দূর দেশের লোকগল্প— ২৩১
তিব্বত (এশিয়া)
দুই পড়শির দুই কর্মফল
চিন্ময় দাশ
দুটো লোক বাস কর এক গ্রামে। একেবারে পাশাপাশি বাড়ি দু’জনের। মনে হবে, যেন গায়ে গা-লাগানো দুটি ভাই তারা।
কিন্তু মনে হলে কী হবে। ভাই তো নয়ই, কোন রকম মিলও নাই দুজনের। একজন বেশ বড়লোক, অন্যজন বেশ গরীব। বড়লোকটির নাম ৎসেরিং। গরীবটির নাম চামবা।
ৎসেরিং হোল অহঙ্কারি, বদমেজাজি আর হাড়কেপ্পন। অন্যদিকে চামবা হোল স্বভাবে শান্ত, মাথা ঠাণ্ডা আর দয়ালু। নিজে গরীব, তাহলেও, সাধ্যমত সাহায্য করে অন্যকে।
হয়েছে কী, দুটো চড়ুই পাখি বাসা বানিয়েছে দুজনের বাড়িতে। ঘরে ঢুকবার দরজার মাথার উপর বাসা তাদের। দুটো বাসাতেই বাচ্চা হয় পাখিদের। দেখতে দেখতে উড়তে শিখল বাচ্চারা। এবার মা-পাখিরা বেরুতে লাগল খাবারের জোগাড় করতে।
একদিন একটা ঘটনা ঘটল চামবার বাড়িতে। মা-পাখি বেরিয়ে গেছে বাসা থেকে। বাচ্চাটা উড়তে গিয়েছিল। পারেনি, নীচে পড়ে গেছে।
চামবা বেরিয়ে গিয়েছিল কাজে। সে ঘরে ফিরে দেখল, একটা বাচ্চা ছটফট করছে মাটিতে পড়ে। আলতো করে তুলে নিয়েছে বাচ্চাটাকে।
হাতে নিতেই চোখে পড়ল, একটা পা ভেঙে গেছে বাচ্চাটার। আহারে, বাছা। ভারি কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়। তাড়াতাড়ি পাতা থেঁতলে, রস লাগাল পাখির পায়ে। তুলো দিয়ে মুড়ে, যত্ন করে বেঁধে দিল পা-টাকে। সাবধানে বাসায় রেখে এলো বাচ্চাটাকে।
দেখতে দেখতে বড় হোল বাচ্চা। পা সেরে গিয়েছে তার। ডানাও শক্ত হয়েছে। উড়তেও পারে ভালো করেই। মা-পাখির সঙ্গে একদিন চলে গেল বাসা ছেড়ে।
কিছু দিন গিয়েছে। চামবা ভুলেই গিয়েছে ঘটনাটা। পাখি কিন্তু ভোলেনি গরীব মানুষটার উপকারের কথা। এই দয়ালু মানুষটার জন্য জীবন ফিরে পেয়েছে সে।
একদিন কাজ থেকে ফিরেছে চামবা। দাওয়ায় বসে আছে অলস ভাবে। হঠাৎ একটা চড়ুই পাখি এসে বসে পড়ল তার সামনে টায়। একটা জলজ্যান্ত মানুষ বসে আছে, গ্রাহ্যই করল না।
কয়েক দানা বীজ এনেছিল ঠোঁটে করে। মেঝেতে ফেলে দিয়ে, কিচির মিচির করে পাখি বলল—তোমার উপকারের কথা ভুলিনি আমি। বীজগুলো দিয়ে গেলাম। পুঁতে দাও যত্ন করে। তার পর দেখবে, কী ফল হয়। কপাল ফিরে যাবে তোমার।
কথা শুনে, খানিক অবাকই হয়েছে চামবা। অবহেলা করল না। উঠোনের এক কোণে যত্ন করে পুঁতে দিল বীজ গুলো।
দেখতে দেখতে একদিন চারা গজিয়ে উঠল। পাতা ছেড়ে বড়ও হতে লাগল গাছগুলো। তার পর যা হয়। কুঁড়ি এল। ফুল ফুটল। গুটি ধরল ফুল ঝরে গিয়ে। চামবা সব নজর রাখছে।
ফলগুলো পেকে উঠল যখন, একটা একটা করে তুলে আনল ঘরে। গরীব মানষ সে। চাষবাস করে পেট চালাতে হয় তাকে। কিন্তু এমন ফসল দেখেনি সারা জীবনে। ভারি কৌতুহল হয়েছে মনে। কী এমন জিনিষ পাখি দিয়ে গেল!
