জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প— ২২৭মুরগিরা কেন মাটি আঁচড়ায়/ফিলিপিনস (দক্ষিণ এশিয়া)/চিন্ময় দাশ

চিত্র- অর্ণব মিত্র 

দূর দেশের লোকগল্প— ২২৭
মুরগিরা কেন মাটি আঁচড়ায়
ফিলিপিনস (দক্ষিণ এশিয়া)।

চিন্ময় দাশ

বাজপাখি। আকাশে চক্কর কাটতে থাকে। তার চোখ কিন্তু থাকে মাটিতে। তীক্ষ্ণ নজরে দেখতে থাকে, শিকার পাওয়া যাবে কোথায়।
চক্কর কাটতে কাটতে, একদিন একটা মুরগিকে দেখতে পেল বাজপাখি। দেখতেও ভারি সুন্দরটি। গায়ে-গতরে বেশ হৃষ্টপুষ্ট। চালচলনে বেশ একটা দেমাকি ভাব মুরগিটার। ভারি পছন্দ হয়ে গেল বাজের। 
দেখল বটে, ছোঁ মেরে তুলে নিল না মুরগিটাকে । মনে মনে স্বপ্নের জাল বোনা শুরু হয়েছে বাজের। একদিন যায়, দু’দিন যায়, তিন দিন যায়। মুরগিকে দেখছে, কিন্তু ছোঁ মারছে না বাজ। 
এমনি করে গেল আরও দিন কয়েক। মুরগিটা দেখতে আরও সুন্দর হয়ে উঠেছে। কী সুন্দর গটগটিয়ে হাঁটা তাঁর। যেন দেশের গরবিনী রাজকুমারি। মনে মনে ভারি পছন্দ হয়ে গেল বাজের। 
একদিন ঝুপ করে নীচে নেমে এসেছে বাজ। মুরগিকে বলল— তোমাকে বিয়ে করতে চাই আমি। তোমার অমত নাই তো? 
সামনে সাক্ষাৎ যম এসে হাজির। একটু ভড়কেই গেছল প্রথমে। এই বুঝি গেল প্রাণটা। কিন্তু এমন প্রস্তাব শুনে, মুরগি তো আহ্লাদে আটখানা।
আকাশে বাজ উড়তে দেখলে, নীচে সবাই নিজের নিজের ডেরায় সেঁধিয়ে যায়। ধেড়ে ইঁদুর, মুরগিদের মতো ছোট মাপের পাখিরা তো বটেই, এমনকি খরগোশেরাও আড়াল খুঁজে নেয় তাড়াতাড়ি। 
না-ই বা হোল চেহারায় তেমন বড়। আকাশের রাজা বলাই চলে বাজকে। সেই রাজা এসেছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। এর চেয়ে আনন্দের কী আছে আর? কত বড় গৌরবের কথা এটা। পাড়ায় ইজ্জত বেড়ে যাবে তার। ভারি আনন্দ মুরগির মনে।
সে মাথা নেড়ে দিয়েছে বাজকে। মুরগি বলেছে—আমার কোনও আপত্তি নাই। তবে, দিন কয়েক সময় দিতে হবে আমাকে।
--আপত্তি যখন নাই, দেরি করে লাভ কী?
--না, দেরি করবার কথা নয়। আসলে বিয়ে করলাম আমরা। তারপর তুমি সারাদিন উড়ে বেড়াবে আকাশে। আমি পড়ে থাকবো নীচে। সে আমার ভালো লাগবে না। আকাশে না থাকলে শিকার পাবো কী করে? 
বাজ চুপ করে আছে। ভেবে দেখছে কথাটা। মুরগি বলল—আমাকে দিন কয় সময় দাও। আমি ওড়াউড়ি শুরু করি। ডানা দুটো শক্ত করি আরও। তাহলে, আমিও উড়ব তোমার সাথে। কসরত করলে, থিক পেরে যাবো। 
একথা শুনে বাজ ভারি খুশি। বউকে পাশে নিয়ে আকাশে উড়ছে, ভেবেই মন ভরে গিয়েছে তার। মুরগির প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। একটা আংটি এনেছিল সাথে। মুরগিকে আংটি ধরিয়ে দিয়ে, বিয়ের কথা পাকা করে ফেলল। বলে গেল—তাহলে তুমি ওড়াউড়ি শুরু করে দাও। ক’দিন বাদেই আমি আসব বিয়ে করতে।
মুরগি ধেই ধেই করে নাচতে লেগেছে মনের আনন্দে। বাজ আংটি দিয়ে গেছে তাকে। আংটিটা গলায় পরে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় মুরগি। 
পরের দিনই মুরগির সব স্বপ্ন চুরমার। পাশের পাড়া থেকে এক মোরগ এসে হাজির। যুবক বয়স মোরগটার। দেখতেও সুন্দর তেমনি। মাথার ঝুঁটি, কানের লতি দুটো যেন গণগণে আগুনের গোলা। দেমাকি ঢঙে হেঁটে যায় যখন, মনে হয় কোনও রাজপুত্তুর চলেছে।
মুরগির গলায় আংটি দেখে, থমকে গেছে মোরগ। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল—আরে, এটা কী তোমার গলায়? আমার সাথেই তো বিয়ে ঠিক হয়ে আছে তোমার। একজনের বাগদত্তা হয়ে, অন্য একজনের  আংটি গলায় পরলে কেমন করে তুমি? 
মুরগি কিছু বলার চেষ্টা করছিল। মোরগ বলল—কিচ্ছুটি বলতে হবে না তোমাকে। শুনতেও চাই না আমি। এক্ষুণি খোল ওটাকে। ছুঁড়ে ফেলে দাও। আমার সামনেই ছোঁড়।
বেচারি মুরগি কী আর করে? গলা থেকে আংটি খুলে, ছুঁড়েই ফেলে দিল। দিন না যেতে, সব স্বপ্ন নিভে গেল বেচারির।
দিন কয়েক না যেতেই বাজ এসে হাজির। দেরি সইছে না তার আর। বাজকে আসতে দেখে, আঁতকে উঠেছে মুরগি। আজ আর রেহাই দেবে না নির্ঘাৎ। তাড়াতাড়ি আড়াল হয়ে গিয়েছে। যাতে বাজের চোখে না পড়ে যায়।
--কোথায় গেলে? তাড়াতাড়ি এসো। দ্যাখো, কী সুন্দর সব জিনিষ এনেছি তোমার জন্য। 
সুন্দর জিনিষের কথা কানে যেতেই, আর তর সইল না মুরগির। বিপদের কথা মনেই এলো না। চটপট বেরিয়ে এসেছে। 

