জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৮৭ / সালেহা খাতুন

অধ্যক্ষ ড. গোপাল চন্দ্র বেরার সঙ্গে আমার কন্যা।

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৮৭ / সালেহা খাতুন

আসলে আমরা যারা বিংশ শতাব্দীতে জন্মেছি তারা চিঠিলেখা বা লিখিত বার্তায় একটু বেশি মাত্রায় অভ্যস্ত ছিলাম। সেজন্য ধৈর্য ধরতে পারি, অপেক্ষা করতে পারি। খুব জরুরি না হলে তাৎক্ষণিক যোগাযোগ করি না। কেউ একবার ফোন না ধরলে তাঁকে বার বার ফোন করি না। বুঝি উল্টোদিকের ব্যক্তির অমূল্য সময়ের কথা। কথা বলার ক্ষেত্রে যেমন ধৈর্য ধরতে পারি তেমনি জীবনে নিজের জন্য সামান্য কিছু পাওয়ার নিমিত্তে করেছি অনন্ত অপেক্ষা।

মনে আছে দু’হাজার সালে যেটাকে সবাই শূন্য দশক বলে অভিহিত করতো সে সময় আমি ঠিক করেছিলাম, চাকরি পেলে প্রথমেই একটি ওয়াশিং মেশিন কিনবো। কিন্তু তার জন্য আমার অপেক্ষা চললো দু’হাজার সতেরো সাল পর্যন্ত। কেননা নিজের একটি জায়গা না হলে তা করা সম্ভব নয়। নিজের জায়গা মানে একেবারে নিজের একটি বাসস্থান। ছোটোবেলায় পড়াশোনায় বা গৃহকর্মে অমনোযোগী হলে শাসনের নিমিত্তে বাবা কখনও কখনও বলেছেন ভিটে থেকে নেমে যা, বিয়ের পর সালাউদ্দিনের আধুনিক আসবাবপত্র সংগ্রহ দেখে শ্বশুরমশাই বলেছেন তোমার অ্যাসেট রাখার মতো জায়গা আমার নেই, মির্জাবাজারের ভাড়া বাড়ির মালিক বলেছেন দুবছর হলে একদিনের জন্য হলেও জিনিসপত্র নিয়ে রাস্তায় দাঁড়াতে হবে, কলেজের কোয়ার্টারে থাকাকালীন কর্তৃপক্ষ কেড়ে নিয়েছেন ব্যক্তিগত সময় ও পরিসর। কথায় কথায় আপনি কোয়ার্টারে থাকেন অতএব ... যদিও সে কোয়ার্টার বিনামূল্যের নয়। আমার হাউসরেন্ট অ্যালাউন্স পুরোটাই কেটে নেওয়া হতো।

ঠিকঠাক সময় না হলে কোনো কিছুই হয় না, যতো চেষ্টাই করি না কেন। নিজের একটি বাসস্থান হওয়া আমার জীবনে একটি অদ্ভুত ঘটনার মতো। স্বপ্ন দেখতাম নিজের একটি বাড়ি হবে, দোতলায় ওঠার জন্য দুদিক দিয়ে সিঁড়ি উঠে যাবে। আরো কত কী!সব ইচ্ছে কি আর পূরণ হয়?

