জ্বলদর্চি

জাতীয় বিজ্ঞান দিবস : প্রসঙ্গ ও প্রাসঙ্গিকতা /ঋত্বিক ত্রিপাঠী

জাতীয় বিজ্ঞান দিবস : প্রসঙ্গ ও প্রাসঙ্গিকতা

ঋত্বিক ত্রিপাঠী 

১৯২৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বিজ্ঞানী সি ভি রামন আবিষ্কার করেন 'রমন এফেক্ট'। জীবনকে বিজ্ঞানমুখী করে তুলতে,  বিজ্ঞানের জনপ্রিয়তা বাড়াতে 'জাতীয় বিজ্ঞান দিবস' হিসেবে ২৮ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ভারত সরকার মর্যাদা দিয়েছে।

চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন, যিনি সি ভি রামন মানেই খ্যাত, তাঁর জন্ম ৭ নভেম্বর ১৮৮৮, তামিলনাড়ুর তিরুচিরাপল্লীতে। বাবা রমানাথন চন্দ্রশেখরন ছিলেন পদার্থ বিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষক। ভালো বেহালা বাজাতেন। বাবার সংগৃহীত বই পড়েই পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ বাড়ে রামনের। মেধাবী রামন পদার্থ বিজ্ঞানে পদক-সহ ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন। বিলেতে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পেলেও দুর্বল স্বাস্থ্যের জন্য তা সম্ভব হয়নি শেষ পর্যন্ত।  মাদ্রাজের প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এম এ - তে প্রথম স্থান অর্জন করেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সেই কলকাতায় সহকারী একাউন্ট্যান্ট -এর চাকরি পান। চাকরির আগেই ১৩ বছর বয়সী লোকসুন্দরী আম্মালের প্রেমে পড়েন ও বিয়ে করেন। বিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্রটির ভাগ্যে জুটলো কিনা অর্থ দপ্তরের চাকরি ! অতৃপ্তি তো ছিলই। তবে চাকরি সামলে গবেষণার কাজ চলতেই থাকলো। অর্থ দপ্তরের কাজেও তিনি ছিলেন সফল।  

🍂

১৯০৬ সালে তাঁর আলোর প্রকৃতি নিয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশ পায় 'ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিন' - এ। দ্বিতীয় গবেষণাপত্র পড়ে নোবেলজয়ী ব্রিটিশ বিজ্ঞানী লর্ড র‍্যালে রামনকে  এক চিঠিতে 'প্রফেসর' বলে সম্বোধন করেন। আসলে লেখার মান দেখে র‍্যালের মনে হয়েছিল, রামন নিশ্চয়ই একজন প্রফেসর। ১৯১৭ সালে স্যার আশুতোষ মুখার্জির আহ্বানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন ও দীর্ঘ ১৫ বছর ওই পদে কাজ করেন।
১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হয়ে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি কংগ্রেসে যোগ দেন। জাহাজে লন্ডন যাওয়া আসার পথে তাঁর মনে প্রশ্ন জাগে -- সমুদ্রের রং নীল কেন!  আকাশের রং নীল কেন, তার  ব্যাখ্যা ইতিপূর্বে দিয়েছিলেন বিজ্ঞানী লর্ড র‍্যালে। তাঁর মতে বাতাসের বিভিন্ন অণুর সঙ্গে আলোর কণার বিক্ষেপণ ঘটে। কোনও কণিকার ওপর আলো পড়লে সেই কণিকা আলোকে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে দেয়,একে আলোর বিক্ষেপণ বলে। নীল রঙের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম বলে আলোর বিক্ষেপণও বেশি। তাই দিনের বেলায় আকাশের রঙ নীল। আর, সমুদ্রের জল নীল কেন ! তবে কি  সমুদ্রের জলে আকাশের রঙের প্রতিফলন হয় বলেই সমুদ্রের জল নীল! এই তত্ত্ব মানলেন না রামন। কারণ রামন দেখলেন পোলারাইজিং প্রিজমের মাধ্যমে আকাশের প্রতিফলন আড়াল করার পরেও দেখা গেল সমুদ্রের জলের রং নীল। আসলে সমুদ্রের জল নিজেই আলো বিচ্ছুরণ করে, তাই জলের রঙ নীল। সমুদ্রের বিভিন্ন গভীরতা থেকে জল সংগ্রহ করে কলকাতা নিয়ে আসেন ও তা নিয়ে গবেষণা করতে থাকেন, যার ফল 'রমন এফেক্ট'(২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯২৮)। ১৯৩০ সালে এই গবেষণার জন্য পান নোবেল পুরস্কার। গবেষণার পুরো কাজটাই করেন কলকাতার ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্স (আই-এ-সি-এস) গবেষণাগারে। উল্লেখ্য, ভারতে স্বদেশি বিজ্ঞান গবেষণার উন্নতি লক্ষ্যে ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই আই-এ-সি-এস, যেখানে গবেষণার জন্য কোনও ডিগ্রি নয়, জরুরি ছিল একটাই যোগ্যতা -- তা হল বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা। রামনের ছিল বিজ্ঞানের প্রতি সেই ভালোবাসা।

 কী এই 'রমন এফেক্ট' ! 

