পুলক কান্তি কর
-স্যার রাস্তায় কোন সমস্যা হয়নি তো? উদ্গ্রীব হয়ে প্রশ্ন করল ভবতারণ।
-না রে বোকা,সমস্যা আর কি? ট্রেনে রাতে চড়লাম, সকালে এসে শিয়ালদা পৌঁছে গেলাম। একটা শাটল ট্যাক্সি ধরে হাওড়া, সেখান থেকে আবার ট্রেনে খড়গপুর। নামতে নামতে তুই। সমস্যার জায়গায়টা কোথায়?
-না মানে এত বার করে চেঞ্জ। পরের বার থেকে হাওড়াতেই গাড়ী নিয়ে চলে যাব স্যার। তাহলে এত কষ্ট হবে না।
-আগে পরের বছর পর্যন্ত বাঁচি!
-এমন কথা বলবেন না স্যার। আপনি মাথার উপর থাকলে মনে হয় বট গাছের তলায় আছি।
-আর কতদিন টানবো রে এই দেহ। আটাত্তর হয়ে গেল।
-সে হোক না স্যার! আপনি একশ পূর্ণ করুন।
-আচ্ছা চল এখন। তোর গাড়ী কোথায় রেখেছিস?
-ওই তো স্যার ফ্লাইওভারটা থেকে নেমে যে স্ট্যান্ডটা আছে, ওখানে।
ভবতারণ সব লাগেজ গুলো নিয়ে ধীরে ধীরে গাড়ীর কাছে এল। ডিকির মধ্যে মাল তুলে পেছনের দরজাটা খুলে দিল স্যরের জন্য।
-তুই কি ড্রাইভার এনেছিস নাকি রে?
-না স্যার।
-তাহলে সামনেই বসি। তোর সাথে গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে।
-আপন স্যার পেছনে আরাম করেই বসুন না। পা টা তুলে বাবু হয়ে বসুন, নইলে আলতো করে শুয়েও যাতে পারেন।
-আরে সারাক্ষণ তো বসেই এলাম রে! আর আরামের দরকার নেই। চল সামনেই বসি। হ্যাঁ রে তারণ, গাড়ী বদলালি নাকি?
-হ্যাঁ স্যার! এক্সচেঞ্জ করে নিয়েছি।
-কেন? গোলমাল করছিল?
-না স্যার, আপনার বউমা বলল - এক মডেল দেখে দেখে সে নাকি বোর হয়ে যাচ্ছে! তাই।
ভবতারণ লক্ষ্য করল - এই কথার উত্তরে স্যার কিছু বললেন না। চুপ করে শুনে নিলেন। বয়স স্যরের মতো লোককেও কি বদলে দেয়? আগে স্যার ট্যাঁকস ট্যাঁকস করে অনেক অপ্রিয় কথা বলে দিতেন মুখের উপরে। আজ এমন একটা বিষয়েও স্যার কিছু বললেন না - একটু অবাকই হল সে। সে কি স্যরের চোখে এখন কেউ কেটা হয়ে গেল যে স্যার আগের মতো আর শাসন করতে পারেন না? নাকি ওর বয়স এখন শাসনযোগ্য বা শোধনযোগ্য নয়? নাকি স্যরের সাথে ওর ব্যবধান বেড়ে গেছে অনেক। মনটা খারাপ হয়ে গেল তার। আচ্ছা সেও চিঠিতে স্যারকে গাড়ী বদলানোর কথাটা বলতে পারতো! সে জন্য কি স্যার অভিমান করলেন? আসলে এত অকিঞ্চিতকর কথা কি জানানো যায় ওনার মতো লোককে?
🍂
ভবতারণ গাড়ী স্টার্ট দিয়ে বলল, স্যার, চালাবো?
-হ্যাঁ রে, চল। নে, হাঁ কর দেখি! বলেই নিজের হাত ব্যাগ থেকে একটা কৌটো বের করে একটা বালুসাই দিয়ে দিলেন ভবতারণের মুখে। বললেন, ‘জানি তোর সুগার! আসলে তুই আমাদের ওখানকার বালুসাই ভালোবাসিস বলে গুনে গুনে ঠিক দু’খানা নিয়ে এসেছি তোর জন্য। আজ একটা খেলি, কাল একটা খাস। তবে ভাতটা আজ একটু কম খাস বাবা।’
-হ্যাঁ স্যার। আমি ডায়েটটা স্ট্রিক্টলি মেনে চলি।
-কী দিন পড়ল বলতো রে তারণ! আগে কোথায় ছিল এসব রোগ? হত বটে, তবে কোবরেজরা বলতেন - ‘মেহ রোগ’। ওষুধ খেতে খেতে সেরেও যেত! আর আজকাল দেখ, ঘরে ঘরে সব ইঞ্জেকশান সিরিঞ্জ নিয়ে বসে আছে মানুষ। শুধু ইনসুলিন নিচ্ছে।
-আসলে স্যার এত স্ট্রেস বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন!
-এত স্ট্রেস কেন? আমরা কি কাজ করতাম না? নাকি সেসময় চাপ ছিল না? স্ট্রেসটা আমার মনে হয় সিম্পলি কোনও কাজকে হ্যান্ডেল করতে না জানা। কোনও সিম্পল জিনিসকে কমপ্লিকেটেড করে ভাবাটাও স্ট্রেস বলতে পারিস।
ভবতারণ মনে মনে ভাবলো, বাঃ কী সুন্দর স্যার স্ট্রেসকে ডিফাইন করলেন। সে আরও একবার মুগ্ধ হল স্যার এর প্রতি।
-জানিস তো, সেদিন বাদলও টেলিফোন করেছিল, ও নাকি এখন এই স্ট্রেস এর জেনেটিক্স রিলেশন নিয়ে কাজ করছে!
-স্যার বাদল কেমন আছে?
-ভালোই। রিসেন্টলি ও নাকি ওর কোনও একটা কাজের জন্যে অ্যাত্তয়ার্ড পেয়েছে। খুব নাকি ব্যস্ত। প্রেসার, সুগার, কোলেস্টেরল সব অর্ণামেন্ট ও জুড়ে গেছে সাথে সাথে। বুকে নাকি ব্লকেজ ধরা পড়েছে, স্টেন্ট বসাবে নাকি কী করবে – এসব নিয়েই কথা হল গত সপ্তাহে।
-আর স্যার অনুজ? ও কী করছে এখন? ও কি এখনও জার্মানিতেই আছে?
-হ্যাঁ। ও বোধ হয় আসবে সামনের মাসে কলকাতায়। কোথায় যেন ওর লেকচার আছে। খুব করে ধরেছে, এবার আমাকে সাথে করে নিয়ে যাবে ওর ওখানে!
-কী বললেন আপনি?
-দুর পাগল! এই বয়সে আর বিদেশ ঘোরা যায়! বাদলও তো বলছিল – ‘স্যার চলে আসুন। বাড়ী কিনেছি ক্যানাডায়। আপনি না এলে ...’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
-যেতেই তো পারেন স্যার। মনও তো ভালো থাকতো তবে।
-তারণ, তুই আমাকে কখনও মন খারাপ করতে দেখেছিস? মন আমার সব সময় ভালো থাকে। আর তাছাড়া এ বয়সে প্লেন ফ্লেন চড়ে এতক্ষণ জার্নিও ঝকমারি। আমি তো কখনও প্লেন চড়িনি, নার্ভাস লাগে।
-এ সব আপনার বাহানা স্যার। পৃথিবীর কোনও কিছুতে আপনি নার্ভাস হোন বা ভয় পান – এ আমরা ভাবতেই পারি না। কারণ পৃথিবীতে আপনাকে নার্ভাস করার মতো সত্যি সত্যি কিছু নেই।
এ কথার প্রেক্ষিতে মুচকি হাসলেন মনোরঞ্জনবাবু। মনোরঞ্জন চক্রবর্তী। একসময় সত্যি খুব ডাকাবুকো ছিলেন তিনি। শুধু হাতে সাপ ধরতে পারতেন। মস্ত নদী সাঁতরে যেতে পারতেন। সে সব কি আজকের কথা! বাংলাদেশের যুদ্ধের সময় যখন ওপার বাংলা থেকে এপারে চলে এলেন, কম ঝামেলা পোয়াতে হয়েছে? পথে তো মা মারাই গেলেন ধকল সইতে না পেরে। সঙ্গে ছিল পাড়ার আর এক ভাই আর তার সোমত্থ বউ। হাতে একটাও অস্ত্র নেই। তবু সে রাত্রে চারটে দুর্বৃত্তকে একা হাতে ঘায়েল করে মেয়েটার আব্রু বাঁচাতে পেরেছিলেন, এখন ভাবলে অবাক লাগে। বললেন, ‘তোদের পরের ব্যাচে শর্মিলা বলে যে মেয়েটি পড়তো, সেও তো এখন নিউজার্সিতে থাকে। ওখানকারই সিটিজেনশিপ নিয়ে নিয়েছে। এই মার্চ মাসে এসেছিল। আমার সাথে দেখাও করেছে। তোর সাথে যোগাযোগ আছে নাকি?
