অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়
শীতের হাওয়ায় লাগলো কাঁপন। পৌষ সংক্রান্তির দোরগোড়ায় এসে গেছি। ঠান্ডা-গরমের রেখাচিত্র ইসিজি রেখাচিত্রের মতো ওঠানামা করছে। দুদিন এখন ঠান্ডা চলছে। অনেকেই কম্বল বা লেপকে দুদণ্ড শান্তি দিতে বদ্ধ জায়গা থেকে বার করে রাতে গায়ে দিচ্ছে আবার অজান্তেই শরীর থেকে সরে যাচ্ছে গভীর রাতে তার মানে গরম লাগছিল। শীতের রাত দীর্ঘ। এতটা সময় যে শেষ হতে চায় না অগত্যা স্মৃতি এসে ভিড় করে মনে। ফিরে যায় ছোটবেলায়।
আকাশের বর্ণময় উজ্জ্বলতা হেমন্তে হারালেও অরণ্যে অরণ্যে জ্বলে ওঠে বিচিত্র উজ্জ্বল রঙ। গাছের ডালে ডালে পাতারা ক্লোরোফিল হারিয়ে সবুজ থেকে কমলা থেকে আগুনের মত লাল হয়ে অবশেষে অলসভাবে বন্ধন ছিন্ন করে বাতাসে উড়তে উড়তে মাটিতে এলিয়ে পড়ে। শুকিয়ে মৃত্যুর আগে এইভাবে জ্বলে ওঠা প্রকৃতির এক মায়াময় খেলা। সে কাশ্মীরে চিনারই হোক বা জাপানে চেরী গাছ হোক অথবা বাড়ির আশপাশে গাছপালা এমনকি বাঁশপাতাও। প্রকৃতির নিয়ম সবখানে। অস্তে যাবার আগে রবির রাঙা হওয়া এবং আকাশ রাঙিয়ে দেওয়া সেই একই খেলা। দৃষ্টিনন্দন আবেগতাড়িত হলেও প্রতিটার পেছনে আছে বিজ্ঞান, অণু-পরমাণু-বিচ্ছুরিত আলোর অবদান। বর্ষার মেঘ-বৃষ্টির যুগলবন্দি শেষে মেঘ-রোদ-বৃষ্টির খুনসুটি নিয়ে শরতের রাধাকৃষ্ণের রাগ-অনুরাগ মলিন হয় হেমন্তের শুষ্ক আগমনে। বিষন্নতা এমনই গভীর শুক্লপক্ষের পূর্ণতাপ্রাপ্তিও সোম-নির্যাস রস নিঙরোতে ব্যর্থ। রাতের বিছানায় কাঁথা বদলে যায়, কালো কম্বলে মুখ ঢাকে ভোর, আশা-কুয়াশার দোলাচালে আড়মোড়া ভেঙে সূয্যিমামার আগমনে বিলম্ব ঘটে, ধীরে চলে রেলগাড়ি, পোতের পথ হারায় বিমান, রাস্তার ধারে দোকানের উনুনে ফোটে মোটা দুধের চা। শীর্ণ হাত কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে যায়, ধোঁয়া ওঠা ভাঁড় মাথায় মোটা চাদর মোড়া মুখে ঠোঁটের স্পর্শ পাবার আশায়। এই দৃশ্য জানিয়ে দেয় শুষ্ক রঙিন পাতার হাওয়ায় বিদায় নিয়েছে হেমন্ত, মঞ্চে শীতের কঠিন পদক্ষেপে দৃঢ় প্রবেশ।
🍂
