জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা ১৮১ তম সংখ্যা

ছোটোবেলা ১৮১ তম সংখ্যা
চিত্রগ্রাহক - রাকেশ সিং দেব

সম্পাদকীয়,
রাকেশ আঙ্কেলের তোলা চগোট্ট বন্ধুর ছবিটা দেখলেই বসন্ত এসে গেছে মনে হচ্ছে। শীত চলে গেছে। তবু শীতের আমেজ ধরে রেখেছে শীতের সময়ে পসরা সাজিয়ে মাঠ দখল করে বসা মেলাগুলো। সবিতা পিসির ছড়ায় সেই শীত বুড়ি আর তার সঙ্গী বইমেলার কথা পড়ে নিও। বইমেলা নয় এবারের শীতে ছক্কা মেরেছে প্রয়াগের কুম্ভমেলা। কোটি কোটি ভক্ত সেই মেলায় গিয়ে ত্রিবেণী সঙ্গমে কুম্ভ স্নান করে আসছে। সেই মেলার গল্প শুনে নিও তানিয়া আন্টির কাছ থেকে। ভানুপ্রিয়ার ছড়া প্রতিবারের মতো সুন্দর তা যে পড়বে সেই বলবে। তোমরাও লেখ ওর মতো, ছড়া কিংবা গল্প। বিপ্লব জেঠু বলেছে জেরির গল্প। সুহার গল্প। এরা কারা তা তোমরা গল্প পড়লেই জেনে যাবে। জয়দীপ আর অভিষিক্তার  মতো তোমরাও ছবি পাঠিয়ে আমাদের ছোটোবেলার বন্ধুদের আনন্দ বাড়িয়ে দিতে পারো৷ রাজর্ষি আঙ্কেলের লেখা পাঠ প্রতিক্রিয়া পড়ে তোমরাও লিখে ফেল তোমাদের প্রতিক্রিয়াটি আর পাঠিয়ে দাও আমাদের দপ্তরে। সামনে দোল। আবির খেলার ছবি পাঠিয়ে ছোটোবেলা রাঙিয়ে তোলো নিজেরাই। -- মৌসুমী।


