জ্বলদর্চি

অব্যয় /পুলককান্তি কর

চিত্র- শুভম দাস 

অব্যয়

পুলককান্তি কর

প্রস্তাবটা শুনেই বড় বিব্রত বোধ করলেন যযাতি।সবিনয়ে বললেন, এসব তো ছেলেখেলা নয় অঞ্জনবাবু, মানুষের জীবন নিয়ে সমস্যা, আপনি বরং অন্য ডাক্তারবাবুদের পরামর্শ নিন।

 – দেশের বড় বড় সব হাসপাতালেই তো দেখিয়েছি যযাতিবাবু, কেউই তো ভরসা দিচ্ছেন না, কোনও উন্নতিও হচ্ছে না গত দু–বছরে।

– একটা ব‍্যাপার পরিষ্কার করে বলুন তো অঞ্জনবাবু, আপনি ডাক্তার কবিরাজ ছেড়ে রোগ নিয়ে এক কবির শরণাপন্ন কেন হলেন? আজকাল মিউজিক থেরাপি–টেরাপি হয় শুনি, সে রকম কারুর কাছে যান বরং – তাঁরা বোধহয় ভেষজহীন চিকিৎসা দিয়ে আপনার বান্ধবীর সমস্যা দূর করতে পারবেন।

– সে চেষ্টাও করা হয়ে গেছে যযাতিবাবু। কিন্তু আমার মন বলছে, এ সমস্যা একমাত্র আপনি সারাতে পারেন।

– এমন মনে হওয়ার কারণ?

–লিপি, মানে আমার বন্ধুটি আপনার লেখার, বিশেষ করে কবিতার অন্ধভক্ত। ও আপনার শব্দপ্রয়োগের দক্ষতা নিয়ে খুব বাঙ্ময় থাকতো। আপনার শব্দগুলোকে ও আক্ষরিকভাবে ছুঁতো – সেসময় ওর চোখ-মুখের বিহ্বলতা এমন হ'তো, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। 

–আপনার বন্ধুটির বয়স?

–সাঁইত্রিশ।

–বিবাহিতা?

– না। অঞ্জনবাবু একটু থেমে খানিকটা করুণ রসিকতার সুরে বললেন, ওকে বিয়ের কথা বললে ও বলতো ‘পৃথিবীতে একমাত্র যযাতি প্রস্তাব দিলে বিয়ের কথা ভেবে দেখতে পারি, নচেৎ নয়!’

    যযাতি কিঞ্চিৎ লাজুক হলেন, বিনম্র গলায় বললেন, ‘তার মানে তো এই নয় অঞ্জনবাবু, আমি গেলেই উনি ভালো হয়ে যাবেন!’

– আমি তো একবারও বলিনি যযাতিবাবু! মনের রোগ একবার দুবারে সারে না। সময় লাগে। লাগাতার ওকে সঙ্গ দিতে হবে, আপনার শব্দ নিয়ে ও যদি আবার ভাবতে শুরু করে, ও আবার আগের মতো হাসিখুশি অবস্থায় ফিরতে পারবে বলেই আমার বিশ্বাস।

–আপনি নিরপেক্ষভাবে ভাবুন অঞ্জনবাবু, আমি ব্যস্ত থাকি; আমার পক্ষে নিরবচ্ছিন্ন সময় দেওয়া কি সম্ভব?

–যযাতির পক্ষে কী না সম্ভব যযাতিবাবু! যদি যযাতি নিজের যৌবন কাউকে অকাতরে দিয়ে দিতে পারে তার কাছে তো এসব তুচ্ছ! 

🍂

–আমি নকল যযাতি অঞ্জনবাবু, আমায় মাফ করবেন। এ প্রস্তাব মানা আমার পক্ষে সম্ভব নয়! 

   বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অঞ্জন। হালকা হাসি ঠোঁটের কোণে টেনে বললেন, ‘ঠিক আছে আমি উঠি; আমার ঠিকানা ফোন নাম্বার দিয়ে গেলাম, যদি কখনও মন পরিবর্তন হয়, জানাবেন । 

   ভারী বিচিত্র এক অনুভূতি হল যযাতির। এমন প্রস্তাব তো জীবনে কখনো পাননি; এই পরিস্থিতিতে কী করা উচিৎ তিনি ভেবেও পাচ্ছেন না। সর্বোপরি এই ধরনের রোগীর কাছে অ্যাপ্রোচটা কি হওয়া উচিত সেটাই তো অজানা। যারা প্রফেশনাল কাউন্সেলার নিশ্চয়ই তারা এতদিন চেষ্টা করেছেন, সুতরাং প্রথাগত পথে ভেবে লাভ নেই। তবু বন্ধু এক সাইকিয়াট্রিস্টকে ফোন করলেন যযাতি। 

–হ্যালো সঞ্জয়, তুমি কি ব্যস্ত ভীষণ? 

–কেন তোমার কাব্য পেয়েছে বুঝি? 

–না। কাব্য এখন পালাবার পথ খুঁজছে! 

–কেন, কী হল আবার?

–আমার এক ভক্তপাঠিকা কী সব জটিল নার্ভের রোগে একেবারে বাকরুদ্ধ! জীবনের প্রতি কোনও আকর্ষণ নেই, কোনও কিছুতে উদ্দীপনা নেই। 

–তো! 

