শিল্পী - শুভম দাস
ব্রোকার
পুলক কান্তি কর
কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে মালতী দরজা খুলে বলল, ‘দাদু কে তোমাকে খুঁজছে’।
কমলেশ বাইরে এসে দেখলেন বিল্টু। ও জমি কড়ি বেচাকেনার দালালি করে। ওঁকে দেখে বলল, ‘কাকু একটা কাস্টমার এনেছি। ওনারা এখনই বাড়ীটা দেখতে চান’।
- এখন আনলে কেন বাবা? আমি তো স্নানে ঢুকছিলাম। কাজের মেয়েটাও কাজ করছে!
- ও কিছু হবে না কাকু। দূর দূর থেকে একটু নজর করে দেখে নেবে ওনারা!
- মানে? দূর দূর থেকে দেখবে কী করে? ঘরে ঢুকবে না?
- ঘরে না ঢুকে দেখবে কী করে, কাকু? কাজের লোক কাজ করেছে বলছিলেন না!
কমলেশের মাথায় এখনও বিল্টুর বলা শব্দগুলোর অর্থ পরিষ্কার হল না। উনি আবার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, পেছন থেকে ওনার স্ত্রী রমলা বললেন, ‘আসতে বলো’।
এক অল্প বয়ষ্ক দম্পতি ঘরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেকক্ষণ ধরে দেখলো। বিল্টু বলল, একদম সলিড বাড়ী, ভবেশদা। সদ্য রঙ করা, একেবারে পুটি পালিশ। কাকীমা খুব যত্নে রেখেছেন বাড়ীটা। বউটি বলল, ‘একটু সেকেলে গড়ন। ভবেশ আমি কিন্তু রান্নাঘরটা একেবারে ভেঙে মডিউলার করব’!
- ও সব পরে ভেবো যূথিকা। আগে তো ফাইনাল হোক্। বিল্টু বলল,’ছ’কাঠা জায়গা ভবেশ দা। বাড়ী বাদ দিয়েও আরও চারকাঠা জায়গা এক্সট্রা। একদম শহরের মাঝখানে এমন জমিওলা জায়গা আর পাবেন না’।
- কাকু, একটু তিনতলার ছাদটা দেখাবেন না? ভবেশ জিজ্ঞাসা করল।
- বাড়ী তো আমার দোতলা, তিনতলার ছাদ কিভাবে দেখাবো?
রমলা শোবার ঘরে কমলেশকে ডেকে বললেন, ‘কী ট্যাঁকস ট্যাঁকস কথা বলো? ব্যাপারটা যখন বুঝেছো, তখন ছাদে নিয়ে যাও না বাপু!’
- কী অশিক্ষিত রে বাবা! দোতলার ছাদকে তিনতলা বলে, একে আমি বাড়ী বেচবো না।
- আ-হা-হা-হা। তোমার বাড়ী বেচার সাথে খদ্দেরের ছাদ সম্পর্কিত জ্ঞানের কী সম্পর্ক? কিছুটা মুখ ভেংচে বললেন রমলা।
কমলেশ সে কথা গায়ে মাখলেন না। বললেন, ‘বা রে! এই রকম একটা লোক – এই বাড়ীটা ভোগ করবে, আমি সেটা মেনে নেব? বাড়ী বিক্রি করছি বলে, কাকে করছি, সেটা দেখে নেব না?
- যাও শিগ্গিরি। তোমার কচকচি পরে শোনা যাবে। এখন দেখিয়ে দাও গিয়ে। ওপরের ঘরের দরজার কোণটায় ছাদের চাবি আছে। কমলেশ তালা খুলে ওদের আহ্বান করলেন, ‘আসুন’।
বিল্টু বলল – কাকু, এটায় কি জলছাদ করানো?
- হ্যাঁ।
যূথিকা বলল, এই ট্যাঙ্কটার ক্যাপাসিটি কত কাকু?
- এ তো আর প্লাস্টিকের ট্যাঙ্ক নয় মা, সিমেন্ট দিয়ে বানানো। ফলে একজাক্ট মাপ বলতে পারবো না। তবে হাজার লিটার তো হবেই।
ভবেশ বললো, ‘দুখানা ট্যাঙ্ক দেখছি।‘
- একটা নীচের তলার, আরেকটা উপরের। চাইলে যাতে নীচের তলাকে সেপারেটলি ব্যবহার করা যায় বা ভাড়া দেওয়া যায় – সেরকম ভাবেই এ বাড়ীর প্ল্যানিং। সিঁড়ি টিঁড়ি সব বাইরের দিকে যাতে কোনও ফ্লোরের প্রাইভেসি নষ্ট না হয়। কমলেশ কিছুটা উদাস হয়ে বললেন।
ভবেশ বললো, কত দাম ঠিক করেছেন?
- এক কোটি দশ লাখ।
- এ-ক-কো-টি! যেন আকাশ থেকে পড়লো ভবেশ। বলল, এত কেন কাকু?
- এখানে তো কাঠা বারো লাখ করে যাচ্ছে বাবা! কী বিল্টু! এখানে কাঠা কত করে?
- এই আট-দশ। আমতা আমতা করল বিল্টু।
- আট-দশ? ঝাঁকিয়ে উঠলেন কমলেশ। একটু পরে নিজেকে একটু শান্ত করে বললেন,’বেশ তো! তোমার কথা অনুযায়ী যদি দশ লাখও ধরি, ছয় কাঠা জায়গার দাম হয় ষাট লাখ। বাকী বাড়ীর জন্য পঞ্চাশ লাখ।
- বাড়ীর আবার কী দাম কাকু? পুরোনো বাড়ীর কোনও দাম হয় না। কী বল হে বিল্টু? ভবেশ সাক্ষী মানলো।
- হ্যাঁ কাকু! পুরোনো বাড়ীর আর কী দাম? ওটা পাঁচ দশ লাখ টাকা কেউ এক্সট্রা ধরে নেয়। বিল্টুর সোজা সাপ্টা জবাব।
- এত বড় মজবুত বাড়ীর দাম পাঁচ-দশ লাখ? আকাশ থেকে পড়লেন কমলেশ। বললেন, জানো – এ বাড়ীর পেছনে কত শ্রম, কত খরচ, কত স্মৃতি আছে?
বিল্টু কাঠখোট্টা ভাষায় জবাব দিল – আপনার শ্রম আর স্মৃতির মূল্য তো শুধু আপনারই কাছে কাকু। অন্য লোক তার দাম দেবে কেন? বাকী যেমন আপনি খরচ করেছেন, তেমনি সে বাড়ীতে এতদিন বাস করলেন, ওটা ভোগ করলেন – সেটা ধরবেন না?
অদ্ভুত যুক্তি। এমন যুক্তি জীবনে প্রথমবার শুনলেন কমলেশ। বললেন এই বাড়ীর প্রতিটি ইঞ্চি, প্রতিটি দরজা-জানালা - একেবারে পরিকল্পনা মাফিক। দক্ষিণ পূর্ব খোলা, বড় বড় জানালা - ক্রশ ভেন্টিলেশন, এত বড় রান্নাঘর, বাথরুম পায়খানা – যে দেখেছে, সেই মুগ্ধ হয়েছে এতদিন। এত বড় বাড়ী সহ জায়গা যে কিনবে সে তো ভাগ্যবান হবে বিল্টু! সর্বোপরি প্রতি দু’বছরে এর প্রতিটি দরজা জানালা আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে রঙ করিয়েছি। ঠিকমতো মেনটেন করলে আগামী বিশ বছরে এই বাড়ীর পেছনে কোনও বড় খরচ হবে না – এটা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি। এমন স্বপ্নের বাড়ীর ভ্যালু তুমি দশ লাখ ফিক্স করে দিলে?
