বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৫৮
তেজপাতা
ভাস্করব্রত পতি
'তোমার জীবন আমার জীবন সবই তো এক,
জীবনটা যেন সবই বৃথা।
কি কর রোজ, খুঁজে দেখ আজ সম্মান মর্যাদা,
দুঃখ- কষ্ট ছাড়া কি আছে তোমার।
কি নেই, খুঁজে আনো বাজারে।
সবই তো আছে, নেই শুধু সম্মান।
সম্মানটুকু থাকে, তুমি নেই চিরতরে।
বলি জীবনটা তেজপাতা।
যা কর, কর ছাত্রজীবনে!
পাও সম্মান মর্যাদা, দুঃখ কষ্ট ও ভোগবিলাস'।
-- জীবনটা তেজপাতা, সোলাইমান
সংস্কৃতে পত্রক, তেজপত্র, ত্বকপত্র, মৈথিলী এবং নেপালীতে 'তেজপাত', লেপচায় চাবর কুঙ, হিন্দীতে 'তেজপাত্তা', মালয়ালম, তেলেগুতে 'বিরিয়ানী আক্কু', সংস্কৃত এবং মারাঠীত 'তমালপত্ৰ' বলে। ইংরেজীতে ইণ্ডিয়ান বে লিফ' (Indian Bay Leaf), cassia, tamala, cinnamon বলে। এটি মধ্যমাকৃতি চিরশ্যামল বৃক্ষবিশেষ। প্রায় ৬০ ফুট উচ্চতার হতে পারে। পাতাগুলো খুবই সুগন্ধী। তেজপাতার পাতা ৭ - ৮ ইঞ্চি লম্বা হয়। পাতাগুলো বিপরীতভাবে বিন্যস্ত। এগুলি প্রথম অবস্থায় লাল, পরে সবুজ হয়ে যায়। মার্চ এপ্রিল মাসে ফুল এবং ফল হয়। পেকে গেলে ফলগুলি কালো রঙের হয়। এদের ফুল ও ফল লবঙ্গের মত। এই গাছের পাতার তেজ গুণ তথা অগ্নিগুণকে অগ্রাধিকার দিয়ে নাম দেওয়া হ'য়েছে তেজপত্র বা তেজপাতা। এটি একটি বৈদিক শব্দ। এটি আছে ঋকবেদের ১।৫৫।১ সূক্তে। ভারত, চিন, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশে এদের অবস্থান। রসুইঘরের অন্যতম মশলা হিসেবে এর ব্যবহার রাঁধুনিদের কাছে অত্যন্ত সমাদৃত।
শুকনো তেজপাতা
সাধারণত দুই ধরনের তেজপাতা গাছ পাওয়া যায়। Cinnamomum tamala এবং রামতেজপাতা বা পাতিবে'দা তথা Cinnamomum obtusifolium। তেজপাতা Lauraceae পরিবারের অন্তর্গত। এছাড়াও তেজপাতার আরও কিছু প্রজাতির নাম হল --
Cinnamomum albiflorum Nees
Cinnamomum cassia D.Don nom. illeg.
Cinnamomum lindleyi Lukman.
Cinnamomum pauciflorum var. tazia (Buch.-Ham.) Meisn.
Cinnamomum reinwardtii Nees
Cinnamomum veitchii Lukman.
Cinnamomum zwartzii Lukman.
ফুলসহ তেজপাতা
কথায় বলে 'বুঝলে ভুজপাতা, না বুঝলে তেজপাতা'। এখানে 'ভুজপাতা' অর্থে 'ভোজপাতা' বলতে পারেন অনেকে। যার অর্থ — ভোজন করার পাতা। যখন রকমারি বাসনপত্র অপ্রতুল ছিল, তখন মানুষ পাতায় ভোজন করত। শালপাতা, কলাপাতা, পদ্মপাতা ব্যবহৃত হত ভোজনে। তবে এই প্রবাদের 'ভুজপাতা' এই ভোজপাতা নয়। এটি আসলে 'ভূর্যপত্র'। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Melaleuca cajuputi। তবে ভূর্যপত্র আসলে পাতা নয়, ভূর্য গাছের ছাল। যা শুকনো করে লেখার কাজে ব্যবহৃত হয়। প্রবাদ অনুসারে 'না বুঝলে তেজপাতা' অর্থে কোনও বিষয় বুঝতে পারলে ভূর্যপত্রে লেখার ক্ষমতা তৈরি হয়। আর না বুঝলে বইয়ের পাতাও মূল্যহীন হয়ে যায় রান্নায় ব্যবহৃত করার পরে ফেলে দেওয়া তেজপাতার মতো।
তেজপাতা গাছের ছাল উদরাময়, গনোরিয়া এবং দাস্ত অপরিষ্কারজনিত বিভিন্ন ধরনের রোগে উপকারী। ওজন কমাতে কাজে লাগে। । বিভিন্ন রান্নায় সুগন্ধি মশলা হিসেবে এর ব্যবহার সর্বজনবিদিত। স্বরভঙ্গে, পিপাসা রোগের নিরাময়ে, রক্তবর্ণ প্রস্রাবে, গায়ে দুর্গন্ধ হলে, অরুচি, অত্যধিক ঘাম নিঃসরণ, ফোঁড়া, ঘামাচি, চোখ ওঠা, মাড়ির ক্ষত, চুলুনি রোগ, দাদ, স্মৃতিভ্রংশ ইত্যাদির নিরাময়ে তেজপাতা ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। কবি রত্না দেব বিশ্বাস ভৌমিক লিখেছেন, 'তেজ পাতার তেজ কতটা আছে, তার কি জানি! / তবে একটু হলেও যে এদের দাম আছে, তা মানি'।
🍂
0 Comments