আমি কৃতজ্ঞ অধ্যক্ষ ড. গোপাল চন্দ্র বেরার কাছে। ঐ যে যেদিন স্যারের সঙ্গে রবীন্দ্রভারতীর দূরশিক্ষা কেন্দ্র সল্টলেক ক্যাম্পাসে গেলাম, সেদিনই ঠিক করলাম কোয়ার্টার আমাকে ছাড়তে হবে। কেননা তখন কোয়ার্টার আর বসবাসের উপযোগী ছিল না। পুরোনো কোয়ার্টারের ওপরতলা সংস্কার করে রাজকীয় রূপ দিতে গিয়ে ফাটল ধরলো একতলার ছাদে। ছাতা মাথায় বাথরুমে যেতে হয়। শুধু কমোডের জল চুঁইয়ে পড়ে না, ছাদের চাঙড়ও ভেঙে ভেঙে পড়ে। মেয়েকে স্নানে পাঠিয়ে ভয়ে ভয়ে থাকি। তার ওপর কলেজের নতুন বিল্ডিংয়ের জলনিকাশের ব্যবস্থা তখন যথাযথ না হওয়ায় প্রবল বৃষ্টিতে কোয়ার্টারে জল ঢুকে যেতো। একতলায় থাকি। মেঝেতে রাখা জিনিসপত্র এবং অনেক বই নষ্ট হয়েছে। গভীর রাতে বৃষ্টি হলে সালাউদ্দিন এবং পার্থ (আমার কলিগ ফিজিক্সের অধ্যাপক ড.পার্থসারথি দাস)দুজনে কোদাল হাতে বেরিয়েছেন ড্রেন কেটে জল নিকাশের জন্য। পার্থ আমার ছোটোবেলার গল্প জানে বলে একবার আমাকে চমকে দেয়, জানতে পারি আমার স্কুলের দিদিমণি লীলা সামন্ত ওর জ্যেঠিমা। আমার ওপর একবার খুব অভিমান করে ও, যে বার সালাউদ্দিনের গলব্লাডার স্টোন অপারেশান হলো। কেননা  ফেসবুক থেকে ওকে জানতে হয়েছে ঐ ব্যাপারে। বলে “পাশে আছি অথচ একবারও জানালে না? তোমাকে কিছুটা অন্তত সাহায্য করতে পারতাম।” সে দু’হাজার পনেরো সালের কথা। রঞ্জিত, মা এবং আমার ভাইয়ের সাহায্য নিয়ে সেবার উৎরে যাই।

যাক সে কথা। অধ্যক্ষের সঙ্গে নানান কথাবার্তা প্রসঙ্গে জানতে পারি পুরোনো কোয়ার্টার আর সারানো সম্ভব নয়। ওটিকে ভেঙে ফেলে নতুন মাল্টিস্টোরেড বিল্ডিং বানানো হবে। যার ফলে ক্লাসরুম সংকটও অনেকটা কম হবে। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা বলে যতো ঘরই বাড়ুক তার সাথে পাল্লা দিয়ে সাবজেক্টও বেড়েছে। পনেরোটা বিষয়ে এম.এ.পড়ানো হচ্ছে।  চব্বিশ-পঁচিশটি বিষয়ে অনার্স পড়ানো, আর্টস সায়েন্সের রিসার্চ সেন্টার সব মিলিয়ে ঘরের চাহিদা কখনই পূরণ হয় না। ক্লাসরুম নিয়ে টানাটানি চলতেই থাকে।

সে সময় কোয়ার্টার ভাঙার প্রসঙ্গ শুনে ফিজিওলজির আর এক কলিগ সপ্তদীপও আমাকে বলে দিদি থেকে যান, “কোয়ার্টার ভাঙতে ভাঙতে আপনার চাকরি জীবন প্রায় শেষ হয়ে যাবে।” সপ্তদীপের কাছেও আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আমার বোন কোয়ার্টারে এসে একবার ভয়ঙ্কর ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে, রাত দুটোয় সপ্তদীপ যেভাবে খালি পায়ে বোনকে নিয়ে মেদিনীপুর মেডিকেল কলেজে গিয়ে ভর্তি করার প্রক্রিয়ায় সালাউদ্দিনকে সাহায্য করে; সে আমি কোনোদিন ভুলবো না।