কুম্ভমেলার গল্প
তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়

ছোট্ট সোনা বন্ধুরা,তোমরা নিশ্চয়ই সবাই মেলা দেখেছো মানে তোমাদের শহরের বা গ্রামের দুর্গাপূজোর বা চড়কের বা অন্য যে কোনো মেলায় ঘুরতে যেতে তোমাদের নিশ্চয়ই খুব ভালো লাগে। মেলায় কত্ত দোকান, কত্ত লোকজন, তাই না? আসলে মেলা কথার উৎস মিলন বা মিলিত হওয়া বা একত্রিত হওয়া অর্থাৎ সমাবেশ। আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম মেলার আয়োজন হয়। এর মধ্যে একটা মেলার নাম তোমরা এখন খবরের কাগজ বা টিভি বা সোশ্যাল মিডিয়ায়  খুবই শুনতে পাচ্ছো, সেটা হলো কুম্ভমেলা। ভারতে হলেও এই মেলাটি এখন আর শুধু ভারতের নয় সারা বিশ্বের অন্যতম সেরা মেলা বলে আখ্যা পেয়েছে। 
এই মেলাটার নাম কুম্ভমেলা হলো কেন জানো? সে এক মস্ত কাহিনি। রামায়ণ আর মহাভারত দুটোতেই আমরা সমুদ্র মন্থন করে অমৃত পাওয়ার গল্প পাই। সে-ই অমৃত একটা কলসী মানে কুম্ভের মধ্যে রাখা ছিল। এই অমৃতের জন্যই তো দেবতা আর অসুরদের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধেছিল। দেবতারা তো কিছুতেই অসুরদের অমৃত দিতে রাজী নয়,তা-ই দেবরাজ ইন্দ্রের ছেলে জয়ন্ত অসুরদের লুকিয়ে সেই অমৃতের কলসী নিয়ে পালিয়ে গেল। এই তাড়াহুড়ো করে পালানোর সময় মর্ত্যের চারটি জায়গায় চারফোঁটা অমৃত সেই কলসী থেকে চলকে পড়ে যায়। সেই চারটি জায়গা হলো প্রয়াগরাজ,হরিদ্বার, নাসিক এবং উজ্জয়নী। দীর্ঘ বারোদিন ধরে দেবাসুরের যুদ্ধের সময় চন্দ্র ও বিভিন্ন দেবতারা এই অমৃত কলস রক্ষা করেন। এ গল্প পুরো বলবো অন্যসময়। 
বেদ বা পুরাণ কাহিনীতে সমুদ্র মন্থনের কাহিনি ছাড়াও ত্রিবেণী সঙ্গমে স্নান অর্থাৎ প্রয়াগে স্নান ইত্যাদির কাহিনি  পাওয়া গেলেও কুম্ভমেলার কথা কিন্তু পাওয়া যায়নি।
১৯ শতকের আগে কিন্তু কুম্ভমেলা নামের মেলার ঐতিহাসিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি এখনো। 
ঐতিহ্যগত ভাবে মনে করা হয়, ৮ম শতাব্দীতে আদি শঙ্করাচার্য সারাদেশের বিভিন্ন মঠ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের একত্রিত হওয়ার জন্য একটি সমাবেশের প্রচেষ্টা করেছিলেন,সেটিই আধুনিককালে কুম্ভমেলা রূপে প্রচলিত হয়ে চলেছে। 
হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী বৃহস্পতি, সূর্য ও চন্দ্রের এক বিশেষ অবস্থানের উপর ভিত্তি করে এই মেলার স্থান এবং সময় নির্ধারিত হয়। যেহেতু বৃহস্পতির কক্ষপথ ১১.৮৬ বছরে সম্পূর্ণ হয় তা-ই গঙ্গানদীর তীরে হরিদ্বার, গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর সঙ্গমে প্রয়াগরাজ, গোদাবরী নদীর তীরে নাসিক এবং শিপ্রা নদীর তীরে উজ্জয়িনীতে কুম্ভমেলা ১১ বছর অন্তর সেই জায়গায় ফিরে আসে। 
এসব নিয়ে অনেক অঙ্ক কষতে এখন তোমাদের হবেনা। 
তবে বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অনুভব করতে পারা সত্যিই খুব বড়ো ব্যাপার। Once in a lifetime achievement বলতে পারো। ২০১৩ সালে প্রয়াগরাজ পূর্ণকুম্ভ মেলায় গিয়ে আমার একটাই অনুভব হয়েছিল যা তোমাদের বলতে পারি, তা হলো কুম্ভমেলায় অমৃতের সন্ধান করতেই মানুষ যায় কি না জানিনা তবে কোটি কোটি মানুষ যেখানে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পরস্পরকে ঘিরে এক উৎসব পালন করে সেখানে অবশ্যই অমৃত কলস উপচে পড়ে। মনুষ্যত্ব যে দেবত্বেরই রূপান্তর, চোখের সামনে তা ঘটছে দেখতে পেলে শুধু শরীরের অমৃতস্নান নয় অন্তরের অমৃতস্নানও হয় বইকি। বড়ো হয়ে  আগামী কুম্ভমেলায় যেয়ো তোমরা আর আমাদের শুনিও তোমাদের সেই অভিজ্ঞতার গল্প।


শীতের বেলা 
সবিতা রায় বিশ্বাস 

মেঘ কুয়াশার চাদর গায়ে 
শনের নুড়ি চুল ঝাঁকিয়ে 
শীতের বুড়ি আসে 

জিরেন কাটে সুবাস ওঠে 
গন্ধে মেতে ভ্রমর ছোটে 
রস খাবার আশে

দুষ্টু ভারি সুয্যি মামা 
পরতে চায়না রোদের জামা
মিটমিটিয়ে হাসে 

রোহিত গিল গ্লাভস প্যাডে 
ছক্কা মারে ক্রিকেট ব্যাটে 
শিশির ভেজা ঘাসে 

বিকেলে জমে বইয়ের মেলা 
গানের সাথে কুইজ খেলা 
বইপ্রেমীরা আসে 

নতুন বই দেখতে ভালো 
জ্বালায় মনে জ্ঞানের আলো
খুশিতে মন ভাসে 

যায় ফুরিয়ে শীতের বেলা 
চড়ুইভাতি মজার মেলা 
পৌষ মাঘ মাসে | 
জয়দীপ সাহা
নবম শ্রেণী, সোদপুর হাই স্কুল, উত্তর ২৪ পরগণা

🍂

গল্প:- ছানাটাকে কে নিল
বিপ্লব চক্রবর্তী

অলকেশ বাজারের ব্যাগটা রেখে দেখল, লিপিকা  ঘর বারান্দা করতে করতে তাকের বই সরিয়ে সরিয়ে কি যেন খুঁছেছে। অলকেশকে দেখলেও বাজারের ব্যাগ দেখছে না। সুহা চুপটি করে মায়ের পিছু পিছু ঘুরছে। রান্না গুছোবার সময় লিপিকার মাথায় কী যে ঢুকল বোঝার জন্য অলকেশ জিজ্ঞাসা করল,কি, হয়েছেটা কী, আমাকে বল? 
 লিপিকা কোন কথা না বলে বিছানার চাদর তোশক গদি খাটের তল একে একে ছানমিন করতে লাগল। মেয়ের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারল সুহা কোন না কোন দুষ্টুমি  করেছে। সেটাকেই বের করার চেষ্টা  করছে। 
অলকেশ মেয়েকে ইসারায় জানতে চাইল ,কী হয়েছে নতুন কিছু করেছিস না কি? 
বাবার ইসারা পেয়ে আঙুলটা ঠোঁটে রেখে মায়ের কান আড়াল করে ফিসফিস করে বলল, চুপ, জেরিকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে! টম ওকে খুঁজছে‌পেলে মেরে ফেলবে!
মৃদু ধমক দিয়ে উঠল অলকেশ, কী দুষ্টুমি করেছিস বল।
  অলকেশের রাগী আওয়াজে সুহার উচ্ছ্বাসটা দমে গেল। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। লিপিকা খোঁজাখুঁজির মধ্যে থাকলেও বাবা মেয়ের দিকেও নজর রাখছিল। সুহার ঐ ভাবে উচ্ছ্বাসহীন হয়ে পড়াটা লক্ষ্য করল। খাট থেকে সোজা নেমে এসে সুহার কানটি ধরে বলল, ঘরে কী ঢুকিয়েছিস বল?  
সুহা আরো নীরব হয়ে গেল মায়ের রাগী চোখ দেখে। অলকেশ বুঝল মা মেয়ের মাঝখানে ঢুকতে হবে। জেরি নামক রহস্যটা জানতে হবে। অলকেশ মুহূর্ত ভেবে নিয়ে লিপিকার হাত থেকে মেয়ের কানটা ছাড়িয়ে মেয়েকে কোলে তুলে নিল। 
বাবার কোল পেয়ে সুহা বুকের ভেতর নিজের মুখটা লুকিয়ে ফেলল। শিশু মন এটা বুঝে গেছে বাবার কোলটাই এইরকম বিপদে একমাত্র আশ্রয়। তা দেখে লিপিকা রাগে ফেটে পড়ল, এই বাপসোহাগী মেয়ে জীবনে মানুষ হবে না। প্রতিদিন  কিছু  না কিছু ক্ষতি করবেই! তারপর কিছুটা থেমে বলল, আমাকে বল ঘরে কী ঢুকিয়েছিস!কিছু  বলব না।
সুহা সেই যে অলকেশের  বুকে মুখ গুঁজেছে কিছুই বলছে না। 
       ঘর ছেড়ে বারান্দায় আসতেই সামনের কামিনি ফুল গাছ থেকে প্রতিদিনকার বুলবলি পাখি দুটো অলকেশের  মাথা ঘেঁষে বার বার উড়ে যাচ্ছে ডাকতে ডাকতে। প্রতিদিন সকাল বেলা সামনের বারান্দায় চা খেতে বসলে অনেকগুলো ছাতার পাখি,দুটো বুলবুলি ,দুটো শালিক পাখি সামনা সামনি ওড়াওড়ি করে। সুহাই বিস্কিট ভেঙে সামনে ছড়িয়ে দিয়েছিল কয়েকদিন আগে। প্রথমে ভয় পেত পাখিগুলো। এখন ভয় ভেঙে গেছে। সামান্য দূরত্বে  হেঁটে হেঁটে খুঁটে খায়। সকালে চা খাবার সময় হলেই ওরা চলে আসে। খেয়ে চলে যায়। আজ এই সময়েও বারান্দার গ্রিলের চারপাশে ওড়াওড়ি করছে। দু দুবার সুহার মাথায় ঠোঁট ছুঁয়ে উড়ে গেল। সুহা খিল খিল করে হেসে উঠল। কিছুতেই  বুলবুলি পাখি দুটো সামনে থেকে যাচ্ছে না। সুহার মাথা ছুঁয়ে বারবার উড়ে যেতেই সুহা মজা পেয়ে গেল। বাবার কোল থেকে ঝপ করে নেমে গেল। পাখি দুটোও ওকে ছাড়ছে না। এমন কান্ড দেখে লিপিকাও উঠোনে নেমে এল। বেশ উপভোগ করার মত দৃশ্য বটে। সুহা উঠোনময় দৌড়তে দৌড়তে বলছে, জানো বাবা ওরা না জেরিকে খুঁজছে!
অলকেশ মেয়ের উচ্ছ্বাসের তালে তাল মিলিয়ে বলল, জেরিটা কে সেটাই তো বুঝতে পারছি  না! কার্টুনের জেরি হঠাৎ এখানে তোর কাছে এল কি করে!
--তুমি টম কে দেখতে পাচ্ছ না, লুকিয়ে বসে আছে জেরিকে ধরার জন্য। 
--আমাকে দেখা
--কেউ লুকিয়ে থাকলে কি ভাবে দেখাবো বল। টমকে  জাননা তুমি খুব হিংসুটে আর দুষ্টু। 
--তাই বুঝি।  
-- তুমিতো জেরিকে চেনোই না বাবা!
অলকেশ অগত্যা মেয়ের অভিযোগ মেনে নিয়ে বলল, চিনিনা বলেই না তোর কাছে জানতে চাইছি জেরি ভূতটা কে?
জেরিভুত কথাটা সুহার কানে যেতেই অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে ছোটাটা থামিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। অলকেশ বুঝল কথাটা মেয়ের পছন্দ হয়নি। মেয়ের সামনে গিয়ে বলল, জেরিতো আমার চেনাজানা কেউ নয় তাইতো ভূত বললাম। 
লিপিকা বাপমেয়ের এই আদিখ্যেতা দেখে দাঁত চেপে টিপ্পনী কাটল, ওটা ভূত নয়, শ্যাঁওড়া গাছের পেত্নী!
সুহা সম্ভবত শ্যাঁওড়াগাছ শব্দটা বোধহয় প্রথম শুনল। বাবাকে মায়ের কান বাঁচিয়ে জিজ্ঞাসা  করল, বাবা শ্যাঁওড়া গাছ কোথায় থাকে? 
 অলকেশ একবার লিপিকার দিকে কটমট করে তাকালো মাঝখানে ফুট কাটার জন্য। মেয়ে এদিকে নাছোড়,বল না বাবা, ঐ গাছটা কোথায় থাকে?
--ওটা একটা গাছের নাম। জংগলে হয়! কোনো কোনো বাড়িতেও হয়।
---তাহলে তো আমাদের বাড়িতেও আছে। বল না বাবা গাছটা কোথায়? 
সুহার বাড়াবাড়িতে অলকেশ ফাঁপড়ে পড়ে গেল। জেরিরহস্য ভেদ করতে তড়িঘড়ি  বলল, ওরে বাবা ও গাছের সামনে আমি যাব না!
সুহা জিজ্ঞেস  করে, কেন যাবে না? 
অলকেশ চোখদুটো বড়বড় করে বলল, জানিস না ওই ভয়ঙ্কর গাছটাতে ভুতের বউ পেত্নী থাকে। সামনে গেলেই কটমট করে চিবিয়ে খাবে। 
অলকেশের বলার ভঙ্গিমাতে সুহা খুব মজা পেয়ে গেল। আনন্দে হাততালি  দিয়ে বলে উঠল, দারুন মজা হবে বাবা, আমরা তাহলে শ্যাঁওড়া গাছে জেরিকে লুকিয়ে রেখে আসব। টম আর খুঁজে পাবে না। অলকেশ এবার নিজের প্যাঁচে নিজেই পড়ে গেল। 
সুহা এবার বায়না দ্বিগুন বাড়িয়ে চেপে ধরল বাবাকে, চল না বাবা,ওই পেত্নী থাকার গাছটা দেখাবে। জেরিকে  বাঁচাতে হবে তো!
অলকেশের হাত ধরে টানতে লাগল। 
সুহার বায়নাটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যেতেই লিপিকা  মেজাজ ধরে রাখতে পারল না। হাতের সামনে হাতপাখাটা তুলে ধরে ধমকে উঠল, পাখার বাঁট দিয়ে পিটিয়ে আজকে তোর পেত্নী ছাড়াবো আমি!
পাখা উঁচু করে মেয়েকে ভয় দেখাতেই গ্রিলের দুই পাশে বসা বুলবুলি পাখি দুটো ভয় পেয়ে উড়ে গিয়ে কামিনি গাছে গিয়ে বসল। সুহা ভয়ে বাবাকে জড়িয়ে  ধরল। লিপিকার কিছু একটা মনে হতেই বারান্দা থেকে উঠোনে নেমে এল। 
সুহা চুপি চুপি অলকেশকে বলল, চল বাবা আমরা পেত্নী থাকার গাছটা দেখে আসি। 
অলকেশ অগত্যা বাড়ির পেছন দিকে মেয়েকে শ্যাঁওড়াগাছ চেনাতে চলল। কাঁঠালগাছের পাশ দিয়ে  সামান্য এগলে অলকেশের বাড়ির একটা পরিত্যক্ত ডোবা আছে। সারাবছর সেখানে বাড়ির আবর্জনা ফেলা হয়। একমাত্র প্রবল বর্ষা হলে ডোবাটা জলে ভর্তি হয়ে ওঠে। এখন বর্ষাকাল ডোবাটা জলে ভর্তি। ডোবার চারপাশে  বিভিন্ন রকমের জংলা গাছের বাড়বাড়ন্ত। নারকেল গাছ বেলগাছ আমগাছের পাশ দিয়ে ঢালুপাড়ে জট ওয়ালা শিকড় আর ছোটো পাতার ঝোপের মতো ঝুঁকে পড়া গাছ টিকে দেখিয়ে বলল, এটাকে শ্যাঁওড়া গাছ বলে!
সুহা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস  করে, পেত্নীকে তো দেখছি না! পেত্নী কোথায়  ?
-- পেত্নীকে খালি চোখে দেখা যায় না। ওরা কক্ষনো মানুষের সামনে আসে না!
-- কেন আসে না মানুষের সামনে? 
---মানুষ তো পেত্নীর চাইতেও ভয়ঙ্কর। তাই ভয়ে ভয়ে লুকিয়ে থাকে। আর আমাদের দেখে!
অলকেশের বলার ভঙ্গিমায় সুহা বেশ মজা পেয়ে গেল। বাবাকে গোপনকথা বলা যায় এই ভরসাটা পেতেই বাবার কানের কাছে মুখ এনে বলল, চল বাবা, আমরা এই গাছের মধ্যে জেরিকে বসিয়ে দিয়ে যাই। মাকে বলবে না। মা তাহলে জেরিকে ফেলে দেবে। তখন টম ওকে ঠুঁকরে ঠুঁকরে মেরে ফেলবে!
বলতে বলতে সুহার চোখটা জলে ভিজে উঠল। গলাটায় কান্নার রেশ অলকেশের কানে এসে লাগল। 
অলকেশ এতক্ষণে মেয়ের বিশ্বাস অর্জন করতে পারার আনন্দে মনে মনে নেচে উঠল। বলল, চল আমরা  জেরিকে নিয়ে আসি!
মেয়েকে নিয়ে সামনের উঠোনের দিকে পুনরায় এগোতে লাগল। অলকেশেরও কৌতূহল বেড়ে গেছে জেরি নামক  অস্তিত্ব টিকে দেখার। আসলে মেয়ের চোখ দিয়ে মেয়ের বিস্ময় আর কৌতূহলী চোখ দিয়ে শিশুর জগৎ দিয়ে নিজেকে দেখতে চায় বলেই মেয়েকে নিয়েই দিনের অনেকটা সময় তার কেটে যায় অলকেশের। মেয়ের দুষ্টুমির মধ্য দিয়েই নিজের শৈশব দেখার এই খেলা অলকেশ সুযোগ পেলেই খেলে। উঠোনে ফিরে আসতেই ওরা দেখতে পেল কামিনি গাছের ডালে আবৃত ঝোপটার ভেতর লিপিকা উঁকি দিয়ে কি যেন দেখছে। বুলবুলি পাখি দুটো লিপিকার কিছুটা দূরে, কামিনি গাছের পাতার  ফাঁকে বসে ডেকে চলেছে। অলকেশ দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস  করল, অমন করে কী দেখছো? 
---তোমার  মেয়ের কীর্তি দেখছি! 
--মানে
অলকেশকে কিছু না বলে সুহাকে জিজ্ঞেস করল, বুলবুলি পাখির বাচ্চাটা কোথায়?  কী করেছিস। 
সুহা একবার বাবার মুখের দিকে একবার মায়ের দিকে তাকাতেই অলকেশের মাথায় বিদ্যুৎ চমকে উঠল। মেয়ের মুখের দিকে তাকাতেই দুষ্টুমি হাসিটা দেখতে পেল। 
    অলকেশ জানে বছরে অন্তত দুবার এই কামিনি গাছের ডালের আড়ালে বুলবুলি পাখি ডিম পাড়ে। ডিম পাড়া থেকে বাচ্চা ফোটা পর্যন্ত কাকের উৎপাত লেগেই থাকে। কাকের হাত থেকে ডিম রক্ষা করতে ছোট্ট পাখি দুটোর গলদঘর্ম চলতে থাকে। পালা করে ছেলে পাখিটা আর মেয়ে পাখিটা পাহাড়া দেয়। কাক ওঁত পেতে থাকলেও সুবিধা করতে পারে না। লিপিকা গাছের আশেপাশে  কাক দেখলেই তাড়ায়। সুহা সেটা লক্ষ্য করে। কাক ধারে কাছে  থাকলেই মাকে জানান দেয়। সে ও তাড়ায়। 
     সবচেয়ে অসুবিধা হয় ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোবার পর। ছানাগুলো কচিকচি ডানা মেলে খাবারের জন্য চ্রিং চ্রিং  করে ডাকতে শুরু করলে কাকেরা বাসার সঠিক জায়গাটা খুঁজে বের করে নেয়। যতক্ষণ না ছানাগুলো নিজেদের পাখায় ভর করে উড়ে যেতে না পারছে বুলবুলি পাখির সঙ্গে লিপিকাকেও কাক তাড়াতে হয়। এবার তিনটে ছানা ফুটে ছিল। দুটো কাক ঠুঁকরে মেরে ফেলেছে। একটা  ছানা বেঁচে ছিল। লিপিকা কামিনি গাছের ডালগুলোকে একজায়গায় করে দিয়েছিল কাক যাতে সরাসরি এসে ঠোঁকরাতে না পারে। সেইমত একটা ছানা এখনো বেঁচে থাকার কথা। লিপিকা সকালে উঠোনে ঝাঁটা দিতে গিয়ে দেখছে শেষ ছানাটাও নেই। কাল বিকেলেও ওটাকে দেখা গেছে। এত নিচু ডালের ঝোপের আড়ালে এই পাখিগুলো বাসা বাঁধে যে কেও চেষ্টা করলে দেখতে পারে। সুহা প্রতিদিন  একটা ডালে পা দিয়ে ওপরের ডালে হাতের ভর দিয়ে ওঠে। বাচ্চা গুলোকে দেখে। কাল বিকেলেও দেখেছে।
   লিপিকার দেখাদেখি অলকেশ  মাথাটা উঁচু করে ঝোপ সরিয়ে দেখল শেষ ছানাটা ওখানে নেই। মনটা বিমর্ষ হয়ে গেল অলকেশের। গাছ থেকে মাথা সরিয়ে দাঁড়াতে সুহা  বাবার হাতটা ধরে ছাদের ওপর দেখাল। প্রতিদিনের  দুষ্টু  কাকটা ছাদের কার্ণিশে বসে একদৃষ্টে সব লক্ষ্য করছে। সুহা দেখিয়ে বলল, ওই  দ্যাখ বাবা দুষ্টু টম ওখানে বসে আছে। তাকিয়ে দেখেই অলকেশ বিরক্তিতে হাতটা তুলে বলল, হুঁশ হুঁশ!
   লিপিকা উঠোন ঝাঁট দিয়ে ঘরে আসার পর ঘর থেকে পাখির ছানার আওয়াজ পেয়ে মনে করেছে, বোধহয় সুহা ছানাটাকে গাছ থেকে তুলে নিয়েছে। সেটাই খুঁজছিল। ঘরে খুঁজে না পেয়ে মেয়ের ওপর দোষ চাপাতেও পারছে না। বুঝতে পারছে না বুলবুলির শেষ ছানাটাকে কে তুলে নিল। কাক না তার মেয়ে সুহা
   বাবা মেয়ে একসঙ্গে ঘরে ঢুকল। দুজনের মুখই খুশীতে ডগমগ। লিপিকার কৌতূহলী দৃষ্টি বাপমেয়েকে অনুসরণ  করতে লাগলো। 
অভিষিক্তা দাস
চতুর্থ শ্রেণি, রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মিশন স্কুল, ব্যারাকপুর

দুঃখ সুখের মাঝে
ভানুপ্রিয়া মাহাত
একাদশ শ্রেণি, জওহর নবোদয় বিদ্যালয়, পশ্চিম মেদিনীপুর


কষ্ট শুধুই কষ্ট, 
কষ্ট এলে সবাই কেন 
বুক ফাটিয়ে কয় ?
সুখ এলে তো সবাই তাকে
আগলে ধরে রয় ।

সুখ, আহা ! কি সুখ 
ক্ই আমি কাউকে তা 
শুনলাম না বলতে,
সবার শুনি দুঃখ জ্বালা 
চিল্লে চিল্লে বুক ফাটে । 

সুখের পরে দুঃখের পালা
চিরন্তন এ এক সত্য 
কান্না হাসি নিয়েই জীবন 
সহজ সরল কথ্য ।

সবাই যদি চাই শুধু সুখ 
দুঃখের ভাগটা কে নেবে ?
কর্ম যেমন করবে তুমি
তেমনি তার ফল পাবে ।

ভাবে যদি কেউ সুখটা নিয়েই 
পালাবে সে তেপান্তর 
জেনে রাখ দুঃখ তোমার 
পৌঁছে যাবে দোর তক ।

সুখ- দুঃখ মানিয়ে নিয়েই 
এ জীবন সুন্দর, 
কান্না হাসির মায়াঘরেই
অপরূপ ও মনোরম।


পাঠপ্রতিক্রিয়া
জ্বলদর্চি ছোটোবেলা ১৮০ 
আলোচক - রাজর্ষি মন্ডল

জ্বলদর্চি ছোটোবেলা একটি অনলাইন পত্রিকা যেটি সম্পাদনা করে চলেছেন মাননীয় সম্পাদক মৌসুমী ঘোষ ম্যাডাম। যে কোনো পত্রিকার সম্পাদকীয় সেই পত্রিকার মানসিকতা বোঝার পক্ষে বড় সহায়ক। এই সংখ্যার সম্পাদকীয় আমাকে সুযোগ করে দিয়েছে এই পত্রিকা ছোটদের জন্য কতটা উন্নতমানের তা জানতে বা  বুঝতে। ছোটদের প্রতি মৌসুমীদেবীর ভালবাসা, তাদের মনের খোরাক যে এই পত্রিকার সর্বোচ্চ কাম্য তা খুব সুন্দর করে তুলে ধরেছেন তিনি। আর পত্রিকার পেজ খুললেই মন ভালো হয়ে যায় কচি  কাঁচাদের উজ্জ্বল মুখের ছবি দেখে। 
           সরস্বতী পুজোর দিন পত্রিকা প্রকাশিত হওয়ায় খুব স্বাভাবিক ভাবেই দেবী সরস্বতীর নদী হিসেবে পূজা পাওয়া থেকে শুরু করে সেই নদী তীরে সভ্যতার বিস্তার, যাগ যজ্ঞ, বেদ পাঠ, সাম গান, তারপর এই নদীর দেবী হয়ে ওঠার চালচিত্র, দেবীর বাহন কেন হাঁস হল, তার তাত্ত্বিক আলোচনাটুকুও এমন সুমিষ্ট ভাবে আর বাচ্ছাদের সম্পূর্ণ উপযোগী করে বর্ণনা করেছেন যে, লেখক তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়কে যত আন্তরিকভাবেই ধন্যবাদ দেওয়া হোক না কেন তা কম বলে মনে হবে।
            সুকুমারীর অভিযান নামে চঞ্চল দাশগুপ্ত যে মজার গল্পটি পরিবেশন করেছেন সেটি পড়ে আমার মতো বুড়োরও যদি হেসে গড়াগড়ি দেওয়ার অবস্থা হয় তাহলে ছোটরা পড়েও যে অনাবিল আনন্দ পাবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সুকুমারী নাম্নী বিড়ালটি যে কাণ্ড কারখানা বাধায় তার সরস উপস্থাপনায় চঞ্চলবাবু সত্যিই মুগ্ধ করেছেন।
              অভীক মুখোপাধ্যায়ের কুস্তিখেলা ছড়াটি শুধু অপূর্ব একটি শিশুতোষ ছাড়াই নয় ছড়াটি ভীষণ বুদ্ধিদীপ্তভাবে লেখা আর দারুণ রকম মজার। পু আর তার দাদা পুকুবাবু পুতুল নিয়ে কী কী খেলা করল আর খেলায় ঝগড়ু সিং আর জয়মালার কেমন কেমন আলোড়ন তোলা অবস্থা হল তার বিবরণ পড়তে পড়তে হাসির ফোয়ারা উঠে আসে, নির্মল হাসিতে মন ভরে যায়। তবে ছড়াটির মাত্রা, তাল আরো সুসংবদ্ধ হলে আরো উচ্চ মানের হতে পারত ছড়াটি।
          শেষে প্রকৃতির ছেলে গোপাল নামের লেখাটি আসলে প্রকৃতি বিজ্ঞানী গোপালবাবুর ছেলেবেলা পেরিয়ে মান্য বৈজ্ঞানিক হয়ে ওঠার গল্প, যেটি খুব সহজ করে গল্পের মাধ্যমে, একেবারে ছোটদের উপযোগী করে, নিটোল গল্প আকারে পরিবেশন করেছেন ধ্রুবজ্যোতি দে।

             শেষে বলব জেভিয়ার্স ইনস্টিটিউটের পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়া অস্মিতা ঘোষের লেখা টুনটুনির গাছ নামের ছোট্ট  গল্পটি নিয়ে। কী সুন্দর করে যে অস্মিতা বন্ধুত্বের বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছে, কী অপরিসীম আন্তরিকতায় সব বন্ধুরা সোনালী ফল ভাগ করে খেল তা আমাদের বড়দের কাছেও একটি শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে রয়ে গেল। খুব ভাল লাগল কেশপুর গার্লস হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী তনুজা খাতুনের করা পেন্সিল ড্রয়িংটি। কারা যেন বলে প্রতিভার অভাবে বাংলা লেখালিখি নাকি গোল্লায় যাচ্ছে। কিন্তু এই দুই খুদে প্রমাণ করে দিয়েছে যে খুঁজে খুঁজে বার করতে পারলে আসলেই প্রতিভার কোনো অভাব ঘটে নি। এমন সুন্দর পত্রিকা ছোট থেকে বড়, যে কারো মন ভরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সম্পাদক মৌসুমী ম্যাডামকে আবারো অসীম ধন্যবাদ জানাই।  শুধু চাইব এমন একটি পত্রিকা শুধু ডিজিটাল না হয়ে ছাপানো পত্রিকা হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করুক।


Post a Comment

0 Comments