বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৬৫
কেয়া
ভাস্করব্রত পতি
'মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি।
আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি।।
কী করি আজ ভেবে না পাই পথ হারিয়ে কোন বনে যাই
কোন মাঠে যে ছুটে বেড়াই সকল ছেলে জুটি।।
কেয়া পাতার নৌকা গড়ে সাজিয়ে দেব ফুলে ফুলে
তালদীঘিতে ভাসিয়ে দেব চলবে দুলে দুলে।।
রাখাল ছেলের সঙ্গে ধেনু চরাব আজ বাজিয়ে বেণু
মাখব গায়ে ফুলের রেণু চাঁপার বনে লুটি'।
-- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এ কবিতা প্রতিটি বাঙালি ছেলে মেয়েদেরই আত্মস্থ। কেয়াপাতার সাথে এক নিবিড় বন্ধন রয়েছে কচিকাঁচাদের। সাহিত্যের অঙ্গনে কেয়াগাছের ব্যবহার বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়। তেমনি কবি কালিদাসের মেঘদূতম কাব্যের ২৪ নম্বর শ্লোকে পাওয়া যায় কেয়ার উপস্থিতি --
কেয়া গাছের ঠেসমূল
এটি ঝাউয়ের মতাে উপকূলবর্তী এলাকার গাছ। এর পরিচিতি ঠেসমূলের জন্য। সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় এ গাছ দেখা যায়। সুন্দরবন এবং দীঘার আশেপাশে কেয়াগাছের ঝােপছাড় রয়েছে। ইদানিং সমুদ্র ভাঙনের দরুন নষ্ট হচ্ছে কেয়াগাছের জঙ্গল। কেয়া মুলতঃ মালয়েশিয়া, পূর্ব অস্ট্রেলিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের স্থানীয় উদ্ভিদ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'নববর্ষা' কবিতায় বর্ষা বন্দনায় উল্লেখ করেছেন কেতকী তথা কেয়াফুলের কথা --
"রাশি রাশি তুলি শৈবাল দল
ভরিয়া লয়েছে লোল অঞ্চল
বাদলরাগিনী সজল নয়নে গাহিছে পরানহরণী
বিকচ কেতকী তটভূমি পরে, বেঁধেছে তরুণ তরুণী'।।
এই গাছের ডালেই নতুন গাছ জন্মায়। তাই একে 'ছিন্নরুহা' বলে। ল্যাটিন ভাষায় কেয়াকে বলা হয় Pandanus odoratissimus নামে। এছাড়াও রয়েছে Pandanus tectorius। এই গাছটি সম্পর্কে প্রথম বর্ণনা করেন সিডনি পার্কিনসন। এটি Pandanaceae পরিবারের অন্তর্গত। সংস্কৃতে একে বলে কেতকী। কেয়া বা কেতকীকে ইংরেজিতে Thatch Screwpine, Tahitian Screwpine, Hala Tree, Pandanus বলে। তবে কেতকী, ইন্দুকলিকা, নৃপপ্রিয়া, শিবদ্বিষ্টা, বিফলা, তীশ্বপুষ্পা, দীর্ঘপত্রা, কচচ্ছদ, সূচিপুষ্প, কলা, পাংশুনা, হলীন, মেধ্যা, জম্বুক নামের পাশাপাশি কেয়াকে হিন্দিতে কেবড়া, কেমুয়া, ওডিয়াতে কেবড়াে, অসমীয়াতে কাদী, সংস্কৃতে শ্লেষ্মঘ্না, স্প্যানিশে Bacua, সিংহলীতে Mudu keyiya, ফরাসিতে Vacquois, ফার্সিতে করজ নামেও পরিচিত।
দীঘা বিচে একাকী কেয়াগাছ
কেয়া একটি গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। লম্বায় ৩ থেকে ৪ মিটার পর্যন্ত হয়। এর কাণ্ড গোলাকার এবং কাঁটাযুক্ত পাতা। কাণ্ড থেকেই শাখা প্রশাখা তৈরি হয়। পাতাগুলি ৩ থেকে ৪ মিটার পর্যন্ত লম্বা এবং ৫ - ৬ সেন্টিমিটার চওড়া হয়। পাতার প্রান্তদেশ খাঁজকাটা। করাতের মতো কাঁটাযুক্ত কেয়াপাতার প্রান্তের কাঁটা দিয়ে জলবসন্তের গুটি থেকে জল এবং পুঁজ বের করে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল একসময়। আর কেয়া পাতা বেটে গায়ে লাগিয়ে দিলে খোসপাঁচড়া থেকে মুক্তি মিলতো। বসন্তের গুটি যখন দেহে খুব চুলকানির উদ্রেক করত, তখন খোঁজ পড়ত এই কেয়াগাছের পাতার। গ্রামের মানুষের কাছে এ এক অনন্য উদ্ভিদ।
অস্তিত্বের সংকটে কেয়াগাছ
কেয়া হল একলিঙ্গিক গাছ। অর্থাৎ স্ত্রী কেয়া ও পুরুষ কেয়া আলাদা আলাদা। স্ত্রী গাছে স্ত্রীফুল এবং পুরুষ গাছে পুরুষ ফুল ফোটে। পুরুষ ফুলের রঙ সাদা। তাই একে বলে সিতি কেয়া বা শ্বেত কেয়া। আর স্ত্রী ফুলের রঙ সোনার মতো। তাই একে বলে স্বর্ণ কেয়া বা হেম কেয়া। কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী তাঁর 'কেয়া ফুল ' কবিতায় লিখেছেন এই কেয়াগাছের ফুল নিয়ে --
'শূন্য ঘরে
হিয়া গুমরিয়া মরে
স্মরি' যত জীবনের ভুল;
অকস্মাৎ তারি মাঝে
ধ্বনি কার কানে বাজে..
নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কেয়াগাছ ও তার ঠেসমূল
কেয়া গাছের স্ত্রী ফুল থেকে আনারসের মতো একপ্রকার ফল জন্মায়। বিভিন্ন দেশে এগুলি খাওয়ার চল রয়েছে। বিরিয়ানি সহ অন্যান্য মুখরোচক রান্নার সময় যে কেওড়ার জল ব্যবহার করা হয়, তা এই কেয়া গাছের ফুল থেকেই পাওয়া যায়। এটি একটি সুগন্ধি উদ্ভিদ। কেয়া ফুলকে বাষ্পীভবন করে তৈরি করা হয় কেওড়ার জল। যা পরিচিত Pandanus Flower Water নামে।
কেয়াগাছের ফল
সমুদ্র উপকূলবর্তী বালিয়াড়ি এলাকায় কেয়া গাছের আধিক্য থাকলে ভূমিক্ষয় রোধ হয়। সমুদ্রভাঙন থেকে রক্ষা করতে পারে এই গাছ। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার শেষ বাস স্টপেজের (পাশেই ওড়িশা) নাম কিয়াগেড়িয়া। একসময় বাসগুলিতে প্রায়ই শোনা যেত 'যা চলে যা কিয়াগেড়িয়া বাম্পার'! অর্থাৎ যে বাস খুব দ্রুত চলাচল করে। দীঘার নিকটবর্তী এই কিয়াগেড়িয়া গ্রামনামাটি তো এই কেয়াগাছ থেকেই সৃষ্টি।
কেয়া + গেড়ে (গেড়িয়া) > কেয়াগেড়ে > কিয়াগেড়িয়া।
🍂
0 Comments