বাসুদেব গুপ্ত
পাঠপ্রতিক্রিয়া নয়, পাঠোদ্ধার, কারণ এই রচনাসমগ্র গপ্পোবাজি নয়, কীলক লিপিতে খোদাই করা মনীষা, বিশ্বাস ও স্বপ্নময়তার ব্যক্তিগত উচ্চারণ। সেই উচ্চারণ স্তোত্রের মত গম্ভীর ও গভীর হয়ে ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে। পড়তে গেলে মনোনিবেশ লাগে, উপলব্ধি লাগে।
লিটল ম্যাগাজিন শ্রী ত্রিপাঠীর জীবিকা নয়, উপজীবিকা নয়, সখের উদ্ধার নয়, বোধহয় তাঁর জীবনের প্রতিরূপ, এক সমান্তরাল যাপন, তাই তাঁর নিঃশ্বাস মিশে গেছে লিটল ম্যাগাজিনের শ্বাস প্রবাহে, তাঁর স্বপ্ন, আশা, সংগ্রাম সব নিয়ে লিটল ম্যাগাজিন তাঁর আর এক অনন্য অস্তিত্ব হয়ে উঠেছে।
জীবনানন্দ লিখেছিলেন-
এই পথে আলো জ্বেলে — এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে;
সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ;
এই বইয়ের পাতায় পাতায় এই মনীষার উন্মেষ। বইটি শুরু হচ্ছে প্রয়াত সন্দীপ দত্ত, লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের এক দিকপুরুষের ভূমিকা দিয়ে। ভূমিকাটি সুন্দর, মোটামুটি একটা সম্পূর্ণ উপক্রমণিকা বলা যায়। বইটিতে ১৪টি পর্ব আছে, তাতে লিটল ম্যাগাজিনের দর্শন, আন্দোলন, সাময়িক পত্রের প্রেক্ষিতে লিটল ম্যাগাজিনের ভূমিকা, ভাষা চর্চার উপরে লিটল ম্যাগাজিনের প্রভাব, এছাড়া, দেশ, ধর্ম, স্বাধীনতা, ইতিহাস, ধর্ম, রাষ্ট্র, এই বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে লিটল ম্যাগাজিনের সম্পর্ক নিয়ে লেখকের মনোজ্ঞ আলোচনা আছে।
একটি বহুল প্রচারিত শব্দবন্ধের কথা মনে পড়ে গেল। এই লেখা পড়তে হয়, নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়। এই লেখা হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যাবে সব লিটল ম্যাগাজিনের লেখক, অনুসংগ্রামী ও পাঠককে। লেখার আলাদা করে আমি উদ্ধৃতি দেব না, পাঠক নিজেই পড়ুন ও বুঝে নিন। তবু আমার ব্যক্তিগত যে উজ্জ্বল বিন্দু গুলি স্পর্শ করেছে, তা হল—
লিটল ম্যাগাজিন শুধু একটা খামখেয়াল নয়, এটি শিশু তীর্থের সেই অন্ধকার থেকে আলোয় ক্রমাগত যাত্রার এক পথরেখা। লিটল ম্যাগাজিনের স্পর্ধা, তার শক্তি, তার জীবনীশক্তি তার প্রতিটি প্রকাশের সংগ্রামে যার তুলনা শুধু হতে পারে এক একটি মানব শিশুর জন্মলাভের মতই, যন্ত্রণার থেকে আনন্দে, অন্ধকার থেকে আলোয় যাত্রার মতই।
কিছু কিছু মণিমুক্তার উদ্ধৃতি দেবার লোভ সামলাতে পারলাম না, পাঠক বুঝতে পারবেন কি অপরিসীম মনীষার ও বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটেছে এখানে।
“লিটল ম্যাগাজিনের লড়াই তার নিজের সঙ্গে… অন্যকে অস্বীকার করব না, অন্যের অন্ধ অনুকরণও করব না।“
“লিটল ম্যাগাজিনের প্রথম শর্তই হল তাকে হতে হবে বিশেষ। প্রতিটি সংখ্যাই যেন হয় বিশেষ সংখ্যা।“
“মাতৃভাষার গুরুত্ব প্রতিষ্ঠায় বার বার সোচ্চার হবেন”।
“রাজনীতির আবর্তে পড়বেন না, কিন্তু সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ে মনস্ক হবেন”। “গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হবেন, তবে ব্যক্তিকে অস্বীকার করে নয়।”
ভাষা নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে এই বইতে। বাংলা ভাষা, বিশেষতঃ পশ্চিমবঙ্গে ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়ছে তার অনেক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। যদিও লেখকের ভাষা নিয়ে গভীর চিন্তা এই বইটিতেই আমার চোখে পড়ল। ভাষা যে একরকম নয়, সরস গল্পের ভাষা, গদ্য কবিতার ভাষা, প্রবন্ধের ভাষা, রম্য রচনার ভাষা, বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা বা বিজ্ঞানমনস্ক লেখার ভাষা, আবার সমাজ আন্দোলনের ভাষার দরকার বিভিন্ন শব্দচেতনা, আঙ্গিক ও চয়ন। এ ব্যাপারে শ্রী ত্রিপাঠী আলোকপাত করেছেন যা সব লেখকের পড়া ও ভাবার অপেক্ষা করে।
সংস্কৃতি, ধর্মচেতনা নিয়ে লেখক নিজের উপলব্ধির কথা বিশদ লিখেছেন। কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের এই ব্যাপারে একমত হবার কথা। কিন্তু এখন যেভাবে অন্ধকারের রাজত্ব বিস্তৃত হয়ে চলেছে, সবাই সব কথা মানবেন কিনা জানি না। কিন্তু সুস্থ বিতর্ক, সাজানো টিভি ডিবেট নয়, সেটাই হওয়া লেখকের কাম্য। আর লিটল ম্যাগাজিনের আত্মার সঙ্গে লেখকের আত্মার সমাপতন ঘটেছে এই সব পরিচ্ছেদে।
বিপণন, প্রকাশনা এই ব্যাপারগুলো যে ছেলেখেলার নয়, সেটা লেখক অনেক জায়গাতেই খুব পরিষ্কার করে দিয়েছেন। তাঁর অবিচ্ছিন্ন দীর্ঘ তিন দশক ধরে লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশনার অভিজ্ঞতা তাঁকে সেই অথরিটি দিয়েছে, মনে হয় যাঁরা লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা ও প্রকাশ করতে চান তাঁদের এ ব্যাপারগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়লে উপকৃত হবেন।
লেখাটি শেষ হয়েছে এই বাক্যবন্ধ দিয়ে—
“লিটল ম্যাগাজিনই তো আসল শরীর। আমি তো তার ছায়া।“
বইটির আবহ ঘিরে রয়েছে এই শ্রদ্ধার বোধ, এই বিশ্বাসের বোধ। লিটল ম্যাগাজিন এক জীবন ধারণা, এক জীবন যাত্রা। বইটি শেষ করার পর এই কথাগুলি মনে থেকে যায়।
মনে পড়ে, জীবনানন্দের কবিতার লাইনগুলো,
“এ বাতাস কী পরম সূর্যকরোজ্জ্বল;–
প্রায় তত দূর ভালো মানবসমাজ
আমাদের মতো ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে
গড়ে দেব আজ নয়, ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে।“
শ্রী ঋত্বিক ত্রিপাঠীর মত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে লিটল ম্যাগাজিনের এই ইতিবৃত্ত আমাদের সেই প্রভাতের দিকে আর এক অসংশয় পদক্ষেপ।
🍂
0 Comments