- আপনার স্বপ্ন কি কাকু অন্য কারোর হতে পারে? প্রতিটি মানুষের স্বপ্ন আলাদা আলাদা। যে এ বাড়ী কিনবে সে তার মতো করে বাড়ী রেনোভেট করাবে। এই তো যূথিকা বলল, তার রান্নাঘর অন্য রকম চাই! সে রকমই বাড়ীটাও হয়তো ভবিষ্যতে এদিক ওদিক ভাঙতে হতে পারে। বাড়ী ভাঙলে যে কিছু ইঁট বাঁচবে, তার দামই আপনি ম্যাক্সিমাম ধরতে পারেন কাকু। উপরন্তু এত বড় বাড়ী ভাঙার আবার এক্সট্রা অনেক খরচ আছে। আমাকে তো সেসবও ভাবতে হবে! ভবেশ বেশ যুক্তি সাজিয়েই বলল কথাটা।
- আপনি কি এই বাড়ী ভেঙে ফেলবেন না কি? কমলেশের চোখে মুখে বিষ্ময়।
- এখনই ভাবছি না। তবে ভাঙতেও পারি।
- আমি আপনাকে এ বাড়ী বিক্রি করবো না মশাই! নমষ্কার। কমলেশ একপ্রকার ওদের চলে যাওয়ার ইঙ্গিত করলেন।
বিল্টু বলল, ছাড়েন তো ভবেশ দা। ওনার কথা গায়ে মাখবেন না। আসলে অনেক যত্ন করে সারাজীবন তিল তিল করে বানানো বাড়ী তো। আমি তো এই ব্যবসাই করি, কতরকম মানুষ চরাই দুইবেলা। আপনি চলেন, কাকীমার সাথে কথা বলি।
কমলেশ হুঙ্কার পাড়লেন, এটা কি কাকীমার বাড়ী?
বিল্টু চোখ টিপে ভবেশকে ইশারা করে বলল, ভবেশ দা – আপনিই বা মিছিমিছি বাড়ী ভাঙার কথা বলছেন কেন? আপনাদের তো এখনই থাকার মতো রেডি বাড়ী চাই, তাই তো! কী বৌদি, আপনি সে জন্যই তো ফ্ল্যাট বুক করলেন না?
কমলেশ বললেন, আমার সামনে আর নাটকবাজি করো না বিল্টু। এ বাড়ী আমি তোমার আনা কোনও খদ্দেরকেই বেচবো না। তুমি যাও!
- কেন সকাল সকাল মাথা গরম করাচ্ছেন কাকু? আমাকে বাদ দিলে এই বাড়ী বিক্রি হবে আপনার? গলায় গরম এনে কথাটা পাড়লো বিল্টু।
কমলেশ বললেন, তেমন বুঝলে আমি বাড়ী বিক্রি করবো না।
বিল্টুরা একটুবাদে চলে যেতে কমলা নিয়ে পড়লেন কমলেশকে। ‘তোমার বাপু এত শত খবরের দরকার কী? কেউ তোমার বাড়ী ভাঙলো না রাখলো, তোমার কী মতলব? যে বাড়ী তুমি বিক্রি করে দিয়েছ, তাতে তারা থাকলো বা প্রোমোটিং করালো – সেটা তার অধিকার!
- বাঃ রমলা! তুমিও এই কথা বলছো? তুমি জানোনা – আমার কষ্টার্জিত পয়সার পাই পয়সা হিসেব করে আমারা এই স্বপ্নটুকু গড়েছি। তুমি দিনের পর দিন বাড়ীর কাজকর্ম সামলে টুসিকে কোলে নিয়ে এখানে এসে বসে মিস্ত্রির কাজকর্ম তদারকি করতে। ওরা বাড়ী গেলে তুমি বাড়ী যেতে। কোলের বাচ্চাকে দিনের পর দিন গাছের তলায় - নইলে এর আধা তৈরী হওয়া কোনও এক ঘরে রেখে ওকে খাওয়াতে, ন্যাপি বদলাতে - সেই বাড়ী আমি ভাঙতে দেব?
- যেটা তুমি বিক্রি করে দিচ্ছ, তার মালিক ভবিষ্যতে তাকে নিয়ে কি করবে তাতে তুমি কোনও ভাবে নাক গলাতে পারো কি?
- বাঃ। এটা তো আমারই বাড়ী ছিল। আমি বিক্রির সময় সেরকম শর্ত দিতে পারি না?
- ধরো তোমার বউ ডিভোর্স করে অন্য কাউকে বিয়ে করলো। মেয়েটি তোমার এককালে বউ ছিল বলে - এখনকার বরের কাছে কোনওদিন গিয়ে দাম্পত্যের অধিকার ফলাতে পারো কি?
- উদাহরণটা প্যাঁচে ফেলার মতো হলেও ঠিকঠাক হল না রমলা। বিয়েটা যদি আমি স্বেচ্ছায় দিই, যেমন ধরো যখন আমি মেয়ের বিয়ে দিয়েছি তখন কি তার ভবিষ্যৎ দেখে দিইনি, নাকি কিছু শর্তাবলী আরোপ করিনি?
- অত আঁকচা আঁকচির দরকার বাপু? তোমার টাকাটা এই মুহুর্তে দরকার। মোটামুটি একটা নেগোসিয়েশনে এসে ঝেড়ে দাও।
- এসব কি বিল্টু মার্কা ভাষা শিখেছ রমলা? ঝেড়ে দাও আবার কী কথা?
- জমি বাড়ী বেচাকে ঝেড়ে দেওয়া বলে, এটাও জানো না? এই জ্ঞান নিয়ে বাড়ী বেচতে চলেছ তুমি?
- তোমারই বা এসব ভাষা কোত্থেকে আমদানি হল? সুপুত্রের থেকে?
- তোমার খালি ঠেস মারা কথা! যেখন থেকেই হোক, কথাটা ঝেড়ে ফেলাই!
- ভাবো, সুনীতি চাটুজ্যে বাড়ী বিক্রি করাকে ঝেড়ে ফেলা বলছেন!
- তুমি তো সুনীতি চাটুজ্যে নও বাপু, কাঠখোট্টা ইঞ্জিনিয়ার। তোমার বাক্যশুদ্ধি নিয়ে এত কচকচানির কী দরকার?
- আমি যাই হই, তুমি এককালে বাংলায় এম.এ পাশ করেছিলে বলেই কথাগুলো কানে বাজলো রমলা; অন্য কিছু নয়।
- ছাড়ো ওসব কথা। আমি বিল্টু কে ডেকে পাঠাচ্ছি। মোটামুটি নব্বই লাখ পেলে ঝেড়ে দাও। দুঃখিত, বেচে দাও।
- ওই বেনে ব্যাটাকে আমি বাড়ী বেচবো না।
- তুমি জানলে কী করে, ও বেনে?
- না হলে কেউ ইঁট ভাঙার হিসেব করে?
- খদ্দের তো তার মতো করে দাম কমানোর চেষ্টা করবে। এটাই তো স্বাভাবিক। তুমি হলেও তাই করতে।
- ছিঃ রমলা। পঁয়তিরিশ বছর ঘর করেও আমার সম্বন্ধে এমন মন্তব্য করতে পারছো! আমি কখনও এভাবে কোনও কিছুর দরদাম করেছি? যখন কোনও কিছু দামি জিনিস কেনার মতো পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে, আমি আগেই বলে দিয়েছি আমার ক্যাপাসিটি এত! তার জন্য কোনও জিনিসের ন্যায্যতাকে আমি ছোট করে দেখাইনি কখনও।
- তুমি সত্যি করে বলতো, বাড়ী বিক্রি কি তুমি চাওনা?
- না।
- কিন্তু বাবুর বক্তব্যটা তো অনায্য নয়। ওরা কলকাতাতেই সেটলড্। তুমি আমি বৃদ্ধাবস্থায় এখানে এভাবে পড়ে থাকবো– এটা কি ওর ভালো লাগবে?
