চিত্র- শুভম দাস
চারপাশের বাড়ীগুলি
পুলক কান্তি কর
এখন এই বাড়ীর যে বড় কর্তা, সবাই তাকে দিব্যজ্যোতি মুখোপাধ্যায় নামে জানলেও আসলে সে বুড়োবাবু। ওর বাবা হরিধন মুখোপাধ্যায় যবে ছেলের মুখে ভাত দিলেন, সেদিনই ওর বুড়ো বুড়ো হাবভাবের জন্য ওর নামও হয়ে গেল বুড়োবাবু। তখন সবে মাটি খুঁড়ে আমার পা গুলো গড়া হচ্ছে। হরিধন তখন ওই যে দূরের মস্ত খিলানওয়ালা বাইজীবাড়ীর অনেক শরিকের এক শরিক। বাড়ীটি প্রায় আঠারোশো সাল থেকে এখনও দাঁড়িয়ে আছে দুই শতকের ইতিহাস স্মৃতিতে নিয়ে। রাজা বাহাদুর বিক্রম মুখোপাধ্যায় যখন রায় বাহাদুর উপাধি পেলেন, তখন তাঁদের আদি বসতবাটী ছিল হাওড়ার আঁদুলের দিকে। এই পুরাতন প্রাসাদটিকে কিনে নিয়ে এখানে তাঁদের মৌতাতের আসর বসত। লক্ষ্ণৌ থেকে নাকি বাইজী আসতো মাঝে মাঝে। সেই থেকে আড়ালে লোকে একে বাইজী বাড়ীও বলে। তা হরিধন যখন পাকাপাকি আমাকে সাজিয়ে ফেললেন তাঁর মনোমত করে, তখন বুড়োবাবুর বয়স দশ-টশ। তখন দেয়াল টেয়াল অতখানি নোংরা করার বয়স চলে গেলেও এদিক ওদিক ওর হাতের ছাপ, রঙ পেন্সিলের দাগে গড়ে ওঠা পাহাড় উঁকি মারত আমার গায়ে। আমি আর বুড়োবাবু তো প্রায় একবয়সী, তাই আমাদের মধ্যে এক আলাদা সখ্যতা আছে, সে আমিও বুঝি, বুড়োবাবুও বোঝে।
মনে পড়ে, বুড়োবাবু তখন বোধ হয় ক্লাস সিক্স, ওদের স্কুলে লিখতে দিয়েছে ‘একটি বাড়ির আত্মকথা। ছাতার আত্মকথা, কলমের আত্মকথা মানা যায়, বাড়ির আত্মকথা লেখা কি চাট্টিখানি কথা! বুড়োবাবু এসে যখন আমার ডানহাতের করিডোরটায় লাটিম ঘোরাতে ঘোরাতে আমায় জিজ্ঞেস করল - আমিই তো ‘থ’। সত্যিই তো, কী বলব এই নিয়ে? আমার ঠিক ডানদিকেই মস্ত এক শিরীষ গাছ আমার মাথার অর্ধেক ঢেকে দাঁড়িয়ে থাকে, শুনে তারও কি হাসি! বলল, ‘পাঁচ বছরের বাড়ী, তুই আবার আত্ম হলি কবে, তোর আবার কথা কী? কথা তো আমার! দ্যাখ্ না, দেড়শো বছর দাঁড়িয়ে আছি - সেই সেপাইরা যখন সাহেবের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরল - তখন তো এখানেই ওদের ছাউনি গড়েছিল। তখন ওই বাইজী আর আমি – এই তল্লাটে দুজনে ছিলাম। হ্যাঁ, দাপট ছিল বটে বাইজীর। প্রায় দুশো সেপাই লুকিয়ে ছিল ওতে। সাহেবরা এসে কামান দাগল, গুঁড়ি দিয়ে দরজা ধাক্কালো।বাইজী সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল তো রইলোই। একচুলও জায়গা দিল না সাহেবদের। আজ ওদের নানা শরিক এখানে এক পশলা, ওখানে এক পশলা যোগ বিয়োগ করে শনির প্রাসাদ বানিয়েছে, নইলে আগে যদি দেখতিস, তবে বুঝতিস আভিজাত্য কাকে বলে! এখন মেয়েলি নাম হয়ে গ্যাছে, আমরা তো আগে ওকে বায়বাহাদুর বলে ডাকতাম।’
এই শিরীষেরও বড় দুঃখ। সঙ্গী-সাথীরা কেউ নেই। সব কাটা পড়ে গ্যাছে। ওরও সময় ঘনিয়ে এসেছে। এতখানি জায়গা দখল করে ওর ডালপালা, কে আর অত জায়গা দেবে? এই বুড়োবাবু যদ্দিন, তদ্দিন। ওর ছেলে অনিন্দ্যের হাতে পড়লে তো আমিও যাব। কতবার ফ্ল্যাট বানানোর জন্য প্রোমোটার নিয়ে হাজির হয়েছে এখানে। নেহাৎ বুড়োবাবুর এখনও তেজ আছে, নইলে কবে ভাঙা পড়তো সবকিছু। মহা ত্যান্দড় হয়েছে ছেলেটা! বুড়োবাবুর কোনও গুণই পায়নি। বাড়ীতে অত সুন্দর সতীলক্ষ্মী বউ, আর ও কিনা অন্য মহিলায় মশগুল! আমি তো সব জানি। বাথরুমে বসে ওইসব মহিলার সাথে চ্যাট্ করে, ওদের নোংরা নোংরা ছবি দেখে। এই তো গত বুধবারই ওর অফিসের কোন মহিলাকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোর ঘুরে এলো অফিস ট্যুরের নাম করে। যাওয়ার আগের দিন বাথরুমে ঢুকে ফিসফিস করে কথা বলছিল, শুনে ফেলেছি। আমি দুচোখে দেখতে পারিনা ওকে। রূপসীও পছন্দ করে না। রূপসী মানে আমার বউ। ওই যে রাস্তার ওপাশের হালকা হলুদ রঙের ছিপছিপে বাড়ীটা! এখনও কী স্লিম, এতকাল রঙ পড়ে না, তবু কেমন লাজুক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আজ এতগুলো বছর! আমার চেয়ে বছর আটেকের ছোট। আমি তো ওকে ন্যাংটো থেকে দেখছি। ওপার বাংলা থেকে এসে বরোদাবাবু মানে বরোদা ভট্টাচার্য যখন জায়গা জমি কিনলেন, তখন এখানে তিনশো টাকা কাঠা। তা তিনকাঠা জমির উপর রয়ে সয়ে প্রথমে একতলা বানালেন। তখন অতখানি রূপ ছিল না রূপসীর। বছর চার পরে, যখন উনি ভালো একটা চাকরী জোগাড় করলেন, তখন রূপসী তার পুরো রূপ পেল। উনি সাধ করে বাড়ীর নাম রাখলেন, রূপরেখা। আমি আদর করে ‘রূপসী’ বলি। আমাদের বুড়োবাবুর বাবার সাথে ওঁর বয়সের ব্যবধান বেশী ছিল। অথচ সহজে দু-বাড়ীর মধ্যে বন্ধুতাও হয়ে গেছিল। ও বাড়ীর বউ এর নাম ছিল কমলা। ভারী চমৎকার রান্না করতেন। প্রায়দিনই তরকারী বাটির চালাচালি হত দুই বাড়ীতে। আমরা গন্ধ পেয়ে বুঝতাম, বাঙাল বাড়ীরই জিৎ হত প্রায়দিন। রূপসীও কবে বাঙাল হয়ে গেছে মনে মনে! প্রায় দিনই আমায় ঠোনা মারতো – ‘হুঁ, বলে দাও তোমার ঘটি গিন্নিমাকে, রান্নাটা ভালো করে শিখতে। ইলিশ মাছে চিনি! ছিঃ ছিঃ! এ বাড়ীর গিন্নিমা তো আজ ভিরমি খেতে খেতে বেঁচে গেলেন।’ আমি বলতাম, ‘মানুষ ভালোবেসে যে জিনিস দেয়, তার খুঁত ধরতে নেই। তোর গিন্নিমা’র এই শিক্ষা!’ রূপসী ফোঁস করে উঠতো। ‘খবরদার, মায়ের শিক্ষা নিয়ে কথা বলো না। এমন মানুষ দেখেছো কখনও? মুখের সামনে কোনও দিন খারাপ বলেছে? দেখবে, কাল গিয়েই কত সুখ্যাতি করবে রান্নার।’ আমি বলতাম, ‘হ্যাঁ , মুখে মিষ্টি, মনে বিষ’। রূপসী শুনে রাগ করে বলত- ‘যাও তোমার সাথে কথা বলব না। যে এমন মানুষকে বিষ বলে, সে নিজেই বিষ!’ রূপসীর সাথে এমন মান অভিমান আমার লেগেই থাকতো। অবশ্য দু-চারদিন। প্রেমের সম্পর্কে এর বেশী অভিমান আর কে বা টানতে দেয়? অবশ্য কমলা ভট্টাচার্য সত্যিকারের ভালো মানুষ ছিলেন, আমি রূপসীকে মুখে যাই বলি না কেন! প্রায় প্রতি বিকেলে ওঁরা কর্ত্তা-গিন্নী মিলে এ বাড়ী আসতেন। আমাদের হরিধনের সাথে কমলার এক গোপন অথচ মিষ্টি সম্পর্ক ছিল। যেদিন বরোদা আসতেন না, আর এ বাড়ীর গিন্নী মা চা-টা বানাতে ভেতরে যেতেন, তখন কমলা মৃদুস্বরে নিজের অনেক দুঃখের কথা বলতেন হরিধনকে। হরিধনও সাধ্য মতো নিজের পরামর্শ দিতেন। তখনকার দিনও ছিল বড়ো ভালো। কোনও অশালীনতা ছিল না এই সম্পর্কে। দুজনেই দুজনকে গভীরভাবে পছন্দ করতেন। অথচ হরিধনের দাম্পত্য তাতে কোনওভাবে ব্যাহত হতো না। বরোদার সাথে কমলার বয়সের ব্যবধান অনেক ছিল। ফলে তাঁদের বাধ্যবাধকতা ছিল অনেক বেশী, সম্পর্ক ছিল অনেক কম। কখনও কমলা আনমনে অনেক কথা বলতে শুরু করতেন, হরিধন সতর্ক থাকতেন, বলতেন - ‘চুপ করো, রত্না আসছে।’
বরোদা আর কমলার দুটি ছেলে আর একটি মেয়ে ছিল। মেয়েটি বড়। নাম ছিল ‘অঞ্জলি’। আর এ বাড়ীর ওই এক ছেলে, বুড়োবাবু। বুড়োবাবু অঞ্জলির চেয়ে বছর দুই এর বড়। এই চার ছেলেমেয়ে আর আশেপাশের দু-একটা বাড়ি থেকে আরও জানা চারেক ছেলে মেয়েরা মিলে আমার সামনের মস্ত যে বাগান আছে, সেখানে খেলত। ডাংগুলি, মার্বেল, চোর-পুলিশ, বুড়িবসন্ত – সব কিছু। অঞ্জলি আর বুড়োবাবু পিঠোপিঠি দুই ছেলেমেয়ে – একসাথে বাড়তে বাড়তে কখন মনে মনে জড়িয়ে গেল দুজনে, ওরা বুঝতেই পারেনি। সবচেয়ে আগে ব্যাপারটা খেয়াল করল রূপসী। আমায় জিজ্ঞাসা করল, ‘হ্যাঁ গো, আমাদের অঞ্জলি যে তোমাদের ওখানে যায়, বুড়োবাবুর সাথে কোনও অসংলগ্ন কিছু দেখেছো?’
-কই! তেমন তো কিছু দেখিনি!
-তা দেখবে কী করে! অতবড় শরীর নিয়ে খাবি খাচ্ছ, কোনও দিকে খেয়াল আছে?
-আচ্ছা, অত রেগে যাওয়ার কি আছে? কী ঘটেছে, বলো না! যেন কত গোপন কথা বলছে এমন ভঙ্গীতে রূপসী ফিসফিস করে বলল, ‘জানো তো, অঞ্জলি বুড়োবাবুর প্রেমে পড়েছে।’
-কী করে জানলে?
-ও আমরা মেয়েরা বুঝতে পারি। আজকাল খুব উদাস থাকে, মাঝে মাঝেই জানলার খড়খড়ি তুলে তোমাদের দিকে চেয়ে থাকে, মনে মনে গান গায় – ওই প্রেমে পড়লে যা হয় আর কি?
