জ্বলদর্চি

ড. নরেশচন্দ্র নন্দ (অধ্যাপক, সমাজসেবী, মৈতনা, রামনগর) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৩৯
ড. নরেশচন্দ্র নন্দ (অধ্যাপক, সমাজসেবী, মৈতনা, রামনগর) 

ভাস্করব্রত পতি

তিনি যখন লণ্ডনে ছিলেন, তখন তিনি 'কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রাম সহায়ক সমিতি'র প্রতিনিধি হিসেবে অর্থসংগ্রহ করেছেন। লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন 'বাংলাদেশ সোসাইটি'র প্রতিষ্ঠাতা কার্যনির্বাহী সদস্য ও 'ইন্ডিয়া সোসাইটি'র কার্যনির্বাহী সদস্য পদে যুক্ত ছিলেন। সেসময় (১৯৭০-১৯৭১) তিনি লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ও বাইরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে অক্লান্তভাবে কাজ করে গিয়েছেন। তিনি এই ১৯৭১ সালেই অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে লন্ডনের Trafalgar Square এ London Colosseum এ ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ঐতিহাসিক জনসভার ব্যবস্থাপনায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবীতে লন্ডনের বুকে জয়প্রকাশ নারায়ণ, পি. সুন্দরাইয়াদের সভা করারও উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি ও তাঁর সাথীরা বাংলাদেশে গণহত্যার (Genocide in Bangladesh) প্রতিবাদে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই একটি চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন এবং লন্ডনের Hyde Park এ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থনে উদ্দীপক ভাষণ দেন। ঠিক একারনেই তিনি এবং তাঁর সঙ্গীসাথীরা একদল লোকের বিরাগভাজন হন। ফলে বেশ কয়েকবার নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত হন। তিনি ড. নরেশচন্দ্র নন্দ। মেদিনীপুরের বীর সন্তান। 

পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি মহকুমার রামনগর থানার মৈতনা গ্রামে ১৯৪০ সালের ৩০ শে জুন জন্মগ্রহণ করেন ড. নরেশচন্দ্র নন্দ। তিনি ছিলেন বংশপরম্পরায় সংস্কৃত ও প্রাচ্য সংস্কৃতিসেবী এবং সুবিখ্যাত এক স্বাধীনতা সংগ্রামী ও সমাজসেবী পরিবারের উজ্জ্বল সন্তান। বাবা ছিলেন নিখিলাশাস্ত্রাধ্যাপক পণ্ডিতকুলশিরোমণি রমেশ চন্দ্র পঞ্চতীর্থ বেদান্তবিদ্যার্ণব বিদ্যালঙ্কার। মায়ের নাম রমা দেবী। 

বাবার কর্মস্থল এগরা থানার গড় বাসুদেবপুরেই তাঁর বেড়ে ওঠা। এখানকার গড় বাসুদেবপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (১৯৪৭-১৯৪৯) প্রাথমিক পাঠ গ্রহণ করেন। এরপর গড় বাসুদেবপুর হরিপ্রিয়া ইনষ্টিটিউশন (১৯৪৯-১৯৫৫) থেকে স্কুল ফাইন্যাল পাস করার পর কাঁথি প্রভাত কুমার কলেজে (১৯৫৫-১৯৫৯) আই এ ডিগ্রী লাভ করেন। এই পরীক্ষায় জেলার মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। বরাবরই মেধাবী ও কৃতী ছাত্র ও গবেষক ছিলেন। কাঁথি প্রভাত কুমার কলেজে বি. এ. (অর্থনীতি অনার্স) পড়ার সময় সুব্রত স্মৃতি বৃত্তি ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মেধা বৃত্তি লাভ করেন। পরে অর্থনীতি অনার্স সহ বি. এ. পাশ করেন। কাঁথি থেকে চলে যান কলকাতা। সেখানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়তে (১৯৫৯-১৯৬১) ফোর্ড ফাউণ্ডেশন বৃত্তি সহ এম. এ. পাশ করেন। ১৯৬৮ তে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার জন্য ইংল্যাণ্ড চলে যান। লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. এস. সি. (১৯৭০) ও পি.এইচ.ডি. (১৯৭২) ডিগ্রি লাভ করে ভারতে ফিরে দু'বছর ভারত সরকারের অধীনে সোস্যাল সায়েন্টিস্ট হিসাবে গবেষণা কাজেও যুক্ত ছিলেন ড. নরেশচন্দ্র নন্দ। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এসসি. (কৃষি অর্থনীতি) ও পি. এইচ.ডি. (আন্তর্জাতিক বিপণন) ডিগ্রি লাভের সময় ব্রিটিশ কাউন্সিল বৃত্তি ও অন্যান্য বৃত্তি (এঊইনা মাউন্টব্যাটেন বৃত্তি, সিনী পেরী ফাউন্ডেশন বৃত্তি ও নর্থ ব্রুক সোসাইটি বৃত্তি) পেয়েছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গবেষণাকর্মের জন্য ইংল্যাণ্ডের Institute of Marketing তাঁকে সাম্মানিক সদস্যপদ দেয় ১৯৭৩ সালে। ড. নরেশচন্দ্র নন্দ ছাত্রাবস্থা থেকেই বিভিন্ন সমাজসেবামূলক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের সাথে যুক্ত থেকেছেন। দেশের পাশাপাশি বিদেশেও তিনি তাঁর প্রতিভার ছাপ রেখে গিয়েছেন। মেদিনীপুরের বুক থেকে উঠে দেশ বিদেশে নিজের কর্মপরিচয়ের ছাপ রেখে গিয়েছেন নানা ভাবে। 