- ওসব লোক দেখানো। আসল ব্যাপার হলো, বাপ থাকতে থাকতে ঝামেলাটা মেটাও। নইলে পরে এই বিক্রিবাটার হ্যাপা কে পোহাবে?
- নিজের সন্তান সম্বন্ধে উক্তি দেখ!
- দৃষ্টি স্বচ্ছ হলে এই বক্তব্যটা তোমারও হতো রমলা।
- আমার যথেষ্ট স্বচ্ছ দৃষ্টি! তোমার কুচুটে মন বলে সব কিছুতে সন্দেহ করো। ছেলে বাপ মাকে দেখতে চাইছে, তাতেও দোষ! না দেখতে চাইলে বলবে, এই তো দেখলো না! ও কি চাকরী ছেড়ে রোজ এই মালদহে যাতায়াত করবে?
- আসল ব্যাপারটা বুঝেও বুঝতে পারছো না কেন রমলা? ওরা যে ফ্ল্যাটে থাকে সেটা দু-বেড রুম। আমরা ওখানে পাকাপাকি চলে গেলে চুমকী কোথায় থাকবে? ওরও তো একটা পড়ার ঘর চাই!
- তাহলে কী বলতে চাইছো?
- বড় ফ্ল্যাট কিনতে টাকা লাগবে। সেটার ব্যবস্থা হবে এই বাড়ী বিক্রি করে!
- আচ্ছা তাই যদি হয়, তাতে সমস্যা কোথায়? আমিও তো শ্বশুড় শাশুড়ী নিয়ে কাটিয়েছি। আমরাও যদি শেষ বয়সে ওদের সাথে থাকি তবে অন্যায়টা কী হবে?
- তোমার বউমা কি তোমার মতো? বুড়ো বয়সে কেন বেবি সিটার হতে চাইছো রমলা? সারাজীবন নিজের মতো বেঁচেছো। আজ মাথার উপর থেকে ছাদ চলে গেলে তখন তো ছেলে বৌ এর হাত-তোলা হয়ে থকতে হবে, সে খেয়াল আছে?
- তোমার বাবা মা কি কখনও নিজেদের হাততোলা ভেবেছেন?
- আবার সেই একই কথা? আমি আর তোমার ছেলে কি একই জিনিস?
- এক হবে কী করে? সে তো তোমার মতো এতো কুচুটে বুদ্ধি পায়নি!
- ছাড়ো রমলা। তোমার সাথে আমার জীবনে কোনও কিছুতে মেলেনি, আজও মিলবে না। আমি এখানে একাই থাকবো।
- আর তোমার খ্যাটন?
- ফের ওইসব ভাষা! তোমাকে আমার খাওয়া পরার ভাবনা ভাবতে হবে না। তুমি যাও। গিয়ে দ্যাখো, কত ধানে কত চাল!
- এই তো তুমি হিসাব দিলে। দু’কামরার ঘর! আমি গেলে থাকবো কোথায়?
- সে আমি কী জানি?
- আমি গেলে যাতে ওখানে থাকতে পারি, সে বন্দোবস্ত করে দাও!
- কী ভাবে?
- বাড়ী বিক্রি করে ছেলেকে টাকা দাও - সে যাতে আর একটা ফ্ল্যাট কিনতে পারে।
- এই তো সত্যিটা জানো! তবে এতক্ষণ নিজেকে চোখ ঠারছিলে কেন?
- এত কথার তো দরকার নেই! এই বাড়ী বিক্রি হবে। এটাই ফাইন্যাল।
- রমলা, এই বাড়ীর পেছনে না হয় আমি শুধু টাকা পয়সা দিয়েই খালাস ছিলাম। তুমি তো প্রাণপাত করেছো। এর প্রতিটি গাঁথনির একটি ইঞ্চি তোমার নিপুণ তত্ত্বাবধানের বাইরে হয়নি। তোমার এর জন্য মায়া নেই? নাকি পুত্রস্নেহের অন্ধতায় এই মায়া ফিকে হয়ে গেছে?
- আমার এত উদলা পীরিত নেই কোনও কিছুর প্রতি। যেটা বাস্তব, সেটাকে মানতে হবে।
- বাস্তবটা কী রমলা? যেটা ঘটতে চলেছে সেটা খারাপ হতে পারে বলে চোখ বন্ধ করে রাখা নাকি সেটা প্রতিহত করার জন্য সতর্ক থাকা?
- দ্যাখো বাপু, এজন্যই তোমাকে কেউ পছন্দ করে না। আগে নিজের স্বভাবটা বদলাও। আমি বেঁচে আছি বলে লোকে তোমার ডাক খোঁজ করে। আমি মরলে তোমাকে চিল শকুনেও ছুঁয়ে দেখবে না। ভগবানকে ডাকো, যেন আমি বাঁচতে বাঁচতে তোমার ভবলীলা সাঙ্গ হয়।
- তোমার বৈধব্যের যখন এত শখ, ঈশ্বর তাই করুন।
- বিল্টুকে আমি খবর পাঠাচ্ছি, তুমি একটা রফায় এসে বেচে দাও বাড়ীটা।
- রফা বলতে? কততে ছাড়লে তোমার গুণধর পুত্রের প্রয়োজন ঘুচবে সেটা জেনে নাও। তার সাথে অতিরিক্ত কুড়ি লাখ না পেলে আমি বেচবো না।
- কেন, কাট মানি?
- হ্যাঁ। নিজের টাকা থেকে নিজে কমিশন খাবো। কিছু যদি থাকে তবে তোমার বৈধব্য ভাতাও জুটবে। হাফ পেনশনে তো ওষুধ খরচাও উঠবে না!
- আমার চিন্তা তোমায় করতে হবে না। নিজেরটা ভাবো।
মানুষ ভাবে এক, আর ঈশ্বর ভাবেন আর এক। রমলার প্রার্থনা ব্যর্থ করে দিয়ে ঈশ্বর একদিন রমলাকে কাছে টেনে নিলেন। যমের সঙ্গে মানুষ কতটা লড়লো বোঝা গেল না, তবে হাসপাতাল ম্যানেজমেন্ট যে কুবেরকে ভালো মতো ধাক্কা দিল – সেটা কদিন বাদেই পরিষ্কার হয়ে গেল। শ্রাদ্ধ শান্তি যে মূলত পুত্রেরই অনুষ্ঠান এবং সে বাবদ খরচপাতি যে তারই করা উচিৎ - সে কথা মনে করাতেও কমলেশের বিবেকে বাধলো। অনুষ্ঠানের পর কলকাতা ফেরের পথে ছেলে বলল, ‘বাবা, এবার এদিকের পাট চোকাও। তোমার খাওয়া দাওয়া, দেখাশোনা কে করবে?’
কমলেশ ও ইদানীং বুদ্ধিমান হওয়ার অনেক ট্রেনিং পাচ্ছিলেন রমলার থেকে। সেইটাই প্রয়োগ করে বললেন, ‘আপাততঃ মালতী কে বলেছি ধোয়া মোছা ছাড়াও রান্নার কাজটা করতে। আর বাড়ী? বিক্রির চেষ্টা তো আমি কবে থেকেই চালাচ্ছি!’