-তুমি প্রেমের কী বোঝ? তুমিও কি আমায় দেখে এমন উদাস হতে?
-বুড়োর ভীমরতি দেখ! অতবড় শরীর তোমার, দেখব কাকে? তোমার ডান হাত জুড়ে বিশাল বারান্দা, বামহাত জুড়েও তাই। মাঝখানে গনেশের মতো পেট আর বুক বের করে রেখেছো বাগান চিরে। তার উপরে মুখের অর্দ্ধেক তো শিরীষ কাকার কবলে। দেখব কী?
-আরে আমাদের খানদানি ব্যাপার। রাজবংশের লোক। তোমার মতো উদ্বাস্তু বাড়ী নাকি?
বলেই বুঝলাম, মস্ত বড় কথা বলে ফেলেছি। এভাবে বলা উচিৎ হয়নি। রূপসী মুখ ঘুরিয়ে নিল। অনেক দুঃখ প্রকাশ করলাম, কাজ হল না। এবার মোক্ষম জায়গায় প্যাঁচ দিলাম। ‘তুমি ঝগড়া করলে বুড়োবাবু-অঞ্জলি প্রেম আখ্যানের কী হবে?’ রূপসীর ও পেট ফুলেই ছিল। এমন মনোগ্রাহী চেষ্টায় ছেদ ঘটাবার মতো রাগের জোর ছিল না। তাই বলল, ‘বুড়োবাবু কি এমন কিছু করে?’
-বুড়োবাবু রোজ খড়খড়ি তুলে দেখে, তবে সেটা অন্য কারণে।
-কী কারণ?
-একদিন হরিধন কী একটা কথায় কমলাকে বলেছিলেন - ‘আমরা তোমাদের থেকে অনেক পরে ঘুমোতে যাই।’ কথাটা সত্যি, তুমিও জানো। মাসের অধিকাংশ দিন তুমি রাতে আগেই ঘুমিয়ে পড়ো। আমার এখানে সবাই ঘুমোলে আমি যখন তোমার সাথে কথা বলার অবকাশ পাই, তখন তুমি ঘুমিয়ে কাদা।
-তার সাথে বুড়োবাবুর খড়খড়ি তোলার কী সম্বন্ধ?
-বুড়োবাবু কথাটা সিরিয়াসলি নিয়ে নিল। আসলে ছোট তো! কখন কোন্ কথা কিভাবে মনে নেয়! এরপর কোনওদিন হরিধনরা আগে ভাগে শুয়ে পড়লেও বুড়োবাবু কিছুতে ঘুমোত না। ও আমার বাঁ হাতের বারান্দার লাগোয়া ঘরে ঘুমোত। ওখান থেকে তোমাকে ভালো দেখা যায় না। সেজন্য উঠে এসে আমার পেটের দিকের জানলার খড়খড়ি তুলে মাঝে মাঝে দেখে যেত তোমার সব আলো নিভলো কিনা! যখন সব আলো নিভে যেত, তখনই নিশ্চিত হয়ে সে ঘুমোতে যেত।
-এতেই তো পরিষ্কার, তোমার বুড়োবাবুও অঞ্জলির প্রেমে পড়েছে।
-কী করে?
-দ্যাখো, হরিধন কমলাকে কী বলেছেন, তা রক্ষার দায় তো বুড়োবাবুর নেই। সেও নিশ্চই একই কথা - হয়তো বাবার মুখ থেকে শুনেই, অঞ্জলিকে বলেছে। সেটাই সে বজায় রাখতে ব্যাকুল। যাইহোক, তোমার চোখে আর কিছু পড়েনি?
-এখনও তো পড়েনি। তবে এবার খেয়াল রাখবো।
বেশী দিন অপেক্ষা করতে হল না। আমাদের বুড়োবাবু কখনও গান টান শেখেনি। তবে খানদানি রক্ত তো! গান শুনতে ভালোবাসতো খুব। নিজেও খোলা গলায় বেশ ভালো গান করতো। একবার হরিধন আর রত্না কি এক কাজে বাইরে গিয়েছিলেন। তখন বোধ হয় পূজোর ছুটিছাটা চলছে। দশটা বাজতে না বাজতেই অঞ্জলি হাজির। কিছু খেলা-টেলার প্ল্যান ছিল হয়তো। কিন্তু সেদিন অন্য কোনও ছেলেপুলেরা না আসায় বুড়োবাবু অঞ্জলিকে নিয়ে ছাতের চিলেকোঠার ঘরে চলে গেল। আমার তো বুক দুরুদুরু করছে। সবসময় মনে হচ্ছে, কী হয় কী হয়! বুড়োবাবু হঠাৎ শান্তিদেব ঘোষের রেকর্ডটা চালিয়ে দিল - ‘চপল তব নবীন দুটি আঁখি - চপল তব...
-এটা কার গাওয়া গান গো বুড়োদা?
-শান্তিদেব ঘোষ।
-খুব সুন্দর তো! আগে শুনিনি কখনও!
-এটা তো তোর চোখের কথা ভেবে লিখেছেন রবিঠাকুর।
-যাঃ।
-যা নয় রে! তোর চোখ দুটো বড় চপল, তবু গভীর।
-চপল জিনিস গভীর হয় কিভাবে বুড়োদা?
-দেখবি? চোখটা বন্ধ কর, দেখিয়ে দেব।
এরপর অঞ্জলি যেই চোখটা বন্ধ করেছে, বুড়োবাবু চকাস্ করে একটা চুমু খেয়ে নিল ডান চোখে।
-এটা কি করলে? ভয়ে কাঁপতে লাগল অঞ্জলি।
-তোকে নজরানা দিলাম। দে বাঁ চোখটা...
-ভ্যাট। বলেই দৌড়ে চলে গেল অঞ্জলি। তবে পালিয়ে গেল না। আমার ডান হাতের কনুইটার কাছে একটা ছোট্ট দরজা আছে শিরীষ তলায় যাবার। সেই দরজার পাশে একটা লম্বাটে জাফরি আছে- সেখানে দাঁড়িয়ে শিরীষ গাছ দেখতে লাগলো। বুড়োবাবু খুঁজতে খুঁজতে এসে পেছন থেকে জাপটে ধরলো ওকে। অঞ্জলি ভয়ে চোখ বুজে ফেলল। বলল, ‘ছাড়ো বুড়োদা। কেউ দেখে ফেলবে।’
-কে দেখবে? বাবা-মা বাইরে গেছে।
-এটা ঠিক নয়, বুড়োদা।
-কেন বেঠিক কি? আমি তোকে ভালোবাসি। বিয়ে করব বড় হয়ে।
-সে বয়স হোক, তখন ভাববে।
-আমি এখন ছোট কী? পি.ইউ পাশ করে গেছি।
-তা হোক, আমার ভয় করে।
-ভয় করুক, তুই আমায় ভালোবাসিস কিনা বল?
অঞ্জলি কিছু না বলে দৌড়ে চলে গেল ওর নিজের ঘরে। সে রাত্রে আমি অধীর অপেক্ষায় আছি, কখন সবাই ঘুমোবে। রূপসীকে এ গল্প করতে না পারলে আমারও শান্তি নেই। কিন্তু অপেক্ষা করলে কী হবে! বুড়োবাবু ঘুমোয় না। খালি চিলেকোঠার ঘরে গিয়ে রেকর্ড চালিয়ে ওই গান শোনে, আর কী সব লিখে রাখে। পরের দিন বুঝলাম, চিঠি লিখেছে। ওদিকে রূপসীর অবস্থাও খারাপ। ওরও আলো নেভে না। এ দিকের জানলা দেওয়া ঘরে ইদানীং অঞ্জলি থাকে। সে ঘরে এখনও আলো। আজ আকাশে অর্দ্ধেক চাঁদ। মাঝরাতের পরেই উঠেছে। চারদিক কেমন ঝাপসা। শিরীষকাকারও বোধহয় ঘুম ভেঙে গেছে। আমায় বলল, কী রে ঘুমোসনি?
-না। ঘুম আসবে কি করে? এতরাত অবধি বুড়োবাবু গান শুনছে।
-কেন রে? বুড়োবাবু প্রেমে পড়েছে নাকি?
শিরীষ কাকা প্রাজ্ঞ মানুষ, বোঝে সব। কিন্তু আমি কী বলব? রূপসীর আগে এমন গোপন খবর দেওয়ার ইচ্ছে হল না। তাই বললাম, ‘কী জানি, বুঝি না তো!’
-তুই আর কি বুঝবি? তোর বয়সই বা কত? প্রেম তো করতো হরিধনের দাদু। চাঁদ উঠলে বউকে নিয়ে আমার কাছে আসতো। কত গান করতো সে। কবি মানুষ ছিল তো! নিজের লেখা শোনাতো বউকে। নে শুয়ে পড়। একটু পরেই কাকপক্ষীর চিৎকারে আর তিষ্টোতে দেবে না আমাকে।
সারারাত দুইবাড়ীর আলো নিভলো না একমুহুর্তও। রূপসীকে ইশারা করে দিলাম, ‘কথা আছে, কাল বলব।’
পরের দিন রূপসীর উত্তেজনা আর কমে না। রাত দেড়টা দুটো নাগাদ যখন সব নিশুতি হল, রূপসী বলল, ‘জানো, আজ সাঙ্ঘাতিক একটা ব্যাপার ঘটেছে!’
-কী গো!
-তোমার বুড়োবাবু লাভ-লেটার লিখেছে।
-তাতে তোমার অঞ্জলির প্রতিক্রিয়া কী?
-গভীর পূর্বারাগ! রাতের ঘুম উঠে গ্যাছে তো। চিঠিটা অন্তত সাতশো বার পড়েছে, চারশো বার শুঁকেছে, হাত বুলিয়েছে কতবার গুনতে পারিনি। এখনও ঘুমোয়নি, আলো নিভিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করছে শুয়ে শুয়ে।
-শুঁকেছে কেন? গন্ধ মাখানো চিঠি নাকি?
-কে জানে? কেন, তুমি দ্যাখোনি বুড়োবাবুকে আতর-ফাতর লাগাতে?
-আমি খেয়াল করিনি। হতেও পারে। বুড়োবাবু আজকাল সেন্ট-ফেন্ট মাখে দেখিতো!
-আর না হলেই বা কি? ভালোবাসারও তো সুগন্ধ হয়! সেই গন্ধই তো খুঁজছিল বোধ হয় অঞ্জলি।
-আচ্ছা রূপসী, অঞ্জলির বয়স কত হল?
-এই তো নাইন পাশ করলো। কত আর হবে? ষোল-সতেরো!
-দূর! বুড়োবাবুই তো এখন সতেরো। তাহলে ওর পনেরো-টনেরো হবে।
-সে যাই হোক, একথা জিজ্ঞেস করছো কেন?
-না মানে ওদের বিয়েটা হলে ভালো হয়! বুড়োবাবু যেমন আমার বন্ধু, অঞ্জলি তো তেমনি তোমার!
-হ্যাঁ ঠিক বলেছো। তবে ভয় পাচ্ছি, এ বিষয়ে না পাঁচ-কান হয়!
-তুমি কিন্তু তোমার পাশের ওই মুটকী মঞ্জরীকে বোলো না। ও তবে এখনি শিরীষকাকা, বাইজী, অবসর, সন্ধ্যানীড় - সক্কলকে বলে দেবে। তবে জানো তো, শিরীষ কাকার সন্দেহ হয়ে গেছে অলরেডি!
-বলো কী?
-হ্যাঁ। ও তো দিনরাত আমার দিকেই মুখ করে থাকে। গতকাল যখন বুড়োবাবু অঞ্জলিকে জড়িয়ে ধরেছিল, তখন দেখে থাকবে।
-তবে তুমিও চোখ কান খোলা রেখো, এখন দুজনেরই বয়স কম। বাড়াবাড়ি কিছু হলে মুখ দেখানো যাবে না কাউকে।
-ঠিক কথা রূপসী। তুমিও খেয়াল রেখো।
এসব কতকালের কথা। বুড়োবাবুর এখন বাহাত্তর চলছে। প্রায় পঞ্চান্ন বছর আগের কথা। এখন বুড়োবাবু কেমন যেন হয়ে গেছে। অবশ্য আমার প্রতি টান তার একটুও কমেনি। যখন অনিন্দ্যের বিয়ে হল, কী সুন্দর সাজিয়ে ছিল আমাকে! দেখে রূপসী তো কতদিন মুগ্ধতা কাটাতে পারেনি। কেবলই ওই রোশনাই আর ফুলের সাজের কথা বলতো। ওই বাড়ীতে তো চার পাঁচখানা বিয়ে হয়েছে, কিন্তু রূপসীর ভাগ্যে এমন সাজগোজ জোটেনি। বরং মোটা মঞ্জরীর কপাল ভালো। প্রায় প্রতি পাঁচ বছরে নতুন নতুন রঙের ওড়না পড়ে ওর গায়ে। এর মধ্যে কতবার কেয়ারি বাগান বসেছে ওর সামনে, তার ইয়ত্তা নেই। এবাড়ীতে বুড়োবাবুকে বাদ দিলে ওই অনিন্দ্যের বউ মউলি আমার খুব যত্ন নেয়। নিজের হাতে আমাকে পরিষ্কার করে। হাত বোলায়। আমি বুঝি ওর কষ্ট! অনিন্দ্য শুধু ওর শরীরটা চেনে। ওর মনের কোনও খোঁজ রাখে না। ওদের ছোট বাচ্চাটা – লাল্টু - কতই বা বয়েস - আট কি নয়! সারাটা দিন মোবাইলে, নইলে ভিডিও গেমে ব্যস্ত। আমার সাথে একটুও খেলে না। আমার ডান হাত, বাম হাতে কত জায়গা! সামনে বাগান। একটু সাইকেল-টাইকেলও তো চালাতে পারে? ওর বাপটাও এমনি ছিল। এত বড় বড় দেয়াল, ওই বাপ-ব্যাটা, কারও একটা আঙুলের দাগ নেই! বুড়োবাবু তো রঙ পেন্সিল দিয়ে সারা দেয়ালে কত আঁকিবুঁকি কাটতো! এতবড় ক্যানভাস্, বাচ্চাদের আঁকতেও ইচ্ছে করে না?
(২)
কোজাগরী লক্ষ্মী পূজোর রাত। এবাড়ীর পূজো কখন শেষ। শিরীষকাকার ঠিক মাথাতেই এখন চাঁদ। আমার জাফরীর ভেতর দিয়ে সেই আলো ভরে দিয়েছে বুড়োবাবুর ঘর। বুড়োবাবু একটু আগেই ঘুমোতে গেল। রূপসী এইমাত্র খবর দিল, অঞ্জলি ঘুমের মধ্যে মারা গেছে। কেউ জানে না। ওবাড়ীতে এমনিও অঞ্জলির খোঁজ কেউ রাখতো না। একটা আয়া রাখা থাকতো তার, শুধু দিনের বেলা। এখন এদিকের জানলা দেওয়া ঘরটায় ওর অধিকার নেই। একতলার একটা কোণের দিকের ঘরে আটকে রাখা হয় ওকে। আজ দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর বিষাদ রোগগ্রস্ত হয়ে বাপের বাড়ীতেই পড়ে আছে সে। অবশ্য ওর বাবা মা বেঁচে থাকতে উপরের এই দিকের জানালাওয়ালা ঘরের মালিকানা তারই ছিল। বছর দশেক হল, ভাইদের সংসারে একতলার ঘরে ঠাঁই হয়েছে তার। বুড়োবাবু যখন বি.এস.সি পাশ করল, ও তখন সবে বি.এ ক্লাশে ভর্ত্তি হয়েছে। লুকিয়ে লুকিয়ে চিঠি পত্র চালাচালি, প্রেম চলছিলই। তবে কোনও পক্ষের বাবা-মা তার আঁচ পায়নি। সেদিন কোনও এক ছুটির দিন ছিল। রত্নার বাপের বাড়ীর সম্পর্কে কেউ হাসপাতালে ভর্ত্তি ছিলেন বলে হরিধন রত্নাকে নিয়ে সকাল সকাল শ্বশুরবাড়ী গেছিলেন। যেমন ছুটির দিনে অঞ্জলি এবাড়ীতে আসে, সেদিনও এসেছিল। এখন দুজনের সেই আগের জড়তা নেই। বুড়োবাবু টুকটাক একটু আদর-টাদর করে দিল সুযোগ মতো। সারা বাড়ীতে এখন শুধু আড়ালই আড়াল।কাজের লোকেরাও সব বাইরে। বুড়োবাবু বলল, অনু যা তো, মায়ের একটা শাড়ী পরে আয়।
-শাড়ী পরতে যাবো কেন?
-যা না। এই চুড়িদারের উপরই পরে চলে আয় না!
-না। যাবো না।
-এত অবাধ্য হোস্ না। জানিস তো আমার রাজরক্ত। কানিজদের বেয়াদপি আমি বরদাস্ত করব না। বলেই পৃথ্বিরাজ কাপুরের স্টাইলে বুড়োবাবু হাঁক পাড়লো, ‘কানিজ’!
-কী আমি কানিজ? যে রাজা কানিজকে হৃদয়ে বসাতে চায়, তার আবার কিসের স্ট্যান্ডার্ড? কপট মুখ ফোলালো অঞ্জলি।
-আরে বাবা, যা না! তুই তো আমার রানী। কানিজ কেন হবি? তোকে শাড়ী পরলে রানীর মতো লাগে কিনা দেখতে হবে না?
-কেন? তুমি আমায় শাড়ী পরতে দেখোনি?
-দেখেছি। তবে সেটা স্কুলের ড্রেস এ। মায়ের একটা ভারী শাড়ী পরে আয় না! দেখি, কেমন লাগে!
-না বুড়োদা। কেউ এসে পড়লে ভারী লজ্জায় পড়বো।
-কেউ আসবে না। তুই যা।
বুড়োবাবু প্রায় বাধ্য করল অঞ্জলিকে ওর মায়ের শাড়ী পরতে। নিজেই খুঁজে খেঁজে ওকে পরিয়ে দিল শাড়ী। তারপর গভীরভাবে ওর কপালে একটা চুম্বন এঁকে দিল। বলল, ‘চল আমার ঘরে।’
-না বুড়োদা। ঘরে যাবো না।
-কেন রে?
