জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প— ২২৮/বুদ্ধির ঢেঁকিদের জনগণনাস্কটল্যাণ্ড (ইউরোপ) /চিন্ময় দাশ

চিত্র-অর্ণব মিত্র

দূর দেশের লোকগল্প— ২২৮

বুদ্ধির ঢেঁকিদের জনগণনা

স্কটল্যাণ্ড (ইউরোপ)

চিন্ময় দাশ


বাবা, মা আর জেনি নামের একটি মেয়ে। এই তিনজনকে নিয়ে একটি সংসার। মোটামুটি সচ্ছ্বল পরিবার। হয়েছে কী,  জেনি দেখতে ভারি সুন্দরী। জন নামে গাঁয়েরই একটি ছেলে তাকে ভারি ভালবাসে। সেই কোন ছোটবেলা থেকে তাদের পরিচয়। এক সাথে খেলাধুলো করে বড় হয়েছে তারা।

সুখের কথা, জেনির বাবা মা রাজি হয়েছে, জনের সাথে মেয়ের বিয়ে দেবে। কয়েক সপ্তাহ পরে বিয়ে তাদের।

একদিন মেয়ের বাবা এসেছে তার বাগানে কাজ করতে। বাগানে একটা কূয়া ছিল, জলের জন্য। কিছু সময় কাজের পর, বিশ্রাম নেবে বলে, কূয়াটার পাশে গিয়ে বসল মানুষটা। বসতে বসতে এক সময় কূয়ার ভেতরে তাকাল, কতটা গভীর দেখবার জন্য। তখনই একটা ভাবনা এসে গেল তার মনে। 

ভাবনাটা হোল, ক’দিন বাদে তাদের মেয়ে জেনির বিয়ে হবে। ছেলেপুলেও হবে তাদের। বলা যায় না, কোনও দিন হয়তো বাচ্চাটা খেলা করতে করতে পড়ে গেল কূয়ার মধ্যে। কূয়ার মধ্যে পড়ে গেলে, কোনও বাচ্চা কি আর বাঁচতে পারে?

এমন একটা দৃশ্যের কথা মনে আসতেই, বুকটা ছাঁৎ করে উঠল। চোখে জল এসে গেল মানুষটার। কাঁদতে লাগল বসে বসে। 

কতক্ষণ এভাবে বসে আছে, খেয়াল নাই। তার বউ তাকে খুঁজতে এসেছে, কোথায় গেল মানুষটা!

স্বামীকে কাঁদতে দেখে, সে তো অবাক। জিজ্ঞেস করল—কী হয়েছে গো? এখানে কূয়ার পাড়ে বসে কাঁদছো কেন? 

--শুনলে, তুমিও কাঁদবে পা ছড়িয়ে বসে।

বউ বলল—আগে তো শুনি। কাঁদা না-কাঁদা তো পরের কথা।

লোকটা বলল—ভেবে দ্যাখো, আমাদের জেনির বিয়ে হবে ক’দিন বাদে। ছেলেপুলে হবে তার। কোনও দিন বাচ্চাটা বাগানে খেলা করতে করতে, কূয়ার মধ্যে পড়ে যেতেই পারে। তখন কী হবে? কূয়ায় পড়ে গেলে, বাঁচবে বাচ্চাটা?

🍂
--হায় ভগবান। এ কী সর্বনেশে কথা গো? আমি তো ভাবতেই পারছি না। সত্যি গো, এমনটা তো হতেই পারে। বলেই বউটিও ধপ করে বসে পড়ল। হু-হু করে জল গড়াতে লাগল তার দু’চোখ দিয়ে।

এদিকে বাবা মা দুজনেই ঘরে ফিরছে না দেখে, মেয়ে এসেছে তাদের খোঁজে। বাগানে এসে, সে তো আকাশ থেকে পড়ল। দুজনেই কেন বসে বসে কাঁদছে? হোলটা কী? 

জিজ্ঞেস করাতে, বাবা মা দুজনেই তাকে ব্যাপারটা খুলে বলল। আর যায় কোথায়! শুনে সে মেয়ের তো মূর্ছা যাওয়ার জোগাড়—ওগো, মা গো! আমার কী হবে গো? আমি কাকে নিয়ে বাঁচব গো? 

হাপুস নয়নে কান্না জুড়ে দিল জেনি। মেয়েকে এভাবে কাঁদতে  দেখে, বাবা মা আবার নতুন করে কান্না জুড়ে দিয়েছে। 

হয়েছে কী, ঠিক সেসময়েই, জন এসে পৌঁছেছে এই বাড়িতে। এভাবে তিনজনকে কূয়ার পাড়ে বসে কাঁদতে দেখে, ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল ছেলেটা। কিছুই মাথায় ঢুকছে না তার। জিজ্ঞেস করল—ব্যাপার কী? বাড়িতে কিছু হয়েছে? এভাবে বাগানে বসে কাঁদছো কেন সবাই? 

জেনির বাবা সব কথা খুলে বলল জনকে। আরও বলল—তাছাড়া, এমন ঘটনা ঘটতে পারে জেনে, তুমিও কি আর বিয়ে করবে এই বাড়িতে? বুঝলে হে, বিপদের শেষ নাই আমাদের।

শুনে, জনও বিপদে পড়ে গেজ। তার বিপদ হোল, রাগ করবে, না হো-হো করে অট্টহাসি হেসে উঠবে—বুঝে উঠতে পারছে না। নিজেকে কোনও মতে সামলে নিয়ে, বলে উঠল—তিন জনেই বোকার বেহদ্দ তোমরা।

বলেই গটগট করে চলে গেল সেখান থেকে। চলে তো গেল, কিন্তু ভাবনাটা কিছুতেই যাচ্ছে না মাথা থেকে। কী করা যায় এখন? এমন একটা বাড়িতে কি বিয়ে করা উচিত? জেনির মাথাতেও যদি একটু বুদ্ধি থাকত, তাহলেও কথা ছিল! কিন্তু সে তো দেখছি বাবা-মায়ের চেয়েও এক কাঠি বাড়া। কিন্তু এদিকে বিয়ের কথাও দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন কি তা খারিজ করা যায়? তাছাড়া, কত দিনের সম্পর্ক তাদের দুজনের। 

শেষমেষ একটা সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছল জন। এখুনি গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়বে সে। এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াবে। মানুষজন দেখবে। যদি দেখা যায়, এদের তিনজনের চেয়েও বোকা মানুষ আছে দেশে, তাহলে কোন চিন্তা নাই। তবে, এক-আধ জন দেখলে হবে না। কম পক্ষে এমন তিন জনকে খুঁজে পেতে হবে, যারা এই তিনজনের চেয়েও বোকা। তাহলেই সমস্যার সমাধান। তাহলেই জেনকে বিয়ে করবে সে। 

সে তো হোল। কিন্তু এবার ঠিক করতে হবে, এই বোকামানুষ খোঁজার কাজটা কতদিন চলবে? সেটাও ঠিক করে নিল জন। যত দিন তার পায়ের বুটজুতো জোড়া ছিঁড়ে না যাচ্ছে, ততদিন খোঁজা চলবে তার। 

যেমন ভাবনা তেমন কাজ। বুট পায়ে গলিয়ে বেরিয়ে পড়ল জন। জীবনে এখন একটাই কাজ, বড় রকমের তিন জন বোকাকে খুঁজে বের করা।

চলেছে তো চলেছে। বোকার মতো কাজ করছে, এমন কাউকেই চোখে পড়ছে না। কতোদিন এভাবে চলবার পর, দাঁড়াতেই হোল জনকে। দেখল, একটা গুদামঘরের দরজার সামনে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা বেলচা। সেটাকে হাতপাখার মতো, ঘরটার ভিতরের দিকে জোরে জোরে নাড়ছে লোকটা। 

জন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল—এভাবে কী করছ তুমি?

লোকটা জবাব দিল—কী আবার করব? কাল গম কেটে এনে, এই গুদামঘরে রেখেছি। এখন বেলচা নাড়িয়ে, রোদ খাওয়াচ্ছি গমকে। ঠিকঠাক রোদ পেলে, তবেই না গমের দানা ভালোমতন শুকনো হবে! জানো না তুমি?