- ওরকম বাছ বিচার করে চালালে কি আর বিক্রি হবে বাবা? প্রোমোটারকে দেবো না, ওকে দেবো না – এরকম করলে হবে না।
কমলেশ বুঝলেন এপ্রান্তের অনেক কথাই রমলা সময় সুযোগ বুঝে পাচার করে দিয়েছেন কথা বলার আনন্দে। তাই সব দিক সামাল দেওয়ার ঢঙে বললেন, ‘না না সে বাছবিচার এখন আর করছি না। মোটামুটি নব্বই-পঁচানব্বই পেলেই বেচে দেবো।’
- এত পাবে না বাবা এখানে। ষাট্ সত্তরেই ঝেড়ে দাও। আবার কথাটা খট করে কানে বাজলো কমলেশের। তবে কিনা বাস্তব বোধ ইদানীং বড় তীব্র হয়ে গেছে তাঁর। তিনি বললেন এত বড় বাড়ী ষাট-সত্তরে বেচলে বড় লস হয়ে যাবে বাবা। ঠিক আছে আর একটু বাজিয়ে নিতে দে। আমি তো আর এখুনি মরে যাচ্ছি না। ছ’-সাত মাস একটু দেখে নিতে দে।
- বেশ। তোমার বয়স হচ্ছে, চিন্তা হয়। এখানে একা একা থাকো। এতদিন তাও মা ছিল।
- ও তুই ভাবিস না হাবুল। আমি এখনও যথেষ্ট সক্ষম।
ছেলে বউমা নাতনি চলে যেতে কমলেশ একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। সমস্ত হিসাব পত্র সামলে ব্যাঙ্ক-ফিক্সড ডিপোজিটের জমা খরচ দেখে তাঁর মনে হল কিছু টাকা ক্যাশ থাকলে ভালো হত। ছেলের বুদ্ধিতে সরকারী হাসপাতালে না দিয়ে কর্পোরেট সামলাতেই মেরুদণ্ডটা বেঁকে গেছে তাঁর। তাঁর নিজেরও মাসে ওষুধ খরচা প্রায় ন’হাজার টাকা। তিনি পেনসন পান প্রায় কুড়ি হাজার টাকার মতো। এখন বড় কোনও অসুখ বিসুখ হলেই সমস্যা। নইলে ঠিক আছে। এখন মেডিক্লেম করানোও দুষ্কর। এই বয়সে করতেই চায় না। অল্প কিছু কিছু বাঁচিয়ে যদি একটা রেকারিংও করা যায় তো বেশ হয়। তবে তাতেও দু-তিন লাখ জমাতে দু-তিন বছরের বেশী চলে যাবে। এর মধ্যে কিছু বিপদ ঘটলে মুশকিল!
কমলেশ এবারে জীবনটাকে একটা রুটিনে বাঁধার চেষ্টা করলেন। আগে বহু কিছুই রমলার জন্য অথবা বাড়ীর কোনও না কোনও প্রয়োজনে হয়ে উঠতো না। এবার তিনি ঘড়ি ধরেই সব কিছু করবেন। যেমন ভোর পাঁচটায় হাঁটতে বেরোনো। ফেরার পথে একটু ফুলটুল কিনে এনে রমলার ঠাকুর বাড়ী পরিষ্কার করা। এরপর জলখাবার সেরে স্নান, পূজা। দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে একটু ঘুম, টভি দেখা, পেপার পড়া। বিকেলে নিজে একটু চা বানিয়ে পার্কে গিয়ে বসা, বন্ধুদের সাথে গল্প করে আটটা সাড়ে আটটায় ফেরা। একটু বই পড়ে টিভি দেখে দশটার মধ্যে ঘুম। বেশ চালিয়ে নিলেন এরকম কয়েক মাস। মাঝে মাঝে ছেলের ফোন আসে - তিনি এটা ওটা ভুজুং ভাজুং দিয়ে কাটিয়ে দেন। সেদিনের পর বিল্টুও আসেনা বা অন্য কোনও দালালও এ পথ মাড়ায় নি। একদিন বিকেল বেলায় তিনি পার্ক থেকে ফিরছেন, পথে বিল্টুর সাথে দেখা ‘কী কাকু, বাড়ীটা কি এরপরে যখ হয়ে আগলাবেন?
- হ্যাঁ বাবা। তুমি যখন ও ঘরে ঢুকতে যাবে, খপ করে টুঁটিটা চেপে ধরবো!
- মজা ছাড়ুন কাকু! হাবুলদা ফোন করেছিল গেল মাসে। ও বলেছে যেন তেন প্রকারেণ যেন বাড়ীটা আমি বেচে দিই। এক পার্সেন্ট এক্সট্রা দেবে বলেছে।
- পরের ধনে পোদ্দারি! তা তুমি সেই লোভে উঠে পড়ে লাগছো না কেন?
- ভাবছিলাম, বাড়ীটাতো আপনার! আপনি খুশি মনে যবে বলবেন, তবেই যাবো। আমার কি কাজের অভাব?
কমলেশ এই ধরনের কথাবার্তা প্রত্যাশা করেননি। মনে মনে খুশিই হলেন তিনি। বুক থেকে একটা বড় পাথরের বোঝা যেন নেমে গেল তাঁর। বললেন, খুব ভালো কথা। আমি মরলেই তবে হাবুলের সাথে কথা বলো বাবা। এই বাড়ীতেই আমি মরতে চাই।
- কাকু আমার কার্ডটা রাখেন! যদি কখনও দরকার পড়ে, আমাকে ডাকবেন।
- তোমাকে তো ডাকার দরকার পড়বে না, বলেই দিলাম বাবা!
- আমি সে দরকারের কথা বলিনি কাকু। কাকীমা মারা গেছেন, কোনও আপদ-বিপদও তো হতে পারে। হুট করলেই তো আর হাবুল’দা আসতে পারবে না এখানে!
ছোকরার পাবলিক রিলেশন সেন্সটা ভালো মানতেই হবে। এসব করে বলেই বোধহয় দালালির ব্যাবসায় ওর রমরমা! তবু ভদ্রতা করে বলেছে তো! কমলেশ বললেন ঠিক আছে, দাও কার্ডটা।
- কাকীমার মোবাইলটা চালু আছে তো? ওতেও দেখবেন, আমার নাম সেভ করা আছে।
দিন চলছিল ঠিক মতোই। হঠাৎ সমস্যা হল মালতীর বিয়ে ঠিক হয়ে। এখন নতুন একটা কাজের লোক, যেমন কুঁড়ে, তেমনি নোংরা। সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, মিথ্যে! ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে বলে মেয়েটি। এতবড় বাড়ী, সব সময় পেছন পেছন ঘুরে তদারকি করা কি সম্ভব? কোনওদিন উপরে ঝাঁট দেয় তো মোছে না, আবার মোছে তো ঝাঁট দেয় না। জানালা-দরজা নিয়ম করে ডাস্টিং করার কথা, কমলেশ প্রায় দিনই আঙুল দিয়ে দেখেন ধূলোর পরতে ভর্ত্তি সমস্ত গ্রীল, বারান্দার রড! তার উপরে কামাই। আগে ও কামাই করলে হোম ডেলিভারি নিয়ে নিতেন, কিন্তু তাদেরও নিত্য নতুন ফ্যাঁকড়া। ফ্লাইং কাষ্টমারদের অনেক দেরী করে খাবার পাঠায়। যার খাবার সুস্বাদু, তাদের এত তেল মশলা যে খেতে ভয় লাগে! যারা হাল্কা রান্না করে, তাদের আবার খাবার মুখে তুলতেই ওয়াক ওঠে! কমলেশ ভেবেছেন রান্নাটা এবার নিজেই করে নেবেন। এসব দিনগুলোয় সেদ্ধ ভাত ভালোই লাগবে। অবশ্য নতুন মেয়েটির রান্নাটাও জঘন্য। বেলা সাড়ে নটা বাজলো, ও এখনও আসেনি মানে আজ নির্ঘাত ডুব। একটু জলখাবারে দুধ মুড়ি খেয়ে রান্না চাপানোর মনস্থ করলেন তিনি। ডোর বেল বাজলো, মনে হল না? এত বেলায় সবিতা আসবে? দরজা খুললেন একরাশ বিষ্ময় নিয়ে। ‘আরে বিল্টু? তুমি এখন?