ঘুর্ণায়মান পৃথিবীতে ঋতুচক্রের নিয়ম মেনেই আসে শীত। শীতের আহ্বান শিউলি ফোটা ফুরনো থেকেই। মনে হয় কালী প্রতিমার গঙ্গায় বিসর্জনে জলে যে উথাল-পাতাল হয় তার প্রভাব পড়ে বাতাসে। পূবের হাওয়া বন্ধ হয়ে দমবন্ধ করা বাতাসহীন একটা আবহাওয়া তৈরি হয় যেখানে দূষণহীন আসমান-পরিবেশে সূর্যের রশ্মি তীব্র হয়ে শুষে নেয় জলীয় বাষ্প, পথ তৈরি করে দেয় উত্তরের হাওয়া আসার। উত্তরের হাওয়া এলেই শীত আসে না, সময় দিতে হয় বরফ ছোঁয়া হিমালয়ে ধাক্কা খেয়ে উত্তর-পশ্চিমের থেকে ধেয়ে আসা শীতল বাতাসকে থিতু হতে। ততদিন হেমন্ত। সেই সময়েই বেজে উঠত স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার ঘন্টা। তখন হেমন্ত আসত শর্ট-টার্ম প্রজেক্ট নিয়ে, এখনকার মত প্রায় দু’মাস থাকতো না। অঘ্রাণের তৃতীয় ইতু পুজো শুরু হওয়ার আগেই পরীক্ষা শেষ হয়ে যেত। তারপর হাফ প্যান্ট পরে গায়ে চাদর জড়িয়ে সকালে পূবের রোদে ওম নেওয়ার ইচ্ছে মানেই শীত ঢুকে পড়েছে। তার আগে থেকেই শরীরে দেখা দিত শীতের ইঙ্গিত, ঠোঁট ফাটা, পায়ের গোড়ালি ফাটা, আর শীতে গায়ে খড়ি ওঠা। চানের আগে বেশ করে সর্ষের তেল দিয়ে গায়ে রগড়ে মাখা। আমার অবশ্য এসব শুষ্ক ত্বকের ঝামেলা ছিল না তবু রোদে সর্ষের তেল মাখার মজাই ছিল আলাদা। ঠাকুমা পই পই করে বলে দিতেন পায়ের আঙুলে নারকেল তেল দিতে, এতে ঠোঁট ফাটে না। কথা মান্য করে দিতামও। আজও আমার ঠোঁট মসৃণ, নরম। আমার পাতকুয়োর জলে চান করতেই ভাল লাগতো, সেই থেকে গরম জলে চানের অভ্যেস আজও তৈরি হয়নি। সে পৃথিবীর যেখানেই থাকি। আসলে পাতকুয়োর জল থাকত প্রাকৃতিকভাবেই উষ্ণ। পুকুর বা গঙ্গার জলও উষ্ণ। টিউবওয়েলেরও। জল ঠাণ্ডা হয় ছাদের ট্যাঙ্কের। সিগারেট ছাড়াই মুখ থেকে গলগল করে ধোঁয়া বের করার অভ্যেস তখন থেকেই, অবশ্য আরও কিছুদিন পরে, পৌষে। তখন চানের সময়েও গা থেকে ধোঁয়া বার হত।
পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরদিন থেকেই বাড়ির কাছে ছোট মাঠে চলে যেতাম বন্ধুরা। অবশ্যই জলখাবার খেয়ে। তখন থেকেই জলখাবারের সাথে চায়ের অভ্যেস হয়ে গেছে। একদিনের মধ্যে গাদির কোর্ট কাটা শেষ। ভলিবলের নেটের জন্যে দুটো লম্বা খুঁটি। ক্যাম্বিস বলে ক্রিকেটের জন্যে ওই মাঠেই পিচ তৈরি। নানা বয়সের অনেক বন্ধু। একেকসময় একেকটা খেলা। দুপুরে মা ডেকে নিয়ে যেতেন চান-খাবারের জন্যে। খেয়ে বিশ্রামের সময় পাওয়া যেত না কারণ দিনের সময় তো খুবই কম, আলো নিভে যেত আকাশের। রাস্তার লাইট জ্বলে গেলে, অন্ধকার ঘনীভূত হওয়ার আগেই বাড়ি ঢুকতে হবে।
