দূর দেশের লোক গল্প— ১৩৪
গুয়াতেমালা (উত্তর আমেরিকা)
খরগোশের খর বুদ্ধি
চিন্ময় দাশ
বউ আর চার-পাঁচটা ছেলেপুলে নিয়ে খরগোশের সংসার। সুখে-শান্তিতে জীবন ভরপুর থাকবার কথা। কিন্তু খরগোশের মনে সুখ নাই এক্টুও। ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতে হয় সব সময়। দুশ্চিন্তায় দু’চোখের পাতা এক করতে পারে না। আর, এই সবকিছুর কারণ হল, একটা নেকড়ে। ভারি উৎপাত শুরু করেছে নেকড়েটা।
খাবার জোগাড় করতে যেতে পারে না। পাড়াপাড়শির খোঁজ নিতে পারে না। ভারি উপদ্রব শুরু হয়েছে তার জীবনে। খড়কুটো জুটিয়ে একটা চালাঘর বানিয়েছিল। সেটা ভেঙে দেয়। একটা বানিয়েছিল পাইনের ডালপালা দিয়ে। ভেঙে দেয় সেটাও। এবং প্রত্যেক বার একটা করে বাচ্চাও খোয়া গেছে তার।
দেখে শুনে খরগোশের তখন পাগল হবার জোগাড়। শেষ পর্যন্ত অনেক ভেবে চিন্তে, জনাকয়েক ছুতোরমিস্ত্রীকে জোগাড় করে এনেছিল। ভারি মজবুত একখানা বাড়ি বানিয়ে দিয়ে গেছে তারা। ভিত গড়েছে পাথর দিয়ে। তার উপর মজবুত কাঠের তক্তা দিয়ে গড়ে দিয়েছে বাড়িটা।
তাতে এখন বেশ নিশ্চিন্ত। খাবারের জন্য বাইরে বেরোণো যায়। গল্পগুজব করা যায় এবাড়ি ওবাড়ি গিয়ে। বাড়ি ফিরে, দু’দণ্ড আগুনের পাশে বসা যায়। পাইপ ধরিয়ে খব কাগজে চোখ বুলানো যায়, আর পাঁচজনের মতো।
তবুও, সাবধানের তো মার নাই। বাইরে যা উৎপাত! বাড়িটার ভিতরে একটা গোপন কুঠরিও বানিয়ে নিয়েছে খরগোশ। দরকার পড়লে, যেখানে তার বউ-বাচ্চারা লুকিয়ে থাকতে পারবে। কুঠরির আগল বানানো হয়েছে ভেতর দিকে। বিপদ বুঝলে, কোন রকমে ঢুকে পড়ো। আর হুড়কো টেনে দাও। কেল্লা ফতে। তখন কারও সাধ্য নাই তাদের নাগাল পাওয়ার।
এবার নেকড়েটা ভারি জব্দ। না পারে ঘর ভাঙতে। না পারে নাকটাও গলাতে। আসে, আর ঘুর ঘুর করে ফিরে যেতে হয়। একটা বাচ্চাকে তুলে নেবে, কোন উপায়ই হয় না।
🍂
একদিন খরগোশ বসে কাগজে চোখ বুলাচ্ছে। মুখে পাইপ। হঠাৎই একটা ধুপধাপ শব্দ। কীসের শব্দ বুঝে উঠবার আগেই, নেকড়েটা হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছে।
খরগোশের তো পিলে চমকে উঠেছে। সাক্ষাৎ যম তার সামনে। বউ আর বাচ্চাগুলো? তারা ঝটপট গোপন কুঠরিতে সেঁধিয়ে গিয়েছে, পলক না ফেলতে। নেকড়েটা নিজেই চেঁচিয়ে উঠেছে—খরগোশভায়া, বাঁচাও আমাকে। কুকুরগুলো তাড়া করে আসছে। ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে আমাকে। বাঁচাও দয়া করে। চুপটি করে বসে থেকো না। একটা কিছু উপায় করো তাড়াতাড়ি। দোহাই তোমার।
মাথার মধ্যে চিড়িক করে উঠল খরগোশের। এমন মওকা সারা জীবনেও পাওয়া যাবে না। আজই খেল খতম করে দেব হতভাগার।
মাথায় ফন্দি এসে গেছে। খরগোশ ব্যস্ত হয়ে পড়ল।একটা সিন্দুক বানিয়ে দিয়ে গেছে ছুতোরমিস্ত্রীরা। সেটার ডালা খুলে, নেকড়েকে বলল—ঢুকে পড়ো এর ভেতরে। সাত জন্মেও টের পাবে না কুকুরের দল।
ছোট্ট একটা লাফ। নেকড়ে ঢুকে পড়ল সিন্দুকে। বলল—যদি ডালা খুলে ফেলে? তখন?
এটাই তো খরগোশেরও ফন্দি। সে বলল—ঠিক বলেছ। মজবুত দেখে একটা তালা লাগিয়ে দিচ্ছি আমি।
বাড়ির দরজা ভেতর থেকে হুড়কো টেনে, নিশ্চিন্ত হয়ে বসল খরগোশ। এবার আসল খেলার কিছু একটা উপায় বের করতে হবে। চেয়ারে আয়েস করে বসে, পাইপে কয়েকটা সুখটান।
ঠিকই। বুদ্ধি এসে গেল মাথায়। সাধে কি আর মুরুব্বিরা বলে গেছে, ধুঁয়ো দিলে মগজ খোলে। মগজ খুলে গেছে খরগোশেরও।
খানিক বাদে ভেতর থেকে নেকড়ের গলা—কীহে, গেছে কুকুরগুলো?
--ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে, একটাকে তো এক্ষুণি দেখলাম, বারবার এসে চিমনির কোণাটা শুঁকে যাচ্ছে।
--তাহলে, থাক। চুপটি করে থাকি।
এছাড়া উপায়ও নাই তোমার আর। মনে মনে ভাবতে ভাবতে, বড় একটা কেটলি বের করল খরগোশ। জল ভরে উনুনে চাপিয়ে দিল। জল ফুটবার শব্দ উঠছে টগবগ টগবগ।
নেকড়ে বলল—কী করছ তুমি?
--কী আর করব? ভাবলাম, বাড়িতে অতিথি এসেছে। এক কাপ গরম কফি খাওয়াই।
বাড়িতে একটা তুরপুন ছিল। সেটা দিয়ে সিন্দুকে ফুটো বানাতে লাগল খরগোশ। ঘর্ঘর ঘর্ঘর শব্দ শুনে, নেকড়ে একটু চমকে উঠেছে। বলল—আরে, করছটা কী তুমি?
--কুকুরগুলো সরে না যাওয়া পর্যন্ত ভেতরেই থাকতে হবে তোমাকে। দম নিতে কষ্ট না হয়, একটা ফুটো বানাচ্ছি তাই। ভয় পাও কেন?
উনুনে আরও কাঠ এনে গুঁজে দিয়েছে খরগোশ। আগুন জ্বলে উঠেছে দাউ দাউ করে। নেকড়ে বলল—খরগোশ ভায়া, কী করছো বলো তো?
--ভালো করে আগুন জ্বালালাম। যাতে ঠাণ্ডা না লাগে তোমাকে।
ভেতরে গিয়ে বউ-বাচ্চাদের বের করে এনেছে খরগোশ। তারা বাইরে বেরোতে পেরে, কলকল করতে শুরু করেছে। নেকড়ে বলল—এখন কীসের শব্দ শুনছি হে?
--কীসের আবার? বাচ্চাদের বলছি, আজ কতো বড় সম্মানীয় একজন অতিথি এসেছে আমাদের বাড়িতে।
বাচ্চাদের দু’হাতে মুখ চেপে বসে থাকতে ইংগিত করে, হাসতে মানা করে দিল খরগোশ। কেটলির জল এখন আগুনের মতো গরম। সিন্দুকের ফুটো দিয়ে ভেতরে জল ঢালতে লাগল সে।
গরম জল লাগছে নেকড়ের থাবাগুলোতে। চমকে উঠে বলল—আরে, আরে। করছটা কী তুমি?
--কিছু না গো। অনেক দিন খুলিনি তো সিন্দুকটা। যদি পোকামাকড় থাকে কিছু। সেগুলো মেরে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। যাতে কামড়ে না দেয় তোমাকে।
খরগোশের বউ বুঝে নিয়েছে ব্যাপারটা। আরেকটা কেটলি বের করে এনেছে সে। পালটা-পালটি করে জল ফোটাতে লেগে গেছে। উনুনে একটার পর একটা কাঠ গুঁজে দিচ্ছে বাচ্চাগুলো।
খরগোশ জল ঢেলেই যাচ্ছে। নেকড়ে বলল—আরে, ভায়া, এবার যে আমাকেও গরম লাগছে।
--এতটা পথ এসেছ এই ঠাণ্ডার মধ্যে। গা একটু গরম হোক না। ক্ষতি কী?
যত জল ঢালছে, জল তত উঁচু হচ্ছে ভেতরে। বুক-পেট ছুঁয়ে ফেলেছে যখন, নেকড়ে আঁতকে উঠেছে—আরে, বুক-পেট ডুবে গেল যে।
--সেটাই তো করছি আমরা। বাড়িতে প্রথম এসেছ অতিথি হয়ে। তায় আবার ঠাণ্ডার দিনে। স্নান না করিয়ে ছাড়া যায় না কি?
বাচ্চাগুলো চেঁচিয়ে উঠল—এমন স্নান করাও, সারা জীবনে আর স্নান করতে না হয় শয়তানটাকে।
আর সহ্য করতে পারছে না নেকড়ে। শরীর জ্বলে যাচ্ছে তার। পরিত্রাহী চেঁচাচ্ছে ভেতর থেকে। সব কথা বোঝা যাচ্ছে না আর। সেসবে কানও দিচ্ছে না কেউ। সবাই তারা জল ঢালতে ব্যস্ত।
ভেতরের শব্দ থেমে গেল খানিক বাদে। গরম জলে পুড়ে মারা গেল নেকড়ে? না কি, দম আটকে গিয়ে? সে সব ভাবনা খরগোশ পরিবারের মাথায় নাই। তারা আনন্দে মেতে উঠেছে।
আর কর্তামশাই? তিনি ফিরে গিয়েছেন উনুনের পাশে। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছেন নিশ্চিন্ত মনে। পাইপের ধোঁয়া ছাড়ছেন হুস-হুস করে। চোখ জোড়া খবরের কাগজে আটকানো।
0 Comments