- অনেকদিন আপনাকে দেখিনা, তাই ভাবলাম একবার খোঁজ নিয়ে যাই।
- এসো, ভেতরে এসো!
- কাকু, আপনার চেহারাটা এত খারাপ হয়েছে কেন? একেবারে অর্দ্ধেক হয়ে গেছেন দেখছি – এই ক’দিনে!
- তাই নাকি?
- একটা ডাক্তার ফাক্তার দেখান!
- ও ঠিক আছে বিল্টু। মনে হয় খাবার সমস্যার জন্য এমনটা হচ্ছে। একটা ভালো কাজের লোক দিতে পারো? এখন যেটা আছে তার কামাই এর শেষ নেই!
- রান্না কেমন করে?
- দেখ বাবা, রান্নার গুণ নিয়ে এতদিন তো আমি বিচার করিনি। আমি মোটামুটি সবই খেতে পারি। কিন্তু এ যেন দুনিয়ার বাড়া। এত জঘন্য আমি জীবনে খাইনি। আসলে বড্ড বেশী নোংরা, এজন্যই বোধহয় এত খারাপ লাগে।
- ছাড়িয়ে দেন নি কেন?
- লোক না পেয়ে ছাড়াই কী করে?
- এই জন্য তো ফোন নাম্বার দিয়েছিলাম কাকু। ফোন করে বলতে তো পারতেন।
- এই সামান্য ব্যাপারে আবার তোমাকে কী জ্বালাতন করবো বাবা?
- ঠিক আছে, আমি দেখছি। এখন আপনি কী করছেন?
- এই রান্নাবাড়ীর তদ্বির করতে যাচ্ছি।
- আজ এসব ছাড়েন। আমি দু-এক পদ তরকারী দিয়ে যাচ্ছি। চিন্তা করেন না, আপনার বউমার রান্নার হাত ভালো।
- না বাবা, সেজন্য নয়। কোন রকমের মায়া আর বাড়িও না। আমি দিব্যি সেদ্ধ ভাত করে নিতে পারবো।
- আপনি ভাতটা শুধু করে নিন না! বাকী সব নিয়ে এত ভাবছেন কেন?
এরপর প্রায়দিনই এটা ওটা নিয়ে বিল্টু আসে। দু-একটা কাজের লোক বদলেও লাভ কিছু হল না। একদিন বিল্টু বলল, কাকু, আপনার চেহারাটা কিন্তু চোখে পড়ার মতই রোগা লাগছে। আপনার বাড়ীতে ওজন মাপার মেশিন আছে না?
- হ্যাঁ। কিন্তু কাকীমা কোথায় রেখেছে জানি না।
- দেখুন ওই গ্যাস সিলিন্ডার রাখার জায়গার আশেপাশে থাকবে। আমি কাকীমাকে গ্যাস সিলিন্ডার ওজন করে নিতে দেখেছি।
খানিকবাদে আবিষ্কার করা গেল, কমলেশের ওজন প্রায় সতেরো কিলো কমে গেছে গত সাত-আট মাসে। বিল্টু বলল, কাকু, আপনি কলকাতা গিয়ে ডাক্তার দেখান। আমি আজই হাবুলদাকে ফোন করছি।
- না বাবা। ওকে আর এ নিয়ে বিব্রত করো না।
- তবে এখানেই ভালো কাউকে দেখান। দরকার পড়লে আমি সাথে করে নিয়ে যাবো।
- সে যাওয়া যাবে। আমার মনে হয়, রমলা বেঁচে থকতে – এটা ওটা নানারকম খাওয়া হতো তো! দুপুরে খাবার পর ফল, বিকেলে দুধ বা ছানা – সেসব তো বন্ধ। তারপর রুটিনের খাওয়াও ঠিক মতো হয় না।
- কাকু, আজ থেকে রান্নার লোক ছাড়িয়ে দিন। আমি দুবেলা এসে আমাদের বাড়ী থেকে খাবার দিয়ে যাবো।
- তুমি একটা হোম ডেলিভারি খুলতে পারো তো বিল্টু!
- এত টাকা আমার কী হবে কাকু? আপনার বউমার উপর চাপ পড়বে ওতে।
- লোক রেখে করাবে।
- দরকার নেই কাকু। আপনাদের আশীর্বাদে সিজনে আমার ভালোই রোজগার আছে।
- কিন্তু তুমি টাকা না নিলে রোজ রোজ নিয়ম করে তোমার থেকে খাবার নেব কী করে?
- এটা কি আমি টাকার জন্য করছি কাকু? আমার বাবার থেকে কি আমি টাকা নিতাম?
- আমি তো তোমার বাবা নই, বাবা! এসব অবলিগেশন আর বাড়িও না। তাও তো প্রায় দিনই কিছু না কিছু তুমি নিয়ে আসো!
- ছাড়েন তো কাকু! এতে কি আমি গরীব হয়ে যাবো? আপনি জানেন আমার মাসে রোজগার কত?
- সে কথা জিজ্ঞাসা করা তো অশোভন, বাবা।
- দেখুন, আমিও শোনানোর জন্য বলছি না; তবে আপনার এমনি এমনি খাবার নিতে খারাপ লাগছে বলেই বলছি, আমার মাস গেলে সিজনে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা রোজগার।
- বল কী?
- হ্যাঁ কাকু! আপনার মতো লোক এখন আর কটা? সবাই তো বাড়ী বেচে ফ্ল্যাট বানাতেই মশগুল। প্রোমোটারকে বাড়ী দিয়ে, দুটো ফ্ল্যাট আর কিছু টাকা পেয়েই খুশী! আরে বাবা, নিজের বাড়ী আর ফ্ল্যাট কি এক জিনিস হল? দেশলাই এর বাক্স!
- তাই বলে এত বিক্রি?
- আরে কাকু, ফ্ল্যাটে থাকাটাই আজকালকার ফ্যাশান। একটা প্রপার্টি বেচলে বাড়ীর মালিক আর খদ্দের দুজনের থেকেই আমরা টু পার্সেন্ট করে পাই। ধরুন পঞ্চাশ লাখ টাকার একটা প্রপার্টি বিক্রি হলে দু লাখটাকা আমার। এছাড়া বাড়ী ভাড়া ইত্যাদি থেকেও টাকা রোজগার হয়। আর তাছাড়া জানেনই তো আমার ছেলেপুলে নেই। বাবা মারা গেছেন। আপনি রোজ খেলে, আপনার বউমা বরং এইটা নিয়ে মেতে থাকবে।
- না বিল্টু। রোজ রোজ তুমি আমাকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলো না। আমি শান্তি মতো খেতেও পারব না তাহলে।
- এত দূরের করে ভাবছেন বলেই সমস্যা হচ্ছে কাকু। ঠিক আছে, এতই যদি আপনার অসুবিধে হয়, তবে কিছু ধরে দেবেন।
- কত নেবে বলো!
- আরে কাকু, এটা কি আমার ব্যাবসা? আপনি শুধু শুধু রাজী হচ্ছেন না বলে ধরে দিতে বলছি কিছু। আপনার যা ঠিক মনে হবে দেবেন!
বড় অস্বস্তিতে ফেললো ছেলেটা। কীই বা করা যাবে। যা হোক এ মাসটা তো যাক। এখন তো লোক আছেই। হঠাৎ বিল্টু এপাশ ওপাশে দৃষ্টি দিয়ে বলল, ঘরটায় বড্ড ঝুল হয়েছে কাকু। দিন দেখি আপনার ঝুল ঝাড়ুনিটা।
- ও থাক বাবা। পূর্ণিমার তো এসব করার কথা। কত দিকে আর তাকাবো? আজ এলে বলব না হয়!
- কিন্তু ঘরটা তো আবার রঙ করাতে হয়ে গেছে। চারদিক বড় মলিন লাগছে। এমনটা আগে কখনও লাগতো না কাকু!
