জ্বলদর্চি

কুশ /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৬১
কুশ

ভাস্করব্রত পতি

অমৃতকুম্ভের সন্ধানে দেবতা এবং অসুররা একযোগে মন্দার পর্বত ও বাসুকি নাগের সহায়তায় সমুদ্র মন্থন শুরু করেন। তখন সেই মন্থনের ফলে আলোড়িত হয় সমুদ্র। তখন সেই আলোড়ন স্তিমিত করতে নারায়ণ কূর্ম অবতার রূপে মন্দার পর্বতকে নিজের পিঠে ধারণ করেন। সেসময় ঐ ঘর্ষণের ফলে কূর্ম অবতারের গায়ের কেশরাশি ঢেউয়ের সাথে ভাসতে ভাসতে তীরে এসে পৌঁছায়। যা পরবর্তীতে কুশগাছ রূপে জন্ম নেয়। বিষ্ণুপুরাণ অনুসারে কুশগাছের উৎপত্তি হওয়ার এই সুন্দর কাহিনিটি সকলেরই জানা। তাই বলা যায়, কুশগাছ একটি অতি পবিত্র গাছ, যার কথা হিন্দুধর্মের নানা গ্রন্থে প্রাচীনকাল থেকেই উল্লিখিত রয়েছে। 
পূজার্চনার সময় পুরোহিতের ব্যবহৃত কুশের আংটি

কুশকে সংস্কৃতে সূচীপত্র, মৃদুদর্ভ, কুশেশশ, হিন্দিতে ডব, কশ এবং ইংরেজিতে medow grass বলে। এছাড়াও কুশ পরিচিত যজ্ঞভূষণ, সূচ্যগ্র, দর্ভ, যাজ্ঞিক, শ্যামাক, সূচীমুখ, দীর্ঘপত্র, মুঞ্জ, পবিত্র, বর্হি, হ্রস্বগর্ভ, কুতুপ, কুথ নামেও। ল্যাটিন ভাষায় একে চেনা যায় ERAGROSTIS CYNOSUROIDES নামে। Poaceae পরিবারের অন্তর্গত। কুশ গাছের অগ্রভাগ খুবই তীক্ষ্ণ। নদী তীরবর্তী এলাকায় খুব জন্মায়। 
কুশগাছের ঝাড়

রামায়ণ অনুসারে কুশগাছের একটি কাহিনির সন্ধান মেলে। সীতা যখন বাল্মীকির আশ্রমে ছিলেন তখন কোনও একদিন সীতা বনে কাঠ কুড়াতে যাওয়ায় আগে বাল্মীকিকে তাঁর শিশু পুত্র লবকে লক্ষ্য রাখতে বলে যান। কিন্তু কিছু সময় পরে বাল্মীকি লবকে খুঁজে না পেয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। ফলে তখন তিনি তাঁর দৈবগুণের মাধ্যমে সীতা ফিরে আসার আগেই লবের মতো দেখতে কুশ দিয়ে তৈরি অবিকল একটি মূর্তি তৈরি করে তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। কিছু সময় পরেই সীতা আশ্রমে ফিরে এলেন। প্রায় সেসময়েই লবও বনের মধ্য থেকে ঘুরতে ঘুরতে আশ্রমে ফিরে এলেন। দুজন একই রকমের ছেলেকে দেখে সীতা অবাক! এরপর বাল্মীকি পুরো ঘটনা জানালেন সীতাকে। তখন ঐ কুশ দিয়ে তৈরি বালকের নাম হল কুশ। আর সীতা দুই পুত্র লব এবং কুশকে নিয়ে বড় করতে লাগলেন। বাল্মিকী রামায়ণে উল্লেখ আছে দর্ভ বা কুশের কথা --
'দীক্ষিতান্ জটিলান্ মুণ্ডান্ গঃ অজিন অম্বর বাসসঃ। 
দর্ভ মুষ্টি প্রহরণান্ অগ্নি কুণ্ড আয়ুধামঃ তথা'॥ 
সমুদ্রমন্থনের সময় কূর্ম অবতারের গায়ের লোম ছিঁড়ে কুশগাছের সৃষ্টি হয়েছে বলে কথিত

ব্রম্ভপুরাণ অনুসারে একসময় ঋক্, যজু, সামবেদী ব্রাহ্মণদের মধ্যে কার মান্যতা বেশি, এই নিয়ে তর্ক শুরু হয়। তখন তাঁরা সিদ্ধান্ত নেয় যে তৃণকে তাঁরা সামনে দেখেছিলেন তাঁকেই ব্রাহ্মণের প্রতিভূ করা হবে এবং তাঁকেই প্রধান করে যাবতীয় তর্ক মিটিয়ে ফেলা হয়। তখন থেকে কুশ নামক তৃণের মান্যতা গৃহীত হয়। যাবতীয় যজ্ঞকাজে এই কুশের স্পর্শ না থাকলে দেহ পবিত্র হবে না বা কার্য সিদ্ধ হবে না -- এই সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়। সেই থেকে কুশ গাছকে পবিত্র হিসেবে মান্যতা দেওয়া শুরু হয়। তর্পণ বা পূজার সময় পুরোহিতরা ডান হাতের অনামিকা আঙুলে কুশের তৈরি আঙটি পরিয়ে দেন। কুশের আসনে বসার রীতিও রয়েছে। 