-তোমার মতলব ভালো নয়।
-দূর বোকা। আমি কি বর্বর নাকি দুশ্চরিত্র? তোর অমতে কিছুই করবো না। চল।
-না বুড়োদা। চলো বরং ডানদিকের ওই জাফরী দেওয়া বারান্দার চৌকিতে গিয়ে বসি।
বারান্দায় গিয়ে বুড়োবাবু অঞ্জলির কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে শুয়ে গল্প করতে লাগলো। বেলা প্রায় দেড়টা বাজে। দুজনেরই খেয়াল নেই। এদিকে আমি দেখতে পাচ্ছি ওকে খুঁজতে বরোদাবাবু নিজে এঘরে আসছে। আমি কি করি। দরজায় ছিটকিনি দেওয়া নেই। শিরীষকাকাকে বললাম। ও বেচারা কতবার ডালাপালা দিয়ে জাফরীতে ঝাপ্টা দিল, তবুও ওদের হুঁশ নেই। অবশেষে বরোদা যখন দরজা খুলেই ওদের এভাবে আবিষ্কার করলেন, তাঁর চক্ষু চড়ক গাছ। মুহুর্তের মধ্যে ফিরে গেলেন বাড়ী। অঞ্জলি যখন বাড়ী ফিরল, ওর জন্য যা তিরষ্কার এবং প্রহার জুটেছিল, বলতে গেলে রূপসীর চোখ এখনও ঝাপসা হয়ে যায়। রাতারাতি কলেজস্ট্রীটের এক ব্যবসায়ীর ছেলের সাথে অঞ্জলির বিয়ে স্থির হয়ে গেল। পনেরো দিনের মধ্যে বিয়ে। দুই বাড়ীর মধ্যে এত হৃদ্যতা এক ঝটকায় শত্রুতায় পৌঁছালো। ছেলে মাতাল, লম্পট। বিয়ের এক বছরের মধ্যে বাচ্চা, জন্মেই সে মারা গেল। রূপসী বলে, সে নাকি বাপের অত্যাচারেই। দুবছরের পর আবার বাচ্চা। তবে এটা আর পৃথিবীর মুখ দেখেনি। পেটেই মরে গেল। পাঁচ সাত বছর পর মেয়ে যখন পাকাপাকি ভাবে রূপরেখায় ফিরলো, তখন তার কেবল ক’খানা হাড়ই আছে। সে সোনার বর্ণ নেই, সেই কাজল চোখে আর আলো নেই। সারা চোখ জুড়েই কালি, আর সারা গায়ে কালশিটে। কিছুদিন ডাক্তার-বদ্যি হল। তারপর যা হয়। ওই জানালার খড়খড়ি দিয়ে সে নাকি সারাদিন এবাড়ীর দিকেই চেয়ে থাকতো, যদি বুড়োবাবুর দেখা পায়। বুড়োবাবু তখন জাহাজের চাকরী নিয়ে চলে গেছে বিদেশ। অবশ্য, যাবার আগে হরিধন এক সুপাত্রীর সাথে তাঁর গাঁটছড়া বেঁধে দিতে ভোলেননি। তার নাম ছিল মায়া। সারাজীবন সে শুধু মায়া দিয়েই বাঁধতে চেয়েছিল সংসার, না ছিল শিক্ষা, না ছিল কৌলিন্য। বুড়োবাবুর মনের নাগাল সে কোনওদিন পায়নি, পাওয়ার চেষ্টাও করেনি। অনিন্দ্যের বখে যাওয়া অনেকটা ওর মায়েরই কারণে। তবে বুড়োবাবু কখনও অনিন্দ্য বা মায়ার অযত্ন বা অবহেলা করেনি। আট বছর চাকরী করে সে যখন পাকাপাকি ভাবে এখানে ফিরে এল, প্রকৃত অভিভাবকের মতো সে সবদিক সামলেছে। শুধু আমি বুঝতাম, বিকেলে সে যখন ছাদে পায়চারি করার নামে যেত, সে একদৃষ্টে ওই জানলার দিকেই চেয়ে বসে থাকতো। কখনও চাঁদনি রাত হলে একটা আরাম কেদারা নিয়ে শিরীষকাকার তলায় গিয়ে বসতো। খুব সকালে উঠে যখন গান শুনতে বসতো, আমি জানি সে সব কিছুই অঞ্জলির তর্পনে। আমি ভাবছি, কাল সকালে অঞ্জলির মৃত্যুর খবরটা কিভাবে নেবে সে। অবশ্য অঞ্জলির মৃত্যু তার কাছে বহু বছর আগেই হয়ে গেছে। তবুও...
বুড়োবাবু অবশ্য খুবই বিচক্ষন এবং পরিণত। তার জীবনে হরিধন-রত্নার মৃত্যু সে খুব ভালোভাবেই সামলেছে। হরিধনের মৃত্যু তো আকষ্মিক। রাতে ভালো মানুষ শুতে গেলেন, সকালে নেই। আর রত্না তো মারা গেলেন বছর দশেক আগে। বয়সের মৃত্যু। অতএব অতখানি শোকেরও কিছু ছিল না। আমি জানি, বুড়োবাবু মায়ের প্রতি মনে মনে খুব দুর্বল ছিল। তবু তাকে সেভাবে ভেঙে পড়তে দেখিনি।
রূপসী বলল, ‘হ্যাঁ গো, মায়ার মৃত্যু কি দু-বছর হয়ে গ্যাছে?’
-হ্যাঁ। দু-বছর তিনমাস।
-মায়ার মৃত্যুর সময় বুড়োবাবু কিন্তু ভেঙে পড়েছিল।
-না রূপসী। ভেঙে পড়েনি, ওর একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল।
-অপরাধবোধ কেন?
-আরে জানোই তো, মায়া চোখে কম, কানে দেখতো বেশী। ওই যে মঞ্জরী বাড়ীর বুড়িটা, ও রোজ এসে মউলির নামে ওর কান ভাঙাতো। ও কেন এটা করে না, ও কেন গান শিখতে যায় - এইসব আর কী! মউলি বিয়ের আগে ভালো গান করতো। অনিন্দ্য তো বউ এর কোনও শখ আহ্লাদ দ্যাখে না। মউলি বুড়োবাবুকে খুব ভালোবাসতো। ও একদিন বললো, ‘বাবা, আমি যদি সপ্তাহে একদিন গান শিখতে যাই, আপনি কি অমত করবেন?
-কেন? আমি অমত করবো কেন?