- আসলে ঘরটা এখন লক্ষ্মীছাড়া হয়ে গেছে বিল্টু। তোমার কাকীমা দিনরাত সমানে পরিষ্কার করে রাখতেন ঘরটা। দরজা জানলা মেঝে ছাদ কোনও খানে একফোঁটা ধূলো থাকার জো ছিল না। আজ উনি নেই বলেই – এমনটা লাগছে!
- রঙটা কি এখন করিয়ে নেবেন? শীতকাল চলছে, ভালোই হবে।
- সাহস পাই না যে! আগে কাকীমা দুবার করে চা করে খাওয়াতো মিস্ত্রিদের। তাতে ওদেরও একটু কাজ করতে মন লাগতো। মন না দিয়ে করলে কোনও কাজ কি ভালো হয় বাবা? এ রঙ ভালো হবে না, মিছিমিছি পয়সা খরচা হবে!
- কিন্তু এভাবে কদ্দিন ফেলে রাখবেন কাকু? রঙ টঙ না করালে ফাটল ধরবে কিছুদিন পরে।
- ততখানিও খারাপ অবস্থা নয় বাড়ীর। আমার বিশ্বাস, আমার জীবদ্দশা নিরুপদ্রবে কেটে যাবে। তারপর যা হয় হবে।
- ঠিক আছে কাকু, আপনি যদি মনে করেন – আমার চেনা মিস্ত্রি দিয়ে রঙ করিয়ে দেব। আপনাকে বেশী ভাবতে হবে না। শুধু ডিসিশনটা জানালেই হবে।
- বেশ।
- আর ডাক্তার দেখাবার কী ভাবলেন কাকু?
- কী ব্যাপারে?
- ওই যে আপনার ওজন কমার ব্যাপারে!
- ও পরে ভাবা যাবে।
- না, না। আমি আজই খোঁজ খবর নিয়ে রাখছি। ডেট পেলেই আপনাকে ফোন করে জানাবো।
২
ডাক্তার সেন, বিল্টুকে দেখে বললেন, ‘কমলেশ বাবু আপনার কে হন? বাবা?
- না। আমার পরিচিত।
- ওনার ছেলে মেয়ে কেউ নেই?
- আছে, তবে কলকাতায় থাকে সবাই।
- দেখুন বিল্টু বাবু, সমস্ত রকম টেস্ট ফেস্ট করে আমার যা ধারনা – এটা মাথার এক ধরনের ক্যানসার। কলকাতায় নিয়ে গিয়ে এর চিকিৎসা করা দরকার।
- কেন ডাক্তার বাবু? এখানে এসব চিকিৎসা হয় না?
- হবে না কেন? এখন গ্লোবালাইজেশনের যুগ। সবখানে সব চিকিৎসাই সম্ভব। তবে কিনা ছেলে মেয়ে থাকতে আপনি কেন নিমিত্তের ভাগী হবেন? যাই করুন না কেন, এতে মৃত্যু তো অনিবার্য।
- কত দিন বাঁচবেন?
- ইট ডিপেন্ডস্। এখন ইনিশিয়াল স্টেজ। এখুনি চিকিৎসা শুরু হলে বেশী দিন বাঁচতে পারেন। আনন্দে থাকতে বলুন যে কদিন বাঁচবেন।
বিল্টু কী করবে, ভেবে পেল না। বাড়ী গেলেই তো কমলেশ বাবু জিজ্ঞেস করবেন। ও বোঝে – এই অবস্থায় হাবুলদাকে জানানোই বুদ্ধিমানের কাজ। আর বললেই ও নিশ্চই কলকাতা নিয়ে যাওয়ার জন্য জোর করবে। কিন্তু কাকু তো ছেলেমেয়ের বাড়ীতে যেতে চান না। এখানেই থাকতে ভালোবাসেন। ডাক্তার সেন যদিও বললেন আনন্দে থাকতে, লোকটাকে এখান থেকে চলে যেতে হলে উনি কি ভালো থাকবেন! এই সব সাত সতেরো ভাবতে ভাবতে সে যখন কমলেশবাবুর বাড়ী এল, উনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী গো বল্টু, ডাক্তার রিপোর্ট দেখে কী বললেন?
- ডাক্তার বাবু বললেন, তেমন কোনও শারীরিক সমস্যা নেই।
- তবে ওজন কমে যাচ্ছে কেন? খাবার জন্যে?
- ডাক্তারবাবু তো তাই বললেন।
- দেখলে তো, আমিও সেকথাই বলছিলাম।
- আমি বলি কি কাকু, আপন বরং কলকাতায় কিছুদিন হাবুলদার ওখান থেকে ঘুরে আসুন। কয়েকমাস ভালোমন্দ খেয়ে দেয়ে চেহারা ফিরিয়ে আবার চলে আসবেন!
- একটু খাবার জন্য নিজের স্বাধীনতা বিসর্জন দেব, বিল্টু?
- এভাবে বলছেন কেন?
- আমি ফ্ল্যাটের ঘুপচি ঘরে থাকতে পারিনা বাবা, দমবন্ধ লাগে।
- আমিও তাই ভাবি কাকু। মানুষজন নিজের বাড়ী ছেড়ে ফ্ল্যাটে উঠে যায় কী বলে, আমার মাথায় ঢোকে না। একটু শিল নোড়ায় বাটনা বাটা যাবে না, উপরের ফ্ল্যাট হলে ছেলে মেয়ে বাচ্চা বেলায় দুপদাপিয়ে হাঁটতে পারবে না, নাচতে পারবে না – এভাবে থাকা যায়?
- জানো বল্টু, আমাদের বাড়ীতে যেমন দরজা খুললেই আকাশ, মাটি – মনটা কেমন উদার হয়ে যায়! সারাদিন ঘুপচি ঘরে থাকতে থাকতে আমার তো মনে হয়, মনটাই না ছোট হয়ে যায়।
- কয়েকটা মাসেরই তো ব্যাপার কাকু। একটু কলকাতায় ঘুরে আসুন!
- তুমি হঠাৎ এত কলকাতায় পাঠানোর ব্যাপারে খেপে উঠলে কেন বাবা? এই তো কথা হল – বউমার হাতে রান্না করা খাবার দুবেলা আমার জুটবে!
- না কাকু! এখন আপনার সারাদিন কারোর নজরদারিতে থাকা দরকার! তিন চার ঘন্টা অন্তরই এটা ওটা মুখের সামনে জোগাতে হবে। তবে আপনার স্বাস্থ্য ফিরবে।
- আমার নীচের তলাটা তো খালি পড়ে আছে বল্টু। তোমরা এসে থাকবে? ভাড়াটাড়া লাগবে না।
- সেজন্য নয় কাকু! আসলে আমারও তো পৈতৃক বাড়ী। মা বেঁচে। তাছাড়া আপনার বউমার আবার গাছপালার শখ। একদিন নিয়ে যাবো, দেখবেন কত রকমের ফুল, শাক-সব্জী! ওগুলোকেই ও সন্তান স্নেহে পালন করে। নইলে আমার আর কী!
- রিপোর্ট গুলো কোথায় রাখলে হে?
- আপনার শোবার ঘরের খাটে রেখেছি। আচ্ছা কাকু, আপনার ছেলের কাছে থাকতে ইচ্ছে না হয়, মেয়ের কাছে গিয়েও তো থাকতে পারেন!
- বিষয়টা ছেলে মেয়ে নিয়ে নয় বিল্টু। আমি এখানেই স্বচ্ছন্দ। আমি এটা ভাবতে পারি আমার বলে। এই বয়সে গাছকে শেকড় সুদ্ধু তুলে নিয়ে অন্য কোথাও বসালে কি আর সে গাছ ওখানে শাখা মেলতে পারে?
