জ্বলদর্চি

ভাঙা আয়নার মন-পর্ব ৪০/মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনীয়া

ভাঙা আয়নার মন 
পর্ব ৪০
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনীয়া


                || কতটুকু ক্ষতি মিতে...||

         
সোতোসিয়িনি তোমার ভিজিটর এসেছে।মনিপুর থেকে আসা ফিফথ ইয়ারের তাসিদি তাকে বলল। তাসিদির হাতে তার বাবার পুরনো সেই চ্যাপ্টা কেটলি।চা করবে বোধহয়।জল ভরে নিয়ে যাওয়ার পথে তাকে ডেকে  গেল। দিদির বাবা ছিলেন একজন ট্রেকিং গাইড। ট্রেকিং করতে গিয়ে স্নো ব্লিজার্ডে পড়ে আর ফেরেননি। উদ্ধারকারীরা যেসব জিনিস ফেরত এনেছিল, তার মধ্যে এই কেটলিটা ছিল।
        মা মোমো বিক্রি করে তাসিদিকে হস্টেলে রেখেই মানুষ করেছে। ছোটর থেকে হস্টেলে হস্টেলে দিদির সঙ্গে কেটলিটাও নাকি অনেক ঘুরেছে। হাসতে হাসতে তাসিদি বলে এটা আমার বাবা বুঝলে?
        লেডিস হস্টেলের অনেক মেয়েই নর্থ ইস্ট জোন থেকে পড়তে আসা।তার রুমমেট দুজনের মধ্যে একজন অসমের জয়ন্তীদি আর তাদের ব্যাচের আলু অর্থাৎ ত্রিপুরার আলোলিকা।দার্জিলিং,সিকিম, তিব্বত, মিজো ,নাগা যেখান থেকেই আসুক ঝিনি দেখেছে এই মেয়েরা নিজেদের মতো দল বেঁধে থাকতে পছন্দ করে। দিনের বেলা সম্ভব না হলেও রাতে কারো একজনের ঘরের মেঝেতে বসে একসাথে  খায়।পাহাড়ি অভ্যেসের দরুণ তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে সবাই একসাথে কফি বা চা খেয়ে যে যার ঘরে পড়তে বসে যায়।    
      জয়ন্তীদি বা আলুর কারণেই সে নানা ধরনের পাহাড়ি খাবারের ভাগ পায়। জয়ন্তীদির বাঁশের কোঁড়ের আচার তো সে আর আলু খেয়ে খেয়ে শেষ করে এনেছে।তাসিদির কথা শুনে হাউজ কোট গলিয়ে সে দুড়দাড় করে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামে।
        ডেকে দেওয়ার অনিমাদি , কল্পনাদিরা প্রায় সময়েই এদিকে সেদিক হাওয়া হয়ে যায়।কাজেই হস্টেলের কেউ বাইরে থেকে ফেরার সময় ভিজিটররা তাদের স্মরণাপন্ন হয়।কে এলো এই সন্ধেবেলা?ছোড়দা, মাসতুতো ভাই মহুল না কি সানা এল বাড়িতে ঝগড়া করে? 