আলোর বিচ্ছুরণের ক্ষেত্রে এটি রামনের এক মৌলিক আবিষ্কার। আলো হল তড়িৎ চৌম্বক তরঙ্গ। সমস্ত পদার্থ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণু-পরমানুর সমন্বয়ে গঠিত। আলো হল তড়িৎ চৌম্বক তরঙ্গ। একবর্ণী তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ বস্তুর  উপর পড়লে, ওই বস্তুর  অণুগুলি স্পন্দিত হয়।  স্পন্দনে জন্ম নেয় তিন ধরনের বিকিরণ। বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো ( স্টোকস লাইন), কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো (অ্যান্টি-স্টোকস লাইন) এবং আপতিত তরঙ্গের সমান তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো (অরিজিনাল লাইন) । এই ঘটনা 'রমন এফেক্ট' নামে পরিচিত।

 রমন এফেক্টের সূত্র ধরেই এসেছে একবর্ণা আলোকের ধর্ম, লেসার রশ্মি ইত্যাদি। বর্তমান, শরীরে রোগে আক্রান্ত কোষকে শনাক্ত করতে রমন স্পেকট্রোস্কপি কাজে লাগছে। চিকিৎসা বিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞানের নানান কাজে ও অণু- পরমাণুর গঠন ও শক্তির স্তর নির্ণয়ে রমন এফেক্ট খুব কার্যকর।

রামন ছিলেন আত্মবিশ্বাসী। ১৯২৫ সালে জি ডি বিড়লার কাছে স্পেক্টোগ্রাফ কেনার জন্য টাকা চেয়ে চিঠিতে লেখেন, "আমি যদি এই যন্ত্রটা পাই তাহলে ভারতের জন্য নোবেল পুরস্কার এনে দিতে পারবো।" আবিষ্কারের পরের দিন ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯২৮ স্টেটসম্যান পত্রিকাতে এই আবিষ্কারের খবর প্রকাশের ব্যবস্থা করেন রামন। বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার প্রাপক হিসাবে তিনি ছিলেন প্রথম এশিয়। এছাড়াও তিনি পান ভারতরত্ন (১৯৫৪) ও লেলিন শান্তি পুরস্কার (১৯৫৭)।১৯২৯ সালে পান নাইট উপাধি। ১৯২৬ সালে  'Indian of  Physics' নামে পদার্থ বিজ্ঞানের জার্নাল চালু করেন রামন।

২১ নভেম্বর ১৯৭০ সালে বেঙ্গালুরুতে তাঁর প্রয়াণ ঘটে।
 ১৯৮৬ সালে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যা যোগাযোগ আয়োগ(NCSTC) ভারত  সরকারের কাছে ২৮ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় বিজ্ঞান দিবস হিসাবে স্বীকৃতির জন্য আবেদন করলে সরকার তা অনুমোদন করে। সেই থেকে প্রতি বছর স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২৮ ফেব্রুয়ারি পালিত হচ্ছে জাতীয় বিজ্ঞান দিবস (National Science Day সংক্ষেপে NSD)। 

তবে, বিজ্ঞানের সার্বিক প্রসারে বিজ্ঞান সাধনা যেন কেবল একটি দিনের দেখানেপনা উদযাপনে না আটকে থাকে। বিজ্ঞানের সুফল নিতে আমরা সবাই উদগ্রীব। কিন্তু কুসংস্কারমুক্ত স্বাধীন মুক্ত চিন্তা চেতনায় বিশ্বাসী তথা প্রকৃত বিজ্ঞানমনস্ক আমরা কতজন! সংবাদপত্রের শিরোনামে যখন দেখি প্রাচীন কুসংস্কারের কারণে কত শত নিরীহ মানুষের প্রাণ চলে যায় অকালে, তখন এই প্রশ্ন জাগে বই-কি! 
---------

Post a Comment

1 Comments

  1. Soumen RoyMarch 02, 2025

    বিজ্ঞানীকে যন্ত্রপাতির জন্য পরাধীন ভারতেও হাত পাততে হতো,এখনও হয়। বিজ্ঞান দিবসের কোন গুরুত্বই নেই শাসকের কাছে।

    ReplyDelete