'পঞ্চাশন্তিঃ ভবেৎ ব্রহ্মা, তদং বিষ্টরং ভবেৎ। 
তদন্ধং চোপযমনং তদদ্ধৈশ্চ কুশৈর্শ্বিজঃ।'
কুশগুচ্ছের সংখ্যার তারতম্যের উপর নির্ভর করে ব্রাম্ভণের প্রতিক তৈরি হতে দেখা যায়। অর্থাৎ পঞ্চাশটি কুশাগ্রের দিয়ে যেটি তৈরি হবে, তিনি ব্রহ্মা পদবাচ্য হবেন। তার অর্ধেক তথা পঁচিশটি কুশাগ্র দিয়ে তৈরি করলে তার নাম হবে 'বিষ্টর'। তার অর্ধেক দিয়ে যেটি, সেটির নাম হবে উপযমন। আর। আর তার অর্ধেক সংখ্যার কুশ দিয়ে প্রস্তুত হলে তা শ্রাদ্ধের কাজে ব্রাহ্মণের প্রতীক। ভাদ্র মাসের অমাবস্যা তিথিতে পবিত্র কুশ গাছ উপড়ে ফেলার শুভদিন বলে কথিত। তাই এই দিনকে বলা হয় কুশ অমাবস্যা। দর্ভাষ্টমীতে (ভাদ্রমাসে) কুশ পুজো করা হয়।

হিন্দুশাস্ত্রে কুশগাছ একটি অতি পবিত্র গাছ। যেকোনো পূজার্চনায় কুশগাছের ব্যবহার বাধ্যতামূলক। এ নিয়ে একটি চমকপ্রদ কাহিনি রয়েছে। বহু আগে ভ্রূত্রাসুর নামে এক মহা শক্তিশালী অসুর ছিল। তাঁর জ্বালায় দেবতাদের ওষ্ঠাগত প্রাণ। দেবরাজ ইন্দ্রও তাঁর বিখ্যাত অস্ত্র বজ্রায়ুধ দিয়ে তাঁকে পরাস্ত করতে পারেনি। বিপদ বুঝতে পেরে প্রজাপিতা ব্রহ্মা আসরে নামেন। তিনি ইন্দ্রের বজ্রায়ুধকে নিজের কমণ্ডলুতে ডুবিয়ে রেখে দেন। আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে বজ্রায়ুধ। ইন্দ্রকে ফের আক্রমণ করার নির্দেশ দেন। অবশেষে ঐ অস্ত্র দিয়ে ইন্দ্র ভ্রূত্রাসুর দৈত্যকে পরাজিত করতে সমর্থ হয়। বজ্রায়ুধ কিভাবে শক্তিশালী হল তা জানতে পেরে ভ্রূত্রাসুর চরম রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে প্রতিশোধ নিতে তৎপর হলেন। যেহেতু বজ্রায়ুধ জলে ডুবিয়ে রাখা হয়েছিল, তাই ভ্রূত্রাসুর নিজে প্রতিটি জলাশয়ে ডুবে জলের যাবতীয় শক্তিকে কেড়ে নিতে তৎপর হলেন। জলাশয় হয়ে উঠলো অস্পৃশ্য। তখন এটা দেখে ব্রহ্মা এই জলাশয়গুলিকে পবিত্র দর্ভ ঘাসে রূপান্তরিত করেন। শুদ্ধ হল সবকিছু। পুরাণের সেই ঘটনার স্মরণে আজও বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সামগ্রী শুদ্ধ করার জন্য কুশ গাছের সম্পৃক্ত জলের ছিটা দেওয়া হয়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করে যে, বোধিবৃক্ষের নিচে কুশের আসনে বসে ভগবান বুদ্ধ সিদ্ধিলাভ করেছিলেন।

আমরা অনেকক্ষেত্রেই 'কুশ পুত্তলিকা দাহ' করতে দেখি। আসলে কোনও অজ্ঞাতস্থানে মৃত্যু হলে বা দীর্ঘ ১২ বছর ধরে কারও সন্ধান না পাওয়া গেলে বা বিষ খেয়ে, গলায় দড়ি দিয়ে, দুর্ঘটনায় বা অন্য কোনো অবৈধভাবে মৃত্যু হলে সেক্ষেত্রে কুশ দিয়ে তৈরি ঐ ব্যক্তির একটি প্রতিমূর্তিকে দাহ করার পর শ্রাদ্ধশান্তি করার বিধান রয়েছে। এখন কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিশেষ বিরোধীতা প্রদর্শনে ওই ব্যক্তির কুশপুতুল দাহ করার রেওয়াজ চালু হয়েছে। যদিও কোনো ক্ষেত্রেই ওই কুশপুতুল নির্মিত হয়না কুশগাছের পাতা দিয়ে। কেননা অতি সহজলভ্য নয় কুশগাছ। কুশপুতুল বা কুশপুত্তলিকার প্রসঙ্গে পাই রামপ্রসাদের লেখায় "বিমাতার তীরে গিয়ে / কুশপুত্তল (কুশপুতুল) দহাইয়ে / অশৌচান্তে পিণ্ড দিয়ে / কালাশৌচে কাশী যাই।"

সাপেদের জিভ চেরা কেন, এ নিয়ে একটি মজার গল্প মেলে গরূঢ়পুরাণে। মহর্ষি কাশ্যপের ১৩ জন পত্নীর মধ্যে একজন ছিলেন কদ্রু এবং আরেকজন ছিলেন বিনতা। এই কদ্রুর ছিল এক হাজার সর্প সন্তান আর বিনতার দুই পুত্র গরূঢ় ও ঈগল। উচ্চৈশ্রবা ঘোড়ার লেজের রঙ কি আছে, এর উত্তর জানতে চেয়ে ছল করে কদ্রু বিনতাকে হারিয়ে দেয়। শর্ত মোতাবেক তাঁকে দাসী করে রাখে। তখন ঈগল এবং গরুড় তাঁদের জন্মদাত্রী মা' বিনতাকে সৎমা কদ্রুর দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে কদ্রুর হাজার সর্প সন্তানদের দাবি মতো স্বর্গ থেকে 'অমৃত' ফিরিয়ে এনে তাঁদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এজন্য দেবতাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতেও হয়েছিল তাঁদের। অমৃতের ভাণ্ড পেয়ে সর্পকূল মুক্তি দেয় বিনতাকে। কিন্তু গরূঢ় শর্ত দেয় যে এই অমৃত খাওয়ার আগে স্নান করে আসতে হবে। শুদ্ধাচারে অমৃত পান করাই বিধেয়। । । । আর অমৃতপূর্ণ কলসটি থাকবে কুশ তথা দর্ভ ঘাসের আসনে। সর্পকূল স্নান করতে গেলে সেই অবসরে দেবরাজ ইন্দ্র অমৃতপূর্ণ কলসটি হস্তগত করে নেন। সর্পকূল ফিরে এসে অমৃত না পেয়ে ঐ ধারালো প্রান্তদেশ বিশিষ্ট কুশগাছের পাতা চাঁঠতে শুরু করে। তাঁদের মনে হয়েছিল, ঐ কুশগাছের পাতায় অমৃত লেগে থাকতে পারে। কুশগাছের ধারালো প্রান্তদেশে চাঁঠার ফলে তাঁদের জিভ চিরে ফালাফালা হয়ে যায় বলে কথিত। সেই থেকে সাপেদের জিভ চেরা। 

চরক সংহিতা, অষ্টাঙ্গ হৃদয় এবং সুশ্রুত সংহিতায় বিভিন্ন রোগের উপশমকারী হিসেবে কুশমূলের কথা উল্লিখিত হয়েছে। চরকের সূত্রস্থানে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় অধ্যায়ে কুশমূলকে দেহের শোধনকার্যের উপযোগী দুর্দান্ত ভেষজ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। একে অথর্ববেদে মৃত্যু ও ক্রোধনাশী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে পাই --
'অয়ং দর্ভো বিমন্যুকঃ স্বায় চারণায় চ।
মন্যোর্বিমন্যুকস্যায়ং মন্যুশমন উচ্যতে॥
এই অথর্ববেদের আরেকটি স্থানে আলোচিত দর্ভ বা কুশ ঘাসকে শরীরের শত্রুনাশক, প্রাণবর্ধক এবং রোগনাশক বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। 
'পঞ্চ রাজ্যানি বীরুধাং সোমশ্রেষ্ঠানি ব্রূমঃ।
দর্ভো ভঙ্গো যবঃ সহস্তে নো মুঞ্চন্ত্বংহসঃ'॥
রক্তপ্রদর রোগ, পিত্তবিকার, প্রস্রাবে জ্বালা, পিত্তথলিতে পাথর, ঘা, অর্শরোগ, পিপাসা, ফোঁড়া, গায়ের দুর্গন্ধ নিরাময়ে কুশ খুব উপকারী। প্রাচীন বৈদ্যককল্পে পাই --
'অরুন কর্ম কর্মকৃতঃ সহ বাচা ময়োভুবা। 
ভেষজ মসি ভেষজং বর্হি পুরুষায় ভেষজম্'।
কুশের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে 'কসমিক রেডিয়েশন' বা তেজস্ক্রিয়তা শোষণ করার ক্ষমতা রয়েছে। কুশ ঘাস অতিরিক্তমাত্রায় তেজস্ক্রিয় রশ্মি শোষণ করতে পারে। প্রাচীনকাল থেকে পানীয় জল বা খাদ্যদ্রব্যের পাত্রে কুশ রেখে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল সম্ভবত এই কারণেই। কুশগাছের নির্যাস অ্যান্টি অক্সিডেন্ট হিসেবে পরিচিত।

🍂

Post a Comment

0 Comments