-মা বলছিলেন, আপনি নাকি এসব অপছন্দ করেন। তাই আমি সাহস করে এতদিন আপনাকে বলতে পারিনি। মাকেই অনেকবার বলেছি। উনি প্রতিবার আপনার বাহানা দিয়ে কাটিয়ে দিতেন। আজ সকাল সকাল উপরের চিলেকোঠার ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখি, আপনি মুগ্ধ হয়ে গান শুনছেন। যে গান ভালোবাসে, সে নিশ্চই গান শিখতে অমত করবে না!
-না বৌমা। আমার কোনও আপত্তি নেই। তুমি কোথায় শিখবে বলো, আমি নিজে গিয়ে তোমায় ভর্ত্তি করিয়ে দিয়ে আসবো।
-আমি তো আগে দক্ষিনী তে শিখতাম, তবে এখান থেকে একটু দূর হবে। আমার কোনও বাছবিচার নেই। এই পাড়ায় কারোর কাছে ভর্ত্তি করে দিলেও আমার চলবে।
-না না, দক্ষিনী এমন কি দূর! বাড়ীর গাড়ীতে যাবে-আসবে। চলো, কালকেই যাই।
মউলির গান শেখা তখন থেকে শুরু। সপ্তাহে একটা দিন মেয়েটা যায়। আর মায়ার সব কাজ যেন তখনই মনে পড়ে যায়। ও যখনই একটু প্র্যাকটিসে বসে, অমনি মায়ার নয়তো অনিন্দ্যের চায়ের তেষ্টা পায়, নইলে এটা ওটা ইচ্ছে হয়। সারাদিন বাড়ীর সব কাজই তো সে করে। তবু ওকে একটু ডিষ্টার্ব না করলে মায়ার শাশুড়ী-বৃত্তিটা যেন সুখ পায় না। সেদিন মঞ্জরীর বুড়িটা এসে বলল, তোমাদের আবার বেশী বেশী! ও মেয়ে বিদ্যেধরী। দ্যাখো না, শ্বশুরকে কেমন বশ করেছে! নইলে কোন বর বউ এর কথা না শুনে বউমা নিয়ে আদিখ্যেতা করে? রাতে মায়ার সাথে এই নিয়ে এপাশ ওপাশ হয়েছিল। মায়ার এমনিতেই হাই প্রেশার ছিল, হার্টের ব্লক-ফ্লকও ছিল। যে কারনেই হোক, সে রাতেই ম্যাসিভ ষ্ট্রোক হয় মায়ার, হাসপাতালে দুদিন কোমায় থেকে মারা যায়। বুড়োবাবু ভাবতো, তার সাথে উত্তপ্ত কথোপকথন না হলে বোধহয় মায়ার ষ্ট্রোক হতো না।
-যাঃ। এতে বুড়োবাবুর কী দোষ! কেউ উল্টোপাল্টা কথা বললে তাকে প্রতিহত করাটা তো আত্মরক্ষার পর্যায়ে পড়ে!
-তা ঠিক। তবে কিনা, বুড়োবাবু মানুষটা তো খুব সেনসিটিভ। তার কারণে কেউ কষ্ট পাক, এটা ভাবতে তার কষ্ট হয়।
-তাহলে ভাবো, অঞ্জলির এই পাগল হয়ে যাওয়া তাকে কত কষ্ট দিয়েছে! ওর পাগল হওয়াটা তো বুড়োবাবুকে কেন্দ্র করেই!
-হ্যাঁ রূপসী। তাই তো ভাবছি। কাল সকালে বিষয়টা জানাজানি হলে কী হবে!
পরদিন আশপাশের বাড়ী থেকে যখন খবরটা এল, তখন বেলা প্রায় সাড়ে ন’টা। দৈনন্দিন কাজ সেরে বুড়োবাবু তখন চা খেতে খেতে পেপারে চোখ বোলাচ্ছিল। কথাটা কানে যেতে বলল, ‘কে মারা গেছে?’
-বাবা, ওই রূপরেখার অঞ্জলি পিসিমা। মউলি বলল।
-কখন মারা গেছে?
-বোধহয় কাল রাতে। কেউ বুঝতে পারে নি। আয়া এসে দ্যাখে খাটের উপর বডি স্টিফ হয়ে আছে।
-ওঃ।
একটুপরে বুড়োবাবু এসে চিলেকোঠার ঘরে গিয়ে বসল অনেকক্ষণ।একটু পরে দরজায় টোকা শুনে বলল, ‘কে?’
-বাবা, আমি।
-ওঃ বৌমা! এসো।
-বাবা, আপনার শরীর ঠিক আছে তো? একবার ডাঃ তরফদারকে কল দিয়েছিলাম। উনি এসেছেন। একটু প্রেশার-ট্রেশার গুলো দেখে দেবেন। আপনি কি নীচে আসবেন? নাকি ওঁকে উপরে আসতে বলবো?
-আবার ডাক্তার কল দিলে কেন?
-আসলে আপনার ছেলেও তো বাড়ী নেই। শুনেছি অঞ্জলি পিসি আপনার ছেলেবেলার বন্ধু ছিলেন। আপনারা নাকি একসাথে খেলতেন?
-কে বলেছে, এসব কথা?
-কেন মা বলতেন তো।
-ওঃ।
-তা তিনি মারা গিয়েছেন শুনে নিশ্চই আপনার খারাপ লাগছে। তাই একটু প্রেশার-ট্রেশার গুলো দেখে রাখা, এই আর কি!
-তোমার কি আমাকে দেখে মনে হচ্ছে, আমি ভেঙে পড়েছি?
-না না। আপনি তো শক্ত মানুষ। এতগুলো বছর তো আপনাকে দেখছি। তবে বাবা, এবারে যেন কোথাও ঘটনাটা আপনার মনকে ছুঁয়েছে বুঝতে পারছি। বলেই মউলি এসে বুড়োবাবুর মাথায় হাত বোলাতে লাগলো। ‘কী বাবা, ঠিক বলছি?’
বুড়োবাবু মউলির মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। বললেন, ‘চলো নীচেই যাই।’
ডাক্তারবাবু প্রেশার সুগার মাপলেন।সবই মোটামুটি ঠিক আছে। বললেন, ‘রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় তো?’
