বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৫৪
নাগদমনী
ভাস্করব্রত পতি
নাগদমনীকে নাগদোনী, নাগদোনাও বলা হয়। ইংরেজিতে Worm Wood, Mugwort, Indian Wormseed, Artemisia, Absinth Sage, Absinth Wormwood, Absinth Sagewort, Common Sagewort, Absinthe Mugwort, Absinthium বলে। এই Mugwort নামটি বিয়ারের স্বাদ দেওয়ার একটি পদ্ধতির ব্যবহার থেকে এসেছে বলে মনে করা হয়। গ্রিভের মতে, মুগওয়ার্টের উৎপত্তি হতে পারে 'মাউট' থেকে (একটি পতঙ্গ বা ম্যাগটের একটি শব্দ)। কেননা এই উদ্ভিদটি অনেকটাই ওয়ার্মউডের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
সংস্কৃতে বলে দমনক, নাগদমনক, তেলুগুতে দৌনা এবং ওড়িয়াতে দহনা বলে। নাগদমনী সম্পর্কে ষোড়শ শতকের বৈদ্যগোষ্ঠী লিখেছেন --
'বিজ্ঞেয়া নাগদমনী বলামোটা বিষাপহা।
নাগপুষ্পী নাগপত্রা মহাযোগেশ্বরী তি চ॥'
অর্থাৎ নাগদমনীর আরও যেসব নাম রয়েছে সেগুলি হল -- বলামোটা, বিষাপহা, নাগপুষ্পী, নাগপত্রা এবং মহাযোগেশ্বরী। এছাড়াও এটি দমু, দনা, দেবানামু, জাম্ববতী, বলা, নাগাস্কা, দমনী, নাগগন্ধা, বৃদ্ধা, রক্তপুষ্পা, জাম্বরী, মোটা, মলয়ী, দুঃসহা, দুর্ধর্ষা নামেও পরিচিত। বাইবেলে নাগদোনাকে দুর্দশার চিহ্ণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
নাগদমনী গুল্মটির বহু প্রজাতি আছে। পৃথিবীজুড়ে এই গণের ২৮০ টি প্রজাতি বর্তমান। এর মধ্যে ৩৪ টি ভারত সংলগ্ন হিমালয়ের উত্তর পশ্চিম এলাকায় মেলে। আমরা সাধারণতঃ দেখতে পাই Artemisia vulgaris Linn কে। এটি সমতল এলাকায় দেখা যায়। Compositeae পরিবারের (এটি সোমরাজ্যাদিবর্গের শাক) অন্তর্গত। এছাড়াও অন্যান্য যেসব প্রজাতির খোঁজ মেলে, সেগুলি হল --
Crinium artaticum
Centipedo orbicularis
নাগদমনী উদ্ভিদটি নাতিশীতোষ্ণ ইউরোপ, এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা এবং আলাস্কায় স্থানীয়, এবং উত্তর আমেরিকার একটি আগাছা জাতীয় গাছ। এটি একটি অতি সাধারণ উদ্ভিদ যেখানে কম নাইট্রোজেনযুক্ত বর্জ্য স্থান, রাস্তার ধারে এবং পোড়ো জমিতে জন্মায়। মাটিতে লাঙ্গল দিয়ে সহজে একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়না এর বিস্তৃত রাইজোমের জন্য। এই গাছের নামে একটি গ্রামনাম রয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গড়বেতা ২ নং ব্লকের জিরাপাড়া ৩ নং গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার ছোট নাকদোনা গ্রামটি এরকমই একটি উদ্ভিদবাচক গ্রামনাম।
নাগদমনী > নাগদোনী / নাগদোনা > নাকদোনা
এটির মৌজা নম্বর ৮২ এবং এটি শালবনী বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। এতদঞ্চলে এই গাছের প্রাধান্যহেতু গ্রামের নামকরণ হয়েছে বলা যায়।
নাগদোনা একপ্রকার কাঁটাযুক্ত গাছ। সাধারণ ক্ষুদ্র ক্ষুপ বিশেষ। মোটামুটি ৩/৪ ফুট লম্বা হয় গাছটি। কাণ্ডে অনেক বহুভাগে বিভক্ত পাতা রয়েছে। সেগুলি ৩ - ৪ ইঞ্চি লম্বা এবং ১ -২ ইঞ্চি চওড়া। নিচের দিকের পাতাগুলি ওপরের দিকের পাতার তুলনায় বেশি চওড়া হয়। এই গাছের পাতার নিচের দিক রোঁয়াযুক্ত, পক্ষগুলি বিচ্ছিন্ন এবং সামান্য সুগন্ধীযুক্ত। লম্বা এবং ধূষর রঙের পুষ্পদণ্ড থাকে। এই ফুল জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ফুটতে দেখা যায়।
চিন ও জার্মানিতে মুগওয়ার্ট একটি সুগন্ধযুক্ত ভেষজ হিসেবে রান্নায় ব্যবহৃত হয়। নেপালে ঘরের ঝাড়ু হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং দেবতার উদ্দেশ্যে ওষধি ধূপ হিসেবে নিবেদন করা হয়। বিয়ার তৈরির প্রক্রিয়া প্রবর্তনের আগে ইংল্যান্ডে স্বাদের এজেন্ট হিসেবে কাজে লাগানো হত। এই গাছটির দ্রব্যশক্তির রস বীর্য এবং রোগ নিবারণী ক্ষমতা রয়েছে। প্রাচীন লেখায় পাই --
'সা তিক্তা নাগদমনী কটুঃ পিত্তকফাপহা।
