জ্বলদর্চি

লিটল ম্যাগাজিন : উদ্বর্তনের ইতিবৃত্ত নিয়ে কলম ধরেছেন মিলি ঘোষ


লিটল ম্যাগাজিন : উদ্বর্তনের ইতিবৃত্ত নিয়ে কলম ধরেছেন মিলি ঘোষ
 

শ্রী ঋত্বিক ত্রিপাঠী। পরিচয় দেবার প্রয়োজন পড়ে না। এ বছর কলকাতা বইমেলা থেকে সংগ্রহ করেছি তাঁর লিখিত বই, 'লিটল ম্যাগাজিন : উদ্বর্তনের ইতিবৃত্ত'। ১৮ টি প্রবন্ধ আছে এই বইতে।

কিছু বলার আছে। আমরা অনেকেই জানি বিভিন্ন পত্রিকার বিজ্ঞপ্তিতে বহু শর্ত থাকে। লেখকদের জন্য। কী ধরনের লেখা দেওয়া যাবে, কী কী দেওয়া যাবে না। লেখা জমা নেবার শেষ তারিখ এবং পত্রিকা প্রকাশের সম্ভাব্য তারিখ। যেহেতু প্রকাশের ক্ষেত্রে 'সম্ভাব্য' শব্দটি ব্যবহার করা হয়, তাই দেরি হলে অপেক্ষা করতেই হবে। আত্মজিজ্ঞাসা প্রবন্ধে লেখক এখানেই প্রশ্ন তুলেছেন, "পত্রিকা যদি নির্দিষ্ট তারিখের পরে প্রকাশ পায়, তবে আগেই বা হবে না কেন!"

সম্পাদকদের সচেতনতার অভাবের কথা তিনি অকপটে বলেছেন। বহু বানান ভুল নিয়ে এক একটা পত্রিকা প্রকাশ পায়। অবশ্যই সব পত্রিকা নয়। এ ক্ষেত্রে লেখক হিসেবে দায় আমাদেরও থেকে যায়। কোনও ইংরেজি শব্দকে বাংলা হরফে লিখতে গেলে উদ্ভট একটা কিছু এসে হাজির হয় কি-বোর্ডের বদান্যতায়। খেয়াল করলে এডিট করি। না করলে ওই অবস্থাতেই পৌঁছে গেল সম্পাদকের কাছে। কি-বোর্ডের দোহাই দিয়ে নিজের অজ্ঞতা ঢাকার প্রয়াস এটা নয়। ভুলকে ঠিক জেনে লেখা আমরাও পাঠিয়ে থাকি। তবে প্রতিটি ভুল থেকে শিক্ষা লাভ করি। প্রতিদিন শিখছি।

লেখক বলেছেন, "পাড়ার ক্রিকেটের ক্যাপ্টেন তিনিই হন, যাঁর ব্যাট বল আছে। প্রথম পর্যায়ে একজন সম্পাদক নিজে থেকেই সম্পাদক। ক্রমশ চর্চার মধ্য দিয়ে তিনি যদি না তাঁর দিগন্ত বাড়াতে না পারেন, তবে সারাজীবন পাড়ার ক্রিকেটই খেলতে হবে।" অত্যন্ত দামি কথা। যা ভাবায়, ভাবতে বাধ্য করে। শুধু সম্পাদক কেন, ভাবতে হবে লেখককেও। এর জন্য দরকার প্রচুর বই পড়ার অভ্যেস তৈরি করা। লেখক এই প্রবন্ধে দুঃস্থ লেখকদের সাহায়্য করার কথা বলেছেন। এখানে আমার একটা প্রশ্ন আছে। কীভাবে বুঝবেন তিনি দুঃস্থ নাকি বিত্তবান। ফেসবুকে প্রোফাইল দেখে? বই কেনার হিড়িক দেখে? এমন মানুষও আছেন যাঁরা নিজের জন্য একটা সুতোও কেনেন না। কিন্তু বই কেনেন। পড়বার জন্য, দেখানোর জন্য নয়। 

🍂

লেখক তাঁর 'সাময়িক পত্র ও লিটল ম্যাগাজিন' প্রবন্ধে   বলেছেন, "নদীর একূলে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির কাছে সহজেই জন্ম নেয় ও-কূল। কিন্তু নদীতে ভেসে যাওয়া সংগ্রামী মানুষটির মূল লক্ষ্য : কূল।" 

এটাই লিটল ম্যাগাজিনের দর্শন, যা আমদের ভাবতে শেখায়। তিনি আরও বলেছেন, "লিটল ম্যাগাজিনের বিকল্প লিটল ম্যাগাজিন-ই।"