-না স্যার।
-সে কী রে!
ভবতারণ একটু অন্যমনষ্ক হয়ে গেল স্যরের এই কথায়। ভবতারণদের স্কুলে ইলেভেন আর টুয়েলভ ক্লাশটা ছিল কো-এড। পাশের গার্লস স্কুল থেকে পাশ করে শর্মিলা ভর্ত্তি হয়েছিল ওদের স্কুলে। ফ্রেসারস ওয়েলকামের দিন শর্মিলার গলায় আবৃত্তি শুনে বেশ দুর্বল পড়েছিল সে। অনেকদিন সেই ঘোর লেগেছিল তার মনে। সাহস ছিল না সে কথা স্বীকার করার। স্যার কি বুঝতে পেরেছিলেন সেদিন? এতদিন সে ভাবতো, এ শুধু তার নিজের একান্ত গোপন ব্যথা। জিজ্ঞেস করল, ‘কী করে সে ওখানে?’
-ও তো ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে টি.সি.এস এ চাকরী করতো। এটা জানিস, না তাও জানিস না?
-এইটুকুই জানি স্যার।
-তারপর ওরাই ওকে ইউ.এস এ তে পাঠায়। ওখানে গিয়ে এখন কোম্পানি বদল করেছে।
-ও ওখানে বাড়ী টাড়ী কিনেছে নাকি?
-বিয়ে করেছে কিনা জানতে চাইছিস কি?
লজ্জা পেল ভবতারণ। মনোরঞ্জন বুঝলেন। ওর অস্বস্তি না বাড়িয়ে বললেন, বিদেশী বিয়ে করেছে। চায়না ম্যান!
এ বাবা! আর লোক পেল না শর্মিলা? ইয়াং চ্যাং -কুতকুতে চোখ, ভ্রু নেই -মনে মনে ভাবতে গিয়েও ভাবনার থই পেল না ভবতারণ। জিজ্ঞেস করল, ‘কলিগ নাকি?’
-কী ব্যাপার বলতো তোদের? আমি কি তোদের মিসিং লিঙ্কেজ? কেউ কারোর খবর রাখিস না?
-স্যার, সবারই ব্যস্ততা।
-সত্যি কি তোরা এত ব্যস্ত? এখন তো তোদের চিঠিও লিখতে হয়না। ফোনে নম্বর টিপলেই কথা। সারাদিনে নইলে সারা মাসে এক মহুর্ত সময় নেই, ছোটবেলার বন্ধুদের খবর নেওয়ার?
একটা চাবুক পড়লো যেন ভবতারণের পিঠে। সত্যিই কি সময়ই এখন একমাত্র অন্তরায়? অথচ ও, অনুজ, বাদল, প্রীতম, সুপ্রকাশ ছিল প্রায় হরিহর আত্মা। হোস্টেলের একই রুমে থাকতো তারা। ভবতারণ ফার্স্ট হত ক্লাশে, আর বাদল সেকেন্ড। হয়তো রেষারেষিও ছিল মনে মনে, কিন্তু সেটা কখনও বন্ধুত্বকে ছাপিয়ে যায়নি। ক্লাশ টুয়েলভের পরেও সম্পর্ক ছিল। ওরা দুজন পিওর সায়েন্স নিয়েই পড়ল, অনুজ ইঞ্জিনিয়ারিং এ চান্স পেয়ে গেল। বাদল কেমিস্ট্রি নিয়ে আর ভবতারণ ফিজিক্স নিয়ে। বাদল মাস্টার্স করার সময় সাব্জেক্ট বদলে বায়োটেকনোলজি নিল, ভবতারণ ফিজিক্সেই রইল। আজ বাদল ক্যানাডায় পড়ায়, নিজের নামে ল্যাব আছে - অনেক বড় জায়গায় গেছে। ভবতারণের সত্যি কথা বলতে সেরকম উচ্চাশাই ছিল না কোনও দিন। এম.এস.সি পাশ করে স্কুলে চাকরী পেল। সেদিনই সে পুরোনো স্কুলে গিয়ে স্যরের সাথে দেখা করেছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কী করবো স্যার? চাকরীটা নেবো?’
-তুই কি চাস তারণ? স্যার উল্টে প্রশ্ন করলেন। ভবতারণ জানতো স্যার কখনও কোনও কিছু চাপিয়ে দেন না। তবে সে দেখেছে কখনও কখনও কাউকে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য মোটিভেট করতেন - আবার কাউকে আপাতত যেটুকু পাওয়া যায় তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে বলতেন। ওঁকে বোঝা সত্যিই মুসকিল ছিল ওর পক্ষে। তাই সে বলল, ‘ঠিক বুঝতে পারছিনা স্যার! সেজন্যই আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি।‘
-তোর বাবাকে বলেছিস?
-না। আগে আপনাকেই বললাম। বাবাকে বললেই তো চাকরীটা নিতে বলবে। জানেনই তো বাড়ীর অবস্থা!
-পি.এইচ.ডি না করলে কি তোর দুঃখ হবে?
-না স্যার! তেমন করে আমি ভাবিনি কখনও। আমার তো সব সময় মনে হয়েছে যাতে ভালো শিক্ষক হতে পারি। কখনও বিরাট বিজ্ঞানী হব - এমনটা স্বপ্নেও ভাবিনি স্যার।
-দ্যাখ বাবা, ভালো শিক্ষক না হলে ভালো সমাজ হবে কি করে? তোর মতো ভালো মানুষ যদি শিক্ষক হয়, তবে সমাজেরই লাভ। তুই জয়েন কর।
-আশীর্বাদ করুন স্যার। আমি ‘আপনি’ হতে চাইনা! হতে চাইনা মানে হতে পারবো না। যদি আপনার মতো কিয়দংশ হতে পারি সেই আশীর্বাদই করুন আমায়।
-দূর বোকা। আমার কিয়দংশ হবি কেন ? আমার গুণিতক হবি। তবে না বিকাশ হবে। পরবর্তী প্রজন্ম যদি আরও আগে না যায় তবে পৃথিবী তো পিছিয়ে পড়বে। বলেই স্যার বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন ভবতারণকে। স্যার কি এমন ভাবেন, ভবতারণ আজ বাদল বা অনুজকে ঈর্ষা করে? তারা আজ এত উপরে; ও সামান্য স্কুল শিক্ষক - এই হীনমন্যতায় সে ফোন করে না বা যোগাযোগ করে না? মনে মনে সে যাচাই করল নিজেকে আর মনে মনেই বলল, ‘না স্যার আমি একটুও হিংসা করি না ওদের, আমার একটুও অসূয়া নেই ওদের প্রতি!’ ফোন ও করে না এটা ঠিক, তবে তা ‘করা হয়ে ওঠে না’ - এই কারণেই। হয়তো সময়টা এমনই। হয়তো ওরাও ব্যস্ত - এই ভাবনাতেই অভিযোজিত হয়ে উঠেছে ওর মন এতদিন। বলল, ‘স্যার, রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটু চা খাবেন কি? গতবারে এই চা টা ভালো লেগেছিল আপনার! সামনেই দোকানটা, দাঁড়াবো?’
-খাবি? চল। চা এর আসক্তিটাও কমে যাচ্ছে রে!
-কেন স্যার? আপনি তো অনেকবারপ চা খেতেন আগে!
