মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৭০
আমিনুল ইসলাম (গবেষক, লেখক, হলদিয়া)
ভাস্করব্রত পতি
উনিশ শতকের বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের জাতীয়তাবোধ ও জাতীয়তাবাদ এবং সমকালীন সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি, ইতিহাসের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তুলে ধরেছেন তাঁর লেখা 'বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও জাতীয়তাবাদ' শীর্ষক বইতে। মেদিনীপুরের প্রান্তশহর হলদিয়ার বসে দীর্ঘদিন ধরে যে নিবিড় গবেষণা এবং সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসচর্চা করে চলেছেন আমিনুল ইসলাম, তা এককথায় অনবদ্য। প্রশংসনীয়। বাঙালি মুসলিমদের অসংখ্য বীরত্বসূচক অজানা কাহিনি উঠে এসেছে তাঁর কলমে। অনেক ভ্রান্ত ধারণার অবসান করেছেন তথ্য দিয়ে। অনেক অনালোচিত কাহিনি লিপিবদ্ধ করেছেন নিবিড় গবেষণার মাধ্যমে। অনেক অনালোকিত ব্যক্তিত্বকে আলোয় এনেছেন সুচারু ক্ষেত্রসমীক্ষা এবং ইতিহাসপ্রাণ হৃদয় দিয়ে। ভারতের অসংখ্য অজানা তথ্য এবং তার যথোপযুক্ত বিশ্লেষণ তিনি করেছেন তাঁর নিরলস প্রচেষ্টা ও অনুসন্ধিৎসু মননের উপহার হিসেবে।
আসলে তিনি সত্যানুসন্ধানে বিশ্বাসী। খোলা চোখের দৃষ্টি দিয়ে জাগতিক সবকিছু বিচার এবং বিশ্লেষণ করে সেসব কলমের আঁচড়ে সাদা কাগজে রেখাপাত করতে বিশ্বাসী মেদিনীপুরের এই বলীষ্ঠ লেখক এবং গবেষক। তিনি বিশ্বাস করেন, সমাজকে বাদ দিয়ে কখনো সাহিত্য করা সম্ভব নয়। সেজন্যই পৃথিবীজুড়ে বারংবার দেখা গিয়েছে সমাজ বদলের জন্য সাহিত্যকে হাতিয়ার করার সুনিপুণ প্রয়াস লেখকদের। আমিনুল ইসলামের কথায়, "আমার কলমও বলতে পারেন সেই লক্ষেই অগ্রসর হয়েছে। আসলে গতানুগতিক সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চায় আমি বিশ্বাসী নই। সমাজকে বা সাহিত্য পাঠকদের আমি সবসময় সঠিক তথ্যের আলোকে ইতিবাচক রচনা উপহার দেওয়ার পক্ষপাতী।"
আমিনুল ইসলামের লেখা গ্রন্থ
১৯৭০ এর ৬ ই জানুয়ারি হলদিয়ার ঢেকুয়াতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা ছিলেন মোহাম্মদ আবদুস সালাম ও মা আনোয়ারা খাতুন। বাবা মহিষাদল রাজ হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন। তিনিও লেখালেখি করতেন। একসময় স্কুলের ম্যাগাজিনে বাবার লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ তাঁকে খুব অনুপ্রাণিত করে। সেই প্রবন্ধটি ছিল 'আমি তোমাদেরই লোক'। আমিনুল ইসলামের দাদু মোহাম্মদ ইসহাকও ছিলেন বাংলা ও ফারসি ভাষার পণ্ডিত। তিনি বাংলা ও ফারসিতে সুন্দর কবিতা লিখতেন। দুই কাকাই ছিলেন সুপ্রতিষ্ঠিত। মেজকাকা মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক ছিলেন হুগলি জেলার ফুরফুরায় ইংরেজি ভাষার শিক্ষক। তিনি পরিচিত ছিলেন 'মাস্টার সাহেব' নামে। শিক্ষা সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক বড়কাকা মোহাম্মদ আবদুল লতিফ ছিলেন ভূমি রাজস্ব দপ্তরের আধিকারিক। সংস্কৃতিচর্চার একটা পরিবেশ জন্মসূত্রে বাল্যকাল হতেই পেয়েছেন। বর্তমানে তিনি হলদিয়ার HIT তে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার। ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি থাকলেও বাংলা ভাষা সাহিত্যে তাঁর দখল ঈর্ষনীয়। বহুদিন ধরেই লেখালেখির সাথে যুক্ত। তাঁর সাহিত্যচর্চা ও গবেষণার বিষয় ইতিহাসাশ্রিত হলেও সাহিত্য সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাবলীল ও অনায়াস বিচরণ তাঁকে ব্যতিক্রমী লেখক করে তুলেছে। নানা বিষয়ের উপর তাঁর বিশ্লেষণধর্মী রচনা দেশ বিদেশের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য পত্রপত্রিকায় ও জার্নালে নিয়মিত প্রকাশিত হয়। প্রতিটি লেখাই উচ্চমার্গের। তমালিকা পণ্ডাশেঠ সম্পাদিত 'আপনজন' সাময়িকপত্রে সাংবাদিকতার মাধ্যমে পেশাগত জীবনের সূচনা হয়েছিল তাঁর। আজ তিনি জেলা তথা রাজ্যের এক অন্যতম প্রতিষ্ঠীত লেখক ও গবেষক। এই মুহূর্তে তিনি 'হলদিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি'র অন্যতম আধিকারিক পদে কর্মরত। মেদিনীপুরের এই জনপ্রিয় 'মানুষ রতন' লেখকটির এ পর্যন্ত ২৮ টি গবেষণাধর্মী গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। পাঠকসমাজে তাঁর প্রতিটি গ্রন্থই নতুন দিশা, নতুন তথ্য এবং নতুন ভাবনার জাগরণ করে। নতুন চিন্তার উদ্রেক করে। বিদ্যসমাজে সেসব যথেষ্ট প্রশংসিত হয়েছে বারবার।
আমিনুল ইসলামের গবেষণামূলক বিভিন্ন গ্রন্থগুলি হ'ল -- ক্ষান্ত করো অনৃত ভাষণ (ল্যকেটু, ২০০৫), সেইসব ইতিহাস (পত্রলেখা, ২০০৬), বাংলা সাহিত্য : জাতীয়তা ও সাম্প্রদায়িকতা (লেখা প্রকাশনী, ২০০৮ ও ২০১৫), বঙ্কিমচন্দ্রের মুসলমানচর্চা (নিউ লেখা প্রকাশনী, ২০১২), রবীন্দ্রনাথের মুসলমানচর্চা (দীপ প্রকাশন, ২০১২), বাংলা সাহিত্যে মুসলিম ঔপন্যাসিক ১৮৬৯ - ২০১৩ (পত্রলেখা, ২০১৫), হাজার বছরের বাংলার মুসলমান (এডুকেশন ফোরাম, ২০১৫ ও ২০১৯), বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও জাতীয়তাবাদ (দিব্যপ্রকাশ, ২০১৬, ঢাকা), ভারতবর্ষের ইতিহাস : রাষ্ট্র ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা (এডুকেশন ফোরাম, ২০১৮), নবজাগরণে বাংলার মুসলিম নারী (এডুকেশন ফোরাম, ২০১৮), বিবেকানন্দ, ইসলাম ও সমকালীন জাতীয়তাবাদ (এডুকেশন ফোরাম, ২০১৮), ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অপ্রকাশিত ইতিহাস (শিখা প্রকাশনী, ২০১৯), ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতি : দ্বিজাতিতত্ত্ব ও দেশভাগ (এডুকেশন ফোরাম, ২০১৯), ভারতীয় মূলধারা ও ধর্মীয় আধিপত্যবাদ (এডুকেশন ফোরাম, ২০২২), মুসলমান ও ভারতীয় সংস্কৃতি (শিখা প্রকাশনী, ২০২৩, ঢাকা), রামমোহন, বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার : পলাশি উত্তর বঙ্গীয় সমাজ ও সংস্কৃতি (এডুকেশন