হৈমন্তিক
শর্মিষ্ঠা সেন
এ সময়টা বড় অদ্ভুত, এই পুজোর পরের সময়টুকু। ভোরের দিকে শিরশিরানি হাওয়া, দুপুরে ঝকঝকে হলদে রোদ্দুর, আর ঝপ করে নেমে আসা সন্ধ্যা যেন সাজ খুলে ফেলা মন্ডপ, বড় রাস্তার মোড়ে বাঁশের তোরণের সাথে সাজুয্য রেখে খামখেয়ালী উদাসী।
এসময় বার বার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে পুজোর দিনগুলোয়, মেয়েবেলায়, যখন অফুরন্ত খুশির ভান্ডারে উপচানো দিন ছিল।
স্মৃতি সতত সুখের, হাসি কান্নার মাঝে শুধু হাসি টুকু ছেঁকে রেখে দিতে জানে; তাই সকালবেলায় জানালার গ্রিল এ বসা চঞ্চল ঘুঘুর ডাক, নিস্তব্ধ দুপুরবেলায় রাস্তা দিয়ে দ্রুত চলে যাওয়া বাইসাইকেলের ঘন্টির আওয়াজ, ক্লান্ত হয়ে ডেকে যাওয়া কোয়ালিটি আইসক্রিমের ফেরিওয়ালা, হঠাৎ বেভুলে ঘরে ঢুকে পড়া বোলতা অনায়াসে ‘সময় ভ্রমণ’ করিয়ে আনে।
🍂
আমাদের বাড়ি ছিল মহানন্দা নদীর পাড়ে। বাড়ি থেকে সাত মিনিট বা দশ মিনিট। নদী এখানে পলি, নুড়ি পাথরের ভারে শান্ত। তাই সন্নিহিত অঞ্চলের মাটি গাছপালায় সবুজ। অন্তত আমার ছোটবেলায় তাই-ই ছিল। সেসময় বাড়ি ভর্তি গাছ। আম, কাঁঠাল, নোনা, নারকেল, সুপুরি, পেয়ারা, জলপাই, কলা, লেবু এবং রকমারী ফুলের গাছ। আমাদের আড়াই কামরার ছোট্ট কাঠের বাড়িতে গাছেদের মাঝে থাকা। তো, আমাদের ছোট আমগাছটায় মাঝে মাঝে মৌমাছি/বোলতা বাসা করতো। নীচে দাঁড়িয়ে দেখতাম কি সুন্দর জ্যামিতিক বাসা তৈরী করতো তারা! বাবা বলতেন ‘বল্লার চাক’। বাবা একেবারেই পশুপ্রেমী ছিলেন না। সাপ দেখলেই মারতেন। ইঁদুর, ছুঁচো অবশ্য মারবারই কথা, ঘরে উৎপাত করতো প্রচুর। চড়ুই এর বাসা ভাঙা(ছানা পোনা বড় হয়ে যাবার পর), কাকের বাসা ভাঙা, উইএর ঢিপি তে কেরোসিন দেওয়া, কুকুর বেড়াল দেখলেই বকা ঝকা দেওয়া এসব…বাবা নেই অথচ এত বছর পরে এখন নতুন বাড়ির বারান্দায় চড়ুইএর জন্য ছোট্ট দোতলা কাঠের ঘর আছে, ছাদের ঘরে পায়রার সন্মেলনে হয় সকাল দুপুর, উই আছে ইতিউতি। এখন পাশের বাড়ির জেনি মায়ের কাছে আসে, মা পুজো দিলে চুপটি করে মেঝেতে নাক ঠেকিয়ে শুয়ে থাকে, দুবেলা বিস্কুট খেয়ে তবে খুশি হয়ে বাড়ি যায়, আগের মতো ছুঁচোর চিকচিক আওয়াজ এখনও উঠোন থেকে পাই…কিন্তু আজ একথা বলতে আসিনি, এসেছি সুর, রং এবং গন্ধ কিভাবে মস্তিষ্কের আলাদা আলাদা প্রকোষ্ঠ খুলে দেয় সেটা বলতে।
বাইরে গান বাজছে। পোস্ট কালীপুজো সেলিব্রেশন। সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া হবে পাশের পাড়ায়। সেখানেই বোধহয়। পুরোনো দিনের গান। পুরোনো মানে সেই বাবার আমলের। সাদা-কালো। ‘তুঝে জীবন কে ডোর সে বান্ধ লিয়া হ্যায়’, ‘ইয়ে নয়ন ডরে ডরে’। বাবার হাতের বালাটার কথা অনেক দিন ভাবিনি। নিয়ে এসেছিলাম হাতে পরবো বলে। তারপর কোথায় রেখেছি মনে নেই। বাবার ঘড়িটা রাখা আছে। বন্ধ হয়ে থাকে। নষ্ট হয়ে গেছে বোধহয়। বাবার ক্যামেরাটা। সাদা-কালো ছবি উঠতো। এমনিতে সাদামাটা বাবা শখ লালন করেছিলেন কিছু। ছবি তুলতেন প্রচুর। হাল-বলদ নিয়ে ছবিটা কি অসম্ভব সুন্দর! ‘মাথাল’ অর্থাৎ চোঙা টুপি মাথায় দিয়ে বাবা জমিতে দাঁড়ানো। প্যান্ট -শার্ট পরা। ছবিটা সম্ভবতঃ বাবা চাকরি পাওয়ার পর তোলা। আরো কত! কবে দার্জিলিং গিয়েছিলেন তার ছবি, মামাতো ভাইয়ের স্যুট টাই পরে কেত নিয়ে ছবি, এক মানুষ লম্বা মানকচু গাছের বিশাল বিশাল পাতার পাশে দাঁড়ানো কাকাদের ছবি, টোপর(?) পরা মায়ের ছবি, ঠাকুরদাদার কোলে আমি, মায়ের সাথে চিড়িয়াখানায়….এসব ভুলে গিয়েছিলাম, আজ গান শুনে ছবি গুলো নাচতে নাচতে চোখের সামনে এসে মনে করিয়ে দিল আমার না দেখা সময়গুলোর কথা।