🍂

       আশ্চর্য! দাঁড়িয়ে আছে তাদের ইয়ারের তনয়।কী ব্যাপার রে?না মানে ইয়ে বলছিলাম। ঝটপট বলে ফেল । মানে আজ তুই প্যাথো প্রাকটিক্যাল ক্লাসে এলি না তাই ইয়ে ভাবলাম শরীর টরির খারাপ হলো কিনা তাই ।তাই তুই খবর নিতে হস্টেলে চলে এলি তাই তো? হ্যাঁ মানে কী বলব তোকে না দেখলে ইয়ে  মানে পড়াশুনোর অসুবিধে মানে এবার ঠিক সাপ্লি খেয়ে যাব মাইরি বলছি তুই একটু বোঝার চেষ্টা কর। 
           এক নিঃশ্বাসে তনয় একগাদা কথা নামিয়ে ফেলে হাঁপাচ্ছিল। তোর কোন হস্টেল রে তনয়। তাদের কলেজে চারখানা বয়েজ হস্টেল। ছেলেরা একে তাকে তোলার চেষ্টায় লেডিস হস্টেলে ঘোরে অনেক সময়।দীনবন্ধু হস্টেল। কেন? বোঝার চেষ্টা করছি কার সঙ্গে চ্যলেঞ্জ করে এখানে এলি। চ্যালেঞ্জ? না না ওসব কিছু না বিশ্বাস কর।
          বেশ। বিশ্বাস করলাম। এবার তুই একটা কথা বিশ্বাস কর। ।এভাবে প্রেম টেম হয় না রে। মানে তুই বুঝতে পেরেছিস? আমি ইয়ে আমি মানে...একটু জ্বলে উঠেই তনয়ের মুখটা একটু নিভে গেল। তবু বলল,কাল তাহলে ক্লাসে আসছিস তো? পাগলামি বন্ধ কর তনয়। হস্টেলে ফিরে পড়তে বস গে যা। কিন্তু তুই মানে ইয়ে মাথায় আমার...। মাথায় তোর বরফের বস্তা চাপিয়ে বসে থাকগে যা।আমায় আর জ্বালাস না। সিঁড়ি ধরে উঠে গেল সে।
           পর পর কদিন তনয় রেগুলার ঝিনির জন্য তাদের হস্টেলে ডিউটি দিতে থাকলে আলু বা কলি কোমর বেঁধে নামল হেস্তনেস্ত করতে।  ভাই তনয় ঝিনিকে মাফ দে তুই। একেবারে  নিরেট  ওটা।কিন্তু এই যে রেগুলার তুই সন্ধেবেলা লেডিস হস্টেলের কেঠো বেঞ্চে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকছিস  তোর এই দুঃখে আমাদের যে বুক ফাটে ভাইরে।আমাদের দুজনের মন বড্ডই নরম।মনের দুঃখু সব  কফের মতো ঝেড়ে ফেলে তুই আমাদের দিকে এট্টু তাকিয়ে দেক দিকি বাপ!তোর ডানদিকে ওই আলু আর বাঁ দিকে এই আমি। আমরা দুজনেই রাজি। তুই বরং টস করে দ্যাখ।
       আলু আর কলির অত্যাচারেই বেচারি তনয় শেষ অব্দি আসা বন্ধ দিল কিন্তু ধরল তাদের ইয়ারের পলাশকে।  
          পলাশ রুখুসুখু গোছের মানুষ।ধার ধোর টিউশানি করে মেডিকেল পড়ার খরচা চালায় আর কলেজ ইউনিয়নের ক্লাস লেকচারিংএ জ্বালাময়ী বক্তৃতা রাখতে পারে বলে কলেজ ইলেকশনের আগে আগে সিনিয়র জুনিয়র সব ব্যচই ওকে হায়ার করে। প্রেম টেম থেকে অনেক দূরের গ্ৰহে তার বসবাস। তবু  আকুল দুঃখী তনয়কে সে একটা ফয়সালার আশ্বাস দিল। তবে সেসব কিছু করার আগেই নিজের ডিওডেনাল আলসার নিয়ে হসপিটালের স্টুডেন্টস কেবিনে ভর্তি হয়ে পড়ল।
         ‌ ঝিনি অবিশ্যি গেছিল কাচরাপাড়া। নতুন চাকরিতে দানাপুরে আটমাস কাটিয়ে দানি কলকাতার কাছে পোস্টিং পেয়েছে। তার কোয়ার্টারের সংসার গুছোতে মা এসেছে বলে সে আর ছোড়দা জুটেছিল সেখানে।
        সোমবার ফিরে সে দেখে হস্টেলে হুলুস্থুলু। তাদের ইয়ারের ব্রততী ভেজিটেবল স্যুপ বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছে,উন্মেষ  মানসরা পেশেন্ট পার্টি হয়ে দুবেলা হসপিটাল সাপ্লাই মাদার ডেয়ারির প্যাকেট লেডিস হস্টেলে পৌঁছে দিচ্ছে।আর পর্ণা প্রিয়ারা তা থেকে ছানা বানিয়ে পৌঁছে দিচ্ছে স্টুডেন্টস কেবিনে।
          সবাই বেশ টেন্সড পলাশের অসুখ নিয়ে। তার নাকি বাড়ির লোক কেউ নেই তাই  তাদের ইয়ারের ছেলেমেয়েরাই পালা করে দেখাশোনা করছে। সে সব ভালো কথা কিন্তু তার টেবিল থেকে সাত আটখানা কবিতার বই উধাও দেখে ভয়ানক চটে গেল সে। তোর মতন স্বার্থপ্পর দুটো দেখিনি। পরশু অব্দি ছেলেটা পেটে ব্যাথায় ছটফট করেছে।কবিতা পড়তে ভালোবাসে বলেই না তোর বইগুলো দিয়ে এসেছি।বেশ করেছিস কিন্তু  এবার ফেরত নিয়ায়।