তাঁর প্রশ্ন বিজ্ঞান বা অঙ্কের অধ্যাপকের বানান ভুল করাটা কি অধিকারের মধ্যে পড়ে! কথায় কথায় 'বাট' শব্দের ব্যবহারে তাঁর আপত্তি আছে। এই জায়গায় ব্যক্তিগতভাবে আমি পুরোপুরি লেখকের সঙ্গে সহমত পোষণ করি। 'কিন্তু' উচ্চারণে 'বাট' শব্দের থেকে কতটা সময় বেশি লাগে? ওই সময়টুকুতে তিনি কী করেন? হতে পারে তাঁর নামের পাশে ১০৮ টা ডিগ্রি আছে। কিন্তু তাঁর মাতৃভাষা বাংলা। বাংলা লেখা বা বলার সময় সচেতন তাঁকে থাকতেই হবে। এখানেই লিটল ম্যাগাজিনের সার্থকতা। মন্ত্রে সংস্কৃত ভাষার ব্যবহার নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। এ প্রশ্ন আমারও। আরাধ্য দেবতা কি শুধু সংস্কৃতই বোঝেন?
লেখক বলেছেন, "সংস্কৃত ভাষায় আমরা খিস্তি মারি না।" ধৃষ্টতা মার্জনা করবেন। 'খিস্তি' শব্দটি কি বাংলা ভাষার অন্তৰ্গত? আমার ঠিক জানা নেই। তাই জিজ্ঞাসা।

'দেশ ও ধর্ম' প্রবন্ধে লেখক প্রশ্ন রেখেছেন, "একটা দেশ ভেঙে যদি দুটো দেশ হয়, তবে উল্টোটাই বা হবে না কেন?" তিনি আরও বলেছেন, ভোগ্যপণ্য ধর্ম মানে না, দেশ মানে না। এ প্রশ্ন আমারও। শরীরের রক্ত কি ধর্ম মানে? দেশ মানে? কার শরীরের রক্ত কার শরীরে যায়, কে তার হিসেব রাখে? 

'স্বাধীনতা' প্রবন্ধে লেখক একটি চরম বার্তা দিয়েছেন।
"আমারই শক্তিতে ক্ষমতাবান হয়ে দেশের রাজা আমাকে ঠকাচ্ছে। ঠকানোর রীতি পদ্ধতি নিত্য নতুন। ... উপকারের নামে সংরক্ষণ! সংরক্ষণের নামে পিছিয়ে পড়া শ্রেণীকে আরও পঙ্গু করা।"
তিনি বারবার প্রশ্ন রেখেছেন লিটল ম্যগাজিনে সরকারের ভূমিকা নিয়ে। সরকারি রেজিষ্ট্রেশনে লিটল ম্যাগাজিনের পরিচয় সংবাদপত্র হিসেবে। তাঁর ক্ষোভ দেশের জনগণকে নিয়ে, তাঁদের মেধা নিয়ে। তিনি এমন একটি বাক্য লিখেছেন যা অন্তত দু'বার না পড়লে অর্থ অনুধাবন করা যায় না। তাঁর বক্তব্য তুলে ধরলাম। "এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে লিটল বলে ব্যঙ্গ করে সুখ পায় বই-কি লিটল ম্যাগাজিন!"
পাঠক পড়ুন। দু'বার পড়ুন। তিনবার পড়ুন। ভাবুন, কোন গভীর অর্থ লুকিয়ে আছে বাক্যটিতে।
তিনি বলেছেন, "চেয়েছি বলেই এত ঠাকুর। নাহলে এক রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট হত।"
এ কথা সত্য। রবীন্দ্রনাথকে মানুষ বোঝার চেষ্টা করেনি। ২৫শে বৈশাখকে তাই 'রবীন্দ্রঝড়' বলে ব্যঙ্গ করাটা রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাষ্ট্রের দিকে বারবার আঙ্গুল তুলেছেন লেখক। সতীদাহপ্রথা বন্ধ হয়েছে কীভাবে? এর জন্য সচেতনতা, শিক্ষা, কড়া অনুশাসন প্রয়োজন। লিটল ম্যাগাজিন আর সংবাদপত্র যে এক নয়, এ বিষয়ে তাঁর কণ্ঠ সোচ্চার। বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিন ও সম্পাদক মহাশয়দের শ্রদ্ধা জানাতে ভোলেননি তিনি। 

এক কথায় বইটি অনবদ্য। প্রতিটি বাক্যের প্রতিটি শব্দে প্রতিবাদ। কিন্তু কে শুনছে! শোনার কথা তো রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র শুনবে না, এটাই স্বাভাবিক। যে রাজ্যে শিক্ষাকে জলাঞ্জলি দেবার সব রকম ব্যবস্থা আছে, সে রাজ্য ভাববে লিটল ম্যাগাজিনের কথা? উত্তর একটাই। শিক্ষা প্রশ্ন করতে শেখায়। সেখানেই তো সমস্যা। শ্রী ঋত্বিক ত্রিপাঠী মহাশয়কে ধন্যবাদ এমন একটি বই আমাদের সামনে তুলে ধরার জন্য। যাঁরা এখনও পড়েননি, পড়ে দেখুন। আশাকরি ঠকবেন না।

Post a Comment

0 Comments