বাজারে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ কখনো নাকে আসে ধনে গুঁড়োর গন্ধ। পৌঁছে যাই আমার দাদুর বাড়ি, নবদ্বীপ পোড়ামাতলায়। চোখ বন্ধ করে কেউ নিয়ে গেলেও বাজারের ভেতরে ফল-সবজি আর গুঁড়ো মশলার গন্ধে ঠিক জেনে যাবো এবার ঠিক ঠিকানায় এসে গেছি। শংকরের একটা বই পড়েছিলাম, ‘এক ব্যাগ শংকর’, সেখানে দুষ্টু লোকেরা কলকাতার গন্ধ ম্যাপ তৈরি করছিল। যাঁরা নিত্য যাতায়াত করেন তাঁরা জানেন বাতাসে ধোঁয়ার গন্ধ, চায়ের দোকানে দু ফুট, তিন ফুটের দুধ চায়ের গন্ধ, রেল স্টেশনে সেঁকা পাউরুটি-অমলেটের গন্ধ, ছানার জল পড়ে কামরা সুদ্ধ টক টক গন্ধ…এখন মিষ্টির দোকানের পেছনে দিকে যেখানে কারিগর মিঠাই তৈরি করে সেখানেও ঐ টকটক গন্ধ পাই আর মনে পড়ে তিরিশ বছর খানেক আগে বাবার সাথে লোকালে শিয়ালদহ যাওয়ার আবছা ছবি, যেখানে মাথার ওপর সার দিয়ে সাদা কাপড়ে নাদা করে রাখা ছিল ছানা, টপটপ করে জল পড়ে কামরা ভেসে যাচ্ছিল আর যাত্রীরা নির্বিকার হয়ে হাসি ঠাট্টা গল্পে জমে ছিল কেমন! এখন ভাবি, আমরা কি আদৌ সাধারণ কামরায় উঠেছিলাম? কি জানি!
বাতাসে মিশে থাকা ধোঁয়া ধূলোর গন্ধ মনে পড়ায় কতকিছু! রাজ্যের সব বাসস্ট্যান্ড! ধূলো আর ধাক্কা খেতে খেতে সুপার বাস এ কুসুমগ্রাম থেকে বর্ধমান যাওয়া…পাউডারের মতো মিহিন ধূলো উড়িয়ে মা, মামা আর দিদার সাথে গ্রামের বাড়ি যাওয়া…এখন লিখতে লিখতে নিজের মনেই হাসছি। মামাবাড়ি পৌঁছে যখন দিদার ছোট আয়নায় মুখ দেখতাম তখন মাথার ওপরেও পাতলা ধূলোর স্তর পড়ে যেত যেন। মনে আছে একবার শিশিতে ভরে সেই ধূলো নিয়ে এসেছিলাম বাড়িতে, মামাবাড়ির ধূলো। কিছু জিনিস মাস্ট ছিল। মামাবাড়ি থেকে নিতেই হবে, সেগুলো হলো পাটকাঠি (ধুয়ে দুধ খেতাম, স্ট্র), এঁটেল মাটি(পুতুল বানিয়ে দিত মা), রয়্যাল(ছোট ছোট টক ফল), সবেদা আর দিদার নস্যির কৌটোর এক কৌটো লঙ্কার গুঁড়ো(তেঁতুল মাখা খাবো বলে)। এসব এক্সক্লুসিভলি আমার নিজের জন্য। আমার মেয়ে তার মামাবাড়ি থেকে কিছুই আনতে চায় না। তার সঅব আছে! আমার এখনো মনে হয় একবার যদি মামাবাড়ি যাই তাহলে একগোছা কচুরিপানা আর কাশফুলের গাছ আনবো!
আবার বড় বেলায় বেদম ধূলো খেতাম উখরায়। সে ধূলোয় আবার কয়লার গুঁড়ো মেশা। প্রথমদিন যখন বাসে চেপে স্কুল জয়েন করতে যাচ্ছি, মনে হচ্ছিল এ কেমন জায়গা! এমন রুখু শুখু! গাছে পাতা নেই, মাঠে ঘাস নেই, পুকুরে জল নেই! মানুষেরা কেমন ধূলো মাখা, দেখে মাথায় ঘুরতো সুকুমার রায়..”মিশিপাখা শিখিপাখা আকাশের কানে কানে/ শিশি বোতল ছিপিঢাকা সরু সরু গানে গানে/ আলাভোলা বাঁকা আলো আধো আধো কতদূরে,/ সরু মোটা সাদা কালো ছলছল ছায়াসুরে।” এই সাদা কালো শহরতলিতে কাটিয়ে ফেলেছিলাম অনেকটা সময়।
তারপর এখন এই ধূসর সময়। পুরাতনের স্মৃতি ভারে ন্যুব্জ এবং ভবিষ্যতের আশঙ্কায় চিন্তিত। ধূসর চিরকাল না-পসন্দ! আমার রং লাল। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ আর সাদা। মনের মাঝে অবিরাম ভেসে যাওয়া ছবি দিনরাত চলে সাদা ক্যানভাসে। কিছু স্মৃতি মুছে ফেলতে হয়, কিছু রেখে দিতে হয় গভীরে। এসব নিয়ে এগিয়ে চলা, দশক পুরোলে আবার যদি কেউ শুনতে চায় তাই গুছিয়ে রাখা রোজকার রূপকথা।
0 Comments