-ভোগ হয়ে যাচ্ছে বোধ হয়। ভগবান তো সব একটা নির্দিষ্ট মাপে পাঠান। তুই আগে ভোগ করবি বা পরে। কোটা নির্দিষ্ট।
ভবতারণ মনে মনে ভাবল - কোন আসক্তি আপনার কাছে স্যার? জীবনের শেষে দেখা যাবে - কোটার সব কৌটোগুলিই ভর্ত্তি থেকে গেছে পরের জন্মের জন্য। চা খেয়েই আবার গাড়ী স্টার্ট দিল ভবতারণ। এখনও ঘন্টা খানেকের পথ। আগে ওদের বাড়ী ছিল বোড়াইএর কাছে একটা গ্রামে। দাঁতন স্কুলে চাকরী পাবার পর এখানেই বাড়ী বানিয়ে নিয়েছে সে। তার আগে এখানেই একটা ভাড়া বাড়ীতে থাকতো। নতুন বাড়ী আর বিয়ে মোটামুটী একই সময়ে। ভাড়া বাড়ীতে মনোরঞ্জন বাবু এসে থেকেছেন কয়েকবার। তবে নতুন বাড়ী হবার পর তিনি প্রতি বছর নিয়ম করে ডিসেম্বরের কুড়ি একুশ তারিখে আসেন। বারো চৌদ্দ দিন থেকে আবার ফিরে যান নিজের বাড়ী মালদহে। এবার হঠাৎ বছরের মাঝে কেন এলেন বোঝা গেল না। উনি মোবাইল ব্যবহার করেন না। বাড়ীতে ল্যান্ড ফোন আছে। তবে সে সব টুকিটাকি ইনফর্মেশনের জন্য। নববর্ষ, বিজয়া দশমীতে তিনি পোষ্টকার্ডই ব্যবহার করেন এখনও। সপ্তাহখানেক আগে ভবতারণের কাছে একটি পোষ্টকার্ড পাঠিয়েছিলেন তিনি, ‘কল্যানীয়েষু, আগামী বিশ এ আগষ্ট তোমার গৃহে যাইবো মনস্থ করিয়াছি। তোমার ছুটি লইবার কোনও প্রয়োজন নাই। আমি খড়গপুর নামিয়া বাসেই চলিয়া যাইতে পারিবো। আমি কুশলই আছি। তুমি চিন্তা করিও না।’ স্যারকে তো জিজ্ঞাসা করা যায়না, হঠাৎ এসময় কেন? তিনি দয়া করে ওর বাড়ী বছরে একবার পায়ের ধূলা দেন - এই তো ওর গর্বের, অহঙ্কারের! কত সাধ্য সাধনা করেও অন্য কোনও প্রাক্তন ছাত্র তাঁকে ওদের বাড়ী নিয়ে গিয়ে রাখতে পারেনা। এটা ওটা বাহানা করে কাটিয়ে দেন তিনি। ফলতঃ সে ওঁকে টেলিফোনেই জানালো সে নিজে গিয়ে ওঁকে নিয়ে আসবে, বাসে আসার দরকার নেই। তবে এসময় স্যরের আসাটা তাকে বিব্রত করেছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
-স্যার আপনার শরীর এখন ভালো আছে তো?
-একদম ফিট এন্ড ফাইন।
-এর মধ্যে ডাক্তার টাক্তার দেখিয়েছেন নাকি?
-অকারণ ডাক্তার দেখাবো কেন? প্রেশার নেই, সুগার নেই। ঘুম ঠিক হয়, খাবার ঠিক মতো হজম হয় - আর কী চাই?
-না স্যার। তবুও সবাই বলে একবার পুরো হেল্থ চেক্আপ করানোটা জরুরী!
-হ্যাঁ, তা না হলে প্যাথোলজি সেন্টারগুলোর পেট ভরবে কি করে? জানিসতো আমাদের বাংলাদেশের গ্রামে খুব বড় এক কবিরাজ ছিলেন। তিনি বলতেন, মানুষ ভালো আছে বুঝবে তিনটি বিষয় দিয়ে। ঠিক মতো ঘুম হয় কিনা? ঠিক মতো খিদে ও হজম হয় কিনা? আর সব শেষে, ঠিক মতো বাহ্যি হয় কিনা? বাহ্যি মানে বুঝিস তো? পটি! পটি!
-স্যার এসেছেন যখন কিছুদিন থেকেই যান না! কী করবেন গিয়ে?
-কেন রে আমার কি কোনও কাজ নেই?
-না স্যার, আপনি যেখানে থাকবেন সেখানেই আপনার কাজ আপনা আপনি তৈরী হয়ে যাবে। সেজন্য নয়, একা একা থাকেন, চিন্তা হয়। নিজে হাতে রান্না করে কদিন চলবে স্যার?
-কদিন কীরে? আজ আঠারো বছর রিটায়ারমেন্ট হয়ে গেল। এতদিন চালাতে পারলাম - শেষ কটা দিন পারবো না?
-দরকার কী স্যার?
-দরকার আছে রে বোকা! যে কাজ আমি নিজে পারি তার জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী কেন হব? তাছাড়া তুই তো জানিস প্রতি বছর কত গাছ লাগাই আমি? তাদেরও তো দেখতে শুনতে হয়!
-বড় গাছ লাগালেই তো পারেন? প্রথম কিছুদিন ছাড়া তাদের দেখতে শুনতে হয় না।
-সে তো তোরাই সব বড় বড় গাছ। এখন যে সব হাতে করে পুঁতি, সবই বর্ষজীবি। এক সিজেনেরই গাছ সব।
-কেন স্যার?
-আর মায়া বাড়াতে চাইনা রে তারণ! চোখের সামনে পুঁতবো, চোখের সামনেই শুকিয়ে যাবে! সেটুকু সহ্য করার অভ্যাসও বজায় রাখতে চাই।
-স্যার এবছর আর কোনও ছেলে মেয়েকে পড়াচ্ছেন?
-এক আধটা জুটে যেতো প্রতি বছর। তবে জানিস তো - বাপ-মায়েরা আজকাল আর বাচ্চাদের কোথাও মাগ্না পড়াতে দিতে চায়না। সবারই কম বেশী সামর্থ্য হয়েছে আজকাল। তাছাড়া ওসব দিকেও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর চল হয়েছে। বুড়ো পুরোনো মাস্টারের উপর আর লোকেদের ভরসা নেই। আমারও তো সামর্থ্য কমছে রে!
ভবতারণ একটু চুপ করে রইল। পড়ানো ছাড়া স্যারের জীবন ভাবাই যায়না। ওদের স্কুলে হেডমাস্টার ছিলেন উনি। ও যখন ওঁকে প্রথম দেখে, তখনই ওঁর এক মাথা পাকা চুল, এক মুখ দাড়ি। অনেকটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদল আসতো ওঁর মুখে। ফটফটে সাদা ধূতি আর উপরে খদ্দরের গেরুয়া বা হাল্কা ক্রীম রঙের পাঞ্জাবী পরতেন তিনি। পকেটে থাকতো সব সময় দুটো ফাউন্টেন পেন। সবাই যমের মতো ভত পেত তাঁকে। ক্লাশ ফাইভে যখন রেজাল্ট বেরুলো ভবতারণের, তখন দেখা গেল দুটো তিনটে সাবজেক্ট বাদে সব বিষয়েই সে ফেল। দুটো তিনটে যেগুলো পাশ, সেগুলো কোনও রকম টেনেটুনে। ওদের স্কুলে নিয়ম ছিল প্রতি ক্লাশে পরীক্ষা শেষ হলে একটা নির্দিষ্ট দিনে ক্লাশটীচার হেডমাষ্টারের সামনেই মার্কশীট দিতেন। ভবতারণের নাম যখন ডাকা হল, তখন ক্লাশটীচার রমেন বাবু বললেন - একেবারে ফাঁকিবাজ ছেলে স্যার। অ্যাটেনডেন্সও খুব পুওর। ভবতারণ মুখ নীচু করে দাঁড়িয়েছিল। হেডস্যার বললেন, ‘কী রে? মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না?’ ভবতারণ কিছু না বলে তখনও মাথা নীচু করে রইল। ওর চোখ থেকে দু’ফোঁটা জল অজান্তে পড়ে গিয়েছিল ওর পায়ে। তখন তো এত ড্রেসের বাহাদুরি ছিল না। খালি পায়ে বা চটিজুতো পরেই অধিকাংশ ছেলে স্কুলে চলে আসতো। স্যার দেখতে পেয়েছিলেন কিনা কে জানে? উনি আর কিছু বলেননি। সেদিন সন্ধ্যায় ও দেখলো স্যার একটা টর্চ নিয়ে ওর বাবার দোকানে এসেছেন। ওদের চায়ের দোকান ছিল একটা পুকুর পাড়ে। গ্রামের স্কুল, এখানে মোটামুটি পুরোনো টীচাররা সব ছেলেমেয়ের বাড়ীর খুবর, ঠিকুজী-কুষ্ঠী জানতেন। ভবতারণ তখন বাবার দোকানে কাজ করছিল। স্যারকে দেখেই ছুটে এসে সে একটা প্রণাম করল। ওর বাবা এসে হাত জোড় করে বললেন, ‘সার চা খেতে এসেছেন? বসেন! বসেন!’