ফোরাম, ২০২৪), জাতীয়তাবাদ : রেনেসাঁ চেতনা বাঙালি মন (এডুকেশন ফোরাম, ২০২৫), নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় : ইতিহাস ধ্বংস ও বৌদ্ধধর্মের পতন (এডুকেশন ফোরাম, ২০২৫), ভারতে সহনশীলতার ইতিহাস (এডুকেশন ফোরাম, ২০২৫), বাংলা সাহিত্যে মুসলমান : সাহিত্যচর্চার আলোকিত অধ্যায় (মল্লিক ব্রাদার্স, ২০২৫), ভারতীয় মুসলমানের মন : মুসলমান ও বর্তমান ভারত (বিশ্ববঙ্গীয় প্রকাশন, ২০২৫), বিলেতে প্রথম ভারতীয় : এহতেশামউদ্দিন ও তাঁর সময় (নিউ লেখা প্রকাশনী, ২০২৫), সাম্প্রতিক ইতিহাসচর্চা : কল্পকথা বনাম বাস্তবতা (সমকালের জিয়নকাঠী, ২০২৫), ইতিহাসচর্চা : সাম্প্রদায়িকতার অভিঘাত (দেশ প্রকাশন, ২০২৫), বাংলা সাহিত্যে মুসলিম মানস : সাধনা ও উত্তরণ, দুই খণ্ড (বাংলার মুখ, ২০২৫), বস্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দ ও মুসলমান সমাজ (শিখা প্রকাশনী, ২০২৫) এবং মুসলিম সম্পাদিত সাময়িকপত্র : হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক (শিখা প্রকাশনী, ২০২৫)।
১৮৩০ সালের ১৯ শে নভেম্বর রাজা রামমোহন রায় খেজুরী বন্দর থেকে 'অ্যালবিয়ন' জাহাজে চেপে বিলেতে গিয়েছিলেন বলে জানা যায়। এরপর ১৮৩১ সালের ৮ ই এপ্রিল ইংল্যান্ডের লিভারপুল শহরে পৌঁছান। এছাড়াও তিনি কয়েক দিনের জন্য গিয়েছিলেন ফ্রান্সে। সেখানে ফরাসি সম্রাট লুই ফিলিপ তাঁকে সম্বর্ধনা জানিয়েছিলেন। কিন্তু আমিনুল ইসলাম তাঁর 'হাজার বছরের বাংলার মুসলমান' বইতে উল্লেখ করেছেন, প্রথম বিলেতযাত্রী বাঙালি হিসেবে রাজা রামমোহন রায়ের নাম বলা যায়না। বরং প্রথম বিলেতযাত্রী বাঙালি হিসেবে জনৈক এহেতেসামুদ্দিনের নাম উল্লেখ করা উচিত। কিন্তু কে ছিলেন তিনি? এই এহেতেসামুদ্দিন ছিলেন নদীয়া জেলার পাঁচনুরের বাসিন্দা। তিনি ১৭৬৫ সালে প্রথম বিলেত গিয়েছিলেন। যা কিনা রাজা রামমোহন রায়ের বিলেতযাত্রার ৬৫ বছর আগেকার ঘটনা। তিনি ফারসি ভাষায় লিখেছিলেন 'শিশুর্ফনামা এ বেলায়েত' নামে একটি কিতাব। যার অর্থ বিলেতের বিস্ময়কর দৃশ্যাবলী। এটি বিলেতে থাকাকালীন ভ্রমণ কাহিনিমূলক একটি গ্রন্থ। ১৮২৭ সালে ক্যাপ্টেন আলেকজান্ডার প্রথম এই বইটির সংক্ষিপ্ত ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। সেসময় তা লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। গবেষক আমিনুল ইসলামের লেখায় প্রকাশিত হয়েছে এক অনুদ্ঘাটিত অজানা অচেনা মানুষের অমিতসুন্দর তথ্য।
নেতাজী সুভাষচন্দ্রকে নিয়ে লেখায় তিনি বিশ্লেষণ করেছেন নেতাজীর উদারমনা, উদাত্তমনা এবং মুক্তমনা হৃদয়ের Vertical এবং Longitudinal ব্যবচ্ছেদ। একজন প্রকৃত সংস্কারমুক্ত মানবের জীবনকাহিনি। তাঁর লেখা 'মহাবিদ্রোহের অজানা কাহিনি' গ্রন্থটি ১৮৫৭ এর সিপাহি বিদ্রোহ তথা মহাবিদ্রোহের উপর লেখা অনালোকিত ও অনালোচিত ইতিবৃত্ত। 'ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অপ্রকাশিত ইতিহাস'তে রয়েছে দেশপ্রেমিক হিন্দু মুসলিম বীর বিপ্লবীদের কথা।