–আমার উপর তার চিকিৎসার ভার পড়েছে! 

–এ তো সিভিয়ার ডিপ্রেশন! তা তুমি কী করবে তাতে? কবিতা শোনাবে? কবিতা থেরাপি!

–জানিনা কী করবো, তাই তো ফোন করলাম তোমায়! 

–চেনো মেয়েটিকে? 

–না। 

–তাহলে? চেনাশোনা থাকলে তাও না হয়... তা বয়স কত? 

–বললো তো সাঁইত্রিশ।

–তোমার কত? পঞ্চান্ন?

–তেপান্ন প্লাস!

–ওই হলো! ভালো; বেশ রোমান্টিক এক্সপেরিমেন্ট করে এসো ভাই। তবে আবার নীপাকে এসব বলতে যেও না। তোমার এক্সপেরিমেন্টের দফারফা করে দেবে! বউরা আবার এসব উটকো অশান্তির শুরুতেই কোপ মেরে দেয়। 

–নীপা এমন নয় সঞ্জয়! 

–তুমি কবি মানুষ, মনের সূক্ষ্ম ভালোবাসার অনুভূতি নিয়ে তোমার কাজ কারবার – মনের জিলিপির প্যাঁচ তুমি বুঝবে কী? সূক্ষ্ম স্থূল কত রকমের অনুমান, প্রমাণ, কল্প বিকল্পের খেলা চলে মনে মনে – তোমরা তার কী বুঝবে! বোঝো হয়তো, কিন্তু আমরা নিয়মিত তার প্রমাণ পাই। 

–এসব কথা ছাড়ো। যদি সত্যি সত্যি আমি মেয়েটির কাছে যাই আমার অ্যাপ্রোচটা কেমন হবে, যদি হেল্প কর! 

–এসব কথা ফোনে ফোনে হয় না ভাই! কল্পনা করে সিচুয়েশন অনুযায়ী বানিয়ে বলা যাবে না। মনের রোগে অন্ দা স্পট ডিসিশন নিতে হয়। পার্টি কী বললো? পেশেন্ট কোনও প্রশ্ন ট্রশ্ন করলে রেসপন্স করে? 

–‘না’ এর মতোই। ক্বচিৎ–কদাচিৎ!

–গিয়ে দ‍্যাখো! 

–ধর, সে আমাকে চিনতেই পারলো না, তখন কি আমি হাতে বা গায়ে আমার নাম বা শব্দ লিখে দেবো? তাতে কি সে শব্দের অর্থ ফিল করতে পারবে? 

–তুমি কি 'ব্ল‍্যাক' সিনেমার অমিতাভ বচ্চন নাকি? নিউরো সাইকিয়াট্রিক ডিসঅর্ডার যখন, ওসব বিশেষ কাজ করবে বলে মনে হয় না! তুমি ওর চিকিৎসার কাগজপত্র পাঠিও, আমি তখন না হয় তোমাকে কিছু ওষুধ বা বিহেভিয়ার রিলেটেড কয়েকটা পরামর্শ দিতে পারব। 


(২)

  এখন থেকে থেকেই ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠে যযাতির। এক ভক্তপাঠিকা যাকে চেনা নেই জানা নেই – তার জন্য রোজ রোজ বাড়ি থেকে দশ কিলোমিটার উজিয়ে গিয়ে শব্দ খেলার কোন মানে হয়? তাও যদি সেই খেলার নিয়ম–কানুন কিছু জানা থাকত! প্রতিদিন যাওয়া এবং না যাওয়ার দোলাচলে থাকতে থাকতে নিজের লেখাজোখা শিকেয় উঠেছে। অবশেষে যাওয়াই স্থির করলেন যযাতি। 

   বাঁশদ্রোণীর কাছেই পুরনো আমলের একটা বাড়ি। কলকাতার জমির দুর্দিনেও বাড়ির সামনে অনেকটা জায়গা। পুরনো দিনের কয়েকটা গাছ। একটা লম্বা সুপারি আর তিনটে পাম গাছ। বহুদিনের আগাছায় ভরে গেছে। মনেই হচ্ছে, বাড়ির মালিকের দৃষ্টিছায়ার বাইরে গিয়ে অভিমান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলো, কখন আবার প্রিয় হাতের স্পর্শ পাবে, এই আশায়।

   বাড়িতে এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা থাকেন, অঞ্জনবাবু বললেন, উনি লিপির মা। লিপি একটি ঘরে শুয়ে; বেশ কোঁকড়ানো গোছা ভরা চুল, মুখে চোখে প্রবল বিষাদের ছাপ – মাঝারি রং, মুখখানা বড় মায়াময়। এককালে দেখতে বেশ সুন্দরী ছিল বোঝাই যায়। অঞ্জনবাবু বেশ আগ্রহ নিয়ে চোখ গোল করে লিপিকে বললেন, ‘দেখ্ লিপি, তোর কাছে কে এসেছেন! যযাতি!’ 

   লিপি কিছু না বলে চোখ বড় বড় করে তাকালো। বোঝা গেল যযাতি শব্দটা হয়তো ওর মনের কেন্দ্রে পৌঁছেছে। যযাতি হাত তুলে নমস্কার করলেন, প্রতিনমস্কার করল না লিপি। 

   অঞ্জনবাবু বললেন, কী রে খুশি হোসনি? তোর কতদিনের সাধ ছিল যযাতি তোর কাছে আসবেন! 