 বলছি ছেলেটা অসুস্থ! এক্ষুনি ফেরত আনা যায়? পাষণ্ড কোথাকারে!
         তোর দয়া ধম্মো নিয়ে এক্ষুনি চোখের সামনে থেকে দূর হ! একে তার প্রিয় বইগুলো হারা উদ্দেশে কার কাছে দিয়ে এল আবার পর্ণা এসে তার মুড়ি বিস্কিট, চানাচুরের বয়ামগুলো ফাঁকা করে শেষমেষ চারটে কাঁচা ডিম নিয়ে চলে গেছে।ভাগ্যিস ট্রাঙ্কটা তালা দেওয়া থাকে। এদের জ্বালায় ভালো কিছু রাখার উপায় আছে? কলিকে বের করে দিয়ে মেজাজ খারাপ করে ট্রাঙ্ক খুলল ঝিনি।  জামাকাপড় আর টাকাপয়সা রাখার জন্য ট্রাঙ্কটা কিনেছিল বাপি। জামাকাপড় সব বের করে দিয়ে সে ট্রাঙ্কেও বই রাখে।জামাটামা সে ধুয়ে শুকিয়ে তোষকের নিচে পাট করে করে রাখে। 
           হাত ঢুকিয়ে ওপরের বইদুটো তুলে নিল সে। জ্যাক লণ্ডনের গল্প সংকলন আর ভান্দা ভেসিলিয়েভস্কার ভালবাসা বইটা। জ্যাক লণ্ডনটা জন্মদিনে তাকে সুহাসদা উপহার দিয়েছে। ভালবাসা বইটা দিয়েছে দানি।
           তৃতীয় ফ্রন্টের ডেডিকেটেড সদস্য সুহাসদা মেডিকেল কলেজে দাদামনিদেরও সিনিয়র। আনমনে ঝিনি পাতা উল্টেই সিঁটিয়ে গেল বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা দেখে।
        " হেমন্তে যদি বাতাস ফোঁপায় কিংবা পঙ্গপাল আসে/অসময়ে গাঁয়ে খামারে গঞ্জে বস্তিতে বাঁকা শীত আসে/তাতে আমাদের কতটুকু ক্ষতি কতটুকু ক্ষতি মিতে/এসো তালি দেওয়া জুতো জোড়ায় সযত্নে বাঁধি ফিতে"! সত্যিই সে যেভাবে এগোবে ভেবেছিল সে পথ এখন দূরে সরে যাচ্ছে। দাদাদের সাথে সে বেড়ে উঠেছে। তাদের ভাবনা বিশেষ করে ছোড়দা তাকে শিখিয়ছে একলা নিজের ভালো চাইতে নেই। জানলার বাইরে পাম গাছটায় বিকেলের রোদ লেগে আছে ফোঁপানো কান্নার মতো।একটু পরেই নিবে যাবে।
        বাড়িতে থাকতে রোজ সন্ধেবেলা ঝিনিইই সন্ধে প্রদীপ জ্বেলে দেএএএ আর মার কথা মতো দোরে জল দিয়ে প্রদীপ আর ধুনো ঘরে ঘরে দেখিয়ে তুলসি তলার কুলুঙ্গির প্রদীপখানা জ্বেলে শাঁখ বাজিয়ে প্রণাম করে উঠলেই ক্যাঁক করে ঘেঁটি ধরে ছোড়দা জিজ্ঞেস করতো কী বললি তোর ঠাকুরকে?কী আবার বলব  বিদ্যে দিও ঠাকুর। উহু! এবার থেকে বলবি সারা পৃথিবীর মানুষের ভালো করো।শৈশবে তাদের বাবার কাজের আবছা স্মৃতির কারণেই সকলের ভালো চাওয়ার রাস্তা খুঁজতে  হবে এমন এক ধারনার আদল নিয়ে সে ঘুরত হয়তো। 
            কিন্তু ভারী মেডিকেল বইগুলো আর আরো ভারী পরীক্ষার চাপে কুঁজো হতে হতে চেহারা বদলে গেছে তার মনের। তারুণ্য পেরিয়ে যেতে যেতে 
 সে তো হেমন্তের হাওয়ার ওই দীর্ঘ গোঙানি শুনতে পাচ্ছে না আর। মরা মানুষের হাড় দিয়ে সে কি অন্য স্বপ্ন গড়ে তুলছে না? সেদিন স্নান করতে করতে সে গুনগুন করছিল আলোর পথযাত্রী। হঠাৎই চমকে থেমে গেল।এ গান গাওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে কি তার? সে তো অর্জন শেখেনি এই অনুভবের। এখন এ গান গাওয়া নিজের কাছেও ভণ্ডামি।পাপপুণ্য থাকলে কে জানে হয়তো পাপও!
        সুহাসদা এক্কেবারে ঠিক লিখেছে,বইয়ের পাতায় হাত রেখে সে ভাবল   এখন শুধু উবু হয়ে বসে ছেঁড়া তাপ্পি  জুতোয় যত্ন করে ফিতে বাঁধার দিন!

Post a Comment

1 Comments

  1. Pallab KirtaniaMarch 27, 2025

    চমৎকার লেখা।

    ReplyDelete