লঘু রুক্ষঃ মূত্রকৃচ্ছ ব্রণাংশ্চ নাশয়েৎ গ্রহান্।
বরটীদষ্ট জালাংশ্চ বিষং চ জাল গর্দভাম্।'
অর্থাৎ এই নাগদমনীর রস তিক্ত, কটু ও রুক্ষ। এটি পিত্ত, কফ এবং বিকার দূর করে। আর রোগ প্রশমনের ক্ষেত্রে মূত্রকৃচ্ছ বিষ, বোলতার হুলের জ্বালা যন্ত্রনা এবং 'জালগর্দভ' রোগ দূর করে। এই জালগর্দভ আসলে অগ্নিবাত।
মানুষের বিশ্বাস যে গোখরো সাপ ফণা তুললে তখন নাগদমনীর শিকড় সামান্য থেঁতো ক'রে ধ'রলেই সাপ ফনা নামিয়ে দেয়। আবার সাপের কামড় খাওয়া ব্যক্তির নাকের ফুটোয় নাকদোনার রস ফোঁটা ফোঁটা করে দিলে খিঁচুনি দূর হয়। আর রস খেয়ে নিলে সাপের বিষ থাকেইনা। যদিও এসবের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
'যঃ পিবেৎ নাগদমনী মূলং হি পুষ্যকালতঃ।
তস্মিন্নপাস্ত দশনাঃ নাগাঃসাঃ নাত্রসংশয়ঃ॥'
অর্থাৎ নাগদমনীর মূল যদি পুষ্যা নক্ষত্রে খাওয়া যায়, তবে বিষধর সাপও বিষদন্তহীন হ'য়ে পড়বে, এতে কোন সংশয় নাই।
'কিং চিত্রং যদি শব্দশাস্ত্র কুশলো লোকো ভবেৎপণ্ডিতঃ কিং চিত্রং যদি দণ্ডনীতি কুশলো রাজাভবেৎ ধার্মিকঃ। কিং চিত্রং যদি রূপ যৌবনবতী যোষিন্ন সান্ধীভবেৎ কিং চিত্রং যদি তত্র নাগদমনী মূলং ন হিংসেদহিঃ॥'
আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য এটির অর্থ করেছেন -- 'শব্দ শাস্ত্রে (ভাষাতত্ত্ব সহ) কুশল ব্যক্তি যদি পণ্ডিত হয়, তাতে আশ্চর্য কিছুই নেই (না হ'লেই আশ্চর্য')। যে রাজা দণ্ডনীতি বিষয়ে কুশল হ'য়ে ধার্মিক হয়, তাতেও আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই, হওয়াই স্বাভাবিক, না হ'লেই আশ্চর্য'। রূপ ও যৌবনসম্পন্না রমণী যদি সতী সাধ্বী না হয়, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই। না হ'লেই বুঝতে হবে খুবই আশ্চর্য। কারণ রূপহীনারাই সতী-সাধী হয়। তেমনি কোথাও যদি নাগদমনী লতার মূল থাকে আর সাপ যদি সেখানে থেকে কাউকেও না হিংসা করে, সেটাতেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ নাগদমনী থাকলে সাপ খুব শান্ত হ'য়ে থাকে। তবুও যদি দংশন করে তবেই আশ্চর্য।'
রসতন্ত্রহৃদয়, রসেন্দ্রচিন্তামণি, রসমহৌষধি, রসার্ণব ইত্যাদি গ্রন্থগুলিতে এই নাগদোনা গাছের নানা উপকারী গুণের বর্ণনা করা হয়েছে। এই নাগদমনীর লোকায়তিক ব্যবহার ক্রিমিকূলকে ধ্বংস করতে ব্যবহৃত হয়। অনেকে তাই প্রশ্ন তুলেছেন, এই গাছের ক্ষেত্রে 'নাগ' সম্পর্কে সাপকে উদ্দেশ্য করে বলা হ'য়েছে না ক্রিমিকে উদ্দেশ্য করে নাগদমনী করা হ'ল, তা গবেষণা করার মতো বিষয়। মধ্যযুগে একে "ভেষজ মা" হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছিল। প্রাচীন চিনা, ইউরোপীয় এবং ভারতীয় বৈদ্যরা আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরির জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত করত। এর মধ্যে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টিহাইপারটেনসিভ, অ্যান্টিহাইপারলিপিডেমিক, অ্যান্টিক্যান্সার, অ্যান্টিইনফ্লেমেটরি, হেপাটোপ্রোটেক্টিভ, অ্যান্টিস্পাসমোলাইটিক, অ্যান্টিনোসাইসেপ্টিভ, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল বৈশিষ্ট্য।
দাদ, চুলকানি, ছুলির নিরাময়ে নাগদোনা পাতার রস লাগানো হয়। দেহের দুর্গন্ধময় ঘা এবং চর্মরোগে এর পাতার রস গরম করে লাগালে উপকার হয়। অনেকের বিশ্বাস এর শিকড় শিশুদের কোমরে বেঁধে রাখলে অপশক্তির হাত থেকে রেহাই মেলে। মাথার যন্ত্রণার উপশমে, গর্ভরোধে, অন্ত্রের মধ্যে থাকা মিউকাস মেমব্রেনে (mucous membrane) অনেকরকম রোগ নিরাময়ে, যে কোনও রকমের ক্ষতে, কানের যন্ত্রনা কমাতে, মূত্র নিঃসরণের কষ্ট কমাতে, মহিলাদের অস্বাভাবিক ঋতুবন্ধ ঠেকাতে, শিশুদের ক্রিমি রোগ থেকে রেহাই দিতে, শিশুদের তড়কা রোগের ক্ষেত্রে নাগদোনা গাছের উপকারিতা উল্লেখযোগ্য।
🍂
0 Comments