পর্ব- ৪
সুমনা সাহারেলগাড়ি ছুটছে। দুরন্ত গতি। নিকষ কালো রাত্রির বুক চিরে রেলগাড়ি ছুটে চলেছে। কখনও তার ছুটন্ত চাকাগুলো লোহার পাটির সঙ্গে ঘর্ষণের বিপুল শব্দ তুলে দাঁড়িয়ে পড়ছে। কোন স্টেশন অন্ধকারে চোখ পেতে কিছুই ঠাহর হয় না। স্তব্ধ হয়ে থাকে যাত্রী মন। স্মৃতির রেলগাড়ি সামনে নয়, ছুটছে পিছন পানে। কখনও স্কুলবেলা, কখনও কলেজবেলা, কখনও মৃত্যু, কখনও জন্ম ঝলক দেখিয়ে যাচ্ছে। একটার সঙ্গে আরেকটা জুড়ে যাচ্ছে, সময়ের হিসেব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। আবার সশব্দে পেরিয়ে গেল কোন আলো ঝলমল স্টেশন, কি যেন দেখব বলে মুখ বাড়াতেই হারিয়ে গেল অন্ধকারে।
ছোটবেলায় একটা কথা বাড়িতে সবসময় ঘুরপাক খেত। যে-ই বাড়িতে আসত, “তোমরা ক’ভাইবোন?” এই প্রশ্নটা ছিল অবধারিত এবং ‘দুই বোন” শুনলেই, “ভাই নেই?” আত্মীয়-স্বজন সবার মুখে শুনতাম, এইবার আমাদের একটা ভাই হবে। একটা ভাই না হলে যেন কী মহা অনর্থ হয়ে যাবে, এমনটাই মনে হত। মা-র পেটের মধ্যে একটা ভাই আছে, অনেকদিন ধরে ওখানে ঘুমাচ্ছে। এবার তার বাইরে আসার সময় হয়েছে। সে যে কী এক্সাইটমেন্ট আমাদের দুই বোনের, বলে বোঝানো যাবে না। মেজ পিসি এসে গেল আমাদের দেখাশোনার জন্য। কারণ মা এখন পারবে না। মেজ পিসির সঙ্গে তার দুই ছেলেমেয়ে, আমাদের পিসতুতো দিদি আর ভাই। আর তারা এলে আমরা আক্ষরিক বাড়িতে নরক গুলজার লাগিয়ে দিতাম। সেসব আরেক ইতিহাস। মা হাসপাতালে চলে গেল। আমরা ভীষণ শান্ত আর ভাল মেয়ে হয়ে গেলাম। পিসি যা দেয় খেয়ে নিই, দাদার সঙ্গে ঝগড়া মারামারি করি না। দাদাও আমাদের প্রতি খুব কেয়ারিং হয়ে গেল। বাড়িটা একেবারে নেড়া নেড়া লাগে। তারপর শুনলাম, আমাদের ভাই আসেনি, একটা বোন হয়েছে। আমরা কবে দেখতে যাব, রোজ ঘ্যান ঘ্যান করি পিসির কাছে। বাবা পিসিকে সঙ্গে নিয়ে দরকারি জিনিসপত্র নিয়ে যায়। আমাদের কে নিয়ে যাবে? দাদাকে বলি, “অ্যাই বড়দা, তুই বাবুকে বল না?” দাদারও মন মরা। এখন আর আমাদের পিছনে লাগে না। না হলে সারাদিন তো আমাদের খেপিয়ে বেড়াত—“পোটকা ট্যাংরা দুই বোন মিটিমিটি চায়/কুকুরের মাংস দেখে তাদের বড় লোভ হয়!” এই ছিল ওর ট্যাগ লাইন। একটা সুর করে বলত। কিন্তু সুরটা শুরু হওয়া মাত্র আমরা ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তাম আর আঁচড়ে কামড়ে দেব, এই ভয়ে দাদা ছুটত। মা বলত, “খোকন কেন বাচ্চাগুলোর পিছনে লাগছিস?” দাদা ছুটে ছুটে হাঁপিয়ে গিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেত আর যাওয়ার সময় পিছন থেকে সদর দরজার ল্যাচ টেনে দিত।
আমরা অপেক্ষা করতাম, “আসুক না আবার, কতক্ষণ বাইরে থাকবে? আজকে শেষ করব ওকে। আমরা কুকুরের মাংস খাই?” মা-বাবু কত বোঝাত, “ওরে তোরা এত বোকা কেন? ও তো ইয়ার্কি মারছে। তোরা রেগে যাচ্ছিস বলেই তো ও মজা পাচ্ছে। তোরা বলবি, হ্যাঁ ঠিক আছে যা, কুকুরের মাংস দেখে আমাদের লোভ হয়। ব্যাস মিটে গেল। আর চেতাতে পারবে না।” তারপর পুরোটা বলার দরকার হত না। শুধু ‘হু হু’ করে ওই সুরটা তুললেই হল, আর রক্ষা নেই, আমরা দৌড়াতাম ওর পিছনে। যেদিন ধরে ফেলতাম দাদাকে, বলত, “আমি তো হরিণের মাংস বলেছি!” আমরাও অমনি শান্ত হয়ে যেতাম। অথচ হরিণের মাংস বা কুকুরের মাংস—কোনটা খাওয়ার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যই হয়নি। যাই হোক, সেই খোকন দাদা এখন আমাদের একটুও খেপায় না। অবশেষে বাবা দাদাকে আর আমাদের দুই বোনকে হাসপাতালে নিয়ে গেল দুদিন পরে বিকেল বেলা। পৌঁছে দরজার কাছে গিয়ে দাদা কেমন লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মা ডাকল, “ও খোকন, আয়, আমার কাছে আয়। পেট ভরে খাচ্ছিস তো বাবা? মুখটা শুকিয়ে গেছে!” এই বলে মা দাদার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতেই দাদার চোখ ছল ছল করে উঠল। আমরা দুই বোন বোনুকে দেখব বলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। একটা পুতুলের সাইজের মানুষ ঘুমাচ্ছে। মাথায় চুল নেই। টুকটুকে ফর্সা। কি মিষ্টি! মা বলল, “গুণে দেখ তো বোনুর হাতের সব আঙুল আছে কি না!” আমরা গুণতে গিয়ে দেখি হাত শক্ত করে মুঠো করা। হাতের মুঠো খোলার চেষ্টা করতেই ‘ওঁয়া’ করে কেঁদে উঠল। আয়া মাসি এসে আমাদের সরিয়ে দিল, “এই তোমরা কিন্তু বাচ্চার গায়ে হাত দিও না।” সারা রাস্তা আমরা খালি সদ্যোজাত সেই ফুটফুটে বাচ্চাটার কথাই বলাবলি করছিলাম। পাড়ার যে মাসিমা মা-কে খুব ভালবাসত, এসে জিজ্ঞেস করল, “কি রে বোন তোর মা-র মত ফর্সা, নাকি বাবার মত কালো?” আমরা সগর্বে বললাম, “মা-র চেয়েও ফর্সা!” পিসি সন্ধ্যা বেলা বসে বসে সুতির কাপড় দিয়ে কাঁথা তৈরি করত, বোনকে নিয়ে মা বাড়িতে এলে দরকার হবে। কাঁথাগুলো কি সুন্দর, ছোট্ট ছোট্ট রংবেরঙের। তারপর একদিন মা এসে গেল, ট্যাক্সি করে বাবা নিয়ে এল। মা আর আগের মত নেই। সারাক্ষণ হাই তোলে। বোনুটাকে নিয়ে শোয়, রাত্রে বার বার উঠে দুধ খাওয়াতে হয়, কাঁথা পাল্টাতে হয়। আমরা দু’বোন তাই পাশের ঘরে শুই। আমাদের দু’বোনের মধ্যে হঠাৎ খুব ভাব হয়ে গেল। আমরা দুজনেই অদ্ভুত একটা অবহেলিত ফিল করছি, ছোট্ট বোনুটার উপর রাগ করতেও পারছি না। কারো উপরেই রাগ করতে পারছি না। কিন্তু বাড়িতে আমাদের গুরুত্ব হারিয়ে গেছে অনুভব করছি। আর সেই সর্বহারাত্বের অনুভবে দুই বোন একাত্ম হলাম। বোনুটা আরেকটু বড় হল। ওর জন্মের চুল মানসিক করা। বড় বড় চুল, চোখ দুটোও পদ্মপাতার মত ডাগর ডাগর। আর দুধে আলতা গায়ের রঙ। বাইরে ঘুরতে বেরোই মাঝে মাঝে ওকে কোলে নিয়ে। সবাই বলে, “ওমা কি সুন্দর হয়েছে রে!” বোন গর্বে গর্বিতা দিদি হিসেবে আমরা বড়দের কাছ থেকে শোনা একটা কথা বলতাম, “বিয়ে দিতে পয়সা লাগবে না!” এখনকার দিনে কথাটা অশোভন শোনাবে হয়তো। কিন্তু আমাদের ছোটবেলার সমাজ এরকমই ছিল। যেদিন আবিষ্কার করলাম ঐ ছোট্ট বোনুটার জন্য বাবা একটা স্পেশাল নরম তুলতুলে সন্দেশ নিয়ে আসে, রোজ রাত্রে চুপি চুপি সেটা ওর মাথার কাছে রেখে দেয়, ভোর বেলা ঘুম ভেঙে গেলে খিদে পায়, তখন যাতে মাকে ডেকে না তুলে ঐ সন্দেশটা খেয়ে জল খেয়ে আবার লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে শুয়ে পড়ে, তাই এই ব্যবস্থা। আর এত কিছু আমাদের কাছে দিনের পর দিন গোপন রাখা হয়েছে—সেদিন যে তীব্র বেদনা বোধ করেছিলাম, মীরজাফরকে সিরাজ যেকথা বলতে পারতেন, “তুমি!” আমাদের বাবার প্রতি মনোভাবটা এরকমই হয়েছিল? ‘বাবু? এতবড় বিশ্বাসঘাতক?’ জানি না, সেইদিন থেকেই কিনা, আমরা দু’বোন বোধহয় একটা দল আর ও একা হয়ে গিয়েছিল। বাইরে নয়, একদম ভিতরে ভিতরে। যতদিন না আমাদের কনিষ্ঠতম বোন এসে ওর খেলার সাথী হয়েছিল, ততদিন। আমরা স্কুলে যেতাম। ও বাড়িতে থাকত। স্কুল থেকে ফিরে আমরা স্কুলের গল্প করতাম, ও এসে দাঁড়ালে ওকে পাত্তা দিতাম না। খুব শান্ত ছিল ও। একা একা খেলত। একটা সজনে ডাঁটা বা একটা পুঁই শাকের লম্বা লতা নিয়ে আপন মনে বকবক করত। এক একদিন আমরা নিষ্ঠুর ভাবে ওকে খেপাতাম। ও কাঁদত। কাঁদলে ওর বুকে ব্যথা হত। আমাদের কাজের এক মাসি বলেছিল, “বুকে ব্যাদনা হয়?” ব্যাদনা মানে বেদনা, ব্যথা। ওই কথা শিখে ওকে ‘ব্যাদনা’ ‘ব্যাদনা’ বলে উত্যক্ত করতাম। তবে সেটা আজ এত বয়সে এসে বুঝি। তখন শিশু মানসিকতা বুঝবে কে? আমরাই তো শিশু। একটু বেশি গণ্ডগোল শুনলেই বড়রা ছোটদের ঝামেলা মেটাতে আসত। তার আগে নয়। তাই মেজটা বেশি বাড়িয়ে তুলছে দেখলে আমিই সামলে নিতাম। আমার কাছে বোনও বেশি নিরাপদ বোধ করত।
একটা বয়সে পৌঁছে সবাই দূরে দূরে চলে যায়, রোজ দেখা হয় না, রোজ কথা হয় না। তাতে কি? আমি যদি অনেকদিন মাথায় শ্যাম্পু করার সময় না পাই, চুলে নোংরা জমে। পায়ের পরিচর্যা বহুদিন হয়ে না ওঠে, নখ বড় হয়, ময়লা জমে। তাই বলে কি আমার চুল, আমার নখ, আমার প্রিয় নয়? ওরা তো আমারই। যাই হয়ে যাক, ওরা আমার অঙ্গ।
(ক্রমশ)
0 Comments