জ্বলদর্চি

ড. সোমনাথ মিশ্র (জাতীয় শিক্ষক, বিজ্ঞান লেখক, তমলুক)/ ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৪৬

ড. সোমনাথ মিশ্র (জাতীয় শিক্ষক, বিজ্ঞান লেখক, তমলুক) 

ভাস্করব্রত পতি

তিনি ছিলেন তমলুকের হ্যামিল্টন হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। জাতীয় স্তরে সামাজিক উন্নয়নমূলক অবদান, পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণ, শিক্ষা সংস্কৃতি প্রসারে অনবদ্য ও নিরবচ্ছিন্ন অবদানের জন্য তিনি পরিচিত। অবসরকালীন জীবনেও তিনি তাঁর কর্মকাণ্ড ধরে রেখেছেন সমানভাবে। Popular Science কে পাথেয় করে সকলের জন্য লিখে চলেছেন নানা গ্রন্থ। 

১৯৫৮ এর ১০ ই মে জন্মগ্রহণ করেন তমলুকে। বাবা ছিলেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার জয়ী (২০১৩) ব্যক্তিত্ব রামেশ্বর মিশ্র। একসময় তিনি ছিলেন পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ইণ্ডিয়ান রেড ক্রশ সোসাইটির সম্পাদক। মা গৃহবধূ সন্ধ্যা রাণী মিশ্র। এহেন পরিবারের দ্বিতীয় সদস্য হিসেবে ড. সোমনাথ মিশ্রও পেয়েছেন জাতীয় শিক্ষকের পুরস্কার। 
রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে জাতীয় শিক্ষকের পুরস্কার গ্রহণ

১৯৮৪ সালে দেউলি আদর্শ বিদ্যাপীঠে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু। এরপর চকশিমুলিয়া বিদ্যাপীঠে প্রায় ২০ বছর শিক্ষকতার পর ২০০৭ সাল থেকে তমলুক হ্যামিল্টন হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষকের দায়ভার গ্রহণ ক'রেন। ছাত্র গড়ার কাজে নিরন্তর যুক্ত থেকেছেন প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই। ২০১৮ এর ৩১ শে মে পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে ৩৩ বছর যুক্ত থেকেছেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে, শিক্ষার সাথে, ছাত্র ছাত্রীদের সাথে। এখনও যুক্ত রয়েছেন শিক্ষার অঙ্গনে। এহেন মানুষ তাই মেদিনীপুরের সত্যিকারের মানুষ রতন।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করার পর জে আর এন রাজস্থান বিদ্যাপীঠ (ডিমড ইউনিভার্সিটি) থেকে এডুকেশন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি এড এবং মাদুরাই কামরাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এড ডিগ্রি পান। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল ওপেন ইউনিভার্সিটি থেকে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট এবং এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স নিয়ে এম এস সি ডিগ্রি লাভ করেন। আসলে বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি জানার প্রবল ইচ্ছার দরুন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠগ্রহণ করেছেন শিক্ষকতার পাশাপাশি। সবসময়ই নিজেকে ছাত্র হিসেবে দেখতে পছন্দ করেন। তিনি বিশ্বাস করেন, জানার, পড়ার এবং শেখার কোনও বয়স হয়না। 