- কদিন কোথাও বেড়াতে যাবেন কাকু?
- কোথায়?
- আপনার বউমার বাপের বাড়ী ময়নাগুড়ির কাছে। চমৎকার জঙ্গল চারদিকে। আপনার ভালো লাগবে।
- না বাবা। তোমরা ঘুরে এসো।
- আপনি এত ভাবেন কেন কাকু? শ্বশুরবাড়ীতে নাই বা থাকলেন! আপনার জন্য গেষ্ট হাউস বুক করে দেব।
- আচ্ছা ভেবে দেখি।
কমলেশের বাড়ী থেকে বেরিয়ে মহা সমস্যায় পড়লো বিল্টু। বিষয়টা হাবুলদাকে বলা তো উচিত। কিন্তু এর পরবর্তী পরিস্থিতিতে হাবুলদা যে সব স্টেপ নেবে, ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল বিল্টুর। সবচেয়ে বড় বাধা এই বাড়ীটা। সে কি আবার খদ্দের দেখা শুরু করবে? এত বড় বাড়ী কেই বা নেবে? যে নেবে সে প্রোমোটিং এর ধান্দাতেই কিনবে। ছ’কাঠা জায়গা চাট্টি খানি কথা? যার এই মুহুর্তে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই দরকার, সেও ভাববে বাকী জমিটা পার্ট পার্ট করে বিক্রি করে দিলে কিছু টাকা উঠে আসবে। এর চেয়ে বড় কোনও প্রোমোটারকে ডাইরেক্ট দেওয়াই ভালো, ওদের পেমেন্ট অনেক বেশী। অত দরাদরিও করতে হয় না। বরং কখনও কখনও বাজার দরের থেকে বেশীও পাওয়া যায়, চাই কি সঙ্গে একটা ফ্ল্যাটও। কিন্তু কমলেশকে এ কথা সে পাড়বে কি করে। দু-চারদিন এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ করে তার আকাঙ্ক্ষার কথাটা যেন ঈশ্বর শুনলেন। কমলেশ একদিন সকালে নিজেই বিল্টুকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, ‘বিল্টু, ভাবছি বাড়ীটা বেচে দেব’।
- কেন কাকু?
- দেখ বাবা, চোখের সামনে বাড়ীটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আজই দেখলাম বাইরের দিকে একটা ছোট ফাটল হয়েছে। প্লাষ্টারেরই হয়তো। এখুনি না সারালে বর্ষাকালে আরও ক্ষতি হবে।
- কিন্তু কাকু, যে কিনবে সে যে ভেঙে প্রোমোটিং করবে না, তার গ্যারান্টী কোথায়? এ বাড়ী ভাঙা পড়বে, সইতে পারবেন?
- কী আর করা যাবে!
- আসলে বাড়ী কিনে সেখানেই বসত করবে – এরকম খদ্দের পাওয়া বড় মুস্কিল কাকু!
- আমি বুঝি! আমি আর আগের মতো ভাববো না বিল্টু। তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ী বিক্রির ব্যবস্থা কর।
- হুড়োহুড়ি করলে দাম পাবেন না কাকু। এ হল নার্ভের খেলা। দম ধরে বসে থাকতে হয়। খদ্দেরের পছন্দ হলে ওরা আপনি এসে বেশী দামে কিনবে।
- আমার এত সময় নেই বিল্টু!
- কেন কাকু? হঠাৎ এত সময়ের কড়াকড়ি শুরু হল কেন?
- আমাকে কেন লুকোচ্ছ বাবা? তুমি তো জানোই আমার কী হয়েছে!
- আপনি জানলেন কী করে?
- এখন পৃথিবীটা অনেক ছোট বিল্টু! রিপোর্ট পড়ে আমার সন্দেহ হয়েছিল। আমার অনেক ক্লাসমেট ডাক্তার। আমি ওদের রিপোর্টটা হোয়াটস অ্যাপ এ পাঠিয়েছিলাম – নামটা চেপে রেখে। ওরা সবাই একই কথা বলেছে। আমার ব্রেনে ক্যান্সার হয়েছে।
বিল্টু চুপ করে রইল। যাকে বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ধীরে ধীরে বলল, ‘হাবুলদাকে তো বলার দরকার। এতদিন আমি বলিনি আপনার খারাপ লাগবে ভেবে!’
- বলেই বা কী হবে বিল্টু? যা যা হবে – সেই গুলোই আগে আগে করি! বাড়ীটার একটা বন্দোবস্ত করি।
- আপনি বাড়ী বিক্রি করে কি হাবুলদার ওখানেই থাকবেন? নাকি...
- ততদিন তো আগে বাঁচি বিল্টু। পরে ওসব ভাববো।
বিল্টুর বৃদ্ধাশ্রমের কথাটা মনে এল, কিন্তু বলাটা সমীচিন হবে কিনা বুঝে উঠতে পারলো না। আজকাল এসব অঞ্চলেও বৃদ্ধাশ্রম এক-আধটা চালু হয়েছে। সব জায়গাতেই বৃদ্ধরা বোঝা, শহরে বেশী, মফস্বলে কম। সর্বোপরি দু-তিন কামরার ঘরে ওদের জন্য জায়গার সঙ্কুলান হচ্ছে না কারোরই। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার একেবারে অন্তস্থল থেকে। আজ যেন কমলেশ ওর মনের কথাগুলো পড়তে পারছেন। বললেন, বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়াই যায়, কিন্তু তাতে থোক কিছু টাকা লাগবে।
- সে তো বাড়ী বিক্রি থেকেই পেতে পারেন।
- আসলে কি জানো বিল্টু, মৃত্যুর আগে ছেলে মেয়ের অসম্মান বাড়িয়ে যেতে চাই না। হয়তো মনে মনে ওরাও এটাই চায়, তবু – মুখে তো বলেনি কোনওদিন। মরার আগে বৃদ্ধাশ্রমে গেলে ওদের সুনাম তো বাড়বে না! তাই ভালো লাগুক বা মন্দ লাগুক ওদের কারোর কাছে ওঠাই ভালো।
- তবে কাকু, নিজের অ্যাকাউন্টে ভালো মতো টাকা রাখুন, যাতে ইচ্ছে হলেই আপনি স্বাধীন ভাবে কোথাও চলে যেতে পারেন। আর একটা কথা আমার বলা উচিত হবে কিনা জানি না, তবে শুনেছি ক্যানসারের চিকিৎসার অনেক খরচ। এখন আপনার এই বাড়ী বিক্রির টাকা থেকে একটা বড় অংশ নিজের চিকিৎসার জন্য সরিয়ে রাখুন।
- এ বাড়ী কততে বিক্রি হওয়া উচিৎ বলে মনে হয় তোমার?
- এক কোটি বলে দেখুন। তবে তাড়াহুড়ো করলে আশি-পঁচাশিতে আরামসে বিক্রি হবে। কিন্তু কাকু, এই টাকা পেতে হলে আপনাকে প্রোমোটারকেই বেচতে হবে। আমি চেষ্টা করব – যাতে আপনি পুরো এক কোটিই পান।
বড় একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো কমলেশের। বিল্টু বলল, ‘আমি আপনার কষ্ট বুঝি কাকু! কিন্তু কী করবেন? আচ্ছা – আপনি কি এই ফ্ল্যাট কমপ্লেক্সে একটা ফ্ল্যাট চান? তবে কিন্তু কম টাকা পাবেন!’
- ফ্ল্যাট নিয়ে কী করব? আর এই বাড়ীর বুকে যে ফ্ল্যাট হবে তাতে কি আমি থাকতে পারবো? প্রথম কথা সহ্য হবে না, দ্বিতীয় কথা ততদিন বাঁচবো না।
- কাকু, আপনি কিন্তু হাবুলদাদের বলবেন ষাট লক্ষ টাকায় বাড়ী বিক্রি হয়েছে। ওদের এরকমই এক্সপেক্টেশন। তাহলে বাকী টাকাটায় আপনার চিকিৎসা ইত্যাদি হতে পারবে।
- মিথ্যে বলবো কেন বাবা? আমি তো মিথ্যে কথা বলিনা!