ফলের খোসা ছাড়ানো শুরু করল যেই, চামবা একেবারে হতভম্ব। পড়ল যেন আকাশ থেকে। এ কী দেখছে চোখের সামনে। একটা করে বীজের খোসা ছাড়াছে। দানা দানা মণি-মুক্তো বেরিয়ে আসছে ভেতর থেকে।
মুখে কথা সরে না মানুষটার। বিশ্বাসই করতে পারছে না কিছুতেই। মন বলল—আরে বেকুব, পাখি নয়। এত দিনে স্বয়ং ভগবান বুদ্ধ মুখ তুলে চেয়েছেন তোর দিকে। কপাল খুলে গেল তো। বাকি দিনগুলো আর দুঃখ রইল না তোর।
হাত জড়ো করে ভগবান বুদ্ধঠাকুরকে প্রণাম করল একটা। কাউকে কিছু বলল না। পুঁটলি বেঁধে, বাজারের দিকে রওণা দিল চামবা। ভালো মতন দাম দিয়ে কিনেও নিল জহুরী। এমন সাচ্চা জিনিষ খুব কম পাওয়া যায়।
হাতে অনেক ইউয়ান (টাকা)। বিশাল বাড়ি বানাল চামবা। জমিজমা কিনল অনেক। বড় এক পাল ভেড়া আনল। আট-দশটা লোক লাগল কাজকর্মের জন্য। এলাহি ব্যাপার এখন চামবার জীবনে।
ৎসেরিং তো পাশেই থাকে একেবারে গা লাগিয়ে। সে তো দেখছে আর ট্যারা হয়ে যাচ্ছে একেবারে। ব্যাপারখানা কী, বুঝতেই পারছে না। এ কেমন ভোজবাজি। কোথা থেকে এতসম্পদ হোল হতভাগার?
চোখের সামনে এমন ভোজবাজি কত দিন চুপ করে বসে দেখা যায়। থাকতে না পেরে, একদিন চামবার কাছে এসে হাজির হয়ে গেল। মুখে মিষ্টি হাসি। যা জীবনে দেখেনি কেউ। বলল—কী গো, ব্যাপারটা কী ভাই? টাকার খনি পেলে কোথা থেকে?
পড়শির মুখে এমন মিষ্টি কথা? জীবনে এই প্রথম শুনল চামবা। এত দিন গরীব বলে, হতচ্ছেদ্দাই করে এসেছে লোকটা। আজ একেবারে ঘরে এসে হাজির।
তবে কি না, চামবা মানুষটা স্বভাবে সহজ সরল। মনে কোন কু নাই তার। অবিশ্বাস নাই। সরল মনে নিজের ঘটনাগুলি সব বলে গেল এক এক করে।
শুনছে আর চোখে মুখে আলো ফুটে উঠছে ৎসেরিংয়ের। এত সহজ ব্যাপার, ভাবতেই পারছে না সে। ফূর্তি যেন ধরে না মনে। নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরে এল।
বাড়ি ফিরেই কাজে লেগে গেল। কাজ বলতে আর কী? চড়ুই পাখি। এত দিন ফিরেও তাকায়নি একটি বারও। আজ খোঁজ শুরু করে দিয়েছে একেবারে।
কপাল ভালোই বলতে হবে ৎসেরিংয়ের। একটা বাচ্চাও চোখে পড়ল বাসায়। মা পাখিটা নাই তখন। খাবার টেবিল থেকে দুটো চপ-স্টিক নিয়ে এলো। তাই দিয়ে বাচ্চাটাকে তুলেছে বাসা থেকে। তার পর? তার পর আর কী? থপ করে নীচে ফেলে দিয়েছে।
যা হবার তাই হয়েছে। একটা পা ভেঙে গেছে বাচ্চাটার। এর পরে কী করণীয়, সেটা তো জেনেই এসেছে পড়শির কাছ থেকে। হেলাফেলা করে ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো দিয়ে ভাঙা পা বেঁধে, আবার গিয়ে বাসায় রেখে দিল পাখিটাকে।
বিড়বিড় করে বলতে লাগল—দেখিস বাপু, ভুলে যাস না যেন। কত যত্ন করে পা বেঁধে দিলাম তোর। রেখেও গেলাম বাসায় এনে। প্রতিদানটা ঠিকঠাক দিবি কিন্তু।
দিন গেল তার পরে। বড় হোল পাখির বাচ্চাটা। ডানা মেলে উড়েও গেল এক দিন। ৎসেরিংয়ের যেন দিন কাটে না এখন। কেবলই অপেক্ষা, কখন পাখিটা আসবে কয়েকটা দানা নিয়ে।
অপেক্ষা লম্বা হোল না। দিন কয় না যেতেই, একটা চড়ুই এসে হাজির তার সামনে। আনন্দে লাফাতে লাগল লোকটা। বলল—যাক বাবা, ভুলে যাসনি তাহলে।
--কী যে বলো না তুমি, তার নাই ঠিক। পাখি বলল--তোমার সেবা কি ভোলা যায়? এই নাও কয়েকটা বীজ। ছড়িয়ে দাও খেতে। হাতে হাতেই ফল পেয়ে যাবে। সারা জীবন মনে থাকবে তোমার।
খুশি ধরে না ৎসেরিংয়ের—হ্যাঁরে, হ্যাঁ। দেবো ছড়িয়ে।
পাখি বলল—না, মানে, বড়লোক তুমি। আয়েসি মানুষ। বীজ বোনা কি তোমার কাজ? শোন, মেহনত করতে হবে না তোমাকে, হেলাফেলা করেই না হয় ছড়িয়ে দিও।
পাখি উড়ে গেল ফুড়ুৎ করে। ৎসেরিংও কাজে লেগে গেল।
ভারি যত্ন করে বীজ বুনেছে। সময় মতো চারাও গজিয়েছে। ৎসেরিং অধৈর্য হয়ে উঠছে কবে ফল আসবে হাতে।
গুণে দেখেছে দশটা গাছ। চিনতেও অসুবিধা হয়নি, বার্লি গাছ।ফসল পেকে উঠল যখন, মনে খুব আশা নিয়ে ঘরে তুলে এনেছে। এগুলো থেকেই বেরোবে মণিমুক্তো। আরও বড়লোক হয়ে যাবো আমি।
একটা দানা ভেঙেছে সবে। অমনি এক অবাক কাণ্ড। কোথায় মণিমুক্তো, কোথায় কী? সামনে একটা মুশকো লোক। একগোছা কাগজ তার মুঠোয় ধরা।
ৎসেরিং তো পড়েছে আকাশ থেকে। ঘাবড়েও গেছে বেশ। এটা কী হোল? তোতলা গলায় বলল—তুমি কে? এখানে কেন?