সারা জীবনের কর্মতৎপরতার জন্য তিনি পেয়েছেন বহু পুরস্কার। জাতীয় শিক্ষকের তকমা তাঁর জীবনের সেরা প্রাপ্তি। ১৯৮৩ তে পেয়েছেন Certificate of Merit from Competition Success Review। এরপর ১৯৯৯ সালে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য Science Association of Bengal থেকে তাঁকে দেওয়া হয়েছিল Gopal Chandra Bhattacharya State Science Award। প্রথম থেকেই বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখির প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল প্রবল। অসংখ্য লেখা লিখেছেন তিনি বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে। ২০০৬ সালে কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় সুচারু চক্রবর্তী ট্রাস্ট এবং পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড থেকে তাঁকে দেওয়া হয় সেরা বিজ্ঞান লেখকের সম্মান। এবছরেই তিনি পূর্ব মেদিনীপুর সাহিত্য সম্মিলনী থেকে লাভ করেন পুলিন বিহারী সরকার বিজ্ঞান পুরস্কার। ২০১১ তে Wildlife and Environmental Studies in South Asia Region থেকে তাঁকে দেওয়া হয় PARYAVARAN DRONACHARYA AWARD। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচ্চশিক্ষা দপ্তর থেকে ২০১২-২০১৩ সালে পেয়েছেন West Bengal State NSS Award। 
গ্লোবাল টিচার পুরস্কার লাভ

২০১৪ তে তিনি লাভ করেন Avantika Swami Dayanand Saraswati Rashtriya Shikshak Samman। যা তাঁর কর্মজীবনের মুকুটে এক অন্যতম পালক বৈকি। এই পুরস্কার তুলে দেন 'অবন্তিকা'-র ডাইরেক্টর ড. আনন্দ আগরওয়াল। ২০১৪ তে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক পেয়েছেন স্বচ্ছ ভারত অভিযান পুরস্কার। এ বছরেই জয়পুরের University of Engineering and Management থেকে পেয়েছেন UEM Academic trophy। বিজ্ঞানের পাশাপাশি গণিত তথা অঙ্ককে জনপ্রিয় করতে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে অঙ্ক ভীতি কাজ করে খুব। সেই ভয় থেকে মুক্তি দিতে নানা পন্থা অবলম্বন করতেন তিনি। তাঁর এই কাজের জন্য ২০১৪, ২০১৫, ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে Science Olympiad Foundation তাঁকে সম্মান জানিয়েছে Letter of Appreciation দিয়ে। 
কবি শঙ্খ ঘোষের সাথে

২০১৫ তে শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য পেয়েছেন জাতীয় শিক্ষকের মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার। ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁর হাতে এই পুরস্কার তুলে দেন। ২০১৫ সালে Indian Society for Industry and Intellection Development থেকে তাঁর নাম ঘোষণা করেছিল Rashtriya Shiksha Saman পুরস্কারের জন্য। এছাড়াও বেশকিছু আন্তর্জাতিক মানের পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। প্রতি বছর ৫ ই অক্টোবর পালিত হয় বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ২০১৬ সালে এই দিনে তিনি MVLA Trust থেকে পেয়েছেন আন্তর্জাতিক মানের Global Teacher Role Model Award। ঠিক পরের বছর Telegraph Education Foundation (Anandabazar Group of Publication) তাঁকে দিয়েছে শিক্ষক হিসেবে Life Time Achievement Award। 

