জ্বলদর্চি

ভাষা, পরিচয় এবং উদারতা /কমলিকা ভট্টাচার্য



ভাষা, পরিচয় এবং উদারতা
কমলিকা ভট্টাচার্য 

ভাষা কেবল শব্দ বা ব্যাকরণ নয়, এটি আমাদের ভাবনা, আবেগ ও চেতনার প্রতিফলন। কথ্য ও লিখিত ভাষার পাশাপাশি চোখের ভাষা, শরীরের ভাষা ও স্পর্শের ভাষাও যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

আবার ভাষা শুধু যোগাযোগের উপায় নয়, এটি সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ধারক। চিন্তার ভাষা আমাদের অভ্যন্তরীণ অনুভূতির প্রকাশ ঘটায়, আর ভাষার পরিবর্তনশীলতা তার প্রাণবন্ততার প্রমাণ।

সত্যিকারের ভাষা সেই, যা শব্দ ছাড়াও হৃদয় ছুঁতে পারে, সংযোগ তৈরি করতে পারে, এবং অনুভূতিকে স্পর্শ করতে পারে। ভাষা কখনো বিভেদের কারণ নয়, বরং এটি ঐক্যের সেতু।


তবে অনেক সময় আমরা আমাদের মাতৃভাষার প্রতি অতিরিক্ত আসক্ত হয়ে পড়ি এবং তার চারপাশে এক কঠোর সীমারেখা তৈরি করি। এই অতিরিক্ত মালিকানাবোধ আমাদেরকে অন্যান্য ভাষার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শনে উদ্বুদ্ধ করে, যেন আমাদের ভাষাটিই শ্রেষ্ঠ। এই ভাষিক গোঁড়ামি বিভাজন সৃষ্টি করে এবং এমন একটি পরিবেশ তৈরি করে যেখানে কিছু ভাষাকে অন্য ভাষার তুলনায় বেশি মূল্য দেওয়া হয়।যার ফলে আমরা অন্যান্য ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল না থেকে অবচেতনভাবে সেগুলিকে ছোট করে দেখি। এই প্রবণতা আমাদের মধ্যে বৈষম্যের জন্ম দেয় এবং ভাষার ভিত্তিতে মানুষকে বিচার করার এক অপ্রয়োজনীয় সংস্কৃতি গড়ে তোলে।

ভাষার প্রতি এই পক্ষপাতিত্বের সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো আমাদের কোনো একটি নির্দিষ্ট ভাষায় দক্ষতা আমাদের আত্মগরিমা বাড়িয়ে দেয় এবং আমরা ধরে নিই যে যে ব্যক্তি সেই ভাষায় দক্ষ নয়, সে হয়তো জ্ঞান বা শিক্ষার দিক থেকে পিছিয়ে। বিশেষ করে ইংরেজির প্রতি সমাজের একটি ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয়েছে। অনেকেই মনে করেন যে, ইংরেজিতে দক্ষতা থাকলেই কেউ স্মার্ট, আধুনিক বা শিক্ষিত।
বিশেষত আমাদের দেশের মতো সমাজে ইংরেজি আজ সামাজিক অবস্থানের প্রতীক হয়ে উঠেছে। এমনকি শিক্ষিত সমাজেও ইংরেজি বলা এবং যোগাযোগ দক্ষতাকে এক করে দেখা হয়। ফলে যারা ইংরেজিতে সাবলীল নন, তাদের নিয়ে উপহাস করা হয়।
 অথচ যোগাযোগ দক্ষতা মানেই ইংরেজি জানা নয়—একজন মানুষ কতটা স্পষ্টভাবে তার ভাবনা প্রকাশ করতে পারছে, সেটাই আসল কথা, সেটা যে ভাষাতেই হোক না কেন। ইংরেজিতে কথা বলতে না পারলেই কাউকে অশিক্ষিত বা অনাধুনিক বলে ভাবা ভুল ধারণা।

🍂

একজন শিক্ষক হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা থেকে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা অবশ্যই তার মাতৃভাষাতে হওয়া উচিত। শিশুর মানসিক বিকাশের প্রথম কয়েকটি বছর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং এই সময়ে সে যে ভাষায় সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, সেটাই তার শেখার জন্য উপযোগী। মাতৃভাষা হলো চিন্তাভাবনা, আবেগ প্রকাশ এবং সামাজিক মেলবন্ধনের মূলভিত্তি। এটি সেই মাধ্যম যার মাধ্যমে একটি শিশু প্রথম পৃথিবীকে বুঝতে শেখে, তাই তার সামগ্রিক মানসিক ও আবেগগত বৃদ্ধির জন্য এটি অপরিহার্য।

ভাষা দিবসে আমার লেখা একটি গল্প, "মাতৃভাষার টানে" তে আমি দেখানোর চেষ্টা করেছি কিভাবে একটি শিশু, যখন তার পরিচিত ভাষা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, তখন সে নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে অসুবিধা বোধ করে। অচেনা ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করতে না পারার ফলে তার মধ্যে মানসিক চাপ তৈরি হয়, যা ধীরে ধীরে তার স্বাভাবিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। এটি বাস্তব জীবনের এক কঠিন সত্য, যা অনেক শিশু প্রতিনিয়ত অনুভব করে, যখন তাদের এমন ভাষায় শিক্ষা নিতে বাধ্য করা হয়, যা তাদের কাছে স্বাভাবিক নয়। আমরা যদি বুঝতে পারি যে মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ কোনোভাবেই শিশুর অগ্রগতিতে বাধা নয়, বরং এটি তার ভিত্তিকে শক্তিশালী করে তোলে, তাহলে আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারবো।

একটি উন্নত, সহিষ্ণু এবং সৌহার্দ্যময় সমাজ গঠনের জন্য আমাদের ভাষার প্রতি আরও উদার দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা জরুরি। প্রতিটি ভাষার নিজস্ব সৌন্দর্য, ইতিহাস ও গুরুত্ব রয়েছে। ভাষার মধ্যে শ্রেণিবিভাগ তৈরি না করে আমাদের উচিত ভাষার বৈচিত্র্যকে উদযাপন করা এবং সকল ভাষার প্রতি সমান শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা দেখানো। ভাষা কখনো মানুষের অগ্রগতির বাধা হওয়া উচিত নয়; বরং এটি হওয়া উচিত এক সেতু, যা মানুষকে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত করে।

আমরা যদি এই মানসিকতা গড়ে তুলতে পারি, তাহলে এমন এক সমাজ তৈরি হবে যেখানে কাউকে তার ভাষার জন্য বিচার করা হবে না, যেখানে প্রতিটি শিশু নিজের স্বাভাবিক ভাষায় শেখার সুযোগ পাবে, এবং যেখানে যোগাযোগ দক্ষতাকে ভাষার ঊর্ধ্বে রাখা হবে। তবেই আমরা একটি সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক বিশ্ব গড়তে পারবো, যেখানে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বোঝাপড়ার মাধ্যমে সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটবে। 

Post a Comment

0 Comments