বিগত ৩ দশকের বেশি সময় ধরে দুই বঙ্গের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আমিনুল ইসলামের লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। একসময় চিঠিপত্র লেখালেখি দিয়ে হাতেখড়ি হয়েছিল। আজ বই লিখছেন। হলদিয়া থেকে প্রকাশিত আপনজন পত্রিকা, কালান্তর, দৈনিক স্টেটসম্যান, দৈনিক নববার্তা প্রসঙ্গ (আসাম), সাপ্তাহিক ও দৈনিক কলম, দিনদর্পণ, নতুন গতি, মিযান পত্রিকায় অসংখ্য প্রবন্ধ ফিচার প্রকাশিত হয়েছে। আর লিটল ম্যাগাজিন হিসেবে পরিচয়, অনুষ্টুপ, অমৃতলোক, অনীক, একুশ শতক, নক্ষত্র, ইসক্রা, কবি সম্মেলন, সমকালের জিয়নকাঠি, উদার আকাশ, শব্দের মিছিল, বলাকা, কাটোয়ার কলম, আন্তর্জাতিক পাঠশালা, বর্ণ পরিচয়, সৃষ্টি, নতুন চিঠি, মুক্তকলম, ঐক্য, দীপন, কাঁসাই শিলাই, বাংলার মুখ, প্রতীতি, শৈবভারতী, কৃষ্ণশিস, ল্যাকেটু, আবার এসেছি ফিরে, একালের রক্তকরবী, মাঝি, এবং মুশায়েরা, এবং এই সময়, তবু একলব্য, আলআমিন বার্তা, প্রগতি, কবিওয়ালা, পিনাক, হুগলি সংবাদ, সাফকথা, শতানীক, সন্ধান, অক্ষরকর্মী, বুলবুল, সমাজ ও রাজনীতি, সকলের কথা, স্বরাস্তর, অথচ, আমার রূপসী বাংলা, দশদিশি, গাংচিল, প্রদর্শিকা, পরিযান, নতুন পথ, এই সময়, পথ, শিলীন্ধ্র, দেশকাল সাহিত্য, তিতীর্ষু, তকমিনা, মেঘবল্লরী, দরিয়া, জিরো পয়েন্ট, আলোর সাকিন, কবিতার কাগজ, মাতৃশক্তি, পত্রী, উন্মেষ, বর্ণমালা, অনুরণন (আসাম), অন্য আকাশ, স্মার্টি সাহিত্য পত্রিকা, প্রতিকথা, জলদর্চি, কারুকথা প্রভৃতি লিটল ম্যাগাজিনে গবেষণামূলক লেখা লিখে চলেছেন নিয়মিত। সব মিলিয়ে ৬০০ টির বেশি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। প্রথমবার পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেছিল সাপ্তাহিক কলম পত্রিকা (২০০৬)। এরপর বর্ণপরিচয় সাহিত্য সম্মান (২০১০) ও নতুন গতি সাহিত্য সম্মাননার (২০১৩) প্রাপ্তি বিশেষ স্মৃতিবহ।
গবেষক আমিনুল ইসলাম প্রতিদিনই কিছু না কিছু লেখালেখি করবেনই। আসলে তিনি চাননি লেখার ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ুক। কখনও প্রবন্ধ ও নিবন্ধ লেখেন। কখনও সমালোচনামূলক কোনও লেখার জবাব দিতে তথ্যনীষ্ঠ লেখা লিখতে হয়। আবার জবাবী পত্রও লিখতে হয়। কিন্তু লিখবেনই। তিনি লিখতে চান লুক্কায়িত ইতিহাসের কথা। তিনি লিখতে চান না জানা কথা। তিনি লিখতে চান জনসমাজে প্রচলিত অসত্য মিথের সঠিক বর্ণনা। তিনি লিখতে চান হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা। আসলে তিনি উপলব্ধি করেছেন, বই ছাড়া মানুষের মুক্তি নেই। বইকে তাই না ভালবেসে পারা যায় না। তাঁর কথায়, "মানুষ তো বই থেকে তাঁর পাথেয় সংগ্রহ করে। সুপথযাত্রীরা কোনোদিন বইকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে না। বই তাঁদের জীবনের সাথী। তবে 'নষ্ট বা দুষ্ট' বই থেকে আমাদের সচেতন থাকতে হবে।"
🍂
0 Comments