লেখক হিসেবেও তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব। বর্তমান সমাজে দূষণমুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার সামাজিক দায়বদ্ধতায় রচনা করেছেন একের পর এক গ্রন্থ রচনা করে। পরিবেশের প্রতি ভালোবাসা এবং পরিবেশ রক্ষার প্রয়াস প্রতিভাত তাঁর এহেন গ্রন্থগুলিতে। পাঠকদের সচেতন করতে অসংখ্য গ্রন্থ উপহার দিয়েছেন তাঁদের। তাঁর লেখা বইগুলি হল -- বিপন্ন বসুন্ধরা (বসাক পাবলিশার্স), জ্ঞান বিজ্ঞানের গল্প (দেজ পাবলিশার্স), প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও প্রতিকার (দেজ পাবলিশার্স), কল্প বিজ্ঞানের গল্প (দেজ পাবলিশার্স), তৃষ্ণার্ত পৃথিবী (দেজ পাবলিশার্স), কল্প বিজ্ঞানের মজার গল্প (দেজ পাবলিশার্স), বিজ্ঞান সাধক জ্ঞান চন্দ্র ঘোষ (দেজ পাবলিশার্স), পরিবেশ রচনা সংকলন (দেজ পাবলিশার্স), কল্প বিজ্ঞানের রহস্য গল্প (দেজ পাবলিশার্স), মানুষ যখন গিনিপিগ (দেজ পাবলিশার্স), কল্পবিজ্ঞানের অ্যাডভেঞ্চার গল্প (দেজ পাবলিশার্স), কল্প বিজ্ঞানের গোয়েন্দা গল্প (দেজ পাবলিশার্স), বিজ্ঞান রচনা সংকলন (দেজ পাবলিশার্স), রাতদিন বিজ্ঞান (দেজ পাবলিশার্স), পরিবেশ বিজ্ঞান (শ্রীভূমি পাবলিকেশন), ম্যান অ্যাণ্ড এনভায়রনমেন্ট (শ্রীভূমি পাবলিকেশন), পৃথিবী তুমি ভালো আছো (দেজ পাবলিশার্স), কল্পবিজ্ঞানের আবিষ্কারের গল্প (দেজ পাবলিশার্স) ইত্যাদি। পরিবেশ ও বিজ্ঞান বিষয়ক এই গ্রন্থগুলি আসলে পরিবেশ সচেতনতামূলক জ্ঞান বিকাশের আকরিক সম্পদরূপে পাঠক সমাজের কাছে সমাদৃত হয়েছে। বলতে গেলে এগুলি আসলে পরিবেশ সচেতনতার দিগ্‌দর্শন।
লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় বই

এই মুহূর্তে তিনি Environmental Education এর অন্তর্ভুক্ত জলের ওপর Post Doctorate Research Scholar হিসেবে গবেষণা করে একদিকে যেমন নানামুখী শিক্ষার বলয়বৃত্তে অনুপ্রবেশ করেছেন, অন্যদিকে তেমনি এই বহুমুখী শিক্ষার আলোকধারা বহুজন হিতার্থে ও রাষ্ট্রীয় সমাজ জীবনে প্রবাহিত করতে নিরন্তন প্রয়াসী হয়েছেন নানা সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানে নিজেকে সংযুক্ত ক'রে। ১৯৮৯ তে ইণ্ডিয়ান রেড ক্রস সোসাইটি থেকে পেয়েছেন Life Member Certificate of award। 
ড. সোমনাথ মিশ্রের সাথে

বিভিন্ন সংবাদপত্রে এবং জার্নালে বিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে লেখা প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তুলতে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন পত্রিকা 'বিজ্ঞানের খবর'। নেতাজী সুভাষ ওপেন ইউনিভার্সিটি এবং রাজা নরেন্দ্রলাল খান মহাবিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের রসায়ন ও এডুকেশন বিষয়ের স্টাডি সেন্টারের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন ২০০১ - ২০১২ পর্যন্ত। বর্তমানে একটি বি এড কলেজের প্রিন্সিপাল পদে যুক্ত। 

ড. সোমনাথ মিশ্র শিক্ষাকেই তাঁর জীবনের অন্যতম আলোকবর্তিকা হিসেবে বেছেছেন। সারাজীবন ছাত্র ছাত্রীদের জন্য নিবেদিত প্রাণ। শিক্ষাগত জীবনেও বড় বড় মাইলস্টোন অতিক্রম করেছেন অবলীলায়। তাই তিনি চান ছাত্র ছাত্রীরাও পড়াশোনা মুখাপেক্ষী হয়ে থাকুক। এজন্য তাঁর নিরন্তর ভাবনা ও প্রচেষ্টা অব্যাহত। শিক্ষা দীক্ষার বলয়বৃত্তে থেকে বিজ্ঞান সচেতনতা ও পরিবেশ রক্ষার দায়বদ্ধতা মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছেন ড. সোমনাথ মিশ্র। এভাবেই বেঁচে থাকতে চান পরিবেশ প্রকৃতি ও বিজ্ঞানকে সঙ্গী করে।

🍂

Post a Comment

0 Comments