-না, না। একটা দরকারে তোমার কাছে এসেছি।
-কী সার? বলেন!
-তোমার ছেলেমেয়ে কটি?
-আজ্ঞে দুই ছেলে, তিন মেয়ে।
-এটি কত নম্বর? বলে ভবতারণকে ইঙ্গিত করলেন তিনি।
-আজ্ঞে এইটি ছোট। তিনটি মেয়ের বিয়ে দিয়েছি।
-বড় ছেলে?
-সে চাষবাস দেখে। বেশী বড় নয়, এর থেকে বছর সাতেকের বড়।
-তুমি চাও না এ ছেলে লেখাপড়া করুক?
-চাই তো সার! কিন্তু দিনতো চলে না! একটু দোকানে এসে আমাকে সাহায্য করে ও। পড়াশুনোয় ঘাটতি হয়!
-ও দোকানে থাকলে পড়বে কী করে? ওকে তুমি হোষ্টেলে রেখে দাও।
-এত খরচ কোথা থেকে দেব সার? আমাদের সে সামর্থ্য নেই।
-ও চিন্তা তোমায় করতে হবে না। ও যদি এবার ক্লাশে হাফ-ইয়ারলিতে ফার্স্ট হতে পারে তবে ওর স্কুলের ফি এবং হোষ্টেলের খরচ মাফ হয়ে যাবে। বলেই ভবতারণের দিকে ফিরে বললেন, ‘কী রে পারবি তো ফার্স্ট হতে?
ভবতারণ জোরে জোরে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ স্যার।’
সেই শুরু। পরে ভবতারণ বড় হয়ে জেনেছিল অন্য টীচারের কাছ থেকে – এরকম কোনও নিয়ম স্কুলে ছিল না। স্যার তাঁর নিজের টাকা থেকেই ওর ফিস্ এবং হোষ্টেলের খরচা দিতেন। শুধু ও নয়, এরকম আরও চার-পাঁচটা ছেলের খরচ তিনি জোগাতেন, এটা ভবতারণ স্কুলে থাকতে নিজেও উপলব্ধি করেছিল। ক্লাশ ফাইভে ওই বছরটি ভবতারণকে আটকেই দেওয়া হয়েছিল। পরের বছর হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষার আগে স্যার মাঝে মাঝেই মনে করিয়ে দিতেন, ‘কী রে, তোকে কী করতে হবে মনে আছে তো?’
ভবতারণ ভয়ে ভয়ে ঘাড় নাড়তো। স্যার বলতেন, ‘কী রে তোর বাবার সামনে যে খুব জোরে জোরে ঘাড় নেড়েছিলি, এখন কি কনফিডেন্স চলে গেছে?
-না স্যার, যদি না পারি?
-দূর বোকা! না পারার কথা ভেবে কোনও কাজ করবি না। পারবি ভেবেই করবি। ভালোবেসে চেষ্টা কর, পৃথিবীতে অসাধ্য কিছু নেই।
তারপর থেকে ক্লাশ টুয়েলভ পর্যন্ত কোনও ক্লাশে ভবতারণ দ্বিতীয় হয়নি। হেডস্যার রোজ সকালে হোষ্টেলের সব ছেলেদের পড়াতেন। তিনি নিজেও হোষ্টেলের একটা ঘরে থাকতেন। তাঁর ঘরে আরেক আপনভোলা নির্বিবাদী শিক্ষক থাকতেন - তাঁর নাম ছিল নরেন স্যার। তিনি খুব ভালো ছবি আঁকতেন, গল্প বলতে পারতেন। রাতের বেলা ছেলেরা নিজেরা পড়তো। খাওয়া দাওয়া শেষ হলে কখনও কখনও নরেন স্যার ওদের সাথে আধঘন্টা একঘন্টা সময় কাটাতেন, গল্প বলতেন। সত্যি কি সব দিন ছিল তখন!
-স্যার এইবারে এসে গেছি। নামুন স্যার সাবধানে। ভবতারণ সব লাগেজ নিয়ে স্যারকে নিয়ে এল ঘরে। ওর বাড়ীতে স্যার এর জন্য নির্দিষ্ট একটা ঘর রয়েছে। সেখানে এসে বলল, ‘স্যার স্নানটা করে নিন। রঘু’দা চা দিয়ে যাবে তারপর। রঘু ওদের বাড়ীতে থাকে, রান্না বান্না করে – বাজার হাট আনে।
মনোরঞ্জন বাবু অনেকগুলো নোনতার প্যাকেট বের করে ভবতারণের হাতে দিয়ে বললেন, ‘বউমা ভালোবাসে এগুলো, তাই নিয়ে এলাম।’
ভবতারণ এই মুহূর্তটাকেই ভয় পাচ্ছিল এতক্ষণ। মাথাটা নীচু করে বলল, ‘স্যার, পলি তার বাপের বাড়ী গ্যাছে কদিন হল। আপনার স্যার অসুবিধে হবে একটু।
-দাদুভাই? সেও কি তার মায়ের সাথে গেছে নাকি?
-হ্যাঁ স্যার।
মনোরঞ্জন কোনও উৎকন্ঠা প্রকাশ করলেন না শুনে। তিনি শুধু বললেন, ‘তুইও ফ্রেশ হয়ে নে, আমি চান করে আসি।’ বলেই স্নান করতে চলে গেলেন তিনি। ভবতারণ অবাক হল। স্যার কিছুই জিজ্ঞাসা করলেন না। অবাকও হলেন না? উনি আসবেন অথচ পলি নেই - এতে কি রাগ হল তাঁর? নিজের উপর রাগ হল খুব। এত বছরেও সে স্যরের অভিব্যক্তি চিনতে শিখল না!
মনোরঞ্জন এসে দেখলেন বরাবরের মতো তাঁর খাটের সামনে একপাটি চটি জুতো রাখা আছে। চেয়ারের মাথায় রাখা আছে দুটো ধবধবে সাদা নতুন লুঙ্গি। এটা ভবতারণের বরাবরের অভ্যেস। তবুও বললেন, ‘কী রে তারণ! আবার চটি জুতো কিনেছিস? গতবারেরটাও তো দিতে পারতিস? বেশী দিন তো হয়নি। সবে আটমাস...’
-কী যে বলেন স্যার! আটমাস ব্যবহার না করা জুতো কি ঠিক থাকে?
-তুই তো জানিস, আমি অপচয় পছন্দ করি না।
-অপচয় কোথায় করি স্যার। আপনার লুঙ্গিগুলো তো আমিই পরে নিই।
–আর জুতো? ওটা কি হয়?
-আপনার পায়ে দেওয়া জুতো কি স্যার আমি পায়ে দিতে পারি, নাকি অন্যকে পরতে দিতে পারি? ওগুলো সব রাখা আছে জুতোর তাকে। পলি গুছিয়ে রেখেছে সব।
-তুই স্কুলে যাবি না?
-আজকে ছুটি নিয়েছি স্যার। আজ আপনার সাথে থাকবো।
-স্কুল অকারণ কামাই করিস না তারণ। ছেলেদের কাছে ভুল বার্তা যায়! আর আমার সাথে থাকার দরকার কি? আমি খাবো দাবো, শোবো। বিকেল হলে সুবর্ণরেখার পাশটায় চলে যাবো। এখন তো কাশ ফুটে গিয়ে থাকবে, না রে?
-হ্যাঁ স্যার। প্রচুর কাশ ফুটেছে এবার।
-তুই স্কুলে যা।
-অনেক দেরী হয়ে গেছে স্যার। পৌঁছতে পৌঁছতে বারোটা বেজে যাবে!
-যায় যাবে! সই করবি না। কিন্তু ক্লাশগুলো তো নিতে পারবি। তোর একটা ক্লাশ কামাই হওয়া মানে ছেলেমেয়েদের কতটা ক্ষতি বুঝতে পারিস?
