হাত থেকে পোস্টারটা নিয়ে মুচড়ে ভেঙ্গে ফেলে দেয় রাস্তায়
তারপর, চলুন বলে একজন মেয়েপুলিশ এসে আমার হাতটা ধরে। মেয়ে হলে কি হবে, হাতটা কিন্তু লোহার মতই।
আমি কেঁদে ফেলতে যাচ্ছি, কিছুই বুঝতে পারছি না, তাও জিজ্ঞেস করলাম ‘আমি কি দোষ করলাম, আমি বাড়ী যাব। আমাকে বাড়ীতে নিয়ে চলুন। ‘
 আবার হাহা করে হাসি সেই রাত দুটোর চৌমাথায় ট্রাম লাইনের ওপর দিয়ে গড়াতে গড়াতে চলে যায়।
-আমাকে এনে হাজতে পুরে দেওয়া হয়। আরো অনেকে সেখানে ছিল। একে একে তাদের বাড়ীর লোক এসে ব্যবস্থা করে, শেষ পর্যন্ত আমিই বাকী ছিলাম, তার পর তুমি এলে।
-আমি এলাম মানে? আমি কোথায় এলাম? 
-এই তো আমাদের থানায়। ওখানেই তো মেয়েদের হাজতে আমাকে রাখা হয়েছে এত দিন ধরে, আমি তো দেখতে পাচ্ছিলাম তোমার কথাও শুনতে পাচ্ছিলাম। তুমি ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললে তাও শুনেছি। 
-তারপর অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে ওদের মাথায় এলো যে আমাকেই তুমি খুঁজতে গেছ। আজ সকালে আমাকে ছেড়ে দিয়ে গেল বাড়ীর দরজায়। 
-কিন্তু তুমি কি করছিলে ওখানে? পাখা পরিষ্কার করতে তোমায় বারণ করেছি না। 
দীপঙ্কর খেয়াল করে ছেঁড়া দড়িটা এখনো পড়ে আছে টেবিলের নীচে। মীনাক্ষী কিছুই বুঝতে পারে নি। 
দুজনে অনেকদিন পরে দেখা হতে যথারীতি আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়। মীনাক্ষী বলে, আমি কিন্তু আবার আন্দোলন হলে আবার রাস্তায় যাব, এবারে তোমাকেও নিয়ে যাব। 
দীপঙ্কর বলে, সেই ভাল। বার বার তো কপালে দড়ি ছিঁড়বে না। যা হবে একসঙ্গেই না হয় হবে। 
আপাততঃ দুজনে দুজনের দখল নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দীপঙ্কর ফোনটা বন্ধ করে দেয় একসময়। 

      -সমাপ্ত-

Post a Comment

0 Comments