লিপি বোধহয় আবার হারিয়ে গেছে ওর জগতে। যযাতি বললেন, ‘হঠাৎ এমন করে কী হয়ে গেল অঞ্জন বাবু?’ 

–আমরাও বুঝিনি। এক্সাক্টলি কী থেকে যে এই সমস্যা তাও পরিষ্কার নয়!

–কোনো প্রণয়জনিত সমস্যা? 

–না বোধহয়! হলে জানতাম। অঞ্জনবাবু পরিষ্কার গলায় বললেন। একটু চুপ থেকে আবার বললেন 'একটু এ ঘরে আসুন'।

–আপনার সাথে সম্পর্ক? যযাতি বেশ সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলেন। 

–আমরা বাল্যবন্ধু। ছোটবেলা থেকে একসাথে খেলেছি, একই সাথে পড়েছি উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত। 

–শুধু কি এটুকুই? মাফ করবেন অঞ্জনবাবু, আসলে বিষয়টা তো আমার কাছে পরিষ্কার হওয়া দরকার। 

–আমি কিছু মনে করিনি। আপনি ঠিকই জিজ্ঞাসা করেছেন, সম্পর্কটা বন্ধুত্বের বাইরে আমি নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম; লিপি রাজী হয়নি। 

–কেন? 

–জানিনা। ও আমাকে বন্ধুর মতো ভালোবাসে; এর বেশী কিছু জায়গা সে আমার জন্য বরাদ্দ করতে চায়নি। 

–কেন? অন্য কেউ কি ওর মনে দুঃখ বানানোর কারিগর আছেন? 

–সেটা বোধহয় আপনি। আপনার লেখাটেখা পড়ে ও বেশ কিছুক্ষণ নিজের মধ্যে সুপ্ত হয়ে যেত শেষ দিকটায়! 

–আপনি বিয়ে করেছেন অঞ্জনবাবু?

–হ্যাঁ। পাঁচ বছর হল। 

–লিপি কি তারপর থেকে অসুস্থ? 

–না। ব্যাপারটা বছর দুই হল ডেভেলপ করেছে। 

–প্রথম প্রথম আপনারা কী দেখে সন্দেহ করলেন? 

   অঞ্জনবাবু বললেন, ‘চলুন, এবার লিপি ঘরে যাই – এই সংক্রান্ত আলোচনা ওর সামনে হলেই ভালো। অন্তত ওর চোখে মুখে কোন অভিব‍্যক্তি বদলাচ্ছে কিনা, আপনি বুঝতে পারবেন।’

  

   লিপির ঘরে এসে একটা ডায়েরী খুললেন অঞ্জন। একটা কবিতা যযাতির হাতে দিয়ে বললেন, ‘পড়ুন এটা।’ 

যযাতি দেখলেন, সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা তাঁরই একটি কবিতা – 'যেটুকু ছুঁয়েছি কাছে/ যতখানি দূর/ সেসব হারানো গেছে,/ মেঘ ছুঁয়ে বেলা/ দাও দাও সুনিবিড়/ হৃদয় কৃপণ/ পড়ন্ত বিকেল বুঝে/ আরো অবহেলা...’ –এ তো আমারই লেখা, কোনও পত্রপত্রিকায় বেরিয়েছিল বোধহয়। 

–হ্যাঁ। এই লেখাটা একদিন আমাকে শোনাতে শোনাতে ওর চোখগুলো কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে গেল। কথাগুলো অস্পষ্ট এবং আবোল তাবোল হতে হতে কখন চুপ করে গেল – ঠিক যেন সমাধিস্থ... কী করব – জলের ছিটেটিটে দিয়ে কিছুক্ষণ পরে স্বাভাবিকের মতো হল। 

–কী বলছিল সে?

–আমার একটা কথা মনে আছে, ও বলছিল, 'দ‍্যাখ এই যে 'অবহেলা' শব্দটা বোঝানোর মতো কোনও অব‍্যয় নেই আমাদের অথচ খুব প্রয়োজন ছিল... 

–ঠিক বুঝলাম না অঞ্জনবাবু!

–যেমন ধরুন, আমরা বলি খাঁ খাঁ ঘর, ধূ ধূ মাঠ – এসব জায়গায় খাঁ খাঁ বা ধূ ধূ বললেই নির্জনতার বা বিস্তীর্ণতার একটা প্রকাশ আপনাআপনি হয়ে যায়। অথচ আপনি ভাবুন তো, অবহেলাও একটা মনোজগতকে বিদীর্ণ করার বড় একটা ফ্যাক্টর, অথচ তার জন্য তেমন কোনও অব্যয় নেই। 

যযাতি তাকিয়ে দেখলেন লিপির দিকে। সে একমনে ওদের দুজনের কথা শুনছে বলেই তো মনে হচ্ছে! যযাতি উঠে গিয়ে লিপির  দু–হাত মুঠোয় ধরে খুব আন্তরিকভাবে বললেন, 'বাঃ! কী সুন্দর ভেবেছেন আপনি! ঠিকই তো, আমি তো এমনটা ভাবিনি কখনও! বাঃ! খুব ভালো। আমি নিশ্চই এর জন্য কোনও অব্যয় খুঁজবো; খুঁজে আপনাকে জানাবো।’ 

অঞ্জন বললেন, শেষ যেবার আপনার লেখা নিয়ে ওর সাথে কথা হল, সেটা হল, ‘ওই দুপুর নিঃসঙ্গ ধূ ধূ' লেখাটা নিয়ে... 

যযাতি বললেন, ‘পুরো লেখাটা মনে নেই, কিছুটা মনে আছে –  লেখাটা ছিল এইরকম – দুপুর নিঃসঙ্গ ধূ ধূ/ ছায়া গ্রাস করে/ কে তুমি ছিনিয়ে নিলে রোদ্দুরের আলো?/ বেশ বেশ! ভেবেছ কি সন্ধে হয়ে যাবে?/ সন্ধ্যে তো শূন্যতা নয়, শোক নিয়ে আসে/ আমি বেশ নিভু নিভু শোক হয়ে যাব... ’

–আপনার এই লেখাটা নিয়ে ও খুব উচ্ছ্বসিত ছিল – বিশেষ করে ‘সন্ধে তো শূন্যতা নয়, শোক নিয়ে আসে...’। দেখুন প্রতিটি কাল একেক রকম মানসিক ভার বয়ে আনে... সেটা খুব সুন্দর ফুটেছেও লেখাটায়। লিপি এই নিয়ে খুব আপ্লুত হয়েই ছিল, কিন্তু ওর ওইরকম অ্যাটাকটা এলো 'দুপুর নিঃসঙ্গ ধূ ধূ' লাইনটা পড়ে। 

–এটা তো নির্দোষ লাইন... 

–ঠিক নির্দোষ নয় যযাতিবাবু! ওই যে 'অব্যয়'! 

–কোনটা? ধূ ধূ? 

–হ্যাঁ। দেখুন এখানে ধূ ধূ টা কার বিশেষণ? 'নিঃসঙ্গ' নাকি 'দুপুরের'? নাকি 'ধূ ধূ দুপুর' এটাই 'নিঃসঙ্গের' বিশেষণ? 

–কবিতায় তো এটাই মজা অঞ্জনবাবু! পাঠক, যেভাবে নেবেন সেই মতো বাক্যটির সৌন্দর্য ফুটবে। 

–সেটা ঠিক আছে। লিপি আপ্লুত হয়েছিল এই বিষয়টা নিয়েই। ‘ধূ ধূ’ – এই ধ্বন্যাত্মক অব্যয় মাঠ বা বালিয়াড়ি এইরকম বিষয়ের শূন্যতা এবং বিস্তার দুটোকেই বোঝায়, কিন্তু ‘খাঁ খা’ এমনটা নয়। এটা কেবল শূন্যতাই বোঝায়। কিন্তু 'নিঃসঙ্গের' বিশেষণ হিসেবে সাধারণভাবে 'ধূ ধূ' বসে না। এইটা বলতে বলতেই লিপি কেমন একটা হয়ে যায়। তারপর আর তার সাথে এসব আলোচনার সুযোগ হয়নি। সেদিনই আমি ওকে ডাক্তার দেখাই। তারপর ও কেবল ঝিমিয়েই থাকে। 

–হ্যাঁ– নার্ভের ওষুধে তো ঘুমপাড়ানি দেওয়া থাকে; সেজন্যই হয়তো হতে পারে।

–হবে হয়তো। কিন্তু যযাতিবাবু, আমার নিজেরও একটা প্রশ্ন, নিঃসঙ্গ বোঝাতে অব্যয় ব্যবহার হতে পারে?

–জয় গোস্বামীর একটা কবিতা পড়েছিলাম, সেখানে উনি – "হা নিঃসঙ্গ সঙ্গ চাও সঙ্গ চাও কার" বাক‍্যটি ব্যবহার করেছিলেন। এখানে 'হা' ব্যবহার করা যেতে পারে – যদিও এখানে 'হা' অব্যয়টা নিঃসঙ্গতার মাত্রা বোঝাচ্ছে না, নিঃসঙ্গ ব্যক্তিটিকে বোঝাচ্ছে। অনন্বয়ী অব্যয়ের একটা প্রকার এটা। 

–যযাতিবাবু আপনারা তো শব্দ নিয়ে কারবার করেন; লিপির মতো সত্যি সত্যি এরকম মনোজগতের তোলপাড় কি আপনাদেরও হয়? 

–সঠিক জানিনা অঞ্জনবাবু। হয় তো নিশ্চই, তবে মাত্রার মধ্যে থাকে বলে হয়তো আমরা লিখতে পারি। আপনার বন্ধুর ক্ষেত্রে এই তোলপাড়টা এত বেশী হয়ে গেছে যে ওঁর মনের সমস্ত শৃঙ্খল ভেঙে গেছে – এইজন্যেই উনি অসুস্থ হয়ে গেছেন। 

–অব্যয় যে মানুষের জীবনকে এভাবে নড়বড়ে করে দিতে পারে জানলে পড়ার সময় আরও ভালো করে পড়তাম। 

–জানেন তো রবি ঠাকুর অব্যয় নিয়ে কী বলেছেন? যযাতি জিজ্ঞেস করলেন। 

–কী? 

