জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৮৬ / সালেহা খাতুন

রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষা কেন্দ্রের মেদিনীপুর কলেজ লার্নার সাপোর্ট সেন্টারের শেষ ব্যাচের সঙ্গে

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৮৬ / সালেহা খাতুন

নির্লজ্জের মতো আত্মকথা কইতে গিয়ে শুধু কাজেরই ফিরিস্তি দিয়ে চলেছি। কর্মক্ষেত্র কাজেরই তো জায়গা। আমরা তো আসলে কাজেরই লোক। তবুও লোকে কেন যে শুধু “কাজের মাসি”রাই কাজ করে বলে জানে! জানি না। অনেকে আবার ফলাও করে বলেন, “কিছু লোকে কাজ করতে ভালোবাসেন বলে কাজ করেন কিন্তু আমি বাবা অতো কাজ ভালোবাসি না”। তাহলে কি তাঁরা ফাঁকিবাজ? এর উত্তরে আমার কলেজের ফিজিওলজির অধ্যাপক সফলদা একটি মজার কথা বলেন, “শোনো কাউকে ফাঁকিবাজ বলো না, যে কর্মক্ষেত্রে ফাঁকি দেয় সে ঘরে কাজ করে আর যে ঘরে ফাঁকি দেয় সে কর্মক্ষেত্রে কাজ করে।”

যাই হোক কর্মক্ষমতা সাধ্যের বাইরে চলে গেলে দেহ মন অবসন্ন হয়ে পড়ে। তাই মানসিক প্রশান্তির নিমিত্ত ২০১৬ – র জুলাইয়ে যখন বাংলা বিভাগের পিজি কোঅর্ডিনেটরের দায়িত্বপত্র পেলাম তা ডিক্লাইন করলাম। অধ্যক্ষ ড. গোপাল চন্দ্র বেরা মহাশয় সদয় হলেন। বললেন, “আপনারা কাজ করেন বলেই তো কলেজটা চলছে। আচ্ছা কিছুদিন মুক্ত থাকুন।” কিন্তু মুক্তি কি আর সহজে মেলে? ঐ বছরই সেপ্টেম্বর মাসে নতুন দায়িত্ব চলে এলো – রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষা কেন্দ্রের মেদিনীপুর কলেজ স্টাডি সেন্টারের কোঅর্ডিনেটরের দায়িত্ব নিতে হলো। একটা বিষয়ের কোঅর্ডিনেটরের দায়িত্ব থেকে মুক্তি চাওয়ার উপহারস্বরূপ পেলাম সাত সাতটি বিষয়ের পিজি কোর্সের কোঅর্ডিনেটরের দায়িত্ব।

🍂

বাংলা,ইংরেজি,সংস্কৃত,ইতিহাস,রাষ্ট্রবিজ্ঞান, শিক্ষাবিজ্ঞান,ইএনভিএস বা পরিবেশ বিদ্যা – মোট এই সাতটি বিষয়ে শুরু হলো স্নাতকোত্তরের পঠনপাঠন। দিন তো আর আটচল্লিশ ঘন্টার নয় চব্বিশ ঘন্টারই। ওভারলোডেড হয়ে গেলাম। নিজের অধ্যয়ন-অধ্যাপনা-পরীক্ষা নেওয়া-খাতা দেখা কোথাও একচুল ফাঁক না রেখে চললো রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষার মেদিনীপুর কলেজ স্টাডি সেন্টারের(পরে নাম হয় লার্নার সাপোর্ট সেন্টার) কোঅর্ডিনেটরের কাজ। শনিবার রবিবার হতে থাকলো তার ক্লাস। তবে ওটি সাধারণত যে অর্থে ক্লাস বলা হয় তা না বলে, বলা হয় পার্সোনাল কনট্যাক্ট প্রোগ্রাম সংক্ষেপে পিসিপি। পড়ান কলেজেরই অধ্যাপকরা। ২০১৬ তে প্রায় সাতাশ জন অধ্যাপককে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম পিসিপির জন্য। মেদিনীপুর কলেজের বাইরের অধ্যাপকদেরও কয়েকজনকে আমন্ত্রণ জানাতে হয়েছিল,কেননা তখন আমাদের কলেজে এডুকেশনের ফুলটাইম ইউজিসি অধ্যাপক কেউ ছিলেন না। 

