জ্বলদর্চি

মহাবলী মকরধ্বজ: মহাকাব্যের আত্মজন /মৌ দাশগুপ্ত আদক


মহাবলী মকরধ্বজ: মহাকাব্যের আত্মজন

মৌ দাশগুপ্ত আদক


 রামায়ণ মহাভারতেই নয়, একাধিক পুরাণেও হনুমানের উপস্থিতি পাই আমরা। আমরা জানি, পবনপুত্র হনুমান, অঞ্জনা-কেশরী নন্দন হনুমান, রামভক্ত হনুমান, বালব্রহ্মচারী হনুমান। তাঁর এই বালব্রহ্মচারী রূপের সুবর্ণনা মুলত রামচরিতমানসেই পাওয়া যায়।পরাশর-সংহিতায় কিন্তু হনুমানের বিবাহিত। তেলেঙ্গানার খাম্মামজেলায় সস্ত্রীক হনুমানজির মন্দিরও আছে। রাজস্থানের বেওয়াড়ে, বেত দ্বারকায় আছে হনুমান ও মকরধ্বজ, পিতাপুত্রের যুগলমন্দির। মকরধ্বজ কামদেবের সাথে এনাকে গুলিয়ে ফেলবেন না কেউ, ইনি সম্পুর্ণ আলাদা অস্তিত্ব। 

বাল্মিকীর রামায়ণ বলুন কিংবা ব্যাসদেবের মহাভারত, এমনকি স্কন্দপুরাণ; দেবী মাহাত্ম্যম; শ্রীমধ ভাগবতম্; নারদ পুরাণ, পদ্মপুরাণ, সর্বত্র হনুমানকে ব্রহ্মচারী বলা হয়েছে।অথচ বাংলার কৃত্তিবাসী রামায়ণে আছে হনুমানপুত্র মকরধ্বজের কাহিনী। থাইল্যান্ডের এবং কম্বোডিয়ান রামায়ণে আছে হনুমান-নন্দন মচ্ছানু বা মৎসানুর কথা। ব্যাপারখানা কি? 

রামায়ণের একটি কাহিনী অনুযায়ী, যখন হনুমান লঙ্কাদহন করে সাগরের উপর  দিয়ে ফেরত যাচ্ছিলেন তখন তাঁর দেহ থেকে ঘামের একটি ফোঁটা সাগরে পড়েছিল। সাগরের গভীরে বসবাসকারী মকরকন্যা সেই ঘামের ফোঁটাটি গিলে ফেললে জন্ম নেয় এক অলৌকিক শিশু। বানর ও মকরের সংকর। মকরধ্বজ। আরেকটি গল্প অনুসারে, হনুমান একবার শ্রীরামচন্দ্রের প্রতি তাঁর ভক্তির নিদর্শন হিসেবে সারাশরীরে সিঁদুর লাগিয়েছিলেন। বায়ুদেবতা পবন তখন তাঁর মানসপুত্রকে সাফসুতরো করতে গিয়ে সেই সিঁদুরকণা উড়িয়ে নিয়ে ফেলেন সমুদ্রে। মহাবলীর ঘাম-সিঁদুর মেশা অঙ্গরাগ গিলে ফেলেন এক মৎসকন্যা, এবং এই ঐশ্বরিক মিলন থেকে মকরধ্বজের জন্ম হয়েছিল। দাক্ষিণাত্যের লৌকিক গল্প বলে, মকরধ্বজ ছিলেন সাগরদেবতা বরুণের পুত্র এবং তাঁর জন্ম হয়েছিল এক মকরকন্যার গর্ভে। তিনি মহাবলী হনুমানকে প্রবল শ্রদ্ধা করতেন এবং নিজেকে হনুমানের সন্তানসম জ্ঞানে (শিষ্য সর্বদা গুরুর পুত্রসম, দীক্ষা/শিক্ষাপুত্র) নিজেকে “হনুমানপুত্র” বলতেন। মালয়ালাম কাহিনী বলে, লঙ্কাদহনের পর ক্লান্ত ঘর্মাক্ত হনুমান মহাসাগরে স্নান করেন, সেই ঘামসহ জল গিলে ফেলেন সাগরদেবতা বরুণের বাহন মৎসগর্ভা। মৎসগর্ভার গর্ভসঞ্চারে তাঁর অনাগত সন্তানের পিতৃত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করায় স্ত্রী বারুণি-গৌরীর ভয়ে আসন্নপ্রসবা মৎসগর্ভাকে পাতাললোকে লুকিয়ে রেখে আসেন বরুণদেব। সেই সন্তানই মকরধ্বজ। তেলুগুদের লোককাহিনী বলে, হনুমান যখন তাঁর সন্ধ্যাবন্দনা করার জন্য পাম্বা-নদীর তীরে গিয়েছিলেন, তখন একটি স্ত্রী কুমির (যিনি আসলে একজন অভিশপ্ত জলদেবী) তাঁর ঘামসহ দেহবর্জ্য গিলে ফেলেছিল, যার ফলে তিনি একটি বানর-কুমীর সংকরসন্তানের জন্ম দেন। শিশুটির জন্মের পর জলদেবতা বরুণ তাঁকে দেবী পাতালভৈরবীর আশ্র‍য়ে ছেড়ে আসেন, শিশুটির নাম রাখা হয় "মগধ্বাজ"।
🍂

এতো গেল মকরধ্বজের দৈব জন্মবৃত্তান্ত। ফেরত আসি পরের কথায়। গর্ভিণী মৎসগর্ভাকে জালে বন্দী করেন পাতালরাজ্যের জেলেরা, পেট চিরতেই দেখতে পান মকরধ্বজকে। বানর-মকরের সংকর সেই শিশুর মাতৃদুগ্ধের প্রয়োজন হয়না, উপরন্তু ঐশ্বরিক ক্ষমতাবলে জন্মের পর থেকে সুর্য্যাস্তের মধ্যে তাঁর শৈশবাবস্থা পার করে ফেলেন। এই অলৌকিক শিশুকে নিয়ে জেলেরা তখন পাতালরাজ মহীরাবণের কাছে হাজির হন। রাবণভ্রাতা মহীরাবণ ছিলেন মায়াবী , তন্ত্র-মন্ত্রের অধীশ্বর। তিনি দেখলেন,শিশুটি অর্ধবানর রূপধারী হলেও দেবতুল্য শক্তিধর, এরপর যোগবলে শিশুর পিতৃমাতৃ-পরিচয় জেনে নিলেন তিনি। মকরধ্বজকে নিজের আশ্রয়ে রাখলেন। সময়ের সাথে পাতালরাজ্যের বিভিন্ন অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন মকরধ্বজ। রক্ষসুলভ মায়াবিদ্যা, ভোজবাজিতেও নিপুণ হয়ে ওঠেন। জলরাশিকে নিয়ন্ত্রণ করা ছিল তাঁর জন্মগত বৈশিষ্ট্য।তরুণ মকরধ্বজের বীরবত্তা ও রণনৈপুণ্য দেখে মহীরাবণ প্রথমে তাঁকে অহীরাবণের অঙ্গরক্ষক ও পরে নিজের সেনাপতি বানালেন। 

এদিকে দশরথনন্দন রাম-লক্ষ্মণ বানরসেনা নিয়ে লঙ্কারাজ রাবনের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। রাম-লক্ষ্মণের পরাক্রমে পিছু হটছেন রাবণরাজ। তখন রাবণের আদেশে মহীরাবণ ছল করে রাম-লক্ষ্মণকে অপহরণ করে পাতালে বন্দি করলেন।খবর পেলেন হনুমান, প্রতিজ্ঞা করলেন যে তিনি একাই রাম-লক্ষ্মণকে উদ্ধার করবেন। তাই পাতালের পথে যাত্রা শুরু করলেন। পাতালরাজ্যে তাঁর পথ আটকালেন সেনাপতি মকরধ্বজ।  বললেন—
“পাতালে প্রবেশ করা সহজ নয়। আমি মহীরাবণের সেনাপতি। আগে আমাকে পরাজিত করো, তবেই ঢুকতে পারবে।”

যুদ্ধ শুরু হলো। মকরধ্বজের বজ্রাঘাতের মতো ঘুষি পড়লো হনুমানের বুকে।হনুমানও পাল্টা আঘাত করলেন। দু’জনের লড়াইয়ে পাতালরাজ্য কেঁপে উঠলো, হনুমান জিজ্ঞাসা করলেন—
“বৎস, তুমি কে, পিতার নাম কি?”  
মহীরাবণের মুখে শোনা তাঁর ঘামের ফোঁটা থেকে জন্মের কাহিনীটি জানালেন মকরধ্বজ। হনুমান অবাক হয়ে গেলেন। কিন্তু সেইমুহুর্তে রাম-লক্ষ্মণ উদ্ধারই তাঁর প্রধান লক্ষ্য। তাই তিনি যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন।মকরধ্বজ সর্বশক্তি দিয়ে লড়লেন।একসময় হনুমান তাঁকে দমন করলেন।নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন,
“বিধাতার পরিহাসে তোমার কর্তব্য মহীরাবণের পক্ষে লড়া। আর আমার কর্তব্য রামের পক্ষে থাকা, তাই এই সংঘর্ষ।” 
অনুতপ্ত হলেও পথ ছাড়তে রাজি হলেন না মকরধ্বজ, পুত্রকে নিজের লেজে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়ে পাতালভৈরবী ভদ্রকালীর অনুমতিক্রমে মহীরাবণকে বধ করলেন হনুমান।রাম-লক্ষ্মণকে মুক্ত করলেন। মকরধ্বজের পরিচয় পেয়ে আনন্দিত হলেন রামচন্দ্রও।  বললেন—
“তুমি বীর, তুমি যোগ্য। মহীরাবণ যেহেতু নিহত, তাই পাতালের রাজপদ শূন্য। তুমি-ই হও পাতালের রাজা।” 
মকরধ্বজ সেইদিন থেকে পাতালের অধিপতি হলেন।

থাই রামায়ণে হনুমানের পুত্রকে মচ্ছানু,মাচ্চানু বলা হয়। মচ্ছানু তীব্র রামবিরোধী এবং রাবণের সেনাবাহিনীর অংশ। মচ্ছানু হনুমান এবং সুপন্নমাচ্চের (সুবর্ণমৎস্য) পুত্র ছিলেন। মৎস্যকন্যাদের প্রধান সুপন্নমাচ্চ আসলে রাবণের কন্যা। বরফের মত সাদা হনুমানসদৃশ্য দেহে মাছের লেজ থাকায় সুপন্নমাচ্চ-পুত্রকে বলা হত মৎস্যহানু বা মাচ্চানু। প্রসবের পরপরই দৈবনির্দেশে সুপন্নমাচ্চ তাঁকে সমুদ্রসৈকতে রেখে এসেছিলেন। সেখান থেকে পাতালের রাজা মাইয়ারব তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে পুত্র হিসেবে লালনপালন করেছিলেন। তিনি তাঁকে বদনের (পাতাল) দ্বাররক্ষকের দায়িত্ব দিয়েছিলেন,  যখন মাইয়ারাব ফ্রা-রামকে অপহরণ করে বদনে  নিয়ে যান, তখন তাদের সেখান থেকে উদ্ধার করতে গিয়ে মাচ্চানুর সাথে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েন হনুমান। পিতা-পুত্রের জীবনে প্রথমবারের মত সাক্ষাৎ হয়। হনুমান দ্বন্দ্বযুদ্ধে মাইয়ারাবকে হত্যা করার পর, ফ্রা-রামের আদেশে ভাইয়াভিককে( বিভীষণ) বাদনের শাসনকর্তা হিসেবে নিযুক্ত করা হয় এবং মাচ্চানু তার প্রধান সেনাপতি হন। এরপর থাই-রাবণ তাসকণ্ঠ বা থাতকাসানকে যুদ্ধে হারিয়ে ফ্রা-রাম সিংহাসনে বসলে মাচ্চানু ফ্রা-রামের সাথে দেখা করতে আয়ুথায় আসেন। ফ্রা-রাম মাচ্চানুর লেজ কেটে তাকে নতুন নাম দেন “ফ্রায়া হনুরত” এবং মালিবনের স্বাধীন রাজা নিযুক্ত করেন।মহাবীর চক্রবত এবং রাণী বাচানিশুনের কন্যা সুন্দরী রতনমালিকে বিয়ে করে রূপকথার গল্পের মতই মালিবনে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন কাটান মাচ্চানু। 

