জ্বলদর্চি

বিবেক দর্শন ও জাগৃতি/ ঈশিতা সেনগুপ্ত

বিবেক দর্শন ও জাগৃতি

 ঈশিতা সেনগুপ্ত


"তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা "-রবি ঠাকুরের এই গানটির অর্থ স্বামীজি তার স্বীয় জীবনে উপলব্ধি করেছিলেন তাঁর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের সান্নিধ্যে এসে।তবে এই কলিযুগে আমাদের জীবনে আমরা প্রকৃত ধ্রুবতারার   খোঁজ করি না।খুব গভীর ভাবে ভাবার সময় এসেছে যে আমরা নিজেরা জীবন সম্পর্কে প্রকৃতপক্ষে কতটা অবহিত আর সেই শিক্ষার কতটুকু আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কে দিতে পারছি। স্বামীজির যে তিনটি বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য মানবজীবনের আদর্শ হওয়া উচিত সে কটি হল-যুক্তিবাদী মানসিকতা, সত্যনিষ্ঠা, ও পরার্থে সর্বস্ব ত্যগ। স্বামীজির যুক্তিবাদী মন প্রাথমিকভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী না থাকায় গুরু রামকৃষ্ণ পরমহংস কেও তিনি নানা মাধ্যমে পরীক্ষা করেছিলেন এবং সাক্ষাতে সরাসরি প্রশ্ন নিক্ষেপ করেছিলেন-"আপনি ঈশ্বরকে দেখেছেন?" অর্থাৎ অকাট্য যুক্তি ব্যতীত স্বামীজি কেবলমাত্র চিরাচরিত প্রথা ও অন্ধ বিশ্বাসে অবলম্বন করে কোনকিছুই গ্রাহ্য করতেন না। কলিযুগের বর্তমান সমাজে এই মানসিকতার বড়ই অভাব পরিলক্ষিত হয়। ইঁদুর দৌড়ের প্রতিযোগিতায় মেতে ছাত্রসমাজ পুঁথিগত  বিদ্যাকে কোনমতে গলাধঃকরণ করে চাকরির বাজারে অর্থোপার্জনের পথে ছুটে চলেছে। যুক্তি দিয়ে বিচক্ষণতার সাথে কিছু আয়ত্ত করার ধৈর্য সময় কিছুই তাদের নেই। 

🍂

তবে এক্ষেত্রে অভিভাবকদের দায় অনেক বেশি থাকে।তারা নিজেদের জীবনেই বা কতটা ঠাকুর-মা-স্বামীজির আদর্শ কে পাথেয় করতে পারে। কর্ম জীবন থেকে অবসর গ্রহণের পরেও আমরা কজন তাঁদের জীবন অনুশীলন করি বলুন তো? বর্তমান সমাজ বড়ই স্বার্থান্বেষী: প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনভাবেই স্বীয় স্বার্থ টুকু ছাড়া কেউ এক মুহুর্ত চলি না। অথচ স্বামীজি যে ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন তার মূল সুর ছিল ঐক্যতা, স্বার্থ শূন্য চিন্তাধারার বিকাশ।"দাও দাও ফিরে নাহি চাও"-স্বামীজির এই ভাবনার নিগূঢ় অর্থ আমরা কি সত্যিই অনুধাবন করতে পারি? পরোপকার করলেও আমাদের মনের অন্তঃকরণে কোথাও যেন অপরের থেকে স্তূতিবাক্য শ্রবণের আকাঙ্খা সুপ্ত থাকে কখনো বা তার অভিব্যক্তি ঘটে নানা রূপে। প্রত্যাশা ব্যতীত পরের জন্য সর্বস্ব নিবেদনের মনোভাব তৈরীর জন্য ঠাকুর নির্দেশিত যে পথ তিনি দেখিয়েছিলেন তা হল -সর্বভূতে ব্রহ্ম দর্শন,যত্র জীব তত্র শিব , শিব জ্ঞানে জীব সেবা। মূলত যখন সকল জীবের মধ্যে আমরা ঈশ্বরের উপস্থিতি অনুভব করতে পারব একমাত্র তখনি আমরা আমাদের ক্ষুদ্র অহঙ্কার কামনা বাসনার মোহ মুক্তি ঘটাতে সক্ষম হব। বর্তমান প্রজন্ম কে আমরা পূজা অর্চনা করতে শেখাই ঠিকই কিন্তু সেই পূজার মাধ্যমে  জীবনের নিগূঢ় সত্য অনুসন্ধানের পথ তাদের দেখাই না। কিছু চিরাচরিত যুক্তিহীন নিয়ম তাদের ওপর আরোপ করে নিজেদের অজান্তেই তাদের যুক্তিবাদী মানসিকতা কে হত্যা করি। তাদের মধ্যে প্রশ্নের ক্ষিদে উঠতে দিনা যে কোনো করব? কী কারণে করব।এই বিষয়টিতেই আলোকপাত করেছিলেন স্বামীজি।"যিনি তোমার অন্তরে ও বাহিরে, যিনি সব হাত দিয়ে কাজ করেন ও সব পায়ে চলেন, তুমি তার একাঙ্গ, তার উপাসনা কর এবং অন্য সব প্রতিমা ভেঙে ফেল।" অর্থাৎ সকল জীবের মধ্যে যে অবিনশ্বর ব্রহ্ম অধিষ্ঠিত তার সেবা করাই প্রকৃত জগদীশ্বরের সেবা। ১২ই জানুয়ারি সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যুগদিবস পালিত হয় ঠিকই কিন্তু তার মূলীভূত শিক্ষার ব্যাপ্তি কি আমরা সমাজের সকল স্তরে ঘটাতে পারি? বর্তমান যুবসমাজ বড়ই দিশাহীন। পুঁথিগত শিক্ষা আয়ত্ত করে ঠিকই কিন্তু জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী, জীবনে চলার পথে অর্জিত শিক্ষার ব্যবহারিক ও পারমার্থিক দিক কতটা এই বিষয়ে তারা কেউ জ্ঞাত নয় , জানার ক্ষিদেটাও নেই। শুধুই অর্থোপার্জন মূল কেন্দ্র। অবশ্যই জীবনের প্রাথমিক চাহিদা পূরণে অর্থের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্ত সেই প্রয়োজনের আদি কোথায় অন্ত কোথায় এই নিয়ে আমরা অনুশীলন কজন করি? চাহিদা তো থাকে অনন্ত। কিন্ত সেই চাহিদাকে সীমিত করার জন্য  মনের উপর স্বনিয়ন্ত্রন বড়ই আবশ্যক। যত জীবনের গহনে প্রবেশ করা যাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রন ক্ষমতাও ক্রমবর্ধমান হবে। জীবনের সত্যানুসন্ধানের মূল ভিত্তি হল গভীর মননশীল চিন্তা। আধ্যাত্মিকতার মূল নির্যাস লুকায়িত স্বামীজির জীবনদর্শনে ।
আমাদের মূল কর্তব্য তাঁর সেই ভাব ও ভাবনাকে আমাদের ভাবী প্রজন্মের কাছে সুপরিকল্পিত ভাবে তুলে ধরা যাতে, তারা প্রকৃত জীবনাদর্শের অভাবে অন্ধকারে না তলিয়ে যায়, জীবন যেন তাদের কাছে প্রকৃত রূপে অর্থবহ হয়ে ওঠে।


Post a Comment

0 Comments