স্যারকে ভবতারণ কখনও ক্লাশ মিস করতে দেখেনি। কখনও কখনও শরীর খারাপ থাকলেও তিনি ক্লাশে আসতে ভুলতেন না। সবসময় তিনি একটা শিক্ষাই দিতেন – ‘দ্যাখো একজন খারাপ শিক্ষক কয়েকটা প্রজন্ম নষ্ট করে দিতে পারে। সুতরাং শিক্ষক হিসাবে ভালো হও, আদর্শ হও। তোমাকে দেখে যেন ছেলেমেয়েরা উদ্বুদ্ধ হতে পারে।‘ স্যারকে সবাই খুব ভয় পেতো। কিন্তু ভবতারণ বড় হয়ে বুঝেছে স্যরের মধ্যে বিরাট যে ভীতি উৎপাদক কোনও কারণ ছিল, তা নয়। তিনি বেশ বন্ধুর মতো পরামর্শ দিতেন, সবার অসুবিধা বোঝার চেষ্টা করতেন, সর্বোপরি সবাইকে ঘটনাচ্ছলে সুশিক্ষা দিতেন। কাউকে অপমান করা বা বেত দিয়ে ঠাঙানোর মতো শিক্ষকোচিত কাজ করতে ভবতারণ কখনও দেখেন স্যারকে। একবার মনে আছে, বিনোদ বলে একটি ছেলে পরীক্ষায় টুকলি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়। রানিং গার্ড ছিলেন কালিকা স্যার। তিনি হেড স্যরের ঘরে যখন বিনোদকে নিয়ে যান, বিনোদের তখন আক্ষরিক অর্থেই প্যান্ট ভিজে গেছে। হেড স্যার বললেন, ‘চোথাটা আমাকে দিয়ে যান আর ওকে নতুন খাতা দিন। পরীক্ষাটা দিক।‘ হোষ্টেল থেকে কারোর একটা হাফ প্যান্ট এনে দেওয়া হল তাকে। ওদের একটা স্টেশনারী দোকান ছিল। পরীক্ষার পরে একদিন সন্ধে বেলায় হেডস্যার ওদের দোকানে গিয়ে দেখলেন - ছেলেটি দোকানদারি করছে। তিনি ইঙ্গিতে ওকে দোকান থেকে বাইরে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার বাবা কই?’
-বাবা একটু চা খেতে বাড়ী গেছে।
-সেজন্য তুমি এখানে বসে আছো নাকি?
-হ্যাঁ স্যার! আমাদের যে কর্মচারী আছে সে একেবারেই বিশ্বস্ত নয়। চুরি করে।
-আচ্ছা বিনোদ চুরি করা তো খারাপ, তাইনা?
বিনোদ লজ্জায় মুখ নীচু করে রইল। সে ভাবলো হেডস্যার তার টুকলি করা নিয়েই বলেছেন নির্ঘাত। তাই খুব লঘু স্বরে বলল - ‘খারাপ স্যার’।
-আচ্ছা বিনোদ, তুমি নিজে নিজের দোকানের জিনিস চুরি করতে পারো?
-একথা বলছেন কেন স্যার?
-দ্যাখো বিনোদ, তুমি যদি মন দিয়ে লেখাপড়া না করো, তবে তুমি তোমার নিজের ভাগ্যকেই চুরি করে নেবে। অন্য কাউকে পাহারায় বসিয়ে তো এই চুরি আটকানো যাবে না!
স্যার এভাবেই শিক্ষা দিতেন। সেই বিনোদ এখন ডব্লিউ.বি.সি.এস পাশ করে বীরভূমের কোনও দিকে এস.ডি.ও হয়েছে।
ভবতারণ স্কুলে যাবার জন্য অন্য ঘরে গেল। রঘুদাকে বলে গেল স্যরের খাবার টাবার যেন ঠিকঠাক গুছিয়ে দেয় সে। স্নান করে সে নিজেও খেয়ে নিল হাল্কা কিছু। মনোরঞ্জনবাবু দূর থেকে দেখছিলেন ওর তৈরী হওয়া। বললেন, তুই কি বাইক নিয়ে যাবি?
-হ্যাঁ স্যার।
-চল আমাকেও নিয়ে চল তোর সাথে। নদীটার পাড় দিয়েই তো যাস। ওখানেই ছেড়ে দিবি।
-এই রোদে নাই বা গেলেন স্যার। বিশ্রাম নিন। আমি বিকেলে এসে নিয়ে যাবো।
-চল না নিয়ে। তুই না নিয়ে গেলে কি আমি একা যেতে পারবো না রে বোকা? তুই আমাকে চিনিস না?
-ছি ছি স্যার! আমী এভাবে বোলতে চাইনি। রোদ বলেই বলছি।
স্যার হাসলেন। বললেন, ‘চল এখন।‘
-চা খেয়েছেন তো?
-হ্যাঁ ! তুই স্নান করছিলি যখন, তখনই খাওয়া হয়ে গেছে আমার।
ভবতারণের ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হল। যদিও আজ সে তাড়াতাড়িই ফিরেছে। এসেই স্যারকে জিজ্ঞাসা করল ‘খাওয়া দাওয়া ঠিকঠাক হয়েছে তো? আসলে পলি তো নেই, রঘুদা নিজের বুদ্ধি মতো করতে পারে না সব।
মনোরঞ্জনবাবু কিছু না বলে চুপ করে রইলেন।
ভবতারণ জিজ্ঞাসা করলো, ‘স্যার দুপুরে কখন ফিরলেন?’
-এই দুটো তিনটে।
-এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?
-তোর স্কুলে গিয়েছিলাম। কাউকে পরিচয় দিইনি নিজের। ঘুরে ফিরে দেখলাম, দু-একজন টীচারের সাথে কথাও বললাম।
ভবতারণের জানার ইচ্ছে হল - ‘কী কথা বললেন’, কিন্তু জিজ্ঞাসা করা হল না। স্যার কি ‘ও’ কেমন পড়ায় টড়ায় - সেই সন্ধানে গেছিলেন নাকি? এতদিন বাদে বুকটা দুরুদুরু করে উঠলো তার। ঠিক ক্লাশ ফাইভের পরীক্ষার মতো। ওকে আশ্বস্ত করার মত কিছুই বললেন না তিনি। একটু বাদে দুজনে বাইরের বারান্দায় এসে বসলেন। সুন্দর নদীর বাতাস বইছে এখন। চা খেতে খেতে মনোরঞ্জনবাবু বললেন, ‘তুই কি এখন টিউশান পড়াস?’
-হ্যাঁ স্যার। তিনটে ব্যাচ পড়াই।
-প্রতি ব্যাচে ক’জন?
-এই বারো চোদ্দ জন।
স্যার কেন একথা জিজ্ঞেস করলেন? ও গাড়ী চড়ে বলে? কিছুক্ষণ চুপ থেকে সাফাই দেওয়ার ঢঙে বললো – ‘জানেন স্যার! আজকাল বিদ্যে অযাচিত দেওয়া যায় না। আগে আমি চেষ্টা করেছিলাম স্কুলের হোষ্টেলে গিয়ে যদি পড়ানো যায় - যেমনটা আপনি পড়াতেন বিনে পয়সায়। কিন্তু এখন হোষ্টেলেও টিউশানের ব্যাচ বসে। যে টীচাররা হোষ্টেলে থাকেন তাঁরাই এর কন্ট্রোলার। আমি ওখানে পড়ানো শুরু করলে ওঁদের ব্যবসায় ভাগ বসবে। বাইরে নিজের বাড়ীতে প্রথমে টাকা পয়সা নিতাম না। দেখতাম ধীরে ধীরে ছাত্র আসা কমতে শুরু হলো। বছর সাতেক আগে একটা ছাত্রও আসতো না পড়তে। ওদের এবং ওদের বাবা মায়ের ধারণা - পয়সা দিয়ে পড়লে নাকি মাষ্টাররা ভালো নাম্বার দেবে। ধীরে ধীরে আমিও ঢুকে পড়লাম ট্র্যাকে।
-ভালোই করেছিস! ফোকটে কোনও জিনিস দিতে নেই! ওতে দাম থাকে না!
-স্যার আমি চেষ্টা করি গরীব ছেলেমেয়েদের থেকে কিছু না নিতে!