বাংলার পিসিপি সুসম্পন্ন করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন আমার বিভাগের ড.সুস্নাত জানা, ড.অমর কুমার সাহা, ড.ফটিক চাঁদ ঘোষ ও আমার বন্ধু নীলাঞ্জনা ভট্টাচার্য্য। পরের বছরগুলিতে অধ্যাপক রবীন্দ্র শীটও যোগ দেন। ইংরেজির ক্লাস নেন ড.অমলকান্তি চক্রবর্তী, অধ্যাপক রাজেন্দ্রনাথ দত্ত, অধ্যাপক সাগির আলি। পরে পরে সাহায্য করেন অধ্যাপক তন্ময় কুণ্ডু, ড. সৈকত সরকার এবং অধ্যাপক সঞ্জয় সরেন। সংস্কৃতের পিসিপিতে সহায়তা করেন ড.গিরিধারী পণ্ডা, অধ্যাপক চন্দন মণ্ডল ও অধ্যাপক তপন দাস। ইতিহাসের জন্য সাহায্য চাইলাম অধ্যাপক সত্যরঞ্জন ঘোষ, ড.অপর্ণীতা ভট্টাচার্য্য, অধ্যাপক শক্তিপ্রসাদ দে এবং গড়বেতা ও গৌরব গুঁইন মেমোরিয়াল কলেজের অধ্যাপক মানস কুমার রাণা ও ড.তপন হাজরার কাছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পিসিপিতে যোগ দিলেন অধ্যাপক দিলীপ কুমার ভট্টাচার্য্য, ড.অন্নপূর্ণা নন্দ এবং পরে অধ্যাপক সুধীন্দ্রনাথ বাগও সাহায্য করেন। এডুকেশনের জন্য পার্শ্ববর্তী কলেজ থেকে এলেন অধ্যাপক ড. মনোরঞ্জন ভৌমিক, ড.আশিস কুমার দণ্ডপাট এবং অধ্যাপক সত্যপ্রিয় বেহারা। বিপদে পড়লে স্বাগত বিজলীও অনেক সময় সাহায্য করেছে। পরিবেশ বিদ্যার পিসিপিতে সহযোগিতা করেছেন অধ্যাপক সুধীন্দ্রনাথ বাগ, ড.মণিশ্রী মণ্ডল, ড. দুলাল কুমার দে, ড.চন্দ্রিমা চক্রবর্তী এবং ড. সুধাময় ঘোষ।

এঁদের প্রত্যেককে রুটিন করে দেওয়া, আমন্ত্রণপত্র দেওয়া, সিলেবাস দেওয়া, স্টাডি মেটিরিয়াল দেওয়া, ক্লাসের হিসেব রাখা, যৎসামান্য সাম্মানিক দেওয়া এবং প্রতিটি সাবজেক্টের একাধিক অধ্যাপকের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের কাছ থেকে অমূল্য সময় নেওয়া এসবের পরও নিজেকে কিছু ক্লাসও নিতে হতো। তার উপর আছে প্রতিটি লার্নারের সঙ্গে ফোন এবং ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখা। আর ছিল কলেজ এবং ইউনিভার্সিটির মধ্যে কোঅর্ডিনেট করা। 

২০১৬ তে মোট ১৯২ জন লার্নার এনরোল করে। বাংলায় ছিল পঞ্চান্ন জন, ইংরেজিতে একুশ জন, এডুকেশনে উনপঞ্চাশ জন, ইতিহাসে বারো জন, সংস্কৃতে তেইশ জন, পরিবেশ বিদ্যায় সাতাশ জন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পাঁচ জন। 

লার্নারদের জন্য স্টাডি মেটিরিয়াল আনতে প্রথম বছর অধ্যক্ষ ড. গোপাল চন্দ্র বেরার সঙ্গে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষা কেন্দ্র সল্টলেকের সেক্টর টু তে গেলাম। সেটা ২০১৭ এর পঁচিশে জানুয়ারি। অধ্যাপনায় যোগ দেওয়ার পর ঐ প্রথম এবং এখনও পর্যন্ত শেষবারের জন্য বিকাশ ভবনে যাই। হাল হকিকত দেখি। কিন্তু আমার কাজ তো রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষা কেন্দ্রে। ওখানকার ফিনান্স অফিসার রামকৃষ্ণবাবু বুঝিয়ে দিলেন কীভাবে আর্থিক দায়দায়িত্ব পালন করতে হবে। বার বার করে বুঝিয়ে দিলেন স্টাডি সেন্টারের মূল দায়িত্ব প্রিন্সিপাল এবং কোঅর্ডিনেটরের। একজন অফিস অ্যাসিসটেন্টও দরকার। প্রথম বছর মিহিরদা এবং পরে শুভঙ্কর এ কাজে যোগ দেয়।