–উনি বলেছেন – সৈন্যদলের পেছনে যেমন একদল অনুযাত্রিক থাকে, তারা রীতিমতো সৈন্য নয়, অথচ তাদের নইলেও চলে না। তারা সৈন্যদের নানাবিধ প্রয়োজন সরবরাহ করতে থাকে। অব‍্যয়ও তেমনই। বাংলা ভাষার পেছন পেছন তারা ঝাঁকে ঝাঁকে হাজার অর্থ প্রকাশ করতে থাকে – অথচ অভিধানকারেরা তাদের গুরুত্ব দেন না। এরা অত্যন্ত কাজের, অথচ অজ্ঞাত, অবজ্ঞাত। 

–ঠিক কথা। কিন্তু ধরুন বহু শব্দের তো সত্যি সত্যি অব্যয় বলা নেই! যেসব অনুভূতি শ্রুতিগ্রাহ্য নয়, তাদের প্রকাশ করার জন্য সত্যিই তো শব্দ চাই। লিপির এই ভাবনা এখন দেখছি আমাকে ছুঁয়েছে যযাতিবাবু। আমি এখন একটু একা বসলেই নানান শব্দ ভাবতে বসি যেগুলোর প্রকাশক কোনও অব‍্যয় নেই। 

–যেমন? 

–অবহেলা, বিহ্বলতা, শোক, নিঃসঙ্গ, বিষন্ন – কত বলব! অন্তত পঞ্চাশটার তালিকা বানিয়েছি।

–বেশি ভাববেন না অঞ্জনবাবু। আপনি অসুস্থ হলে কিন্তু আমি সিটিং দিতে আসব না। 

হাসলেন অঞ্জনবাবু। যযাতি বললেন, আপনার বন্ধুটির প্রতি আপনার দুর্বলতার কথা আপনার স্ত্রী জানেন? 

–না। 

–এই যে আপনি ওনাকে চিকিৎসার জন্য এদিক ওদিক দৌড়োচ্ছেন – ম্যানেজ করছেন কী করে? 

–যথাসম্ভব লুকিয়ে। আমার স্ত্রী সন্দেহবাতিক! 

–যযাতি মনে মনে হাসলেন। সঞ্জয়ের কথা মনে এল। এক্ষেত্রে অঞ্জনবাবুর স্ত্রীর সন্দেহ যে অমূলক নয় সে তো বোঝাই যায়। মুখে বললেন, আজ উঠি অঞ্জনবাবু, আসবো আবার। লিপির সামনে দাঁড়িয়ে ওর হাত দুটো ধরে কিছুটা আবৃত্তির ঢঙে বললেন, "শব্দ যখন ভাঙে তখন তুলোর মতন ভাঙে/ ভাঙতে ভাঙতে ওড়ায় তাকে ধূপের মতন পোড়ায়/ ঢেউয়ের মতো ভেসে বেড়ায় নীলিমা ভাঙা ছবি/ শব্দ যাকে খায় তাকে নদীর মতন খায়/ দ‍্যাখো দ্যুলোক শুয়ে আছে যৎসামান্য রোদে/ এমন মায়া হাতে ছুঁলেই ভালবাসার আঠা/... কিংবা সবই দৃষ্টিভুলো শব্দ শব্দ খেলা/ শব্দ যাকে ভাসায় তাকে সর্বনাশে ভাসায়!" সুনীল গাঙ্গুলীর লেখা, মনে করিয়ে দিলাম আবার। ’

   লিপির চোখ একটু চকচক করে উঠলো কি? যযাতি ওর চোখে চোখ মিলিয়ে বললেন, 'ধন্যবাদ লিপি! আবার দেখা হবে'। 


(৩)

    বেশ কিছুদিন ধরে অঞ্জন বাবুর কথা খুব ভাবছেন যযাতি। বেশ একটা গল্পের ক্যারেক্টার। একটা মানুষ এতখানি কাউকে ভালবাসতে পারে? ‘নিঃস্বার্থ' ভালোবাসা বলে সত্যি কিছু আছে কিনা জানেন না যযাতি। কাউকে ভালোবেসে আনন্দ পাওয়াটাও তো একটা স্বার্থ! নিশ্চয়ই অঞ্জন প্রণয়প্রার্থনা করেছিলেন কোনওদিন, লিপি হয়তো প্রত্যাখ্যানও করেছিল – প্রত্যাখ্যানের কষ্ট প্রতি নিয়ত বুকে কি তাঁর এখনো পোড়ায়? তবু প্রতিনিয়ত অবিচল কর্তব্যে বাড়ির লোকের চোখকে ফাঁকি দিয়ে তিনি কীভাবে এদিক সামলে চলেন – তা রীতিমত কৌতূহল জাগায়। প্রায় বছর ঘুরতে চলল। এখন লিপি অনেকখানি স্বাভাবিক। যযাতির সান্নিধ্য আর সঞ্জয় এর কিছু বিহেভিয়েরাল থেরাপি। যযাতি প্রতিদিন এসে কোনও শব্দ নিয়ে খেলা করতেন। বাচস্পত‍্যম ঘেঁটে প্রতিটি শব্দের ধাতু, তার ব্যুৎপত্তি, নিরুক্তি খুঁজে, সেইসব শব্দ নিয়ে কবিতা লিখে আনতেন। শব্দের যে নিজস্ব একটা সাম্রাজ্য আছে, তাদেরও তো যে এত রকম আইন কানুন আছে – লিপির সান্নিধ্যে না এলে অজানাই থেকে যেত আজীবন! আগে তিনি শব্দ প্রয়োগ করতেন হৃদয় থেকে, সেইসব শব্দের রহস্য রোমাঞ্চ তিনি উপভোগ করতেন গোয়েন্দা সিনেমার দর্শকের মতো! এখন তিনি উপভোগ করেন সিনেমার ডিরেক্টরের মতো! 

    আজও একটা কবিতা লিখে এনেছেন যযাতি। 'শোক প্রস্তাব কখন থামলো চুপ/ অস্থির চোখের কোণে বিহ্বলতা ঝুরো ঝুরো সারি ধরে আছে/ হয়তো এসেও ছিল বেদনার বাঁশি টুকু নিয়ে/ শব্দ ছুঁয়েছিল শুধু, স্পর্শ ফিরে যাবে যাতে প্রত্যাখ্যান আছে... 

    লিপি বলল, এইতো আপনি বিহ্বলতার পরে একটা অব্যয় বসিয়েছেন; তবে সব বিহ্বলতার মাপকাঠি 'ঝুরো' দিয়ে হবে না। 

–সে তো একশোবার! 

–আচ্ছা যযাতি, আপনি এত দুঃখের কবিতা লেখেন কেন? আপনি কি দুঃখবিলাসী? 

–বিলাসে কি কোন সৃষ্টি হয় লিপি? বিলাসে একপ্রকার আত্মমগ্নতা আসে, ওখান থেকে সৃষ্টি হয় কম। তুমি আমাকে দুঃখবৎসল বলতে পারো। 

–পৃথিবীর এত কবি–লেখক, আপনি কি বলতে চান বাস্তব জীবনে তারা কোথাও না কোথাও দুখী! 

–এই দুঃখবোধটা ঠিক প্রচলিত দুঃখবোধ নয় – এটাই তোমাকে সবার আগে বুঝতে হবে লিপি। প্রত্যেকের কথা আমি বলতে পারব না, তবে মনে মনে লেখক–কবি যখন নিজের সাথে দাঁড়ায় তখন কোথাও একটা শূন্যতা তার মধ্যে নিশ্চয়ই কাজ করে – নইলে তিনি লিখতে পারবেন না। 

–তাহলে আনন্দের গান বা কবিতা লেখা হয় কীভাবে? 

–তার মূলও এই দুঃখবোধ। আর তাছাড়া সেরকম কাব্য গানের সংখ্যা কিন্তু খুব বেশি নয়।

–এর মধ্যে কি একটা নেগেটিভ ব্যাপার কাজ করছে না? সবকিছুর মধ্যে একটা শূন্যতা, দুঃখবোধ খোঁজা? 

–একেবারেই না। শাস্ত্রে বলেছে, মানুষের জন্মটাই দুঃখপ্রক্রিয়ার  এক অনুবর্ত্তন। দ‍্যাখো জগতে প্রচুর দুঃখ আছে, আনন্দের বিষয়ও আছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে একদল সেই আনন্দের সন্ধান পান, একদল কেবল দুঃখ দেখেন। কবি–লেখকরা দুঃখের জায়গাগুলোকে অন্যদের তুলনায় বেশি দেখেন। তারপর সেই দুঃখের সমুদ্র ছেঁচে যে অমৃত তুলে আনেন তাতে দেখবে, আনন্দেরই রকম ফের। ধরো আমার আগের কবিতাটিতে যে শূন্যতা দুঃখবোধের কথা আছে, সেই শব্দগুলো কোথাও তোমাকে স্পর্শ করে একপ্রকার সমাহিত আনন্দই দিচ্ছে – তাই তোমার কবিতাটি ভালো লাগছে... 

–আনন্দ কি তাহলে দুঃখেরই একটা রূপ? 

–আপাতদৃষ্টিতে দুটি পরস্পরের বিপরীত! কিন্তু মনের এই অনুভূতিগুলো একেবারে অতিমাত্রায় পরস্পরের বড় কাছাকাছি থাকে! প্রায় একই রকম! তুমি যদি মির্জা গালিবের শায়েরি গুলো পড়ো, দেখবে কী অপূর্ব আনন্দ লুকিয়ে আছে প্রতিটি অক্ষরের অন্দরমহলে। তার বেশিরভাগই কিন্তু বিরহ–দুঃখগাথা...

–মির্জা গালিব ব্যক্তিগত জীবনেও তো খুব দুঃখী ছিলেন... প্রবল অর্থকষ্ট... ধারদেনায় ডুবেছিলেন পায়ের নখ থেকে মাথা পর্যন্ত। 

–হ্যাঁ। চার সন্তানের মৃত্যু জয় করেও সামান্য কিছু টাকার জন্য পদে পদে অপমানিত এই আপোশহীন মাথা ঋজু করে চলা মানুষটি সংসারের প্রয়োজনে ব্রিটিশদের কাছে কিছু ভাতা পাওয়ার আশায় ১৮৪৬ সালে কলকাতা এসেছিলেন। লাভ হয়নি কিছু। ব্যর্থ হয়ে যায় যখন দিল্লির গলি কাসিমের হাভেলিতে ফিরে এলেন, দেখলেন তাঁর শেষ সন্তানটিও মৃত অবস্থায় জন্মেছে। বেগমের চোখে তাকালেন, কথা হলো না। বেগমের রুক্ষ ঈষৎ পাক ধরা চুল, বেদনাতুর মুখে–চোখে কালির পোচ, ক্লান্ত বিষন্ন গালিব ধীর পায়ে দোতলায় উঠলেন –  মদের খোঁজে। সেও খালি... তখন এক অসামান্য শায়েরী লিখলেন গালিব... জানো সেটা... 