তখন রেডিওতে সন্ধ্যে সাড়ে পাঁচটায় কৃষিকথার আসর হত, আর ছটায় যাত্রা। আমাদের বাড়িতে রেডিও আসার আগে পাশে ঠাকুমার বাড়িতে রেডিও খোলা থাকত। বেশ মজা লাগত সেই যাত্রাপালা শুনতে। বিকেলে সারা বছরই ঠাকুমার বাড়ির বাইরের ঘেরা রক বা বারান্দায়, রাস্তার পাশেই, মহিলাদের আড্ডা বসত। সেখানে তিন ঠাকুমা, মা, কাকিমা, জ্যেঠিমা এবং পাড়ার আরও কিছু মহিলারা আসর জমাতেন। যেদিন খেলতে ভাল লাগত না বা দলে জায়গা হত না, বিশেষ করে এই শীতকালে, সেদিন আমিও ওখানে বসতুম। এলাকার এপাড়া-ওপাড়া থেকে আশপাশের বাড়ির নানা খোঁজখবর আদান-প্রদান হত। একদিন সকালে পূবের রোদের ওম পোয়াতে গিয়ে টুংটাং আওয়াজ শুনতে পেতাম। এই দিনটার জন্যে আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। ছুটে চলে যেতাম মাঠে। তিন-চারটে গরুর গাড়ি, গাড়ি বোঝাই কলসি-হাঁড়ি আর কলসি ভর্তি খেজুর গুড়। গরুগুলো খুঁটিতে বাঁধা। দু-একটা কলসি খোলাই থাকত, আমরা হাত বাড়াতেই দানাওলা গুড়। সেই দানাওলা গুড় আর দেখি না, বড় আফসোসের। সকাল একটু এগোলেই গাড়ি-গুড়ের মালিক নিজে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খবর দিত। গুড় আসতো বসিরহাট থেকে। যেমন তার গন্ধ, তেমন স্বর্গীয় স্বাদ। লম্বা শিক দিয়ে কলসির ভেতর থেকে গুড় টেনে বের করে পরীক্ষা করাতো ক্রেতাদের। দু দফায় আসত। প্রতি দফায় আমাদের একটা করে কলসি বেছে কেনা হত। সকালে জলখাবারে রুটি/পরোটা/লুচি সহযোগে এবং রাতে রুটি বা লুচি দিয়ে শেষের পাতে। গুড় দিয়েই তিন/চারটে রুটি খাওয়া হয়ে যেত। এছাড়া এমনি এমনি তো আছেই। কলকাতা পেরিয়ে জয়নগর তখনও পেনেটিতে এসে পৌঁছত না বা এলেও দু-একবার। ফলে মোয়া বলতে চিঁড়ে-মুড়ির মোয়া, খইয়ের মোয়া। এই মোয়ার কথায় মনে পড়ে গেল শীতের ছুটিতে, মানে ডিসেম্বরের ২৩ বা ২৪ তারিখে স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়ে গেলে বড়দিন থেকে নিউ ইয়ার (তখনও আমাদের মধ্যে ‘হ্যাপি’ আসেনি, যদিও সুখের ঘাটতি ছিল না), আমরা মাঝেমধ্যে সাদার্ন মার্কেটের পেছনে ভবানন্দ রোডে মামাবাড়ি চলে আসতাম। শীতের ওই ঠাণ্ডার সকালে এক ফেরিওয়ালা কাঁধে টিনের বাক্স নিয়ে হাঁকতে হাঁকতে যেত ‘চাই মুড়ির মোয়া, চাই চিঁড়ের মোয়া’ – আজও সেই হাঁক আমার কানে বাজে। মামাবাড়িতে আবার অন্য মজা। চিড়িয়াখানা, ভিক্টোরিয়ার বাগান, জাদুঘর বেড়াতে যাওয়া, জয়নগরের মোয়া খাওয়া, আর বছরের শেষে সবাই মিলে কাঁপতে কাঁপতে ট্যাক্সি চড়ে রাতের শোয়ে সিনেমা যাওয়া। ভবানীপুরে কত হল, উজ্জ্বলা থেকে পূর্ণ, মাঝে বিজলী, ভারতী, ইন্দিরা। বসুশ্রীতে গেছি বলে