 তখন সল্টলেক থেকে পরে পরে স্টাডি মেটিরিয়াল আনতে গেলে রোহনের সাহায্য পেয়েছি অনেকবার। আমার কোঅর্ডিনেটরের স্ট্যাম্প বানিয়ে দেওয়া, নেমপ্লেট তৈরি করা সব ওরই দেখভালে সম্পন্ন হয়। ওকে বললাম সব কিছু আমার নামে বানিয়ে ফেলছো কেন? পরের জন দায়িত্বে এলে আবার তাঁর নামে বানাতে হবে। নামের জায়গাটা ফাঁকা রাখো। রোহন বললো, “ আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন ম্যাডাম আগামী দশ বছর কেউ এই দায়িত্বে আসবে না।” সত্যি সত্যিই ২০২৪ এর জুলাই পর্যন্ত আমাকেই দায়িত্বভার সামলাতে হলো।

মাঝখানে দুবছর করোনাকালে সব কিছু অনলাইনে সামলাতে সামলাতে দিনরাত চলে গেল। কে ফর্ম ফিলআপ করতে পারছে না, কে টাকা জমা দিতে পারছে না, কে অ্যাডমিট ডাউনলোড করতে পারছে না, কে লিঙ্ক পাচ্ছে না, কার পোর্টাল খুলছে না, কে অ্যানসার্স স্ক্রিপ্ট সাবমিট করতে পারছে না আরো নানান ঝক্কিতে একেবারে টেলিফোন অপারেটরের মতো কাজ করতে হয়েছে। 
২০১৭ তে  RBU/DDE  - তে আমার ক্রিয়াকলাপের কিছু নিদর্শন তুলেছিল রঞ্জিত।

দূরশিক্ষা কেন্দ্রের তৎকালীন ডেপুটি রেজিস্টার অধ্যাপক ড. বিকাশ ঘোষের সঙ্গে কাজ করে অনেক সম্মান পেয়েছি কিন্তু অন্যান্য অফিসাদের সঙ্গে ঠিকঠাক তাল মিলতো না। ইউজিসির নানান নিয়মকানুনের গেরোয় পড়ে ওঁরা অনেক সাবজেক্টের পঠনপাঠন বন্ধ করতে বাধ্য হন আর লার্নারের সংখ্যাও কমতে থাকে। ফলে আর্থিক সহায়তার পরিমাণও কমতে থাকে। লার্নারদের কথা ভেবে আমরা অনেকেই বিনা সাম্মানিকে কাজ করেছি। কলেজের যে পরিমাণ আর্থিক ব্যয় হয়েছে তার ন্যূনতমও কলেজ ফিরে পায় নি। তবে মেদিনীপুর কলেজ অনেক সামাজিক কাজ করে তার পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষজনের জন্য। এটিও তার মধ্যে অন্যতম একটি।

 এম.এ. যেহেতু দুবছরের কোর্স ফলে ২০১৬ তে যারা ভর্তি হয় তারা  ডিগ্রি লাভ করে ২০১৮ তে। এদিক দিয়ে দেখলে ২০১৮,২০১৯,২০২০,২০২১,
২০২২,২০২৩ এবং সম্ভবত ২০২৪ এই সাত আটটি ব্যাচ এম.এ.ডিগ্রি অর্জন করলো, মেদিনীপুর কলেজ স্টাডি সেন্টারের তত্ত্বাবধানে, এও কী কম কথা! ২০২২-২৩ থেকে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ হলো মেদিনীপুর কলেজ স্টাডি সেন্টারে। লাস্ট ব্যাচের ডিসার্টেশান পেপার জমা নিলাম ২০২৪-এর এপ্রিল মাসে। সেদিন ওদের কয়েকজনের সঙ্গে একটি ফোটো তুলে এই সম্পর্ককে স্মৃতিতে ধরে রাখলাম। কেননা ২০২৪ এর জুলাইয়ে ওদের সার্টিফিকেট মার্কশীটের সব ফাইল তুলে দিই কলেজের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হাতে। তবে এখনও লার্নারদের ফোন পাই। এতো জনসংযোগে জীবন কাটছে যে ফোনে ফোনে জেরবার হয়ে যাই। এখন ফোন সব সময়ই সাইলেন্ট মোডে রাখি। ভাগ্যিস স্মার্ট ফোন এলো তবু কিছুটা মুক্তি। সবাইকেই প্রায় বলে রেখেছি আমাকে জরুরি প্রয়োজনে ফোন না করে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করবেন।

(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments