কমলিকা ভট্টাচার্য
প্রতিবছর আন্তর্জাতিক নারী দিবস এলেই আমাদের মনে পড়ে নারী শক্তির কথা, নারীর অধিকারের কথা, নারীর সংগ্রামের কথা। কিন্তু সত্যিকারের ক্ষমতায়ন কি শুধুমাত্র লিঙ্গের ভিত্তিতে হতে পারে? আমরা কি শুধুই নারী বা পুরুষ পরিচয়ে আবদ্ধ? নাকি আমাদের প্রকৃত পরিচয় মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকা?
আমি বিশ্বাস করি, নারীবাদ, ক্ষমতায়ন, বা অধিকার শুধুমাত্র নারী-পুরুষ বিভাজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এগুলো আসলে মানুষের সম্মান, আত্মবিশ্বাস, এবং নিজেকে গড়ে তোলার বিষয়। তাই নারী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে বাঁচাই হোক আমাদের লক্ষ্য।
আমাদের সমাজ পরিচয় নির্ধারণ করে বাহ্যিক কিছু উপাদানের মাধ্যমে—নাম, পেশা, বা সম্পর্কের ভিত্তিতে। একজন নারী যখন শিক্ষিকা, চিকিৎসক, লেখক, গৃহিণী, বা কর্মজীবী হন, তখন সমাজ তাকে ওই পরিচয়েই চেনে। কিন্তু তার প্রকৃত পরিচয় কী?
আমি মনে করি, পরিচয় কোনো পদবি বা বিশেষণ নয়। পরিচয় আসলে নির্ভর করে আমাদের আচরণ, মূল্যবোধ, চিন্তাধারা এবং দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। আমি কেমন করে অন্যকে সম্মান করি, কীভাবে কঠিন পরিস্থিতি সামলাই, সেটাই আমার প্রকৃত পরিচয়।
🍂
নারী বা পুরুষ, কেউই এক রকম থাকতে পারে না। সময়, পরিবেশ, পরিস্থিতি অনুযায়ী আমাদের পরিচয় বদলায়। কিন্তু আমাদের যা কখনো বদলানো উচিত নয়, সেটি হলো আমাদের আত্মসম্মান।
বর্তমানে অনেকেই বলেন, "আমি নারী, তাই আমার এই অধিকার চাই।"
কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, অধিকার কখনো ভিক্ষা চেয়ে পাওয়া যায় না, তা অর্জন করতে হয়। যদি আমি নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারি, তাহলে সমাজ আপনাআপনি আমাকে সম্মান করবে। সমান সুযোগ পাওয়া আমাদের অধিকার, তবে তা পুরুষদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নয়, বরং নিজেদের দক্ষতা ও সক্ষমতার মাধ্যমে অর্জন করা উচিত।
অভিযোগ করে নয়, বরং নিজেকে গড়ে তুলে সামনে এগিয়ে যাওয়াই প্রকৃত ক্ষমতায়ন। যখন একজন নারী আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচে, তখন সে কারও করুণার ওপর নির্ভর করে না, বরং নিজের আলোয় পথ খুঁজে নেয়।
অনেকেই মনে করেন, নারীদের জীবন অনেক কঠিন। কিন্তু আমি মনে করি, সংগ্রাম শুধু নারীদের নয়, পুরুষদেরও। নারীরা যেমন সামাজিক বাধার বিরুদ্ধে লড়েন, তেমনি পুরুষরাও দায়িত্ব ও প্রত্যাশার ভার বইতে গিয়ে সংগ্রাম করেন। জীবন সকলকেই কঠিন পরীক্ষার মুখে ফেলে, পার্থক্য শুধু সংগ্রামের প্রকৃতিতে।
আমাদের সমাজ নারীদের শেখায়—চুপ থাকতে হয়, মানিয়ে নিতে হয়। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, কথা বলা অপরাধ নয়, বরং নিজের মত প্রকাশ করাই বুদ্ধিমানের পরিচয়। আমরা সবসময় ঠিক নাও হতে পারি, কিন্তু আমাদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা থাকা উচিত।
বর্তমানে অনেকেই বলেন, "পশ্চিমা পোশাক পরলেই একজন নারী আধুনিক!"
কিন্তু আধুনিকতা পোশাকে নয়, চিন্তায়। যদি কোনো পোশাক আপনাকে স্বাচ্ছন্দ্য দেয়, আপনার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মানানসই হয়, তবে সেটাই সঠিক। কিন্তু শুধুমাত্র "ট্রেন্ড" অনুসরণ করা বা অন্যকে খুশি করার জন্য নিজেকে বদলানো আধুনিকতা নয়।
সত্যিকারের আধুনিকতা হলো—নিজের জন্য নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা।
বাহ্যিক সৌন্দর্যের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসুন
আমাদের সমাজ আমাদের শেখায়, নারীর সৌন্দর্যই তার আসল পরিচয়। তাই আমরা নারীরাও নিজেদের এই ফাঁদে ফেলে দিই। আমরা নিজেদের বাজারের পণ্য বানিয়ে ফেলি, যেখানে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা ঠিক করে সমাজ, আর আমরা সেই ছাঁচে নিজেকে গড়তে ব্যস্ত থাকি।
কিন্তু আসল সৌন্দর্য কী?
সৌন্দর্য কখনোই বাহ্যিক কিছু নয়। একজন নারীর সত্যিকারের সৌন্দর্য তার আত্মবিশ্বাস, তার চিন্তার গভীরতা, তার আত্মসম্মানবোধে নিহিত। সমাজ বাহ্যিক সৌন্দর্যের যে ফাঁদ তৈরি করেছে, সেই ফাঁদ থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের নিজেদের গড়ে তুলতে হবে।
আমি বিশ্বাস করি,
আপনাকে আগে নিজেকে সম্মান করতে হবে, তারপর অন্যদের কাছ থেকে সম্মান আশা করুন।
অধিকার ভিক্ষা করবেন না, নিজের যোগ্যতা দিয়ে তা অর্জন করুন।
অভিযোগ নয়, নিজের উন্নতির দিকে নজর দিন।
নিজের জন্য ভাবুন, নিজের জন্য বলুন, নিজের আত্মসম্মান রক্ষা করুন।
নারী হওয়া কোনো সীমাবদ্ধতা নয়, আবার বিশেষ সুবিধাও নয়। আমাদের পরিচয় আমরা নিজেরাই তৈরি করি। আমাদের আত্মবিশ্বাসই আমাদের আসল শক্তি। আমাদের নিজেকে গড়ে তুলতে হবে, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে হবে।
আমরা নারী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে বাঁচি—এই হোক আমাদের অঙ্গীকার। যাতে শুধু আজকের দিনটি নয়, বরং প্রতিটি দিনই আমাদের জন্য বিশেষ হয়ে ওঠে।
0 Comments