চিত্র- শুভম দাস
পূর্বাশ্রম
পুলককান্তি কর
(১)
ফোনের রিসিভার নামিয়ে রেখে বড় মহারাজ গম্ভীর মুখে বললেন, পূর্ণ মহারাজকে একবার ডাক তো হে! বলবে, জরুরী ব্যাপার, এক্ষুণি যেন আসেন।
কথাগুলি যে ব্রহ্মচারীর উদ্দেশ্যে, তিনি বললেন, পূর্ণ মহারাজ তো এখন আশ্রমে নেই মহারাজ। উনি তো এখন বড় তিলাইপাড়ায় গিয়েছেন।
ওখানে আশ্রমেরই একটা কাজে বড় মহারাজই ওকে পাঠিয়েছেন, সেই কথাটি ভুলে গিয়েছিলেন বলে একটু খেদোক্তি করে বললেন, ‘কী করা যায় বল দেখি আনন্দ! খুব জরুরী যে ব্যাপারটা!’
খুব বেশী কৌতূহল প্রকাশ করা ব্রহ্মচারীদের উচিৎ কিনা, এই দ্বন্দ্বের মধ্যে থেকেও একটু উৎসুক মুখে আনন্দ বললেন, মহারাজ সংবাদ কি কিছু গুরুতর?
পূর্ণ মহারাজের মা অমৃতলোকে যাত্রা করেছেন।
সে কী! ওনার পূর্বাশ্রম তো শুনেছিলাম বাঁকুড়ার কোনও এক গ্রামে। যেতে যেতেই তো একদিন পার হয়ে যাবে!
তা তো যাবেই আনন্দ। কী আর করা যাবে! সাধু-সন্ন্যাসীদের হাতে মুখাগ্নি নেওয়ার জন্য তো কেউ আর শবদেহ ফেলে রাখে না। সৎকারই করে দেয়।
সাধু-সন্ন্যাসীরা কি মুখাগ্নি করতে পারে মহারাজ?
অনেক পরম্পরায় নিষেধ আছে। বহু সাধু-সন্ন্যাসী আছেন যাঁরা সন্ন্যাস নেওয়ার আগে পিতা-মাতার শ্রাদ্ধকার্য সম্পন্ন করে নেন!
বাবা-মা বেঁচে থাকতেই? কিছুটা বিস্ময়ের স্বরে বললেন আনন্দ।
হ্যাঁ। আসলে এটা প্রতীকী। এটা নিজেকে বলা যে, তোমার আর পূর্বাশ্রমের সাথে কোনও সম্বন্ধই রইল না। তবে আমাদের গুরুদেব এ ব্যাপারে ভীষণ উদার । তিনি মনে করতেন, মাতৃ-পিতৃদায় কোনও সন্ন্যাসী যদি অস্বীকার করেন সেটা নিজের জন্মকেও অস্বীকার করা ।
কিন্তু মহারাজ আমরা যারা গৃহত্যাগ করে এসেছি বাবা-মা বা পূর্বাশ্রমের কাউকে কি আমরা কষ্ট দিয়ে আসিনি? সেটা কি অন্যায় হয়নি? যখন বৃদ্ধাবস্থায় ওনাদের একটা আশ্রয় দরকার ছিল, আমরা নিজেদের মোক্ষচিন্তায় সেটা অস্বীকার করেছি। সেটা কি পাপ নয়?
আগে দ্যাখো পূর্ণ মহারাজকে কীভাবে খবর দেবার ব্যবস্থা করা যায়! এ নিয়ে কথা বলতে বসলে তো রাত কেটে যাবে। যুক্তি প্রতিযুক্তি অনেক আছে।
ঠিক কথা মহারাজ! তিলাইপাড়ায় আমাদের কোনও পরিচিত ব্যক্তি কি আছেন-যাঁকে ফোন করা যায়? নইলে সাইকেল বা অন্য কিছু ব্যবস্থা করে ওখানে পৌঁছতেও তো ঘন্টা দুই যাবে!
এইসব ফোনের রেজিষ্টার তো পূর্ণই দেখাশোনা করে আনন্দ। দেখো ওর ঘরে খাতাটাতা কিছু খুঁজে পাও কিনা।
দেখুন না মহারাজ আমাদের এখানে প্রতিমা দেবী নামের যিনি আসেন - উনার ছেলের একটা মোটর সাইকেল আছে। ওনাকে ফোন করে যদি বলা যায়….
দ্যাখো। ওর নম্বরও তো ওই পূর্ণর খাতাতেই আছে। আর শোন, খবরটা একটু সইয়ে দেবে। পূর্ণ মহারাজ শক্ত মানুষ, ঠিক আছে। তবু মা তো!
ঠিক আছে মহারাজ। আমি কিছু একটা ব্যবস্থা করছি।
(২)
পূর্ণ মহারাজ যখন বিষ্ণুপুর স্টেশনে এসে নামলেন তখন ভোর হয়নি। ক্রমশ আকাশ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে। স্টেশনের আলোর জন্য আকাশটা ভালো বোঝা যাচ্ছে না। শেষ এই স্টেশনে উনি নেমেছিলেন - তাও প্রায় কুড়ি-একুশ বছর হয়ে গেল। কত কিছু বদলে গেছে! প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে তাঁদের গ্রামের রাস্তা ধরলেন মহারাজ। চারপাশে যে সব বড় বড় গাছ শোভা পেত, তাদের অনেকাংশই কাটা পড়েছে। এখানে এসে ঊষার প্রকৃত রূপটা টের পেলেন পূর্ণ মহারাজ। কয়েকদিন আগেই বড় মহারাজ ঋকবেদের একটা শ্লোক বলছিলেন, আজ যেন তার মর্ম অক্ষরে অক্ষরে টের পেলেন তিনি। “পরায়তীনামন্বেতি পাথ আয়তীনাং প্রথমা শাশ্বতীনাম্/ ব্যুচ্ছন্তী জীবমুদীরয়ন্ত্যুষা মৃতং কং চন বোধয়ন্তী কিয়াত্যা যৎ সময়া ভবাতি যা ব্যূষুর্যাশ্চ নূন্নং ব্যুচ্ছান্/ অনু পূর্বাঃ কৃপতে বাবশানা প্রদীধ্যানা জোষমন্যভিরেতি”। (ঋকবেদ ১/১১৩/৮, ১০)। শাশ্বতীদের প্রথমা এই ঊষা - এক্ষুণি বিচ্ছুরিত হবেন যিনি - যা বেঁচে আছে - তা প্রস্ফুটিত হয়ে উপরপানে ছুটবে, যা মরে ছিল - সেও জেগে উঠবে। ‘উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে, ওই যে তিনি ওই যে বাহির পথে’। তিনি, ও-পারের বুকে মিলিয়ে যায় যে ঊষারা - তাঁদেরই লক্ষ্য করে চলেছেন। তিনি মিলিয়ে দেন অতীতের ঊষাদের সাথে - যে ঊষা এক্ষুণি উদ্ভাসিত হবেন, তাঁকে। প্রাক্তনী ঊষাদের জন্য যেমন ব্যাকুল তিনি - তেমনি করে নিবিড় বেঁধে রাখেন সেই ঊষাদের যাঁরা আজও আসেনি, আসবেন একদিন।‘ পূর্ণ মহারাজের মনে পড়ে এমনি ঊষা প্রায় চল্লিশ বছর আগে যেদিন এক কিশোর বালক তার ঠাকুরদার হাত ধরে শুকতারা দেখেছিল, এমন ঊষা - যে বিনিদ্র রাত দেখেছিল বহু বহু বার এক যুবকের সাথে; এমনি ঊষা যেদিন শেষবারের মতো ঘরছাড়া হয়েছিল একটি নাম। আজকের ঊষাও তেমনি মাতৃহীন ভিটেবাড়ির আহ্বান জানাচ্ছে পরম ঔদাসীন্যে। এত ভোরে ভ্যানরিক্সা পাওয়া যাবে না। অবশ্য পূর্ণ মহারাজের হাঁটতে কোনও অনীহা নেই। দেবরাজ ইন্দ্র রাজা হরিশ্চন্দ্রের পুত্রকে যেমন বলেছিলেন, বৎস হাঁটো, হেঁটে যাও ক্রমাগত জীবন সন্ধানে। হাঁটলেই তুমি উড়ুম্বর পাবে, পাবে মাধ্বীক মধু; পূর্ণ মহারাজও এই মন্ত্র মেনে চলেন। চরৈবাতি। মাইল খানেক হাঁটতে হাঁটতেই পরিপূর্ণ সকাল উপস্থিত হল আকাশ জুড়ে। আলোয় আলোকময় হয়ে উঠেছে পৃথিবী। নাঃ, অনেক করে ভেবে দেখলেন পূর্ণ, এই আলোয় কোথাও মাতৃবিয়োগের বেদনা ভারী হয়ে নেই। কোথাও একচুলও দুঃখ পুঞ্জীভূত হয়ে নেই পাখিদের গানে। গ্রামে ঢোকার মুখে তেমন কারো মুখোমুখি হতে হল না। হয়তো কেউ চিনতেও পারতো না - একমাথা চুল দাড়ি আর গেরুয়া বসনের এই মানুষটিকে। তবে গ্রামের মানুষজন তো শহরের মতো নয়। তারা স্বভাব কৌতুহলী। চিনি না যখন গায়ে পড়ে কথা বলবো কেন - এই তত্ত্বে আদৌ বিশ্বাসী নয় তারা। পূর্ণ মহারাজ অবশ্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়েই এসেছেন - সব ধরণের কথা শোনার স্থৈর্য্য নিয়ে। ঘরের সামনে অনেকখানি খালি জায়গা ছিল তাঁদের। এখন কেমন ঝোপঝাড় হয়ে পড়ে আছে। কে ই বা করবে! বাবা গত হওয়ার পর থেকে মায়েরও তো সংসারে তেমন মন ছিল না। এতদিন বেঁচেছিলেন নেহাৎ আয়ু মানুষের হাতে নেই বলে। ঘরের দরজার কাছে এসে অবাক হল পূর্ণ, দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। কে আছে ভেতরে? মামাবাড়ীর লোকজনেরা কেউ এসেছে নাকি? এরই মধ্যে জবরদখল হয়ে গেল সবকিছু? একটুখানি ভেবে দরজায় টোকা দিলেন তিনি। একটু বাদে এক ভদ্রমহিলা দরজা খুলে বললেন, এসো পরিতোষদা।
আমাকে চেনা যাচ্ছে এত সহজে? পূর্ণ মহারাজ একটু বিস্ময় নিয়ে বললেন।
চেনার চোখ থাকলে চেনা যায় পরিতোষদা। ঈষৎ বাঁকাভাবে কথাটা বললেন ভদ্রমহিলা। একটু চুপ করে থেকে বললেন, তা তোমাকে পরিতোষদা বলে ডাকা যাবে - নাকি এখনকার নামে…
সাড়া কি দিইনি?
আমাকে চিনতে পেরেছো নাকি পরিচয় দেবো?
এভাবে বলছো কেন সোহিনী?
না প্রথমে যেভাবে ভুরু কুঁচকে তাকালে, তাতে ভাবলাম চিনতে পারোনি বুঝি!
প্রথমটায় সত্যিই চিনতে পারিনি সোহিনী। তোমার চেহারাটা একদমই বদলে গেছে। এখন একেবারে গিন্নিবান্নি।
তা গিন্নি হলে চেহারাটাও তো সেরকমই হবে! আর তাছাড়া বয়স কি কম হল? এতো আর শহর বাজার না! গ্রামের মেয়েদের তিরিশ পেরোলেই বুড়ি লাগে - আমার তো বিয়াল্লিশ হতে চলল।
বিয়াল্লিশ হয়ে গেল?
কেন নিজের বয়সের হিসাব রাখো না? নাকি তোমাদের এসব নিষেধ?
নিষেধ কিছুই নেই! তবে বহু দিন গুনি না।
তোমার এখন ছেচল্লিশ চলছে পরিতোষদা। সামনের মাঘ মাস আসলে সাতচল্লিশ হবে!
তা তুমি এখন এই বাড়ীতে?
এই ভিটেতে এখন তো কাউকে থাকতে হবে! শ্রাদ্ধ-শান্তি না মেটা পর্যন্ত! এবার তুমি এসে গেছো যখন, আমার ছুটি।
মায়ের শেষ সময়ে তুমি ছিলে?
হ্যাঁ। গত সাত বছর খুবই খারাপ কেটেছে কাকীমার। প্রায় দিনই অসুস্থ থাকতেন। দু-একবার তো প্রায় মরো মরো হয়ে গিয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম তোমাকে খবর দিই, তা তিনি কিছুতেই দিতে দেন নি। বলেছিলেন, মরলে খবর দিস। অবশ্য দিয়েই বা কী হতো! তুমি কি আসতে?
তা তো বলতে পারি না সোহিনী! কাল্পনিক কথার উত্তর দিয়ে কী হবে! যেটা হয়নি, সেটা হয়নি। মায়ের মৃত্যুটা কখন হল?
গেল বুধবার রাত সাড়ে বারোটার সময়। দু-তিন দিন ধরেই শরীরটা খারাপ ছিল। সুবল ডাক্তার সন্ধ্যায় দেখতে এসে বলল, আশা নেই। স্যালাইন ও নিতে পারছে না। আমরা মোটামুটি তখন থেকেই মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। ঐ রাতে তোমাকে জানানো হয়নি। সকাল হতে ফোন করেছিল কানুদা। যা হোক, তুমি এখন কী খাবে বলো! চা খাবে?
চা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি সোহিনী।
কেন? আসক্তি মুক্ত হওয়ার চেষ্টা?
বলতে পারো।
সরবতে তো নিশ্চই দোষ নেই।
চা তেও দোষ নেই। আমি খাই না। আমদের অনেক মহারাজ খান।
ঠিক আছে। তুমি দাঁতটাঁত মেজে স্নান সেরে নাও। আমি সরবত নিয়ে আসছি।
সোহিনী উঠে যেতে পূর্ণ মহারাজ ঘুরে ঘুরে সবগুলো ঘর দেখতে লাগলেন। শুধুমাত্র ঠাকুর ঘরটাই একটু পরিষ্কার আর গুছানো। বাকী ঘরগুলোয় অজস্র ঝুল আর মাকড়সা। টালি আর অ্যাজবেষ্টারসের ছাউনি দেওয়া মাটির দোতলা বাড়ী। ঠাকুরদার আমলে দেড়তলা বাড়ীতে খড়ের ছাউনি ছিল, বাবা এটাকে বাড়িয়েছিলেন ছেলের বিয়ে থা হলে ঘর লাগবে এসব ভেবে। বাবার একটা বড় ছবি মা এর ঘরটায় টাঙানো। পূর্ণ মহারাজ হাত দিয়ে দেখলেন - হাতের ছাপ পড়ে গেল ওতে - এতখানি ধূলো। মায়ের একখানি ছবি, বিয়ের পর তোলা, বাঁধানো হয়ে থাকতো ড্রেসিং টেবিলটার ওপর। ওর কোনও হদিস নেই। মা-ই নিশ্চই কোথাও সরিয়ে রেখে থাকবে। নিজের সধবা অবস্থার ওই ছবি হয়তো নিঃসঙ্গ অবস্থায় সহ্য করতে পারতো না মা! ড্রেসিং টেবিলটার আয়নাটাও কেমন তেলচিটে হয়ে আছে। অন্তত পাঁচ-ছ’ জায়গায় ফাটা। আয়নায় তাকাতেই মায়ের ঘোমটা পরা এক খাবলা সিঁদুর মাথায় ছবিটা আবছা ভেসে এলো কাঁচে, পূর্ণ মহারাজ নিজেকে সামলে নিলেন। সোহিনী বোধহয় এই খাটেই শুয়েছিল, এখন মশারি টাঙানো আছে। সদ্য মৃতার ঘরে এইভাবে সারারাত একা একা কাটানো, সত্যি সময় মানুষকে বড্ড বদলে দেয়। আগে গ্রামে কেউ একজন মারা গেলে সোহিনী একা রাস্তায় বেরোত না। ওদের বাড়ী এই বাড়ী থেকে পাঁচ-সাতটা বাড়ীর পরেই। সেইসব দিনে সন্ধ্যে যদি হয়ে যায় - কাউকে না কাউকে আলো নিয়ে ওকে পৌঁছে দিয়ে আসতে হতো। তখন খুব ছোট ছিল না সে! আঠারো উনিশ তো হবেই। হঠাৎ সোহিনীর গলা শুনতে পেলেন তিনি, ‘কোথায় গেলে পরিতোষদা?’
এই তো মায়ের শোবার ঘরে!
যাও স্নানটান করে নাও। সারারাত ট্রেনে নিশ্চই ঘুম হয়নি। স্নান করলে ফ্রেস লাগবে। একটু গরম জল করে দেব? বাতাসে তো একটা ঠাণ্ডা ভাব এসে গেছে এখনই!
ওসব বাহুল্য সোহিনী। শীতকালেও আমি ঠাণ্ডা জলেই স্নান করি।
ঠিক আছে। তাই করে এসো গিয়ে।
স্নান সেরে জপতপ করতে ঘণ্টাখানেক লাগলো। পূর্ণ মহারাজ দেখলেন সোহিনী একটা বড় কাঁচের গ্লাসে সরবৎ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই রকম কাঁচের গ্লাস আজকাল আর দেখতে পাওয়া যায় না। অন্তত আধ লিটার জল ধরে এই গ্লাসগুলিতে। ওঁর ছোটবেলায় এই রকম গ্লাস বারোটা ছিল বাড়ীতে। এখনও আস্ত আছে দেখে কিছুটা বিস্মিত হলেন। সোহিনী বললেন, ‘পরিতোষদা এসে যখন পড়েছো শ্রাদ্ধ-শান্তির কিছু একটা ব্যবস্থা করো।‘
আমি সন্ন্যাসী মানুষ সোহিনী। আমার টাকা-পয়সা কোথায় ওসব করার?
বাঃ রে! তাই বলে মাতৃদায় পালন করবে না?
সে সব তো অনেক খরচার ব্যাপার। লোকজন না খাইয়েও পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকা অন্ততপক্ষে লাগবে। তার চেয়ে কোথাও মন্দিরে গিয়ে কিছু করে দিলে হবে।
তা হয় না পরিতোষদা। এটা গ্রামের বিষয়। লোকজন আপদে বিপদে সবাই পাশে এসে দাঁড়াতো। সেই রাতে আমি খবর দিতে সবাই তো এসে যথাসাধ্য করেছে, শ্মশান বন্ধু হয়ে গেছে। তুমি কোনও অনুষ্ঠান না করা মানে তাদের ভূমিকাকে অস্বীকার করা।
সবই তো বুঝলাম, কিন্তু করণীয় কী?
তুমি ননী কাকা, খগেনদা, মন্টু পরিয়ারী - এদের বাড়ী তো মনে রেখেছো নিশ্চই - এরা গ্রামের বিশিষ্ট এবং বয়স্ক মানুষ - ওদের সাথে কথা বলো গিয়ে।
সে না হয় বললাম। কিন্তু পকেটে টাকা থাকলে তবে না এসব আলোচনা!
তুমি এক কাজ করো না পরিতোষদা। তোমাদের এত জমিবাড়ী - সবই তো এবার ভূতে খাবে। তুমি এই কাজের বাহানায় একটা দুটো বেচে দাওনা কেন!
তা হয় না সোহিনী। যা আমি ত্যাগ করে গেছি আজ তাকে উত্তারাধিকারের বলে গ্রহণ করতে পারি না। এসব বিক্রি করার আমার কোনও অধিকার নেই।
যাঁদের জিনিস তাঁদের কাজেই তো লাগছে পরিতোষদা। এতে দোষ হবে না।
এটা যদি মাতৃদায় হয় সোহিনী, তবে সে দায়টা আমারই উপর বর্তায়। আমি বরং কয়েক ঘর থেকে চেয়েচিন্তে কাজটা করতে পারি।
ভিক্ষে করবে?
ওটাই তো আমাদের কাজ সোহিনী। ওতে আমরা লজ্জা পাই না।
দয়া করে আর লোক হাসিও না পরিতোষদা। তোমাদের নিয়মকানুন গ্রামে গঞ্জে চলে না। তোমরা গ্রামের জমিদার বংশ। আজ ভিক্ষে করে যদি বাপ-মায়ের কাজ করতে যাও - ওঁদের মুখেই কালি পড়বে। এমনিতেই বাড়ী থেকে পালিয়ে যথেষ্ট তুমি ওঁদের লাঞ্ছনা করেছো, মৃতলোকে আর তাঁদের কষ্ট দিও না।
সোহিনীর কথাগুলো শুনেও খুব বেশী গায়ে মাখলেন না পূর্ণ মহারাজ। সোহিনী একটুক্ষণ চুপ থেকে নিজের দু-খানা বালা খুলে ওঁর হাতে দিয়ে বললেন, রানাদের বাড়ী যাও। ওরা বন্ধকের ব্যবসা করে। এ-দুটো বালা দিলে আপাততঃ হাজার বিশেক টাকা পাবে। টুকটাক কাজকর্ম চলুক এতে। কাকীমার পাস বইটা খুঁজে দেখি। কিছু টাকা তো নিশ্চই থাকবে ওখানে। তোমার বাবার পেনশন তো আর পুরো খরচ হত না।
পূর্ণ মহারাজ সজোরে বালাদুটো প্রত্যাখান করলেন, তোমার দান আমি স্বীকার করছি সোহিনী, কিন্তু তুমি আমাকে আর তেজারতি বন্ধকীর মধ্যে জড়িও না। এক্ষুণি এক্ষুণি আর কী খরচা লাগবে? এখনও কাজ হতে সাতদিন বাকী। ততক্ষণ তুমি দ্যাখো মায়ের টাকা-পয়সা কিছু আছে কিনা। তাঁর অর্থে তাঁরই পারলৌকিক ক্রিয়া হোক।
তুমি তাহলে একবার ননীকাকাদের বাড়ী ঘুরে এসো। এসে কী খাবে?
যা জোটে।
আমি রান্না করলে তুমি খাবে, নাকি স্বপাক?
আমার এত গোঁড়ামি নেই সোহিনী। তুমি চাইলে রেঁধে রাখতেই পারো। তুমি বাড়ী যাবে না?
গত দশ বারোদিন তো এই বাড়ীতেই আছি। তা তুমি যখন এসে পড়েছো, ও বেলা তো যেতে হবেই।
আমি তোমার শ্বশুর বাড়ীর কথা জানতে চাইছি।
সোহিনী খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। বলল, যাও বেলা বাড়ছে, লোকজন বেরিয়ে যাবে। কথা বলে এসো।
(৩)
পূর্ণ মহারাজ অনেকক্ষণ ধরেই অপেক্ষা করছিলেন পুরোহিত মশাই এর জন্য। পাশের গ্রামেই থাকেন। বয়স অনেক হয়েছে ওনার। পূর্ণ মহারাজের অন্নপ্রাশন ওনার পৌরহিত্যেই সম্পন্ন হয়েছিল। এ বাড়ী ওঁদের বংশানুক্রমিক যজমান। গ্রামেরই একটা ছেলে গিয়ে খবর দিয়ে এসেছিল। উনি একটা তালিকা করে দিলে কেনাকাটা শুরু করতে হবে। বাইরে এখন গোধূলি। সামনের শিরীষ গাছটার ফাঁক দিয়ে একফালি নরম আলো এসে পড়েছে ওঁর ডান দিকের দেয়ালে। সেখানে একটা বেঞ্চের উপর বসে সোহনী এক মনে চাল বাছছিল। বলল, ‘তুমি রান্নার ঠাকুরকে কখন ডেকেছ পরিতোষদা?’
ও তো দুপুরে এসে দেখা করে গেছে সোহিনী। তুমি যেন কোথাও গিয়েছিলে সেই সময়। তোমাকে বলতে ভুলে গেছি।
তা তুমি কতজনের আয়োজনের কথা বলেছ?
আমি কী আর অতশত জানি গ্রামের কথা। ননীকাকা বলছিলেন পাশাপাশি দুটো গ্রাম বললে প্রায় সাড়ে সাতশো লোক। আমার ক্ষমতাটুকুই তো আমি জানি না। তাই বলে দিয়েছি কাল সকালে আসতে - তুমিই সরাসরি কথা বলে নিও।
লোকজনকে তো মৎস্যমুখীতেই বলবে নাকি? শ্রাদ্ধের দিন ব্রাহ্মণ ভোজন আর দরিদ্র সেবা হোক - পরের দিন মাছ ভাত!
তুমিই নিমন্ত্রণ কর্তা সোহনী। মায়ের শেষ বেলাটুকু যখন তোমার হেফাজতেই কেটেছে- আমি আর তার মধ্যে ঢুকতে চাই না। তোমার ভাণ্ডারে যেমন অর্থ আছে, সেই বুঝে ব্যয় করো সোহিনী। আমার মতামত নেওয়ারও দরকার নেই। দ্যাখো তো ইনিই ঠাকুর মশাই কিনা! একেবারে চেহারা ভেঙে গেছে, চিনতে পারা বড় মুশকিল।
হ্যাঁ। যাও উঠে গিয়ে ঝোলাটা ধরো।
পূর্ণ মহারাজ উঠে গিয়ে পুরোহিত মশাইকে সসম্মানে ভেতরে নিয়ে এলেন। উনি সকৌতু্কে বললেন - তোমাকে তো এমন জটাযুত সমাযুক্ত দেখিনি কখনও। তা তুমিই তো পরিতোষ?
হ্যাঁ জ্যাঠামশাই।
তোমার মায়ের থেকে তোমার খবর পেতাম। অবশ্য ওই বা তোমার বেশী খবর পেতো কোথায়? গ্রামের কেউ কখনও তোমাদের আশ্রমে ফেরত এসে যদি খবর দিত, সেইটুকুই যা খবর। তা বাবা তুমি এখন কোথায় আছো?
আমি এখন কোচবিহারে থাকি।
কলকাতার দিকে ছিলে শুনেছিলাম!
আমাদের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয় বড় আশ্রম থেকে। আপাতত কয়েক বছর কোচবিহারে আছি।
তুমি যখন গয়ায় থাকতে, তখনই গ্রামের লোকজনদের সাথে দেখা হত বেশী। কম-বেশী সবাই তো গয়ায় পিণ্ড দিতে যায়!
হ্যাঁ আমাদের আশ্রমেও পিণ্ড দেওয়ানোর ব্যবস্থা আছে।
তা বাবা তুমি কি মায়ের শ্রাদ্ধ-শান্তি করবে, নাকি তোমার নিষেধ আছে?
আমার কোনও নিষেধ নেই। তবে কিনা আমি তো মায়ের প্রতি কোনও কর্তব্য-কর্ম করিনি! বরং সোহিনী ওঁর শেষ সময়ে অনেক করেছে। যদি ও এইসব ক্রিয়া করে মায়ের আত্মার শান্তি হবে।
তোমার কথা আমি স্বীকার করি বাবা। কিন্তু গ্রামে-গঞ্জে স্বাভাবিক লোকাচারের বিরুদ্ধে গেলে অনেক বাঁকা কথা শুনতে হয়। ওতে সোহিনী মায়ের সম্মানও বাড়বে না। তুমি কী বলো সোহিনী?
না জেঠামশাই। উনি তো সংসার জগতে থাকেন না। এসব বোধবুদ্ধি নেই। উনিই কাজকর্ম করুন। তবে বরুণের কী কী করণীয় তা যদি বলেন!
পূর্ণ মহারাজ জিজ্ঞাসা করলেন, বরুণ কে?
আমার ছেলে। সোহিনী উত্তর দিল।
ওর করণীয় বলতে?
পুরোহিত মশাই বললেন, আসলে ওই মুখাগ্নি করেছে তো!
সোহিনী বলল, তোমার মায়ের শেষ ইচ্ছা এটাই ছিল।
পূর্ণ মহারাজ বললেন, ও কোথায়?
ও বাঁকুড়া জেলা শহরে পড়াশুনো করে। চলে আসবে কাজের আগের দিন।
বেশ তো। এটাই তো সবচেয়ে ভালো সমাধান হল জেঠামশাই। ওই শ্রাদ্ধ-শান্তির সব কাজ করুক। যেটুকু আমার না করলেই নয়, সেটুকুই শুধু আমি করব।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পূজা উপাচারের ফর্দ করে বেরিয়ে গেলেন পুরোহিত মশাই। পূর্ণ মহারাজ জিজ্ঞাসা করলেন, বরুণের বয়স কত?
কুড়ি হল গত মাসে।
কী পড়ে ও?
সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারী পড়ে।
পড়াশুনোয় ভালো তাহলে।
হ্যাঁ। ও খুবই ভালো ছেলে।
আচ্ছা সোহিনী, তুমি সেদিন এড়িয়ে গেলে, কিন্তু এ ক’দিনে আমি অনুমান করেছি তুমি শ্বশুর বাড়ী যাও না। তা ছেলের লেখা পড়ার খরচ চলে কী করে?
খাওয়া-পরাটা আমার দাদারাই দেয়। আর বরুণের হোস্টেল খরচা আর পড়ার খরচা কাকীমা দিতেন।
কাকীমা মানে আমার মা?
হ্যাঁ।
তাহলে তুমি যে শ্রাদ্ধ-শান্তির নামে সব উড়িয়ে দিচ্ছ - বরুণের আসবে কোত্থেকে?
যাঁর টাকা তাঁর কাজেই তো দিচ্ছি। উনি তো আর ওর জন্য কিছু রাখতে বলেন নি।
এমনটা করো না সোহিনী। ছেলের ভবিষ্যতের কথাটা ভাবো।
ও যথেষ্ট বড় হয়েছে পরিদা। দরকার পড়লে টিউশনি পড়িয়ে খরচা সামলে নেবে।
কিন্তু তোমার শ্বশুর বাড়ীতে কী সমস্যা হল? তোমার বরের কী খবর?
জাগতিক সংসারের জটিলতা থেকে যখন মুক্ত হতেই চেয়েছো, তবে মিছিমিছি আর ওসবের মধ্যে ঢুকছো কেন?
আমরা তো হিমালয়বাসী তপস্বী নই সোহিনী। আমরা লোকালয়ের মধ্যেই থাকি। মানুষজন নিয়েই, তাদের সুখ-দুঃখ নিয়েই আমাদের কারবার। শুধুমাত্র নিজের মোক্ষচিন্তায় সব কিছুর আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে যাইনি আমি।
তবে কিসের জন্য সংসার ছেড়ে পালিয়েছিলে?
সংসারের কণ্ঠস্বর যেন কর্কশ চাবুকের মতো বাজতে লাগলো চারদিকের দেয়ালে।
পূর্ণ মহারাজ চুপ করে রইলেন। একটু বাদে গলার স্বর নরম করে সোহিনী বলল, জানো পরিদা, গ্রামে সবাই হাসাহাসি শুরু করে দিয়েছিল তুমি নাকি আমার বিয়ের খবর শুনেই বাড়ী ছেড়ে পালিয়েছিলে?
পূর্ণ মহারাজ হেসে বললেন, ‘তাই বুঝি?’ হঠাৎ সোহিনীর মুখটা নিমেষে কালো হয়ে যেতে সম্বিত ফিরল তাঁর। নরম গলায় বললেন, বিয়ের খবর তো মাসখানেক আগেই শুনেছিলাম। আমি যেদিন চলে যাই তার চারদিন বাদে তোমার বিয়ে ছিল।
তুমি কেন চলে গিয়েছিলে আমার জানতে খুব ইচ্ছে করে। দ্যাখো যতটুকু আমি তোমাকে চিনতাম তোমার মধ্যে সন্ন্যাসের কোনও বৈরাগ্যই দেখিনি কখনও! তোমার মধ্যে ভোগ-বিলাসের আকাঙ্ক্ষা পুরোমাত্রাতেই ছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছিলে। বিদেশে যাবার স্বপ্ন দেখতে। কী এমন হয়ে গেল? যারা সব কিছু ত্যাগ করার ক্ষমতা রাখে, তাদের কি কোনও পূর্ব লক্ষণ ধরা পড়ে না?
পূর্ণ মহারাজ হাসলেন। বললেন, আমি নিজেও সবটুকু ভালো মত তোমায় বোঝাতে পারবো না সোহিনী। তবে তোমাকে একটা প্রতীকী গল্প শোনাতে পারি। শুনবে?
বলো।
স্বামী জ্ঞানেশ্বরানন্দজীর লেখা একটা বইতে পড়েছিলাম - জীবনটাকে যদি একটা মহা বৃক্ষ বলে ধরা যায় - সেই বৃক্ষে থাকে দুটি পাখি। যে একেবারে উপরে বসে থাকে - সে এই বৃক্ষ থেকে কিছু আশা করে না - সে স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বয়ং উদ্ভাসিত, সদা আনন্দিত। সে সুখের জন্য, জ্ঞানের জন্য কারো উপর নির্ভর করে না - বরং তার নিজস্ব দ্যুতি আছে, বুদ্ধিমত্তা আছে - অথচ তার এই বিষয়ে কোনও অহংকার নেই। সেই বৃক্ষে থাকে আর একটি পাখি যে লোভ ও লালসায় পূর্ণ। সে প্রতিনিয়ত গাছের মিষ্টি ফল খুঁজে বেড়ায় ও তাতে ঠোকরায়। মিষ্টি ফল পেলে সে সাময়িকভাবে মনে করে সে সুখী, সে পরিপূর্ণ। কিন্তু কিছু পরে সে আবার ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ে। হয়তো বা সে এবার একটি তেতো ফল আস্বাদন করে, ওর মন বিগড়ে যায়, সে দুঃখী হয়। সেই মুহূর্তে তার মধ্যে সাময়িক দু-একবার হয়তো বৃক্ষের উপরে বসা পাখিটার ছায়া এসে পড়ে। তার আলোকিত উদ্ভাস তাকে উদ্দীপ্ত করে। সে সেই পাখির দিকে আকৃষ্ট হয় - আবার জাগতিক ফলের মোহে ভুলে যায়।
তুমি কি এই দ্বিতীয় পাখিটা? নাকি প্রথমটা?
আগে শোনই না পুরো গল্পটা। সব কিছু তোমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে সোহিনী।
বলো।
এইভাবে অস্থির পাখিটা ফল ঠোকরাতে ঠোকরাতে ক্রমাগত সেই মহাবৃক্ষের উপরে এসে পৌঁছায়। এমনটাও দেখা যায় কখনও কখনও কোনও পাখি সরাসরি ওই উপরে বসা পাখিটার কাছে গিয়ে পৌঁছায় অথবা কখনও ধীরে ধীরে সইয়ে সইয়ে পৌঁছায়। যখন ওই দ্বিতীয় পাখিটা প্রথমটার কাছে পৌঁছায় - তখন তার ব্যক্তিত্বের উদ্ভাসে সে চূড়ান্তভাবে প্রভাবিত হয়। একটা সময় এমন হয় -দ্বিতীয় পাখিটার আর আলাদা অস্তিত্ব থাকে না, সে প্রথমটার মধ্যেই সমাহিত হয়।
কিছুই তো বুঝলাম না পরিদা।
হয়তো সময় লাগবে বুঝতে। তুমি শুধু মনে রেখো আমাদের দৈহিক ও মনোগত আমিটা হল দ্বিতীয় পাখি। আমাদের প্রকৃত আত্মাটি হল উপরের পাখিটা। আমদের জীবনের যাত্রাক্রম হল দ্বিতীয় পাখি থেকে প্রথম পাখিটায় ওঠা। নানান সুস্বাদু ফলের মতো যারা আমাদের সেই যাত্রাক্রমকে বাধা দেয় - তাই মায়া। এই সৃষ্টির রহস্যই হল মায়া। এক একজন তার প্রকৃতি অনুযায়ী সময় নেয় সেই মায়ার আবরণকে সরাতে।
সোহিনী বলল, তুমি এবার খেতে বসো পরিদা। আমিও বাড়ী যাব। রাত হয়ে যাবে অনেক।
তুমি তো আর আগের মতো ভয় পাও না সোহিনী, চিন্তা কী?
সোহিনী কিছু না বলে ভেতরে ফলটল কাটতে গেল। পূর্ণ মহারাজ বাইরের উঠোনটায় এসে দাঁড়ালেন। তারা ভর্তি আকাশের দিকে চেয়ে মনে মনে আবৃত্তি করলেন ঋকবেদের একটি সূত্র - ‘দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং পরি যস্বজাতে/ তরোরণ্যঃ পিপ্পলং স্বাদ্বত্ত্যনশ্নন্নন্যো অভিচাকশীতি/ যত্রা সুপর্ণো অমৃতস্য ভাগম্ অনিমেষঃ বিদথামিস্বরস্তি/ ইনো বিশ্বস্য ভূবনস্য গোপাঃ স সা ধীরঃ পাকমত্র বিবেশ’। (ঋকবেদ ১/১৬৫/২০-২১) কী সুন্দর কথাগুলো প্রাচীন মুনি-ঋষিরা লিখে গেছেন! দুটি পাখি - যারা সখা, যারা একসাথে থাকে তারা একই বৃক্ষকে আছে জড়িয়ে। তাদের একজন খায় স্বাদু পিপ্পলী, আরেকজন না খেয়ে শুধু তাকে চেয়ে দেখে। যেখানে সুপর্ণ আত্মারা অমৃতের ভাগ পেয়ে অনিমেষে বিদ্যার কথা ঘোষণা করেন - সেইখানে জগৎ-পিতা পরমজ্ঞানী হয়েও আবিষ্ট হলেন অজ্ঞানী আমার মধ্যে! এ যেন রবিঠাকুরের সেই গানটি - তাই তোমার আনন্দ আমার পর/ তুমি তাই এসেছ নীচে…
(৪)
সকাল থেকেই চারদিকে হইচই ব্যাপার। উঠোনের একটা কোণে রান্নার ব্যবস্থা হয়েছে। একদিকে শ্রাদ্ধ-শান্তির জন্য জায়গা ঘেরা হয়েছে। সোহিনীর আয়োজনে কোনও ত্রুটি নেই। প্রায় জনা বারো পুরোহিত তারস্বরে মন্ত্র পাঠ করে চলেছেন। পূর্ণ মহারাজ সব কিছু ঘুরে ফিরে দেখছিলেন, হঠাৎ সোহিনীর গলার স্বরে ঘুরে দাঁড়ালেন, ‘নাও এনাকে প্রণাম করো’। এই ছেলেটিই তবে বরুণ। ধুতি আর উত্তরীয় পরে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর সামনে। ঈষৎ কৃশ দীর্ঘ চেহারা। গালে অল্প দাড়ি। মুখটা বড় চেনা চেনা মনে হল তাঁর। কোথায় যেন দেখেছেন। পুরোহিত মশাই দুজনকেই ডাকলেন। বরুণ মূল কাজে বসেছে। মায়ের একটা অল্প বয়সের ছবি কোথা থেকে বের করে রেখেছিল সোহিনী। ওটাই বাঁধিয়ে আনা হয়েছে। ওই ছবিটা দেখতে দেখতে হঠাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো উঠে দাঁড়ালেন পূর্ণ মহারাজ। সোহিনীকে বললেন, মায়ের শোবার ঘরে একটু এসো তো!
কেন? এখন আবার কী দরকার?
চলো। ওখানে গিয়েই বলব।
মায়ের ঘরে এসে পূর্ণ মহারাজ বললেন, শিগগির পুরোনো অ্যালবামগুলো বের করো তো!
সোহিনী কথা না বাড়িয়ে অ্যালবাম কয়েকটা বের করে দিল। বেশ কিছুক্ষণ পাতা হাতড়ে হাতড়ে একটা ছবি বের করলেন পূর্ণ মহারাজ। ওঁর উপনয়নের দিনের তোলা ছবি। দীর্ঘ চেহারা, ধুতি আর উত্তরীয় দিয়ে। একটু বেশী বয়সে উপনয়ন হয়েছিল তাঁর। গালে অল্প খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ওঁদের মুণ্ডন হওয়ার বিধি ছিলনা। ঠিক যেন বরুণ দাঁড়িয়ে আছে। এইজন্যই মায়ের ছবিটা দেখে ওঁর ভেতরটা কেমন করে উঠেছিল। তাকিয়ে দেখলেন - একটু দূরেই দাঁড়িয়ে সোহিনী এইদিকে তাকিয়ে আছে। ওকে কিছু বলতে যাবার উপক্রম করতেই সোহিনী কারো ডাকে যাই বলে অন্যদিকে চলে গেল।
ওঁর মনে পড়ল একদিনের কথা। সেদিন মা সোহিনীকে আইবুড়ো ভাত খাওয়ানোর নেমন্তন্ন করেছিলেন। উনি সেদিন কলকাতা থেকে ফিরেছিলেন অনেক রাতে। বিনিদ্র রাত যখন ঊষার লগ্নে এসে দাঁড়িয়েছিল, সোহিনীকে হঠাৎ করে উনি আবিষ্কার করেছিলেন ওঁর শোবার ঘরের দরজায়। বরুণ কি তবে…? মাও কি একথা জানতেন? সোহিনীকে কি একথা জিজ্ঞেস করবেন তিনি? থাক, কী লাভ আর ওতে? হৃদয়ের বাসনাগুলোকে যখন ঝেড়ে ফেলা যায়, তখনই মর্ত্য হয় অমৃত আর তখনই ব্রহ্মকে সম্ভোগ করা যায়। তাঁর কানের মধ্যে যেন বাজতে লাগলো - বৃহদারণ্যকোপনিষৎ -এর মন্ত্র - ‘যদা সর্বে প্রমুচ্যন্তে কামা যে’হস্য হৃদি শ্রিতাঃ। অথঃ মর্ত্যো’হমৃতো ভবত্যত্র ব্রহ্ম সমশ্নুত।
0 Comments