খুব কম সময়ের জন্য কাঁথির বসন্তিয়া হাইস্কুলে শিক্ষকতা করছেন। তারপরে টানা সাত বছর কাঁথি কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। শুধু কাঁথি কলেজে নয়, তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় অধ্যাপনা করেছেন। প্রথমে কাঁথি প্রভাত কুমার কলেজ (১৯৬২ - ১৯৬৮) অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে সুনামের সঙ্গে কাজ করার পর ১৯৬৮ - ১৯৭০ এ স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী ও গবেষক হিসেবে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন। অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে স্কুল অফ্ বিজনেস্ স্টাডিজ লন্ডনেও (১৯৭২-১৯৭৩) ছিলেন একবছর। ভারত সরকারের কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক্ এ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রিয়াল রিসার্চ (C.S.I.R.) এ ১৯৭৩ - ১৯৭৫ তে ছিলেন সোস্যাল সায়েন্টিষ্ট পদে। ১৯৭৫ - ১৯৮৭ তে উত্তর চব্বিশ পরগণার কাঁচরাপাড়া কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মতৎপরতা দেখিয়েছেন সুনামের সঙ্গে।  সবশেষে কলকাতার বিবেকানন্দ কলেজে অধ্যক্ষ (১৯৮৭ - ২০০০) পদে তিন বছরকাল কাজ করেছেন। কলেজে অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ থাকাকালীন তিনি যুক্ত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ও শিক্ষক আন্দোলনের সাথে। তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ অধ্যক্ষ সমিতির (West Bengal Principals' Association) প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক। SOLIDARITY নামে (Quartely Bulletin of W.B.P.A.) এক পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক পদেও ছিলেন বহুদিন। ছোট থেকেই তিনি ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান স্বদেশপ্রেমী এবং দক্ষ সংগঠক। 

১৯৭৩ সালে ফলিত আন্তর্জাতিক বিপণনের গবেষণায় মৌলিক অবদানের জন্য ইংল্যান্ডের ইনষ্টিটিউট অফ মার্কেটিং এর সাম্মানিক সদস্যপদ (এম, ইন্‌স্ট্র, এম.) লাভ করেন। ২০০৫ এ লণ্ডনের রয়‍্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি তাঁকে সাম্মানিক 'ফেলো' নির্বাচিত করেছে। ড. নরেশচন্দ্র নন্দের প্রকাশিত গ্রন্থটি হল 'জ্বেলে দিয়ে জ্ঞানের আলো'। অর্থনীতি বিষয়ে তাঁর ইংরেজী ও বাংলা ভাষায় বেশকিছু প্রবন্ধ দেশে ও বিদেশে প্রকাশিত হয়েছে। যা বোদ্ধা মহলে প্রশংসিত হয়েছে। এছাড়াও ভারতীয় সংস্কৃতি ও দর্শন বিষয়ে তাঁর অসংখ্য প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। 

অর্থনীতি, অদ্বৈত বেদান্ত, প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞান, ভারতীয় সংস্কৃতি ও সংস্কৃত প্রভৃতি বিষয়ের ওপর বহু মূল্যবান প্রবন্ধের লেখক ড. নরেশচন্দ্র নন্দ দেশে বিদেশে নিজেকে প্রোথিতযশা অধ্যাপক, গবেষক ও অধ্যক্ষ হিসেবে মেলে ধরেছেন। তিনি হলেন মেদিনীপুরের সত্যিকারের মানুষ রতন। শিক্ষা সাহিত্য সংস্কৃতিতে এক উল্লেখযোগ্য পুরোধা পুরুষ।

🍂

Post a Comment

0 Comments