-হ্যাঁ।
-তবু হাল্কা একটা অ্যাংজিওলাইটিক লিখে দিলাম। ঘুম না এলে খেয়ে নেবেন।
সারাদিন আমারও মনটা ভালো নেই। বুড়োবাবুর ভেতরটা আমি বেশ পড়তে পারছি। আষাঢ়ের মেঘ জমেছে ভালোমত! শিরীষকাকা বলল, ‘নিরালা, তোর আমার দিনও ফুরিয়ে এলো রে! বুড়োবাবুর একটা কিছু হলে অনিন্দ্য এক সেকেন্ডও দেরী করবে না। এই তো, গত বুধবারই ও বারান্দাতে দাঁড়িয়ে কোন্ প্রোমোটারকে ফোন করছিল, দশলাখ অ্যাডভান্সও করতে বলছিল - ওই প্রোমোটার রাজী হয়নি। বলল কী ভরসায় দেব মিঃ মুখার্জী! আপনার বাবা যদি এখনও দশবছর বেঁচে থাকেন, তবে আমার কত লোকসান হবে বুঝেছেন?
-শিরীষকাকা, এ ব্যাটা বুড়োবাবুকে ধাক্কা-ফাক্কা দিয়ে ফেলে মেরে দেবে না তো?
-এতটা বোধহয় পারবে না। বৌমাটা তো বুড়োকে ভালোবাসে খুব। একা একা এতটা সাহস পাবে না।
-খাবারে বিষ-টিষ মিশিয়ে দিলে?
-এতটা ভয় পাস না নিরালা। সে হলে কবেই অঘটন ঘটিয়ে দিত। সরকারী চাকরী-বাকরী করে। অত রিস্ক নেবে বলে মনে হয় না।
-শিরীষকাকা, দেখেছো তো আজই ‘অবসর’ ভাঙা পড়েছে? বড় বড় বুলডোজার দিয়ে ওর হাড়-পাঁজর সব ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে - তাকিয়ে দেখলেও কান্না পাচ্ছে। আমার কত পরের বাড়ী। অথচ ওর আজ কী হাল!
-আমি বছরখানেক আগেই বুঝতে পেরে গেছি রে নিরালা, যেদিন ওই বাড়ীর সামনের কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া গাছগুলো সার দিয়ে কেটে বেচে দিল - সেদিনই পরিষ্কার হয়ে গেছে, ওখানে ফ্ল্যাট হবে।
-এখন আমার চিন্তা, আমি আগে যাবো, না রূপসী? ওই ঘরে তো দুই ভাই এর বনিবনা নেই। অঞ্জলি ছিল বলে একটা বাধা ছিল। ফ্ল্যাট হলে বোন কোথায় থাকবে? এখন তো সে বাধাও কেটে গেল। ভালোই হল, রূপসী আগে গেলেই ভালো -আমি সইতে পারবো। ও তো এক-দুদিনেই মাটিতে মিশে যাবে। আমাকে ভাঙতে তো আর শুধু গাঁইতি শাবলে হবে না। বড় বড় দু-তিনটে বুলডোজার লাগবে। দিন পনেরো লাগবে আমায় ধুলিস্যাৎ করতে! রূপসী কী করে দেখবে? ও তো ভয়েই ভেঙে পড়বে নির্ঘাত!
-তুই এত ভাবিস না নিরালা। দ্যাখ বুড়োবাবু কেমন থাকে! চুপচাপ লোকদের নিয়েই তো সমস্যা।
হঠাৎ রূপসীও এসে যোগ দিল কথায়। বলল, কী গো, বুড়োবাবু ঘুমোতে গেল?
-না। এখনও তো চিলেকোঠায় বসে আছে।
-অনিন্দ্য ফিরেছে?
-হ্যাঁ।
-মউলি?
-ও বেচারা কী করবে? অনিন্দ্য ফিরেই খাওয়া দাওয়া সেরে মউলিকে সমানে ইশারা ইঙ্গিত করছে তাড়াতাড়ি শুতে যাওয়ার জন্য।
শিরীষকাকা বলল, ‘হারামজাদা! শুধু শরীর আর শরীর! এ সপ্তাহে বোধহয় ওই শাকচুন্নীদের সাথে বেড়ানো হয়নি!’
রূপসী বলল, ‘দ্যাখো না গো, বুড়োবাবু বেরোল কিনা!’
-না গো! চুপ করে চোখ বন্ধ করে বসে আছে আরাম কেদারায়।
-গান শুনছে নাকি?
-না না, রেকর্ড তো কবেই খারাপ হয়ে গেছে। সি.ডি প্লেয়ারটা তো কদিন ওর শোয়ার ঘরে।
-নিশ্বাস প্রশ্বাস পড়ছে তো?
-তা পড়ছে। কিন্তু বুড়োবাবু এত ঘামছে কেন? শিরীষ কাকা একটু হাওয়া দাও না!
-আরে আজ তো ঠান্ডা রে বাইরে! অক্টোবর শেষ হয়ে গেল। বলছিস যখন, ডালপালাগুলো নাড়িয়ে দিচ্ছি - তবে আমার মনে হয়, হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে। দ্যাখ না নিরালা, মুখ চোখ স্বাভাবিক কিনা?
-কেমন যেন করছে গো বুড়োবাবু! শিরীষকাকা কী করবো? বুড়োবাবু কেমন করছে যে!
-কী আর করবি? শান্তিতে যেতে দে ওকে। রূপসী তুইও শক্ত হ। কয়েকদিনের মধ্যে আমি আর নিরালা মাটি নেব। অবশ্য তোরও বেশী দিন নেই। চল আমরা সবাই মিলে খুশীতে বুড়োবাবুকে বিদায় জানাই।
হঠাৎ করে শিরীষকাকা প্রবলভাবে দোলাতে লাগলো তার সব ডালাপালা। বাসায় যেসব পাখিরা ঘুমোচ্ছিল, ভয় পেয়ে তারা সব চিৎকার করতে করতে উড়তে লাগলো শিরীষকাকার চারপাশে। দু-একটা বড় ডাল ভেঙে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। রূপসী মুখ নীচু করে কাঁদতে লাগলো। আকাশে তখন কৃষ্ণা প্রতিপদের চাঁদ চারদিক জ্যোৎস্নায় প্লাবিত করতে করতে মনে করিয়ে দিল, পুরোপুরি নিভে যেতে তারও আর বেশী বাকী নেই।
1 Comments
অপূর্ব!
ReplyDelete