বার্লিনের ডায়েরি ৭৩ পর্ব
(ভিসুভিয়াস )
চিত্রা ভট্টাচার্য্য
পাহাড়ের গায়ে সরু কালো ফিতের মত রাস্তায় ধীরশান্ত গতিতে জীপ চলেছে ভিসুভিয়াস ন্যাশনাল পার্কে। ধূসর আকাশে শেষ বিকেলের একগুচ্ছ সিঁদুরে মেঘ পাহাড়ের ঘাড়ে মাথায় লুটোপুটি খেয়ে অনেকটা জায়গা জুড়ে জাঁকিয়ে বসেছে রানীর মত। আসমানী নীলরঙা আকাশের বুকজুড়ে ভাসছে মেঘপরীদের কমলারাঙা সাম্পান। ছলেবলে নামছে তারা দূরপাহাড়ের আদুরে গায়ে। যতদূর তাকাও দেখাযায় উঁচুনীচু রুক্ষু তামাটে পাথরের ঢেউ। গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে বহুদূরে নেপলস ঠিক যেন খেলনাবাড়ি। পাহাড়ের পায়ের তলায় আড়ালে চলে যায় একালের পম্পেইয়ের ব্যস্ত জীবন। আদ্রিজা দুশ্চিন্তায় ভাষাহারা ,এক অব্যক্ত ভয় মিশ্রিত চিন্তায় চলেছে নির্দয় ভঙ্করের সামনে। যার মূহুর্তে জেগে ওঠার দস্যিপনায় নিমেষে তছনছ হতে পারে হাজারহাজার জীবন্ত প্রাণের স্পন্দন শহর থেকে গ্রাম নগর। ঋষভের হাত দুটো শক্ত করে মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ দেখে বাঁ দিকের ঐ ডাউনের ফিরতি পথে আমরা নেপল্সে ফিরবো। চিন্তানেই বাসষ্ট্যান্ডে অপেক্ষারত সন্ধ্যে ছটার বাসে রোমে পৌঁছতে রাত সাড়ে ন ' টা হবে।
ভিসুভিয়াসের জ্বালামুখ
শ্রীর মনে হয়,তিতিরের এই চিন্তা মোটেই অমূলক বা অস্বাভাবিক নয়। এক অজানা প্রাণ সংহারী ভয় ! সেই মুহূর্তে গ্রাস করেছে জীপে ভ্রাম্যমান সব আরোহীকেই।ও নিজের কান কে সর্বদা সতর্ক রাখে একটু গুমগুম একটু দুমদাম শব্দ হলেই ভয়ার্ত চোখে চমকে উঠে এলোমেলো তাকায়। কী জানি এই সুপ্ত পাহাড়ের কী মতলব ? ঋষভ আশ্বাস দিয়ে বলে তেমন বুঝলে ট্যুর কর্তৃপক্ষ এই ন্যাশানালপার্কে মোটেই বেড়াতে নিয়ে আসতো না। তোমরা অকারণে ভয় পেয়ো না।
🍂
শ্রীর চিন্তার ঝাঁপিতে ভিসুভিয়াস ঝিঁঝিঁ পোকার মত ঝাঁজর বাজায়। ও যে কোনো এক ভূতাত্ত্বিক জার্নালে পড়েছিল এই আগ্নেয় পর্বতমালার চলমান জীবন শুরু মাউন্ট সোম্মা নামক একটি প্রাচীন আগ্নেয়গিরির ক্যালডেরায় ১৭,০০০ বছর আগে। চূড়ান্ত অগ্ন্যুৎপাতের সময় মাউন্ট সোম্মা ভেঙে পড়েছিল এবং যার ফলে ক্যালডেরা তৈরি হয়। ধ্বসের সময় ক্যালডেরায় ভিসুভিয়াস বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ভিসুভিয়াসের উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব দিকে এখনও মাউন্ট সোম্মার কিছু অংশ দেখা যায়। ৭৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ভিসুভিয়াসে কমপক্ষে ছত্রিশবার অগ্ন্যুৎপাত হয়েছে। কালের বিবর্তনে বর্তমানে যদিও সে আজ শান্ত, তবুও সে এককালের সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। এর ভয়াবহ চরিত্র , অগ্ন্যুৎপাতের ইতিহাস-- ইঙ্গিত দেয় যে এর আশেপাশে বসবাসকারী তিন মিলিয়নের ও বেশী মানুষের জন্য হঠাৎ কতটা ভয়ানক ও বিপদজনক রূপ নিতে পারে ?