- স্যরি কাকু! কিন্তু এ না হলে সংসারে অশান্তি হবে যে!
- তুমি যে বলছো, দলিলে টাকার কথা লেখা থাকবে না?
- আজকাল প্রোমোটারটা পুরো টাকা কিছুতেই দেখায় না কাকু। ওরা সমানে ফোর্স করবে পঁচিশ পারসেন্ট ক্যাশে নিতে।
- এতে লাভ?
- সরকারকে কম ট্যাক্স দিতে হবে।
- না বাপু, আমি ট্যাক্স ফ্যাক্স ফাঁকি দিতে পারবো না। যে টাকায় কথা হবে, সে টাকাই দলিলে লিখবে।
- তাহলে দু-এক লাখ টাকা কম পাবেন কাকু!
- তা হোক।
- তবে ছেলে মেয়েকে কীভাবে ভাগ করবেন? পুরোটা দিয়ে দেবেন? বিল্টুর চোখেমুখে উৎকণ্ঠা।
- না। আমার বাড়ী যখন, নিজে কিছু রাখাটা তো অন্যায় হবে না। আমি বলেই রাখবো। আশিতে বিক্রি হলে দুজনকে তিরিশ করে দিয়ে দেবো। বাকীটা ব্যাঙ্কে আমার নামে রেখে দেবো।
৩
অনেক দফা খদ্দের দেখিয়ে অবশেষে বাড়ীটার বিক্রি ফাইন্যাল করে দিল বিল্টু। শহরের সবচেয়ে বড় প্রোমোটার। বিরানব্বই লাখ টাকায় সেটলমেন্ট করিয়ে দিয়েছে সে। আজই রেজিষ্ট্রি। কয়েকমাসের মধ্যে ঘর ছেড়ে দিতে হবে। ন’ই জানুয়ারী ভাঙার কাজ শুরু হবে। দিনটি নাকি শুভ। ধ্বংসের জন্যও শুভদিন – ভাবতেই একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল কমলেশের মেরুদণ্ড বেয়ে। এই বাড়ীর উপর হাতুড়ির বাড়ী পড়বে – না কি বুলডোজার – ভাবতেই কেমন মাথাটা শূন্য হয়ে এল তাঁর! এত ভাবুক হলে হবে না। রমলার কথায়, বাস্তববোধ দিয়ে ভাবতে হবে। তিনি তো বাড়ীটা বিল্টুকে দান করে দিতে চেয়েছিলেন – বিল্টুই অসম্মত হলো। হাবুলের চোখে নাকি সে ছোট হয়ে যাবে! লোকে নাকি বলবে – এজন্যই সে বুড়ো মানুষটার খোঁজ খবর নিত! হয়ত ঠিকই বলেছে বিল্টু। মৃত্যুর আগে তাকেই বা অকারণ অসম্মানে ফেলে দিয়ে কি হবে! তাঁর মৃত্যুর পর কোনও আশ্রম মঠকে ভালো কোনও কাজের জন্য দান করে দিয়ে গেলেও হয়তো হতো; তবে কি না টাকার দরকার, বড় দরকার! আর নিজের অপত্যদের স্বার্থচিন্তা কিছু মাত্রও কি তাঁর মনে আসে নি? টু-পার্সেন্ট হিসাবে বিল্টুর পাওনা হয় এক লক্ষ চুরাশি হাজার টাকা। কমলেশ পাঁচ লক্ষ টাকার একটা কিষাণ বিকাশ ওর নামে কিনে দেবার কথা ভেবেছেন। আর বিশলাখ টাকা তাঁর অ্যাকাউন্টে রেখে পঁয়তিরিশ করে দুই ছেলেমেয়েকে ভাগ করে দেবেন। বিল্টুকে আরও কিছু দিয়ে গেলে হ’তো! ওর তো ছেলে মেয়েও নেই। বেশী দিয়ে কী হবে? নিজেকে প্রবোধ দিলেন তিনি। আচ্ছা – চিকিৎসার জন্য কি কুড়ি লাখ টাকা লাগবে? যে টাকা বেঁচে থাকবে সেটা তো ব্যাঙ্কেই থাকবে। ব্যাঙ্কের নমিনি বিল্টুকে করে দিলে হয় না? থাক্! ওতেও ওর বিড়ম্বনা বাড়বে। রমলার সব গয়নাগাঁটিই তো বউমা আর মেয়ে ভাগ করে নিয়ে নিয়েছে। যদি একটা আধটা থাকতো, বিল্টুর বউকে দিয়ে দিলে হ’ত। আচ্ছা – ওর বউকে একটা ভালো দেখে হার আর বালা বানিয়ে দিলে হয় না? লাখ দুই-এ একটা ভালো জড়োয়ার সেট হয়ে যাবে। নিজের এই বুদ্ধিতে মনটা খুশি হয়ে গেল তাঁর। জানালা দিয়ে দেখলেন, বিল্টু – বাইরের গেট দিয়ে ভেতরে আসছে। রেজিষ্ট্রি অফিসে যাবার সময় হয়ে গেছে। বিল্টু এসে বলল,’আপনার বউমা – এই জলখাবারটা পাঠালো, খেয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন। ফিরতে ফিরতে কটা বাজবে ঠিক নেই!’
সব কিছু মিটে যেতে দুপুর তিনটে পেরোল। প্রোমোটার এক কথার লোক। সমস্ত টাকা চুক্তি মতো মিটিয়ে দিয়েছে সে। ভদ্রতা করে গাড়ী করে গেটের মুখে নামিয়েও দিয়ে গেল। আজ অনেকদিন পরে গেটের বাইরের থেকে বাড়ীটাকে দেখলেন তিনি। রমলাকে আদর করে মাঝে মাঝে রমা ডাকতেন। বাড়ীর নামও বড় বড় করে খোদাই করে লেখা ’রমা’। আর একমাস পরে এই বাড়ীটি ধূলিস্যাৎ হয়ে যাবে! আজ থেকেই নতুনের খেলা এখানে আইনত আরম্ভ হয়ে গেছে। কমলেশের মনে পড়লো – এই বাড়ীতেই রমলার সাথে নিভৃত হওয়ার স্মৃতি, হাবুল আর টুসীর দুষ্টুমি, হাবুলের মাথা ফেটে যাওয়া, রবিবার বন্ধুদের সাথে গল্প। এই বাড়ীতেই হাবুলের জয়েন্ট এন্ট্রান্সের আগে কত রাত জাগা, টুসীর পাত্র দেখা, সাধের খাওয়া – কোনও স্মৃতি আর বেঁচে থাকবে না কদিন পর থেকেই। কদিন পরে কেন? আজই কি আর কোনও স্মৃতি দেখাবে ওঁর ঠিক খাটের উপরে ছাদের বিমখানা বা উল্টোদিকের জানালার খড়খড়িটা? ধীরে ধীরে চোখটা নীচু হয়ে গেল তাঁর। তিনি আর ‘রমা’র সাথে চোখ মেলাতে পারছেন না। বিল্টুকে বললেন, এ ক’টা দিন তোমার বাড়ীতে আমাকে থাকতে দেবে বাবা?’ ওর সম্মতির অপেক্ষা না করেই আবার বললেন, শোবার ঘর থেকে আমার দু একটা জামা প্যান্ট গামছা আর দুটো লুঙ্গি নিয়ে এসো। তা দিয়েই এই ক’টা দিন চলে যাবে!
1 Comments
সুন্দর গল্প
ReplyDelete