🍂

সুন্দর সুন্দর রঙীন এক বোঝা পালক এনেছে বাজ। বিয়ের কনেকে সাজাবে বলে। বিয়ে বলে কথা। জাঁকজমক করে সাজগোজ না করলে, মানায় কখনও। পালকের বোঝা মুরগিকে তুলে দিতে গিছে, এমনি গলায় চোখ পড়ে গেছে বাজের। সে আঁতকে উঠেছে। হোলটা কী? আংটি নেই কেন গলায়?
মুরগিকে জিজ্ঞেস করল—আংটি দিয়ে গেলাম সেদিন। সেটা কোথায়? গলায় দেখছি না কেন? পরোনি? 
মুরগির তো কথা সরছে না গলায়। কী জবাব দেবে? সত্যি কথা তো বলাই যাবে না। তাহলে হয়তো এখুনি এখানেই চিরে ফালাফালা করে দেবে তাকে। কোনও রকমে বলল—না, না। পরেছিলাম তো। 
--পরেছিলে, তো খুলেছ কেন? 
--আমি কিন্তু খুলিনি। কাল পাশের বাগানে একটা সাপের মুখে পড়ে গিয়েছিলাম। ছোটাছুটি করবার সময় কোথায় যে পড়ে গেল। কতো খোঁজাখুঁজি করলাম। পাওয়া যাচ্ছে না আংটিটা।
মুরগির তোতলানো গলা শুনে, বাজের সন্দেহ হয়েছে। নিশ্চয় সত্যি কথা বলছে না। নির্ঘাৎ কিছু একটা ঘটেছে। কিন্তু হবু বউ, রাগের বশে হঠাৎ করে কিছু করে বসাটা সঙ্গত হবে না। একটু সময় দেওয়া দরকার।
গরগরে গলায় বলল—তুমি বিশ্বাসঘাতকতা করবে আমার সাথে, ভাবতেই পারছি না। শোন, কথার খেলাপ আমি পছন্দ করি না। আমার সাথে চাতুরি করে থকো যদি, রেহাই দেব না আমি।
মুরগি তো কুঁকড়ে গেছে ভয়ে। কোন রকমে বলেছে—না, মানে আমি—
বাজ হেঁকে উঠল—কোনও মানেটানে নয়। এক্ষুণি খুঁজতে শুরু করো। আংটি আমি দেখতে চাই। আংটি খুঁজে না দিলে, আমার মতো খারাপ আর কেউ হবে না। এই বলে গেলাম।
একটু থেমে বলল—আর শোন, যতদিন না পাও, খুঁজতে থাকো। পেয়ে গেলে খবর দিও আমাকে। আবার এসে বউ করে নিয়ে যাবো তোমাকে।  
ধমকই সার হয়েছে বাজের। আংটি খুঁজে পাওয়ার খবর নাই কোনও। মুরগিকে বউ করে নিয়ে যাওয়ার সাধ, মনেই থেকে গেছে আকাশের বাজপাখির। 
আর সেই মুরগি? সারা জীবন ধরে খুঁজেও, আংটির সন্ধান করে উঠতে পারেনি সে। 
তার পর কেটে গিয়েছে হাজার হাজার বছর। মুরগিটার বংশধরেরা কিন্তু আংটি খোঁজার কাজটা ভুলে যায়নি। আংটি খোঁজায় আজও বিরাম নাই মুরগিদের। সামনে যা-ই পায়, আঁচড়াতে থাকে দু’পা দিয়ে। যদি আংটিটা খুঁজে পাওয়া যায় কোনও রকমে!

Post a Comment

0 Comments