-ওরকম একদম করবি না। বিদ্যা দয়ার জিনিস না। ওরা দেখবি বাবা মা’র থেকে তোর নামে টাকা নিয়ে অন্যত্র ওড়াবে।
স্যার এরকম কথা বলছেন? তাহলে উনি নিজে বিনে পয়সায় পড়াতেন কেন? বিদ্যা যদি দয়ার দান না হয় - তবে উনি ওকে দয়া দেখালেন কেন? স্যার কি রাগ করলেন ‘ও’ টিউশান পড়ায় বলে? এতদিন স্যার জিজ্ঞাসা করেন নি বলেই ওরও বলা হয়ে ওঠেনি। মিথ্যে তো বলা যায় না স্যারকে। স্যার মিথ্যাকে ঘৃণা করেন। মুখেও বলেন, ভালো কাজে হোক অথবা মন্দ, মিথ্যাটা মিথ্যাই। যে বলে, মিথ্যা তাকে ছোঁবেই। অথচ এই স্যার কি মিথ্যা বলেন নি? ভবতারণের মনে আছে, ওদের হোষ্টেলে যে রান্নার কন্ট্রাক্ট নিত - সেই দুখীরাম’দা একবার একবস্তা পেঁয়াজের দাম খরচের খাতায় দুবার লিখে দিয়েছিল। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির একজন ভদ্রলোক - তিনি তৎকালীন সময়ে পার্টি ফার্টিও করতেন - তিনি চাইছিলেন যেন তেন প্রকারে দুখীরামকে এই কন্ট্রাক্ট থেকে হঠাতে। নিজের ধামাধরা কেউ ছিল হয়তো! মিটিং এর দিন স্থির হল। দুখীরাম এসে হেডস্যরের পায়ে পড়ে গেল। বলল, ‘সার আমি আজ এত বছর কাজ করছি এখানে, আপনি কি আমায় অবিশ্বাস করেন সার?’
-অবিশ্বাস করব কেন তোমাকে। কিন্তু একই পেঁয়াজ তুমি দুবার লিখেছ কেন?
-সার কোনও ভাবে ভুল হয়ে গেছে। হয়তো অন্যমনস্ক ছিলাম, হয়তো বা ভেবেছি লেখা হয়নি। খুঁটিয়ে দেখিনি সার। আপনি দয়া করুন সার; আমার ছোট ছোট ছেলে মেয়ে - এই কাজ চলে গেলে আমরা খাবো কি, ওদের লেখাপড়ারই বা কী হবে?
দুখীরাম’দা আদতে মানুষটি ভালোই ছিল। সৎ এবং পরিশ্রমী। এই কন্ট্রাক্টের সাথে সাথে দুপুরবেলা স্কুলটাইমে সে একটা ক্যান্টিনও চালাতো - ঘুগনী-আলুরদম, পাউরুটি পাওয়া যেত সেখানে। এই কাজ চলে গেলে সেটাও যাবার সম্ভাবনা। হেডস্যার বললেন, ‘ঠিক আছে, চিন্তা ক’রো না। আমি ম্যানেজ করে নেবো।‘
মিটিং শুরু হল যথা দিনে, যথা সময়ে। স্যার বললেন - ‘দুখীরামকে পেঁয়াজের বস্তার দামটা আমিই দুবার লিখতে বলেছি। গতমাসে ওর একটা বস্তা পেঁয়াজ বৃষ্টিতে পুরো পচে যায়। গরীব মানুষ, ও কোথা থেকে ভর্তুকী দেবে? আমায় বলেছিল, আমিই ওকে দুবার লিখতে বলেছি’। তখনকার দিনে হেডমাষ্টারদের দাপট থাকতো খুব। তাছাড়া মনোরঞ্জনবাবু সৎ, দয়ালু এবং ছাত্রবৎসল হিসাবে এতটা জনপ্রিয় ছিলেন যে কেউ বলার সাহস পেল না - ‘এত যখন দরদ, নিজেই ভর্তুকীটা দিয়ে দিন না!’ বা এজাতীয় কিছু। দুখীরাম’দা ই স্কুলে থেকে গেল। বছর দু-এক আগে এই প্রসঙ্গ নিয়ে একবার কথা উঠেছিল। ভবতারণ জিজ্ঞেস করেছিল - ‘স্যার তখন যে মিথ্যে বলেছিলেন, সেটা কি আপনাকে ছোঁয়নি?’
-হ্যাঁ। ছুঁয়েছে বই কি!
-তবে বললেন কেন?
-না বললে দুখীরামের সংসার ভেঙে যেতো। ও সৎ। কিন্তু লোকে জানতো ও কারচুপি করেছে বলে ওর কন্ট্রাক্টটা গেছে। ওর সততার পুরস্কার এভাবে হওয়াটা বাঞ্ছনীয় ছিল না। আমার মিথ্যা ওকে আরও সৎ এবং আরও সচেতন হতে সাহায্য করবে, এই বিশ্বাস আমার ছিল।
-কিন্তু আপনার তো মিথ্যা বলা হল?
-আমি আর পাপ-পূণ্য নিয়ে কী করব তারণ? যা ধার বাকি থাকে থাক।
ভবতারণ জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার আপনি কি রাতে ভাত খাবেন নাকি রুটি?’
-তুই তো রুটি খাস রাতে। তাহলে আমাকেও রুটি দিতে বল।
-স্যার আপনি তো ভাতই ভালোবাসেন, তাই খান না! আমি আপনার অভ্যেস বদলেছে কি না তাই জানতেই জিজ্ঞেস করলাম শুধু!
-আমি সর্বভুক তারণ। সব খাদ্যই ঈশ্বরের দান। আমি সব খাই।
-কাল সকালে ব্রেকফার্স্টে কী খাবেন স্যার?
-এসব কি তোর কর্ম তারণ? এসব নিয়ে ভাবছিস কেন? রঘু যা ঠিক মনে করবে, বানাবে।
-আসলে স্যার পলিই তো সব দেখতো। ও নেই বলেই আমি ভাবছি।
হঠাৎ বেশ গম্ভীর স্বরে মনোরঞ্জনবাবু বললেন, ‘বউমা হঠাৎ বাপের বাড়ী গেল কেন?’
ভবতারণ চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। অবশেষে অনেক শক্তি জোগাড় করে বলল –‘ও ডির্ভোস চাইছে।‘
-কেন?
-ও আমাকে সন্দেহ করে। স্যার আপনাকে বলিনি, মানে ভয়ে বলতে পারিনি। আপনি যখন আসবেন বলে চিঠি লিখেছিলেন, তখনই আমার বলা উচিৎ ছিল...
-না বলে কি ভবি কে ভোলাতে পারলি তুই?
-না স্যার! লজ্জার কথা কী বলব! আমার স্কুলে একজন টীচার আছে দেবাপ্রিয়া নামের। ওকে নিয়ে নানান সন্দেহ, কটু কথা বলে পলি।
-দেবাপ্রিয়া কি বিবাহিতা?
-হ্যাঁ স্যার। একটা বাচ্চাও আছে।
-তুই কি মনে করিস এই সন্দেহের পেছনে তোরও কোনও অবদান আছে? বউমা তো আগে সন্দেহবাতিক ছিল না!
-স্যার পরোক্ষ কি ইন্ধন আছে আমি জানি না, তবে প্রত্যক্ষভাবে আমিই জড়িয়ে নেই।
-কিন্তু তোর স্ত্রী যদি তোকে জড়িয়ে কছু কল্পনা করে, তুই তো দায় অস্বীকার করতে পারিস না!
-স্যার দায় স্বীকার করছি বলেই গত তিন চার বছর মানিয়ে তো আছি। কতবার কতভাবে বুঝিয়েছি – ‘ও আমার বন্ধুর মতো।‘ পলি কিছুতেই বোঝেনি। বাড়াবাড়ি হয়েছে গেল মাসে। ও ফোন করে আমার আত্মীয় বন্ধু-কলিগ-জনে জনে জানিয়েছে এই কথা। স্যার এসব মুখরোচক কথা। একবার মান গেলে সে আর ফেরে?
-বউমা চলে গেল কেন? এই নিয়ে তুই কি কিছু বলেছিলি?
-সেদিন স্যার দেবাপ্রিয়া’র হাজব্যান্ড ফোন করে আমায় গালি দিল। পলি ওকেও নাকি ফোন করেছে। সেদিন আমি নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারিনি। ওকে একটা চড় মেরেছি। ও পরের দিনই ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ী চলে গেছে।
-দাদুভাই এর স্কুল? ও তো তোর স্কুলেই পড়তো।
-ইদানীং আসে না তো দেখি। কী করছে কে জানে?
-তুই কি তারপরে ওকে ফোন করেছিস বা ও তোকে?
-পলি ফোন করেছিল। ও ডিভোর্সের নোটিস পাঠিয়েছে।
-তুই কি ঠিক করেছিস? দিয়ে দিবি?