মনে পড়ে না। যেখানেই থাকি শীতের অনেক রাতেই খেতাম কড়াইশুটির কচুরি, আলুরদম, ছোলার ডাল আর শেষপাতে গুড়। তবে গুড় ভালো খেতাম পানিহাটিতেই। মামাবাড়িতেও লেক মার্কেট থেকে গুড় নিয়ে আসা হত। আমরাও পানিহাটি থেকে নিয়ে আসতাম সেই গুড়। ট্রামে চড়ে দুপুরে এসপ্ল্যানেডে মনুমেন্টের নিচে কাবুলিদের মেলা, মাদারির খেলা আর নানা রকমের আসরে ছিল সীমাহীন মজা। মামাদের সাথে ইডেনে গিয়ে এক-দুদিন টেস্ট ক্রিকেট দেখাটাও ছিল শীতের বিলাসিতা। পয়লা জানুয়ারি কেক খেয়ে বাড়ি ফিরতাম।
শীতকালে বাবা ফেরাজিনির পাউরুটি আনতেন প্রায়ই, মিষ্টি সুবাস ম ম করত। কেক বলতে বড়ুয়ার, বড়দিন আর পয়লা জানুয়ারি খাওয়া হত। তবে খেজুর গুড় দিয়ে পায়েস হত প্রায়ই। ক্ষীরেও গুড় মেশানো হত। পানিহাটির বিখ্যাত গুপো সন্দেশও এসময় গুড়ের হত। জানুয়ারিতে নতুন ক্লাসে বুকলিস্ট দিত। নতুন বই কেনা হত যদি দাদার সেই বই না থাকে। কিছু বই অন্য কারোর থেকে হাফ দামেও কেনা হত। কাগজ কিনে এনে বাড়িতে গুনছুঁচ-সুতো দিয়ে খাতা বানানো হত। বাড়িতে রাফ-ওয়ার্কের জন্যে বালির কাগজের খাতা তৈরি করা হত। বই-খাতা মলাট দেওয়ার জন্যে ক্যালেন্ডার বা ম্যাগাজিন।
অভিজ্ঞতা বলে আবহাওয়া সম্বন্ধে আমাদের স্মৃতি ক্ষণস্থায়ী। এ নিয়ে নানা কথা, তর্ক হয়। পুরনো লেখা থেকে জানলাম গত দুবছর ধরে পৌষের প্রথম দিন থেকেই শীতের হাওয়ায় লাগল কাঁপন। এ বছরও তার অন্যথা হয়নি যদিও পূর্বরাগ জমে উঠেছিল দিন চারেক আগে থেকেই। শহরে শীত রঙিন, ফলে, সবজিতে, ফুলে, পোশাকে। কেক, কুকিজ বহুবিধ, সুস্বাদু। মলে, বাজারে ভিড়। সাংস্কৃতিক জগত আকর্ষণীয় নানা মেলা, ফেস্টিভ্যাল ইত্যাদিতে। তবে পার্ক সার্কাস ময়দানে জন্তুজানোয়ার আর ট্রাপিজের খেলা দিয়ে সাজানো সার্কাসের মজা হারিয়ে গেছে।
শহর থেকে দূরে শীত এখনও শুষ্ক, বড়ই শুকনো। বন্যার জল শুকিয়ে আলগা মাটি হাওয়ায় উড়ছে, গাছেদের পাতায় সেই ধুলোর আস্তরণ। শুকনো মানুষের মুখ, পেট। একটার পর একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোর দুশ্চিন্তার জাল কেটে বেরনো বড় কষ্টের।
1 Comments
এটি একটি অনবদ্য লেখা। শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতি বারে বারে ফিরে পেলাম। সুললিত লেখাটির জন্য অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়কে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ReplyDelete