পাশের এক পোলিশ সহযাত্রী আলোচনায় যোগ দিয়ে বলে , ইতালীর মাউন্ট ভিসুভিয়াসের কথা বলতে গেলে এটি কখন শান্ত হয়ে ঘুমে মগ্ন ,কখন ই বা রুদ্রমূর্তি ধারণ করে প্রলয় নাচন শুরু করবে কেউ সঠিক সময় জানে না। সে রাগে গরগর করে কখন যে ফুলে ফেঁপে মেদিনী কাঁপাবে ? কখন যে শুরু করবে অগ্ন্যুৎপাত তারই প্রশ্ন জাগে সর্বদা ? সাধারণ মানুষ কে তাই সদা শঙ্কিত ও তঠস্থ থাকতে হয়। এই কারণে আধুনিককালে ভিসুভিয়াস অবজারভেটরি ভূমিকম্পের কার্যকলাপ, গ্যাস নির্গমন এবং অন্যান্য সূচকগুলি চব্বিশঘন্টা পর্যবেক্ষণ করে যাতে এটি যে কোন সময়ে বিস্ফোরিত হতে পারে তা জানার জন্য। সর্বদা তাই কর্তৃপক্ষকে বিশেষ নজরদারি রাখতে হয়। দূরে পাহাড়শীর্ষে উদ্যানের ঘেরাও করা ফেন্সিং দেখাযায়। ঋষভ বলে , আমরা প্রায় আগ্নেয়গিরির সংরক্ষিত এলাকায় এসে গিয়েছি । হ্যাঁ ঠিক এখানেই , ১২৮১ মিটার উচ্চতায় অগ্নিকুন্ডকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে ১৩৫ বর্গ কিলোমিটারের ন্যাশনাল পার্কটি ।
পম্পেই নগরী
এড্রিক বলে দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে ওর শীর্ষদেশ জুড়ে চকচকে লালচে পাথরের ঢাল।পাহাড়ের দুই পাশে ঢালু বনের বুক চিরে ঘুরে ঘুরে উপরের দিকে চলে গেছে পিচঢালা সরু সর্পিল রাস্তা সেখানে একটু লক্ষ্য করলে দেখতে পাবে কোথাও তামাটে ঝামা পাথরের স্তূপ,বা কোথাও জমাট বাধা লালচে মাটি কোথাও মিশকালো মাটির ঢিবি । হাজার হাজার বছর আগের লেলিহান লাভা এখানে জীবনীশক্তি হারিয়ে পরিণত হয়েছে শক্ত নীরেট পাথরে। শ্রীর চোখে বাইনোকুলারে দেখাযায় চারদিক ঘিরে নীরেট পাথরের রাজ্যে কত সবুজের বাঙময় সমারোহ। আকাশচূম্বী শতশত চেনা অচেনা গাছের সারি। একের পর এক জন্মে সারসার দাঁড়িয়ে ঢেকে ফেলতে চাইছে পুরোনো সব বিভীষিকাময় ক্ষতের চিহ্ন ! ধ্বংসের স্মৃতি কে।
ইরিনা মনদিয়ে হেডফোনে ভয়েস রেকর্ড শুনছিলো-- শেষ অগ্নুৎপাতটি ১৯৪৪ সালে ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। যার ফলে সামান্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল এবং ২৬ জন নিহত হয়েছিল। ভিসুভিয়াসের গর্ভ থেকে লাভা প্রবাহ উপচে প্লাবিত হয়ে দেড়সপ্তাহ ধরে ছোটখাটো অগ্ন্যুৎপাতে পরিণত হয়েছিল। এবং বিশাল বিস্ফোরনের ফলে তীব্র আকারের রূপ নিয়েছিল । তবে পূর্বাভাস অনুসারে বেশীর ভাগ শহরবাসী কে সরিয়ে নিরাপত্তা দেবার জন্য যথেষ্ট সময় ও পাওয়া যাওয়ায় ক্ষয় ক্ষতির পরিমান বিধ্বংসী অগ্ন্যুৎপাতের তুলনায় খুবইকমছিল। ইতিহাসের পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে এই আগ্নেয়গিরির পাশে বসবাসের সহজাত বিপদের কথা তুলে ধরার জন্য, গত হাজারহাজার বছরের ভিসুভিয়াসে আটটি বিশালকার ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছে। ১৬৩১ সালে, ভিসুভিয়াসের অস্থিরতায় আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের সময় চলেছিল লাভা প্রবাহ এবং অসংখ্য অগ্ন্যুৎপাত । ১৭০০, ১৮০০ এবং ১৯০০ এর দশকের গোড়ার দিকে বিস্ফোরক অগ্ন্যুৎপাত ঘটে, যার ফলে আরও লাভা প্রবাহ এবং ফাটল তৈরি হয় যা আগ্নেয়গিরির আশেপাশের শহরগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস করে দেয় বারেবারে।