-কী করব স্যার? সন্দেহ এমন একটা জিনিস, এ যাবার নয়। এর আগেও দেখেছি। সব কিছু বুঝিয়ে টুঝিয়ে মিটমাট হয়ে গেল - আবার কোনও একটা ইস্যুতে সেই একই কাসুন্দি! আগে ফিল্মে দেখতাম বা গল্পের বইতে পড়তাম - গল্পের শেষে যে দুষ্টু, তার একটা রিয়ালাইজেশন হ’ত, এবং শেষমেষ হ্যাপি এন্ডিং হতো। ব্যাপারটা কিন্তু রিয়ালিটিতে হয় না। একটা রিয়েলাইজেশন হয়তো হয় - কিন্তু সেটা ফর দা টাইম বিইং। একটা সময়ের পর আবার পুরোনো সিচুয়েশন, আবার একই রকমের স্পেকুলেশন।
-ঠিক আছে। হঠকারি কোনও সিদ্ধান্ত নিস না। ভেবে চিন্তে সব করিস।
রাতে খাবার খেয়ে শুতে চলে গেলেন মনোরঞ্জন বাবু। তিনি একদম ঘড়ি ধরে দশটায় খাবার খান। ভবতারণ যদিও রাত এগারোটার আগে খায় না, তবু স্যরের সাথে আজ খেয়ে নিল সে। স্যরের সাথে এই নিয়ে কথা বলতে হবে এটা ভাবতেও লজ্জা হল তার। ছিঃ ছিঃ পলি এ কোথায় নামিয়ে দিয়ে গেলে তুমি? স্যার ভাববেন তাঁরই হাতে গড়া ছাত্র – তার চরিত্রের ঠিক নেই। নিজের প্রতিও ধিক্কার এল তার। বিয়েটা করাই উচিৎ ছিল না তখন। স্যরের মতো অবিবাহিত থাকলে এই দিন দেখতে হয় না তাকে। আচ্ছা স্যার এসব বিষয় কি বোঝেন? হৃদয় ঘটিত এইসব ব্যাপার, মান অভিমান? ভবতারণের মনে পড়ে অনুজ একবার টুয়েলভে পড়ার সময় ওদের স্কুলেরই অনিল স্যরের মেয়ের প্রেমে পড়েছিল। বেখেয়ালে ওর লেখা চিঠি থেকে গিয়েছিল কোনও একটা খাতায় - আর পড়বি তো পড় একেবারে স্যরের হাতে। স্যার কিছু না বলে চিঠিটি সরিয়ে রেখেছিলেন। অনুজ পরে খাতার মধ্যে খুঁজে না পেয়ে ভাবলো চিঠিটা হেডস্যরের হাতেই নির্ঘাত পড়েছে। ও তখন ভাবতে শুরু করলো হেডস্যার নিশ্চই অনিল স্যারকে বলবেন। তিনদিন চারদিন কোনও তরফ থেকে কোনও উচ্যবাচ্য না হতে ওর মনে হল নির্ঘাত গার্জেন কল হবে। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় অনুজের ডাক পড়লো হেডস্যরের হোষ্টেলের ঘরে। ওর হাতে চিঠিটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন - তোমার বয়স কত?
-সতেরো স্যার। বলতে গিয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে সে।
-হায়ার সেকেন্ডারির পরীক্ষা কতদিন পর?
-ন’মাস বাকী স্যার।
-এখন এসবে মন দিলে পড়বে কখন?
-এমন ভুল আর হবে না স্যার কখনও!
-কী হবে না? চিঠি লেখা হবে না, না কি খাতার মধ্যে ভুলে রেখে দেওয়া হবে না?
-চিঠি লেখা হবে না স্যার।
হা হা করে হেসে উঠলেন স্যার। ভালো তবে কি আর বাসলি বোকা?
অনুজ চুপ করে রইল। স্যার বললেন - এখন মন দিয়ে পড়াশুনো কর। সময় যখন আসবে তখন ভাববি। কী ভাবছিস, ‘মনে তো স্যার সবসময়ই ভাবি, ভুলবো কী করে?’
অনুজ এখনও চুপ।
-কী রে তাই ভাবছিস কি?
-হ্যাঁ স্যার।
-শোন, যখন যে জিনিস ভুলতে চাইবি, তাকে কোনও ভাবে মাথাতেই নিবি না। যখন মনে পড়বে - পীথাগোরাসের থিওরেম ভাববি। কোনও ভাবে মনে এন্ট্রিই দিবি না। মন থেকে দূরে রাখতে রাখতেই দেখবি অভ্যেস হয়ে গেছে।
আজ অনুজ জার্মানিতে থাকে। ও যখন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে স্যারের সাথে দেখা করতে এলো, স্যার বললেন ‘কী রে, অনিলকে কি ওর মেয়ের জন্যে তোর কথা বলবো? ও সম্বন্ধ খুঁজছে।‘ অনুজ বলল – ‘না স্যার, ওটা ক্লোজড চ্যাপ্টার। আমি ভুলে গেছি সব, আমি আরও পড়তে চাই।‘
দিন পাঁচেক পরে স্যার একদিন সন্ধ্যেবেলা চা খেতে খেতে বললেন - তারণ কালকেই চলে যাবো রে।
-কাল কী করে যাবেন?
-কেন? যেভাবে এসেছিলাম। আমার টিকিট করাই আছে।
একথার উপর কথা চলে না। শুধু বলল, ‘এত তাড়াতাড়ি?’
-তাড়াতাড়ি কোথায়? সাতদিন থাকলাম তো!
-থেকে যান না স্যার। আপনি থাকলে তবু মনে হয় বাড়ী আসি; অন্যসময় শূন্য বাড়ীটা যেন গিলতে আসে।
-দেখবি সবকিছুই একদিন অভ্যেস হয়ে যায়।
-স্যার এখন মনে হয় আপনি সব থেকে ওয়াইজ ডিসিসান নিয়েছেন।
-কোন ডিসিসান?
-এই যে বিয়ে না করা। বিয়ে করলেই মানুষের স্বার্থ বুদ্ধি জাগে। এই ছেলের জন্য সঞ্চয় কর, বউ এর জন্য গয়না কেনো, এটা বানাতে হবে, ওটা করতে হবে, এটা দেওয়া যাবে না – নানা রকম ফ্যাসাদ।
-বোকা এটা সমস্যার অতি সরলীকরণ হয়ে গেল।
-কিন্তু স্যার আমি যেটা বললাম সেটা কি ভুল?
-এটা মানুষের উপর নির্ভর করে। আংশিক ভাবে সত্য তো বটেই। তবে পুরোটা নয়।
-স্যার সাহস পাইনি কোনও দিন। আজ একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
-কী কথা?
-আপনি বিয়ে কেন করেননি স্যার?
-শুনবি? ঠিক আছে কাল যেতে যেতে পথে বলবো।
সেদিন রাত্রে ভবতারণ শুতে গিয়ে বেশ উত্তেজনা অনুভব করলো। স্যার তাঁর জীবনের না-জানা কথা বলবেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পরের দিন সকালে স্যার চা টা খেয়েই বেরিয়ে গেলেন। ভবতারণকে বলে গেলেন রাত সাড়ে দশটায় শিয়ালদা থেকে ট্রেন ছাড়বে। অতএব সেইই মতো বেরোতে হবে এখান থেকে। ভবতারণ বলল বিকেল চারটা নাগাদ বেরোলেই হবে। ও তিনটের মধ্যেই ফিরে এল স্কুল থেকে। এসে দেখে স্যার একদম তৈরী। সময়ের ব্যাপারে উনি একদম স্ট্রিক্ট। গাড়ীতে উঠে অনেকক্ষণ কোনও কথা বললেন না কেউই। ভবতারণ বলল, ‘কই স্যার বললেন না তো?’
- খুব কৌতুহল হচ্ছে বুঝি ?