–বাংলাটা মনে আছে, মূলটা মনে নেই। বাংলাটা আপনারই করা। 

–হুঁ। ‘দুঃখ একটু সইয়ে নিলেই/ দুঃখ মিটে যায়/ কিন্তু সমস্যা হল এই/ এমন সমস্যা এলো/ আর কোনও দুঃখবোধই রইলো না।’ 

–চমৎকার! কী সুন্দর কথা... দুঃখের উপর্যুপরি অন্য কোনও সমস্যা এলে আর পুরনো দুঃখের কথা মনে পড়ে না। 

যযাতি বললেন, ‘ভাবো যারা কারাদন্ডে দণ্ডিত হয়, তারা যদি এক ঘন্টা দু'ঘণ্টা একদিন দুদিন করে দিন গুণতে থাকে তবে আর বছর ফুরোবে না। কিন্তু যেদিন গোনাটাই বন্ধ করে দেয়, দুঃখবোধটাও কম হয়।’ 

–আমাদের ক্ষেত্রেও হয় যযাতি। ধরুন কোনও জায়গায় লম্বা লাইনে দাঁড়ালে বা রাস্তা হঠাৎ করে সারাদিনের জন্য অবরোধ হলে মনটাকে যদি তৈরি করে নিই, তেমন কষ্ট হয় না। 

–ঠিক। গালিব এই কথাই বলেছেন... দুঃখের সাথে সমঝোতা করো, তবে তা পোষ মেনে যাবে। 

–আচ্ছা যযাতি, আপনার জীবনে দুঃখ নেই? 

–দুঃখ কার জীবনে নেই লিপি? তবে আমি দুঃখকে দুঃখের মতো নিই না – ওর গভীরটা খুঁজি। 'ইয়ে গম্, তেরে রুখসানা জঞ্জীর তো ঢের থা/ পর কশিশ ইতনি কমজোর, কি সব রো পড়ে/ আরে রোনা হি থা তো নিগাহেঁ ক‍্যা দেখে/ গম্ তো কবসে আঁসু কে পিছে হি খাড়া থা'! 

–গালিব নাকি? 

–না। অধমের। 

–তাই! আপনি আজকাল শায়রীও লিখছেন নাকি? প্রকাশ হয়নি তো একটাও!

–নাঃ। 

–খুব সুন্দর। ভাবনাটাও। ঠিকই তো, কাঁদলে আর দুঃখ কী থাকে! ছোটবেলায় একটা কবিতা পড়েছিলাম – "Home they brought her warrior dead" – ওর মূল বক্তব্য তো ওটাই ছিল, যেকরেই হোক মৃত সৈনিকের স্ত্রীকে কাঁদাও... 

–মনে আছে লিপি। কাঁদতে জানলে এক দুঃখ থেকে অন্য দুঃখে খুব সহজে যাওয়া যায়। তুমি বোধহয় কাঁদতে পারো না, না? 

–আপনি কী করে আন্দাজ করলেন?

–তাহলে তোমার এত কঠিন মনের অসুখ হতো না। 

–কিন্তু আমার তো কাঁদার মতো কোন ইস্যু ছিল না। 

–ছিল, তুমি বুঝতে চাওনি। 

–কিন্তু আমার অ্যাটাক তো কোনও শব্দকে ঘিরে হতো! 

–ওটা বহিঃপ্রকাশ। মূল কারণটা বোধহয় অন্য কোনও শূন্যতা।

   লিপি চুপ করে রইল। যযাতি বললেন, 'অঞ্জনবাবু তোমাকে খুব ভালোবাসেন লিপি'। 

–জানি।

–আমার বিশ্বাস, তুমিও তাঁকে ভালবাসতে, নিজের কাছে স্বীকার করো নি। 

–ভালো ঠিক বাসতাম না যযাতি! ও আমার ভালো বন্ধু ছিল। 

–ওর বিয়ে করে নেওয়া তুমি মানতে পারোনি। 

–চুপ করে রইল লিপি। একটু থেমে বলল, ‘আমার পক্ষে ওকে বিয়ে করা সম্ভব ছিল না যযাতি। কিন্তু বিয়েটা ওকে করতেই হতো। আমি বাধা দিইনি। বিয়েটা করে কোন সুখ আছে সে? দিন–রাত অশান্তি!’ 

–তোমার ওকে বিয়ে করা কেন সম্ভব ছিল না লিপি? 

–যার শরীর জুড়ে যযাতির শব্দেরা খেলা করে, সে কি অন্যকে বিয়ে করতে পারে? 