--সে কী? ছোটবেলার বন্ধুকে চিনতে পারছ না? লোকটা বলল হেসে হেসে।
--আমার ছোটবেলার বন্ধু? কী গল্প শোনাতে এসেছ?
--গল্পটাই বলি তা হলে। লোকটা শুরু করল—নদীতে চুবিয়ে মেরেছিলে নিজের বন্ধুকে। ভুলে গেলে সব কথা? ব্যবসা করবে, টাকা দরকার পড়েছিল। বাড়িঘর বাঁধা রেখে টাকা নিয়েছিলে আমার থেকে। টাকা চাইতে গেলাম। নদীতে চুবিয়ে চুবিয়ে মেরেছিলে আমাকে। এবার মনে পড়েছে নিশ্চয়। এই তো সবে পঁচিশ বছর হোল। ভুলে যাওয়ার কথা নয়, বন্ধু।
বেমালুম ঘাবড়ে গেছে ৎসেরিং। অস্বীকার করবার উপায় নাই। এই কুকর্মটি সে করেছিল। গুণে গুণে ঠিক ২৫ বছরই হয়েছে সেদিনের পর। সেসময় দুজনের বয়সও ছিল ঐ বছর পঁচিশেক। মুখে কথা জোগাচ্ছে না তার।
লোকটা অধৈর্য হয়ে উঠেছে। খেঁকিয়ে উঠল—চুপ করে থাকলে কি রেহাই পাবে ভেবেছ? সে পাত্র আমি নয়। টাকা ফেলো আমার।
ৎসেরিং বলল—এক সাথে এতো টাকা এক্ষুণি আমি পাবো কোথায়?
--সেটা তোমার ভাবনা। আমার নয়। তবে, সব ব্যবস্থা করেই এনেছি আমি। এই হোল তোমার দলিলপত্র। যা রেখে টাকা নিয়েছিলে। লেখাপড়া তো করাই আছে এতে। এখন কেবল বুড়ো আঙ্গুলটা একবার চেপে দাও। কাজ খতম। তোমার দলিলপত্তরও সব হজম।
হা-হা করে হেসে উঠল লোকটা। আকাশ ফাটানো সে হাসি। ঘরবাড়ি গাছপালা সব কেঁপে উঠল থরথর করে।
আর ৎসেরিং? তার বুকের ধুকপুকানি থেমে যাওয়ার জোগাড়। একেবারে পথের ভিখিরি হয়ে যাচ্ছে সে। কান্না ঠেলে আসছে গলায়। কোন রকমে বলল— ভগবানের দোহাই, দয়া কর আমাকে।
--দয়ার যোগ্য মানুষ তুমি? পাখিটাকে দয়া দেখিয়েছিলে? বাচ্চা একটা পাখি। মণিমুক্তোর লোভে, আছড়ে ঠ্যাঙ ভেঙে দিয়েছিলে পাখিটার। সে পাপের ফল এবার ভুগতে হবে তোমাকে সারা জীবন ধরে।
কী আর করে? দলিলে টিপছাপ লাগিয়ে দিল ৎসেরিং। ঘাড় ধাক্কা মেরে, তাকে একেবারে রাস্তায় বের দিল লোকটা। ৎসেরিং ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল—হায়, হায়! আমি খাব কী? দু-মুঠো মুখে তুলব কী করে।
ততক্ষণে ৎসেরিংয়ের দাওয়ায় উঠে পড়েছে লোকটা। এই পেল্লায় বাড়ি, তার সব জমিজিরেত, গরুভেড়া, কাজের লোকজন সব, সব এখন তার। মুখ ফিরিয়ে বলল—পেট চালাবার ভাবনা কিসের? অনেক ভেড়া আছে এ বাড়িতে। কাজে লেগে যাও। ভেড়া চরানোর কাজ তেমন ভারি নয়। দু’বেলা পেট ভরে খেতে দেবো তোমাকে।
হাসতে হাসতে ঘরের দখল নিয়ে, ভেতরে ঢুকে প্রল লোকটা।
0 Comments