-হ্যাঁ স্যার।
-শোন, তখন আমার বয়স ছাব্বিশ সাতাশ। ওপার বাংলা থেকে এপারে যখন দেখি নানান রকম ভাগ্যের পরীক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছি, তখন কেউ বলল বনগাঁর দিকে একটা স্কুলে টীচার নেবে। আমি ওপারে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেই এসেছিলাম, আমার চাকরীটাও হয়ে গেল। ক্লাশ টেন অব্দি স্কুল। তখন এত সব স্পেশালাইজেশন ছিল না। সব সাবজ়েক্টই পড়াতে হতো। ওই স্কুলে এক দিদিমনি ছিলেন - চন্দ্রাবতী ঘোষ। তিনি আমারই বয়সী, এক আধ বছর কমই হবেন হয়তো। আমার সাথে সাথে উনিও জয়েন করেছিলেন বলে ওঁর সাথে আমার একপ্রকার ঘনিষ্ঠতা এবং বন্ধুত্ব হয়েছিল। তখনকার দিনে মহিলা স্কুল টীচার এমনিতেই কম ছিল। উনি বিবাহিত ছিলেন। ওঁর স্বামী স্থানীয় ব্যবসাদার। পয়সা ছিল, শিক্ষা ছিল না। ফলে চন্দ্রাবতী স্বামীর ঘর করলেও মানসিক ভাবে খুব সুখী ছিলেন না। ওঁর স্বামীর আরো গুণ ছিল। তিনি কারণে অকারণে চন্দ্রার গায়ে হাত তুলতেন। মাঝেমাঝেই দেখতাম চন্দ্রা স্কুলে আসতেন না। পরবর্তী সময়ে যখন বন্ধুত্ব গাঢ় হল, তখন জানলাম ওনার স্বামী রাত্রে মোটামুটি সুস্থ থাকতেন না এবং নানা কারণে একটু হাতের সুখ না করে নিদ্রা যেতেন না। এবং পরের দিকে জানা গেল কিছুটা কারণ নাকি আমিও। এরপর একদিন এমন হল, চন্দ্রাবতী হসপিটালাইজড্ হলেন। এটা এমন একটা স্থিতি, আমার কিছু করারও ছিল না, বলারও ছিল না। তখন তো এখনকার মতো এত অবসর খোঁজার সুযোগ ছিল না, তবু যতটুকু বাঁচিয়ে বলা যায় - সেভাবে চন্দ্রাবতী আমাকে জানালেন - তিনি এই মানসিক যন্ত্রনা থেকে মুক্তি চান এবং আমি যদি ওঁকে সাহস দিই তবে উনি ডিভোর্সের মামলা করবেন। ওঁদের কোনও সন্তানাদি ছিল না এবং ওঁর বাপের বাড়ীরও তেমন পয়সার জোর ছিল না। আমি সব দিক বিবেচনা করে এই প্রস্তাবে অসম্মত হই ও সেখানকার চাকরি থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিই।
-এটা কি ঠিক হল স্যার? একজন মহিলা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার, আপনি চলে এলেন?
-তুই যে পলিকে চড় মারলি এটা কি ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স নয়?
-স্যার এটা আর ওঁর স্বামীর দিনের পর দিন অত্যাচার দুই কি সমান হল?
-সমান নয় কেন? এটা তুই বলে? তুই টীচার বলে? ছেড়ে দে। চড় মারাটা বড় কথা নয়। তোর কথা অনুযায়ী পলি যে তোকে দিনের পর দিন মানসিক কষ্ট দিতো সেটাও কি ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স নয়? এখানে রক্ত দেখা যাচ্ছে না বলেই কি? এটা একটা আপেক্ষিক ব্যাপার তারণ! পলিও কিন্তু মনে করছে সেও এরকম ভায়োলেন্সের শিকার।
-স্যরি স্যার! আমি ওরকম ভাবে আপনাকে বলতে চাইনি। তারপর কী হল বলুন।
-আমি চন্দ্রাকে একদিন ডেকে বললাম – ‘দ্যাখো শিক্ষকতাই আমাদের পেশা। আমি যদি তোমাকে বিবাহ করি – সারা স্কুলেই এই নিয়ে ঢি ঢি পড়ে যাবে। এখানে আমরা কোনও দিন মাথা উঁচু করে বাঁচত পারবো না। ছাত্রছাত্রীদের আমরা কিছু নীতিশিক্ষা দেবার জায়গায় থাকবো না। এখন যদি তুমি ডির্ভোসের মামলা করো, তবে কোর্টে আমারও ডাক পড়বে, কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি হবে। তারচেয়ে চাকরীটা ছেড়ে দিই। তাতে তোমার বাড়ীর অশান্তি কিছুটা হলেও স্থগিত থাকবে অন্তত মাস ছয়েক। তারপর তুমিও চাকরীটা ছেড়ে দিও।‘ ও বলল - ‘চাকরী ছেড়ে যাবো কোথায়? খাবো কি?’ আমি বললাম - ‘সে চিন্তা তুমি ক’রো না। সে ভার আমার।’ কিছুটা চুপ করে রইলেন মনোরঞ্জন।
-স্যার, তারপর?
-তারপর আমি চাকরী ছেড়ে দিলাম ওখানে। কী করব, কোথায় যাবো ঠিক নেই। কিছুকাল সাধুবাবাদের সঙ্গ নিয়ে ঘুরলাম এপাশ ওপাশ। একদিন এক মহাপুরুষের সঙ্গ নিয়ে যাচ্ছিলাম পুরী জগন্নাথ দেবের দর্শনে। পথে যেতে যেতে তোদের গ্রামের স্কুল দেখে অ্যাপ্লিকেশন করে দিলাম। কিছুদিন বাদে এসে খবর নিলাম, চাকরী হয়ে গেছে। পরে তো আমি ওখানে হেডমাষ্টারও হলাম।
-আর ওদিকে?
-মাস দুই যেতে না যেতেই আবার চন্দ্রার উপর অত্যাচার শুরু হল। এবার অপরাধ সন্তানহীনতা। তখন স্থানীয় কিছু মানুষের সহায়তা নিয়ে ও ডির্ভোসের আবেদন করে এবং পেয়েও যায় বছর খানিক বাদে। মালদহে আমার এক আত্মীয় থাকতেন। আমার ঠিকানা হিসাবে ওই ঠিকানাই ওকে দেওয়া ছিল। ও এসে ওঁর কাছেই ওঠে। চন্দ্রার পরিচয় ওঁরা জানতেন আমার তুতো বোন হিসেবে। একজন এস-আই’র সাথে সেসময় আমার খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। ওঁকে বলে কয়ে মালদহের একটি স্কুলে চন্দ্রার চাকরীর ব্যবস্থা হয়। এখন আমি মালদহের যে বাড়ীতে থাকি ওটা চন্দ্রারই বানানো বাড়ী। যতদিন ও স্কুলে চাকরী করতো আমি একটা দিনের জন্যও ওখানে যাইনি। চিঠি লিখতাম, ফোন করতাম - কিন্তু দেখা করিনি একদিনও। আমার রিটায়ারমেন্টের পর আমি ওখানে পাকাপাকি চলে যাই।
দেখতে দেখতে খড়গপুরও এসে গেল। নামার আগে ভবতারণ বলল, ‘স্যার আমার পক্ষে চাকরী ছাড়া সম্ভব নয় আপনার মতো!
-দূর বোকা! আমি কি তাই বলতে চেয়েছি তোকে? এখন তোর বয়স হয়েছে। চাকরী ছাড়লে খাবি কি? এখন তো আগের মতো দিনকাল নেই যে স্কুলে অ্যাপ্লাই করে দিলি আর চাকরী হয়ে গেল!
-দেবপ্রিয়াই বা ছাড়বে কেন স্যার!
-কাউকেই চাকরী ছাড়তে হবে না তারণ। তুই যদি তোর নিজের কাছে সৎ থাকিস - কিচ্ছু করতে হবে না তোকে। যা হবার তাই হবে।
-পলির ব্যাপারে কী করব স্যার?
-তুই আজই এখান থেকে ফিরে ওকে নিয়ে আয়। ও অনুতপ্ত।
-আপনি জানলেন কী করে?
-আজ দেখা করেছি।
-কোথায় স্যার? ও জানলো কী করে আপনি এসেছেন?
-ছাড় ওসব কথা। ওকে নিয়ে আয়। আর একবার ওকে সুযোগ দে। মানুষ অনুতপ্ত হলে তাকে আর সাজা দেওয়ার কিছু থাকে না তারণ। এরপর যদি আবার সমস্যা হয় – তখন তুই যা ভালো বুঝবি তাই করিস।
গাড়ী থেকে নেমে আস্তে আস্তে ফ্লাইওভারের দিকে হাঁটতে লাগলেন মনোরঞ্জন। এই বয়সে এখনও ঋজু, নির্ভার এবং আত্মসচেতন। স্যারকে নতুন করে আজ জানলো ভবতারণ। এই রূপ শুধুমাত্র সেই জানে এই পৃথিবীতে, শুধুমাত্র সেই...। একটু পরে ট্রেনও চলে গেল। জানলা দিয়ে শুধু একবার হাত নাড়লেন তিনি। এটাই তাঁর অভ্যেস! ট্রেন ছেড়েও গেল একসময়। ঘোর ভাঙতে ভবতারণের মনে হল, যাঃ! এতকথার মাঝে জানা হলো না তো – চন্দ্রাবতী এখনো বেঁচে আছেন কিনা?
1 Comments
Khub bhalo laglo ...sundor ar mone rakhar moto golpo
ReplyDelete