জীপের গাইড মিস্টার জোনাথন ইরিনা কে স্বাগত জানিয়ে বলেন , ফ্রেজারের সূত্র অনুযায়ী বলা যায় ভূতাত্ত্বিক এবং আগ্নেয়গিরিবিদরা যারা আগ্নেয়গিরি ও অগ্নুৎপাত নিয়ে নিত্য গবেষনা করছেন তারা সহজেই স্বীকার করেছিলেন যে মাউন্ট ভিসুভিয়াসের বিস্ফোরণের জন্য অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল।
বর্তমানে ভিসুভিয়াস অবজারভেটরি ভূমিকম্পের কার্যকলাপ, গ্যাস নির্গমন এবং অন্যান্য সূচকগুলি চব্বিশ ঘন্টা পর্যবেক্ষণ ও নজরে রাখা হয় যাতে এটি কখন বিস্ফোরিত হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়। সেই অনুযায়ী সতর্কতা অবলম্বন করে জনসাধারণের জীবন রক্ষার চেষ্টা বিশাল ক্ষয়ক্ষতি থেকে সতর্ক হওয়ার আপৎকালীন ব্যবস্থা ও গভর্মেন্ট থেকে বিশেষ ভাবে সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব নেওয়া হয়েছে।এবং ভিসুভিয়াসের আশেপাশের অঞ্চলটি ১৯৯৫ সালের ৫ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় উদ্যান হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। পার্ক কর্তৃপক্ষ সাপ্তাহিক ছুটিতে এই পার্কটির রিতিমত বিশেষ যত্নসহকারে রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকেন ।
পাহাড়ি ঢালের গায়েই বেশ খানিকটা জায়গা বাঁধানো। জীপ ,পার্কিং লটে থামলে এখানেও আগের থেকে বুক করা রোমান গাইড অপেক্ষমান। মূল ফটক পেরিয়ে লালমাটির রাস্তা চলে গেছে ঢাল বেয়ে ওপরের দিকে। বেশ ছড়ানো রেলিং দেওয়া পথ লাট্টুর মত পাক খেয়ে উপরে উঠে গেছে একেবারে শিখর পর্যন্ত। অদ্রিজা তরতর করে এগিয়ে বিস্ময়ান্বিত চোখে ভিসুভিয়াসের শীর্ষ শিখরটি দেখে , বিরাটাকার ঐ জ্বালামুখীর উন্মুক্ত হাঁ মুখদেখে শ্রী কে বলে এ যেন ছোটবেলার রূপকথায় পড়া রাক্ষসীর সেই কদাকার হাঁ মুখটির মত। সব এক নিশ্বাসে গিলে ফেলবে।
লাল মাটি, গড়ানে নুড়ি পাথরের রাস্তা লাল কাঁকরের রাজত্ব। খুব সন্তর্পনে পা টিপে টিপে শ্রী ঋষভের সাহায্যে নিয়ে এগিয়ে চলেছে। শিখরের ২০০ মিটার এর মধ্যে রাস্তার সাহায্যে সংযোগ স্থাপন করা আছে এবং আগ্নেয়গিরির মুখ পর্যন্ত যাতায়াতের জন্য রেলিং দেওয়া সরু রাস্তা। সংরক্ষিত উদ্যানে কঠিন পাথরের বুকে ফুটে রয়েছে বাহারি অর্কিড জাতীয়ফুলের সম্ভার। মৃদু গন্ধ এবং বিচিত্র দৃষ্টি নন্দন শোভায় ভরে আছে চারদিক। যদিও বর্তমানে সময়ের সাথে ব্যাপকভাবে বারংবার অগ্ন্যুৎপাতের ফলে ভৌগোলিক গতিপথে নানাবিধ পরিবর্তন এসেছে এবং পাহাড়ের শীর্ষ দেশের চূড়াটি ও যথেষ্ট পরিবর্তিত ও হয়ে গিয়েছে।
অবশেষে সুপ্ত জ্বালামুখীর মুখের কাছে পৌঁছে শ্রীর মত আরো দর্শনার্থীরা উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে। চারদিকে হালকা আকাশীনীল মেঘের স্বচ্ছ ওড়নায় আবৃত পর্বতশিখর। মায়াবী স্নেহের আঁচলের তলে উন্মত্ত চঞ্চলা পৃথিবী শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে । কোথাও আগ্নেয়গিরির জঠরের জ্বালা থেকে নির্গত ধোঁয়ার ধূম উদ্গিরণের চিহ্ন নেই । ভিসুভিয়াসের কুখ্যাত জ্বালামুখ তখন মাত্র একটি রেলিংয়ের ব্যবধানে। -পৃথিবীর বিরলতম আশ্চর্য্য এক ঐতিহাসিক বিস্ময় ! এক কঠিন সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে নির্বাক শ্রী। ওর জলে ভরা চোখে পলক পড়ে না।
ভূতাত্ত্বিক এড্রিক প্রথম কথা বলে , নানা ধরণের শিলাস্তর নিয়ে লক্ষ্য করে দেখ ,কেন্দ্রপর্যন্ত এরপরেই কেমন ঢাল নেমে গিয়েছে । এখানেও তাপ-চাপের কারণে নানা রকম চিত্র-বিচিত্র শিলা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে জ্বালামুখের আশেপাশে। অন্দরে জন্মেছে কিছু প্রাণের তাগিদ। আলোর আশায় উর্দ্ধমুখী অসংখ্য গাছপালা। ইরিনা দেখালো নীচের দিকের এক প্রান্ত থেকে গন্ধক পোড়া গন্ধের সাথে ক্ষীণ ধোঁয়া ছড়াচ্ছে । এড্রিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে ওখানে ভূমির তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশী হতে পারে । মাটি মনে হয় ফুটছে টগবগ করে,কতটা উত্তপ্ত হলে শিলা থেকে ধোঁয়া বেরোতে পারে ? উৎক্ষিপ্ত লাভা নয়, আগুনের ফুলকি নয়,হলদেটে সোনালী পাথর নয়, সেই অল্পঅল্প গন্ধক পোড়া ধোঁয়া প্রত্যেকের মনের মাঝে এক অদ্ভুত সংশয় রোমাঞ্চের সৃষ্টি করেছিল।
শ্রী ও অদ্রিজার দুজনের মনেই তখন আন্দামানের মাড ভল্কানো দেখার স্মৃতি নাড়া দিয়ে যায়। যেখানে মাটির বুক চিরে বেরিয়ে ঘন কাদার স্রোত প্লাবিত হচ্ছিল। তালতাল ফুটন্ত কাদা ছড়িয়ে পড়ছিল নির্দিষ্ট গতিপথে। বেশ মনে আছে একটা তাড়া খাওয়া সোনালীডানার চিল কেমন করে কাদায় এসে ঝুপ করে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছিল। অসহায়ের মত শ্রী ও তিতির প্রকান্ড পাখিটির বেঁচে থাকার জন্য ডানা মেলে ছটপটানি , প্রাণের বেঁচে থাকার যে অন্তিম লড়াই দেখেছিল সে সময়ে --আজও সেই দৃশ্য দুজনের কেউই ভুলতে পারেনি। অনেকদিন পর সেইবহু পুরোনো স্মৃতি মনের পাতায় নাড়া দিয়ে গেলো।
গন্ধকের তীব্র কটু গন্ধ-বিশালগহ্বরটি থেকে উঠে আসছে। ভয়ংকর, নিষ্ঠুর সেই অন্ধকূপের মত জ্বালামুখ সর্বগ্রাসের লোভে হাঁ মুখটি তার প্রসারিত। কখনো যেন বন্ধ হবে না। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর দানবের মতোই যেন অপেক্ষা করছে অবশ্যম্ভাবী কোনো পরিণতির জন্য। গাইড সাহেব বলেন মাঝেমাঝে এ ধোঁয়া বড্ড জোরালো হয়ে ইউরোপের নানা দেশে তো বটেই এমনকি ১২০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে তুরস্কের ইস্তাম্বুলের আকাশ পর্যন্ত দখল করে নিতে পারে ।
এড্রিকের মতে ভূতাত্ত্বিকদের বিস্তর গবেষণায় জানা গেছে আল্পস পর্বতমালার জন্ম যে কারণে হয়েছে, ভূপৃষ্ঠে ভিসুভিয়াসের উদ্ভব ও সেই একই কারণে। আফ্রিকা মহাদেশীয় প্লেটের সঙ্গে ইউরেশীয় মহাদেশের প্লেটের সংঘর্ষ।
ভিসুভিয়াস দেখা শেষে হলো এবার ওরা আবার জীপে উঠে বসেছে। চলতি পথে যেতেযেতে ইরিনা এবার অদ্রিজাকে বলে তোমাকে গ্রীক পুরাণের এক গল্প শোনাই , এই আগ্নেয়গিরির একটি দীর্ঘ ঐতিহাসিক এবং সাহিত্যিক ঐতিহ্য রয়েছে। ৭৯ খ্রিস্টাব্দের অগ্ন্যুৎপাতের সময় এটিকে জিনিয়াস ধরণের দেবতা হিসেবে বিবেচনা করা হত। পম্পেই থেকে বেঁচে থাকা অনেক লারারিয়া বা গৃহস্থালি মন্দিরের আলংকারিক ফ্রেস্কোতে এই আগ্নেয়গিরিকে ভিসুভিয়াস নামে খোদাই করা একটি সর্প হিসাবে দেখানো হয়েছে । ''ক্যাপুয়া থেকে একটি শিলালিপি '' ইঙ্গিত স্পষ্ট যে তাকে বৃহস্পতির শক্তি হিসেবে পূজা করা হত। অর্থাৎ, বৃহস্পতি হচ্ছে ভিসুভিয়াস। অবশ্য রোমান নেতারা ভিসুভিয়াস পর্বতকে হারকিউলিসের প্রতি উৎসর্গীকৃত বলে মনে করত।
সুপ্ত পাহাড়ের ওপর মেঘ।
শ্রী বলে ,ইতিহাসবিদ ডিওডোরাস সিকুলাস বলেছেন যে হারকিউলিস তার শ্রম সম্পাদনের সময় সিসিলি যাওয়ার পথে নিকটবর্তী কুমে দেশের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলেন এবং সেখানে "ফ্লেগ্রিয়ান সমভূমি" নামে একটি স্থান দেখতে পেয়েছিলেন , "যে পাহাড় থেকে প্রাচীনকালে একটি বিশাল আগুন জ্বলত। সেই পাহাড়টিকেই আদিকাল থেকে ভিসুভিয়াস বলা হতো।" পুরাণ মতে এখানে "পৃথিবীর পুত্র", দৈত্যাকার দস্যুদের বাস ছিল। দেবতাদের সহায়তায়, তিনি এই অঞ্চলটিকে শান্ত করেছিলেন। সম্ভবতঃ এই পাহাড় থেকেই হারকিউলেনিয়ামের নামকরণ করা হয়েছিল। যদিও সে নিছকই অনুমান । ৮৮ খ্রিস্টাব্দে কবি মার্শালের একটি এপিগ্রাম থেকে জানা যায় যে ৭৯ সালের অগ্ন্যুৎপাতের ফলে বিধ্বস্ত অঞ্চলে পম্পেইয়ের পৃষ্ঠপোষক শুক্র এবং হারকিউলিস উভয়েরই পূজা করা হত।
পাকদন্ডীর পথ ধরে ভিসুভিয়াস কে পিছনে ফেলে নির্জনতার অপরূপ শোভায় নিমগ্ন হয়ে ওরা এগিয়ে চলেছে নেপোলির দিকে। স্বর্ণালী সন্ধ্যার মেঘমালার দল তখন ভেসে চলেছে রাতের গহীনে গোপন অভিসারে। চলন্ত জীপ থেকে শ্রী দেখেছিলো , উদ্ধত দৃঢ় শিরের পর্বত শিখর আকাশের দিকে মুখ তুলে ধ্যান গম্ভীর শিব নেত্রে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে যেন সেই পৌরাণিক যুগের গ্রীকদের শৌর্য্য বীর্য্যের দেবতা ও মর্তের বীর সাহসী পুরুষ হারকিউলিসের মত । আপাত শান্ত অচলায়তনে দিনশেষের শেষখেয়ায় ছায়া ঘনিয়ে আসছে। ধীরেধীরে সব আলো মুছে গিয়ে গাঢ় আঁধারে নিমগ্ন অচেতন পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়বে। নিঃসঙ্গ ধরিত্রীতে ঐ জ্বালামুখী ও অনন্তকাল ঠিক অমনি অবিচল দাঁড়িয়ে থাকবে রাতের অবসানে নতুন দিনের প্রতীক্ষায়। তারপর আবার হয়তো কোনোদিন ,কোনোকালে ঐ লাভা ,ছাই , স্কোরিয়া এবং পিউমিসের স্তর বৃদ্ধির ফলে কোন রাসায়নিক বিক্রিয়ায় হিংসাত্মক অগ্ন্যুৎপাতের পর্যায় প্রবেশ করে হঠাৎ জাগ্রত হয়ে ধ্বংসের প্রলয় নাচনে মেতে উঠবে আজকের ঐ সত্য সুন্দর শৌর্য্যের প্রতীক সুপ্ত আগ্নেয় পাহাড় ভিসুভিয়াস।
0 Comments