🍂

চাকরি জীবন পুরোটাই কোয়ার্টারে কাটিয়ে বাড়ি ফিরে যাবো ভেবেই প্ল্যান করেছিলাম। কিন্তু তা আর সম্ভব হবে না বলেই মনে হলো। মেয়ের তখন ক্লাস নাইন। সামনে মাধ্যমিক। পড়াশোনার জন্য নানান জায়গায় ছুটতে হচ্ছে। ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় ভূগোল পড়ার জন্য যেতে হতো মেদিনীপুরের ক্ষুদিরাম নগরে। ঐ পঁচিশ জানুয়ারি অধ্যক্ষের সঙ্গে কলকাতায় যাওয়ার পরের সপ্তাহেই একত্রিশ জানুয়ারি হঠাৎ ক্ষুদিরাম নগরে ঢোকার মুখে চমৎকার ছিমছাম একটি বিল্ডিং দেখি। বিজ্ঞাপন দেখি। তাতে যোগাযোগ নম্বর দেওয়া। প্রথমে ভেবেছিলাম কোনো রিসর্ট হবে, তারপর জানলাম ওটি একটি ফ্ল্যাটবাড়ি। ভোর সাড়ে পাঁচটায় মুগ্ধচোখে দেখা বিল্ডিংটি নিয়ে সারাদিন নিজের সঙ্গে অনেক কথা বিনিময় করে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম। ফোন করলাম। যে আমি ফোনে নিজেকে খুবই অপ্রস্তুত বোধ করি সেই আমি কথা বললাম ফ্ল্যাটের ওনারদের সঙ্গে। ফোন ধরলেন মানবকল্যাণ পণ্ডিত। তিনি এ ব্যাপারে প্রায় মেন্টরের ভূমিকা পালন করলেন আমার জীবনে। সব কিছু বুঝিয়ে দিলেন। ঐ একত্রিশ জানুয়ারিতেই কিছু অগ্রিম দিয়ে ফ্ল্যাট বুক করলাম। কিন্তু দু’হাজার ষোল সালের নোটবন্দির ফাঁদে পড়ে নিজের টাকা নিজেই তুলতে না পেরে ডাউনপেমেন্টের দিনক্ষণ পিছিয়ে যেতে লাগলো। শুধু কি তাই? অসহ্য দাঁতের ব্যথায় ডাক্তারের কাছে যেতে পারছি না কেননা ডাক্তার একশো টাকার নোট ছাড়া নেবেন না। সুধীনবাবু জানতে পেরে নিজের অতিকষ্টে সংগ্রহ করা দশটি একশো টাকার নোটের পাঁচটি আমাকে দিলেন। ডাক্তার দেখিয়ে দাঁত তুলে ব্যাঙ্কের লাইনে কন্যাসহ দাঁড়ালাম সংসার খরচের জন্য নিজের কাছে থাকা দশটি হাজার টাকার নোট ফেরত দেওয়ার নিমিত্তে। সে সব দিন ভোলার নয়।
হাস্যমুখের ব্যক্তিই আমার কলিগ অধ্যাপক ড. পার্থসারথি দাস।

ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রেশন হলো দু’হাজার সতেরোর সতেরো মে। ডাউনপেমেন্টের জন্য প্রিয়জনের কাছে হাত পেতেছিলাম, সংকুচিত সে হাত পূর্ণ হয় নি; শূন্যই ছিল। অন্নের মতোই বাসস্থানের ব্যবস্থা একেবারে নিজেরই রোজগারে। লোন ম্যানেজার কিছু না বুঝেই কেন আমার নামে ফ্ল্যাট কিনছি সে ব্যাপারে জেরা করতে থাকেন। আসলে তিনিও তো পুরুষ, একজন নারীর উত্থান সহজে মেনে নিতে পারেন না। তার উপর নাম দেখে ভেবেছিলেন লেখাপড়া না জানা কোনো এক মূর্খ মেয়েমানুষ। সে জন্য অধ্যাপনা করি আর ইএমআই আমিই দেবো শুনে চমকে ওঠেন। আমাদের পূর্বপুরুষরা অনেকেই সুদ দেওয়া নেওয়ার ঘোর বিরোধী। এক্ষেত্রেও আমি প্রথা ভেঙে দিয়েছি। কুড়ি বছর ধরে ব্যাঙ্কের সুদসহ ঋণ শোধ করে যাবো।

মেয়ের পড়াশোনার জন্য সে সময় ফ্ল্যাটে লোকজন আত্মীয়স্বজনের প্রবেশ প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। ফ্ল্যাটের স্বল্প পরিসরে আমি যদি হাট বসাই একজন শিক্ষার্থীর মনোনিবেশে বাধা পড়বে। মেয়ে নীরবে মনে মনে পড়ে । নিজেরাও উচ্চস্বরে কথা বন্ধ রাখি। তবুও শব্দদূষণ আটকানো সম্ভব হয় না। অর্থনীতির অধ্যাপক আমার কলিগ চন্দ্রিমা আমাকে গাইড করেন, বলেন “দেখো সারা বছর তুমি মেয়ের পাশে থাকতে না পারলেও পরীক্ষার সময়টা ওর সঙ্গে থেকো। শুধু পড়াশোনা নয় শরীরটা যাতে ঠিক থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।”

আমার এতো কাজের মধ্যেও মেয়ের মাধ্যমিকের সময় এক-দেড়মাসের চাইল্ড কেয়ার লিভ অনুমোদন করেন অধ্যক্ষ ড. গোপাল চন্দ্র বেরা। তাঁর কাছেও আমি কৃতজ্ঞ। ৯৩ শতাংশ নম্বর পেয়ে মেয়ে মাধ্যমিক পাশ করে ২০১৯ সালে, অর্থাৎ আমার মাধ্যমিকের (১৯৮৯) ঠিক তিরিশ বছর পরে।

(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments