জ্বলদর্চি

কুঁচ /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৬৩
কুঁচ

ভাস্করব্রত পতি

'কুঁচবরণ কন্যা রে তার মেঘ বরণ কেশ।
ওরে আমায় নিয়ে যাও রে নদী সেই সে কন্যার দেশ রে।।
পরনে তার মেঘ ডম্বুর উদয় তারার শাড়ি
ওরে রূপ নিয়ে তার চাঁদ সুরুজে করে কাড়াকাড়ি রে
আমি তারি লাগি রে
আমি তারি লাগি বিবাগী ভাই আমার চির পথিক বেশ'।।
  -- কাজী নজরুল ইসলাম
কুঁচফলের মত গায়ের রঙ আর কালো চোখযুক্ত সুন্দরীর রূপ বর্ণনার 'কুঁচবরণ কন্যা' নামের উপমা মেলে কাজী নজরুল ইসলামের গানে। কুঁচফলের বীজের রঙ দুধে আলতা রঙের মতো। তা থেকেই কুঁচবরণ কন্যার নামকরণ করা হয়েছে বলা যায়। এই অসাধারণ সুন্দর চোখযুক্ত কুঁচফল সাদা, কালো সহ নানা রঙয়ের হলেও সবচেয়ে বেশি পাওয়া ‌যায় লাল রঙের কুঁচ। কুঁচফলকে কেউ খায়না। কিন্তু ফলটি দেখতে দারুণ সুন্দর। লাল সিঁদুরের মতো রঙ। এর মধ্যে কালো কাজলের রঙের মতো একটি ফোঁটা রয়েছে। যা এঁর রূপবৈচিত্র্য বাড়িয়ে দিয়েছে। তা নিয়েই রাজশাহী এলাকার গ্রামাঞ্চলের লোকধাঁধায় শোনা যায় --
'সিঁদুরে ডগমগ কাজলের ফোঁটা, 
এক হাজারে হাজার ফলে একটাই বোঁটা'।
খোলকের মধ্যে কুঁচফল

কুঁচগাছ হল লতানো উদ্ভিদ। শাখা প্রশাখায় বিন্যস্ত। বনে বাদাড়ে অতি অযত্নে জন্মাতে দেখা যায়। এই সুন্দর কুঁচ ফলটিকে সুন্দরী মেয়ে বলেই কল্পনা করা হয়েছে দুই ২৪ পরগনা জেলায় --
'সিঁদুরের ঝলমল কাজলের ফোঁটা, 
এমন সুন্দরী মেয়েটি তোমার বনে কেন বাসা'? 
হাওড়া জেলার লোকেদের মুখেও শোনা যায় এরকম একটি ছড়া --
'রক্তে টলমল কাজলের ফোঁটা
দেখিতে এমন সুন্দর, বনে কেন বাসা'? 
বাংলাদেশের বগুড়ার লোকেদের বলতে শোনা যায় --
'লাল ডুগডুগ মুণ্ডুটি
তাতে কাল চোখটি'। 
কুষ্টিয়াতে লোকমুখে উচ্চারিত হয় --
'লাল ডুগ ডুগ মুণ্ডুটি
তাতে কালো চোখটি'। 
কুঁচফলের মালা

এঁর প্রতিটি পত্রদণ্ডে ২০ - ৪০ টি ২ - ৩ ইঞ্চি লম্বা মাপের পাতা থাকে। তেঁতুল পাতার মত ছোট ছোট পাতা। এদের শাখা বেশ নরম। ভাদ্র আশ্বিন মাসে প্রচুর ফুল ফোটে। এর পুষ্পদণ্ডে প্রচুর ফুল থাকে। শিম ফুলের মত দেখতে এর ফুল। ফুলের বাইরের অংশ পশমের মতো নরম। তবে আকারে কিছুটা বড়। ফুলের গায়ে লাল বা সাদা রঙের আভা দেখা যায়।

কুঁচকে সংস্কৃতে গঞ্জা, গুঞ্জ, হিন্দিতে ঘুঁষচি, চিরমিটি, মারাঠিতে গুঞ্জা, কন্নড়ে গুলাগাঞ্জি, তেলুগুতে গুরুভিন্দা গিঞ্জা, মালয়লামে কুন্নিকুরু, তামিলে করিন, কুণ্ডুমনি, ওড়িয়াতে রুঞ্জ, অসমীয়াতে হব্ নামে চেনে। আবার আফ্রিকাতে Ojuologbo (Yoruba), Oto Berebere (Igbo), Idonzakara (Hausa), ফারসিতে চশমেখ্ রুশ, ঘানাতে Obirekuaiura, সিংহলীতে ওলিণ্ডা এবং নাইজেরিয়ায় বলে Nneminua। ইংরেজিতে বলে Jequirity, Indian Liquorice, Crab's eye, Rosary Pea, Precatory Pea or Bean, Weather Plant, Paternoster Pea, Love Pea, Prayer Bead, John Crow Bead, Coral Bead, Red Bead Vine, Country Licorice, Indian Licorice, Wild licorice এবং Jamaica Wild Licorice। চিনের ট্যাং রাজবংশের সময়কালে ওয়াং উই 'One hearted' (Xiāng Sī / 相思) নামে একটি কবিতায় Abrus precatorius কে 'Red Bean' (hóng dòu / 红豆) বলে লিখেছিলেন। এছাড়াও কুঁচ পরিচিত চূড়ামনি, রত্তি, অরুণা, তাম্রিকা, শাঙ্গুষ্ঠা, কৃষ্ণলা, রক্তিকা, কম্ভোজী, কুঁচ, সোনাকুঁড়ি, কইচ গোটা, ভিল্লিভূষণা, মাণচূড়া, সৌম্যা, শিখন্ডী ইত্যাদি। কুঁচের বিজ্ঞানসম্মত নাম Abrus precatorius Linn। এটি Fabaceae পরিবারের অন্তর্গত। এটি মূলতঃ এশিয়া এবং অষ্ট্রেলিয়ার গাছ। এছাড়াও কুঁচফলের আরও কিছু প্রজাতির নাম হল --
Abrus maculatus Noronha
Abrus pauciflorus Desv.
Glycine abrus L.
Orobus americanus Mill.
Zaga latifolia Raf.
Zaga parvifolia Raf.
 কুঁচগাছের পাতা

গ্রামাঞ্চলে ছোটবেলায় অনেকেরই এই ফলটির সঙ্গে ভালো পরিচিতি থাকলেও, বর্তমান প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা অবশ্য এই ফলকে দেখা তো দূরের কথা, নামটুকুও শুনেছে বলে মনে হয়না। আসলে নগর সভ্যতার করালগ্রাসে পরিবেশগত অবক্ষয়ের কারণে ক্রমশঃ হারিয়ে যেতে বসেছে লতানে এই গাছটি। বগুড়া এলাকার একটি জনপ্রিয় শ্লোকে মেলে কুঁচফলের উপস্থিতি --
'সিন্দুরেরি ডগমগ, কাজলেরি ফোঁটা
এই শিল্লোক যাঁই ভাঙ্গাবার পারবি
তাই চাঁন খাঁর বেটা। 
চাঁন খাঁর ব্যাটা লয়রে
চাঁন খাঁর লাতি
এই শিল্লোক ভাঙ্গাতে লাগবি
আশ্বিন আর কাতি'। 
কুঁচ

প্রাচীনকালে সোনা পরিমাপ করার জন্য কুঁচ বীজ পরিমাপক হিসেবে ব্যবহৃত হত। আসলে প্রতিটি কুঁচফলের ওজন same to same। সময়ের পরিবর্তনের সাথেও ওজনের হেরফের হতনা। তাই স্বর্ণকাররা তাঁদের দোকানে সোনা ওজন করার বাটখারা হিসেবে প্রতিটি কুঁচফলকে ১ রতি বলতো। এইজন্য কুঁচফলকে বলে রতিফল। 
১ কুঁচ = ১ রতি
৮ রতি = ১ মাশা
১২ মাশা = ১ তোলা
১ তোলা = ১১.৬ গ্রাম
শুঁটিযুক্ত কুঁচফল

কুঁচফল শুঁটির মতো। এগুলি ১ - ২ ইঞ্চি লম্বা। বীজগুলো পেকে গেলে বিভিন্ন রঙের হয়। ময়মনসিংহের লোকজন বলে --
'লাল লাঠি তিলের ফোঁটা
এই শিলোক যে ভাংগায় সে বাপের বেটা'। 
কুঁচফলের বাইরের খোলক খুব শক্ত। কিন্তু বীজের ভেতরের অংশ খুব বিষাক্ত। গবাদি পশু খেয়ে নিলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। সাধারণত দু ধরনের কুঁচফল দেখা যায়। একটি রক্তকাঁচ, যার সারাদেহ রক্তবর্ণ। আর মুখের কাছে কালো। আরেকটি হল শ্বেতকুঁচ, যার সারাদেহ সাদা। মুখের কাছে কালো। একে বলে শ্বেতগুঞ্জা, ভিরিন্টিকা, কাকাদনী। মথুরাতে ভগবান বিষ্ণু এবং শ্রীকৃষ্ণের সাথে কুঁচফলের সংস্পর্শ রয়েছে। এখানে কখনও কখনও কুঁচফলের মালা পরানো হয় শ্রীকৃষ্ণের গলায়। তবে কুঁচের পাতা, শিকড়, ছাল থেকে নানা ধরনের ভেষজ ঔষধ তৈরি হয়। কুঁচের মূলের চেয়ে পাতার স্বাদ মিষ্টি। কুঁচফলের বাইরের আস্তরণ খুব কঠিন। বীজের ভিতরের অংশ মারাত্মক বিষাক্ত।  ভুল করে ঘোড়া বা অন্যান্য কোনও কোনো গবাদি পশু খেয়ে নিলে মৃত্যু হতে পারে। 
গাছে ঝুলছে কুঁচফল

কুঁচকে বলে গুঞ্জা। তাই 'গুঞ্জা ফুলের মালা' কথাটিও এই কুঁচ থেকেই এসেছে বলে অনেকের ধারণা। বুদ্ধদেব গুহর  একটি উপন্যাসের নাম 'গুঞ্জা ফুলের মালা'। কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন --
'গুঞ্জা মালা গলে কুঞ্জে এসো হে কালা
বনমালী এসো দুলায়ে বনমালা॥
তব পথে বকুল ঝরিছে উতল বায়ে
দলিয়া যাবে বলে অকরুণ রাঙা পায়ে
রচেছি আসন তরুণ তমাল ছায়ে
পলাশ শিমুলে রাঙা প্রদীপ জ্বালা॥
ময়ূরে নাচাও তুমি তোমারি নূপুর তালে
বেঁধেছি ঝুলনিয়া ফুলেল কদম ডালে
তোম বিনা বনমালী বিফল এ ফুল দোল
বাঁশি বাজাবে কবে উতলা ব্রজবালা'॥

🍂

Post a Comment

1 Comments

  1. কমলিকা ভট্টাচার্যMarch 16, 2025

    বাহ!

    ReplyDelete