–এটা পালিয়ে যাওয়ার কথা লিপি। মেয়েরা উত্তমকুমারকে ভালোবাসে, স্বামীরূপেও হয়তো মনে মনে চায় – তাই বলে কি তারা অন্য কাউকে বিয়ে করে না? জীবনে তোমার আর আমার দেখা হওয়ার কি খুব সম্ভাবনা ছিল? বিয়ে তো দূরের কথা! 

–কেন? 

–তুমি তো আমার সমসাময়িকও নও। আমি তোমার থেকে আঠারো বছরের বড়!

–ওসব কোনও ইস‍্যু নয়! আচ্ছা যযাতি, আপনার পুরো নাম কি?

–যযাতি! 

–পদবী নেই? নাকি লেখেন না! 

–এটা আমার ছদ্মনাম। 

–যাঃ বাবা! এই যুগে ছদ্মনামেও কেউ লেখে? সবাই নিজের নামের সঙ্গে খ্যাতিটাকে এত ভালবাসে, কেউ আর ছদ্মনাম নেওয়ার রিস্ক নেয় না। অথচ আগে সবার ছদ্মনাম ছিল  এখনকার কোনও লেখক কবির ছদ্মনাম আছে, আপনি জানেন? 

যযাতি ঘাড় নেড়ে অস্বীকার করলেন। লিপি পুনরায় বলল, ‘তা আপনার আসল নাম?’ 

–নিবারণ চক্রবর্তী। 

–যাঃ বাবা। এতো চমকের পর চমক। আপনি কি তবে আসলে অমিত রে? ছদ্মের ছদ্ম! 

–না না। বাবা–মার দেওয়া নামই নিবারণ চক্রবর্তী। 

–আপনার বাবাও এসব রসের রসিক ছিলেন বোঝা যায়। 

–কথা থেকে চালাকি করে পালিয়ে গেলে লিপি?

–কথায় থেকে বা লাভ কী? আপনি আমায় বিয়ে করবেন? 

–আমি বিবাহিত লিপি। 

–তো কী? গোপনে করবেন। পৃথিবীর কেউ জানবে না। শুধু মনে মনে আমি আর আপনি জানবো –  

–তা হয় না লিপি। 

–আপনাকে সত্যিকারের কোনও দাম্পত্যেও যেতে হবেনা যযাতি। আমি শুধু আপনার শব্দগুলোকে গায়ে মাখবো তাদের ধারণ করবো। 

–সে তো এমনিতেই করো! 

–পাঠিকা হিসেবে করি। তাতে অধিকার বোধ করি না।

–অধিকার হলে আর ওই ছোঁয়ার মজাটা পাবে না লিপি। তখন হয়তো ছোঁয়ার ইচ্ছেটাও চলে যাবে! এই দ‍্যাখো না, আমি নিজে লিখি, অথচ আমি যতখানি ওদের ছুঁতে পারি তুমি তার কয়েকশো  গুণ বেশি পারো। ওটা সঠিক যুক্তি নয়। 

–তাহলে আমাকে বেকার কেন সারিয়ে তুললেন? বেশ তো আপনার তৈরি শব্দ জগতে থাকতাম! 

–ওটা অসুস্থতা লিপি। স্বাভাবিক জীবনের বাইরে থেকে কোনও কিছু উপভোগ করা যায় না। তুমি সুস্থ মন নিয়ে উপভোগ করো, তাদের আনন্দ নাও। তোমার কল্যাণে আমার নিজের কবিতা অনেক বদলে গেছে লিপি। আমি যতদিন বাঁচবো অনেক অনেক ভালো লেখার চেষ্টা করবো।     

   লিপি উঠে এসে যযাতির হাত দুটো জড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বলল, ‘আপনার নিবেদিত পাঠিকা হিসেবে কি আমার সে যোগ্যতা তৈরি হয়নি যাতে আমি আপনার কাছে বিশেষ কেউ হয়ে উঠতে পারি?’

–তুমি আমার কাছে বিশেষ লিপি। কিন্তু তুমি যেভাবে চাইছো সেটাই বিশেষ হওয়ার একমাত্র উপায় নয়। 

–আপনি চান বা না চান আমি আমার সমস্ত দেহ মন আপনাকেই সঁপে দিয়েছি। আর যে কারণেই আপনার কাছে আমার কোনও লজ্জা নেই। জীবনে আর কোনওদিন এমন কথা উঠবে কিনা জানিনা, আপনি অন্তত একবার আজ পরিপূর্ণভাবে আমাকে আলিঙ্গন করুন – এই দেয়াল, আলমারি, ছাদের বাইরে কেউ একথা জানবে না...

    যযাতি দেখলেন লিপির চোখ দুটোয় তীব্র ব্যাকুলতা হা হা করছে। তিনি ধীরে ধীরে হাত দুটো ছাড়িয়ে বললেন, ‘আজ বেশ দেরি হল লিপি, বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যাবে...’

    আচ্ছা, প্রত্যাখ্যানের কষ্ট মাপার সঠিক শব্দ কী? কষ্ট তো কত কিছুর জন্যই হয়! প্রত্যাখ্যান করার যেমন কষ্ট আছে, পাওয়ারও তো! আলাদা কোন শব্দ আছে কি তার? না  হে যযাতি, বাংলা শব্দের ভাণ্ডারটা ভালো করে দেখতে হবে তোমায়! ওপরচালাকি করে কেবল বাক্য লিখে গেলে হবে না!

Post a Comment

0 Comments