জন বলল—সেটা জানি। কিন্তু ঘরের ভিতর গম রেখে, তাকে বেলচা দিয়ে রোদ খাওয়াতে হয়, সেটা জানতাম না। আমি বলি কী, এর চেয়ে, পুরো গমটা বাইরে রোদে মেলে দিচ্ছ না কেন? তাতে তো অনেক ভালোভাবে শুকোতে পারবে দানাগুলো। লোকটা অবাক হয়ে, মাথা নাড়তে লাগল- যীশু তোমার মঙ্গল করুণ। ঠিকই বলেছ। আমার অনেক পরিশ্রম বাঁচিয়ে দিলে তুমি।

--এই হোল বোকা নং এক। ভাবতে ভাবতে জন চলল দু’ নম্বরের খোঁজে।

চলছে তো চলছেই। একদিন একটা গ্রামের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। একটা দারুণ দৃশ্য চোখে পড়ে গেল। 

ছোট একটা ঘর। দেওয়ালে সিঁড়ি লাগানো । হাতে দড়ি নিয়ে, ছাদের ওপরে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। দড়ির অন্য মাথাটা নীচে একটা গরুর গলায় বাঁধা। গরুটাকে উপর থেকে টানাটানি করছে লোকটা। 

জন তাকে জিজ্ঞেস করল—ওহে, এভাবে করছটা কী?

--কেন হে, দেখতে পাচ্ছো না, ওপরে কতো ঘাস গজিয়েছে। গরুটাকে ওপরে তোলার চেষ্টা করছি, ঘাস খাওয়াবো বলে। 

--কেন? তুমি তো ঘাসগুলো কেটে আনতে পারো। নীচে থেকেই তোমার গরু দিব্বি ঘাস খেতে পারবে। এত মেহনতের দরকারটা কী?

লোকটা অবাক। বলল—ঠিক বলেছ তো। আমি কোনদিন ভাবিনি এ ভাবে। মাঝখান থেকে ভালো ভালো কতগুলো গরুকেই মেরে ফেলেছি। 

জন মনে মনে বলল—একে নিশ্চয় বোকা নং দুই বলে দেওয়া যায়।

আবার অনেকটা পথ চলে এলো জন। এত দিনে তার ধারণা হয়েছে, এ দুনিয়ায় অনেক বোকাই আছে। সে নিজে যা ভেবেছে, সংখ্যায় তার চেয়ে অনেক বেশি। এখন অবশ্য তার বেশি চিন্তা, তিন নং বোকার দেখা কবে পাওয়া যাবে? কারণ, পায়ের জুতোর অবস্থা খুব খারাপ হয়ে উঠেছে। 

একদিন একটা খোলা মাঠের উপর দিয়ে যাচ্ছে। একটা অবাক করা দৃশ্য দেখল জন। খুঁটি পুঁতে তাতে এক জোড়া ফুলপ্যান্ট ঝোলানো। আর, একটা লোক দূর থেকে দৌড়তে দৌড়তে এসে তার উপর লাফ দিয়ে দিয়ে পড়ছে। 

জন চেঁচিয়ে বলল—ওহে, শুনছ? এভাবে করছোটা কী তুমি? 

লোকটা বলল—চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করবার কী আছে এতে? তুমি কি দেখতে পাচ্ছো না, আমি ফুলপ্যান্টটা পরতে চেষ্টা করছি? বলেই, একবার এপাশ একবার ওপাশ থেকে, আরও দু’-তিনবার লাফালো এবং ব্যর্থ হোল।

জন বলল—কিন্তু তুমি প্যান্টগুলো নামিয়ে, নিজেই পা গলিয়ে পরে নিচ্ছ না কেন? তাই তো করে সবাই।

--ঠিক বলেছ তো! লোকটা অবাক হয়ে বলল—একেবারে ঠিক কথাই বলেছ। আমি কেন এতো দিন এভাবে ভাবলাম না? এখন ভাবছি, তুমি আরও আগে এলে না কেন? ভাবতেই পারবে না তুমি, খামোখা কতো কতো মূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে গেছে আমার!

জন আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল—পেয়ে গেছি। এ-ই তিন নম্বর বোকা।

পায়ের জুতোজোড়া এখনও পুরো ছিঁড়ে যায়নি। খুশি খুশি মনে, বাড়ি ফিরে চলল সে। 

বিয়ের দিন পাকা করা ছিল আগে থেকেই। সেই দিনেই জেন-এর সাথে বিয়ে হয়ে গেল জনের। সুখে শান্তিতে দিন কাটতে লাগল তাদের। 

একটা কথা বলে রাখা ভালো, বাগানের ভিতর যে কূয়া নিয়ে এত সব, সেটার কথা ভোলেনি জন। বিয়ের পরে পরেই, কূয়াটাকে ঘিরে দিয়েছিল মজবুত বেড়া দিয়ে। কোনও বাচ্চাই কূয়ায় পড়ে যায়নি কোনদিনই।

Post a Comment

0 Comments