 তবে কম্বোডিয়ার রাম-কাহিনীটিতে একটু ভিন্নতা রয়েছে। এখানে মহীরাবণ নন, অহিরাবণ মৎসানুর পালকপিতা।  হনুমান রাম-লক্ষ্মণকে খুঁজতে গিয়ে পাতালে একটি পদ্মফুলে ভরা কাকচক্ষুবর্ণ সরোবর পান। সেই সরোবরের রক্ষক ছিল মৎসানু। কেউ কাউকে রাস্তা ছাড়তে রাজি না হওয়ায় দ্বৈরথ শুরু হয়।তখন আকাশের সোনালী-তারা আকাশবাণী করে, যে, হনুমান যাকে শত্রু ভেবে যুদ্ধ করছেন তিনি রাবণের জলপরী-কন্যা শুভান্নামাচ্চার গর্ভজাত হনুমানপুত্র।  হনুমান তৎক্ষণাৎ মাঝ আকাশে তাঁর দিব্যাস্ত্র সম্বরণ করেন,পিতা-পুত্র একে অপরকে চিনতে পারেন । পিতৃপরিচয় জানার পর রণে ক্ষান্ত দিলেও মৎসানু জানান যে, অহিরাবণ যেহেতু তার পালকপিতা, তাই অহিরাবণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। হনুমানকে মৎসানু একটি ধাঁধাঁ বলেন, সেই ধাঁধাঁ সমাধান করতে গিয়ে হনুমান বুঝতে পারেন যে, এই সরোবরেই লুকানো আছে পাতালের প্রবেশপথ।  পাতাললোকে গিয়ে মহীরাবণ ও অহিরবণকে হত্যা করে রাম-লক্ষ্মণকে উদ্ধার করেন হনুমান। বাকি গল্প থাই-রামায়ন রামকিয়েনের অনুরূপ। 

ভারতের ক্ষত্রিয় রাজপুতদের জেঠোয়াগোষ্ঠী নিজেদের মকরধ্বজের বংশধর বলে দাবি করে। তাদের বংশের লোককাহিনী অনুসারে, মকরধ্বজেরপুত্রের নাম ছিল মোদধ্বজ বা মদধ্বজ এবং তাঁর এক পুত্রের নাম ছিল জেঠিধ্বজ বা জৈষ্ঠধ্বজ। তিনিই বংশের আদিপুরুষ,  যেকারণে গুজরাটের জেঠোয়া রাজবংশ, তথা জেঠওয়ারা রাজপুতগোষ্ঠী আজও হনুমানকে তাদের ইষ্ট-দেবতা হিসাবে পূজা করেন।তবুও, অনেক প্রাচীন গল্পের মতো, এটিও এক উত্তরহীন প্রশ্ন রেখে যায়। মকরধ্বজের অস্তিত্ব কি সত্যিই ছিল, নাকি এটি এক প্রতীকী গল্পকাহিনী মাত্র! 

Post a Comment

1 Comments

  1. মৌ "মহাবলী মকরধ্বজ.." ভালো লেগেছে। আগে পড়িনি। ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা।

    ReplyDelete