যে সব কথা লেখা হয় না
পর্ব- ৬
সুমনা সাহা
আমাদের সময় ছোটবেলার দিনগুলোতে পড়াশুনোর বেদম চাপ ছিল না। খেলার আর গল্পের বই পড়ার আর প্রতিবেশীদের বাড়িতে যাওয়ার অফুরন্ত সময় ছিল। তবুও রবিবার হল গিয়ে রবিবার। একাল বলো আর সেকাল—মানুষের মনে তার আদরের আসন পাতা সব কালেই। রবিবার মানেই এক তো ইস্কুল ছুটি। ভালমন্দ খাওয়াদাওয়া। তখন ‘রেড মিট’ ইত্যাদি নিয়ে অতশত দুর্ভাবনা আরম্ভ হয়নি। প্রত্যেক রোববার পাঁঠার মাংস রান্না হত। প্রেসার কুকার অনেক পরে এসেছিল, প্রথম দিকে লোহার কড়াইতেই মাংস রান্না হত। আলু ভেজে আলাদা তুলে রাখা হত, ঠিক সময়ে মেশাতে না পারলে হয় সিদ্ধ হবে না, নয়তো আলু গলে যাবে। মাংস এবং আলু দুটোই ঠিকঠাক সিদ্ধ হওয়াটা ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ। তারপর কার পাতে মেটে পড়ল না, আর কেই বা নালীটা পেয়ে গেল—এই নিয়ে আরেকটা ধুন্ধুমার অপেক্ষা করত খাওয়ার সময়, সে তো আরেক ইতিহাস! ডাইনিং টেবিল নামক বস্তু এসেছে অনেক পরে। মাটিতে পিঁড়ি পেতে বসে খাওয়া হত। মা মাঝখানে বসত ভাতের হাঁড়ি, মাংসের কড়াই সব নিয়ে আর সবাইকে পরিবেশন করত। একটা শুক্তো আর শাকভাজা প্রতিদিন হত। এর সঙ্গে অন্যান্য দিন মাছের ঝোল, আর রবিবার মাংস এবং চাটনি। রবিবারের দ্বিতীয় মজা, মহা ধূমধাম করে রান্নাবাটি খেলা। তিন, চুল কাটা। তিন নম্বরের কথায় পরে আসছি। এন ব্লকের একেবারে কোণের একতলায় থাকত একটি বিহারি পরিবার। তাদের বাড়ির মেয়ে সরোজিনী ছিল পাড়ায় খুব পপুলার। তবে আমরা বাইরে বেরিয়ে রান্নাবাটি খেলার আসর জমাবার আগেই তারা বদলী হয়ে পাড়া ছেড়ে চলে গিয়েছিল। পরে প্যাত্না বিভুদা’রা ঐ ফ্ল্যাটে এসেছিল। তার আগে পর্যন্ত বেশ কিছুদিন ফ্ল্যাটটা ফাঁকা পড়েছিল। কালো কুচকুচে গায়ের রঙ আর সাপের মত হিলহিলে চেহারার জন্য তার এই নামকরণ করেছিল বড়দারা। পেত্নির পুংলিঙ্গ হিসেবে প্যাত্না। ঘরে তালা লাগানো থাকলেও যেহেতু একতলা, বারান্দার রেলিং টপকে আমরা ছোটরা উঠে যেতাম সেইখানে। রোদ্দুর লাগে না, বেশ পুতুলের সংসার পাতানো যেত সেখানে। সেই বারান্দার মাঝখানে মা-র কাছ থেকে চেয়ে আনা একখানা কাপড় টাঙিয়ে দুই ভাগ করা হত। একদিকে মিতু, ফুলিদের পুতুলের সংসার, আরেকদিকে আমার আর বোনের। আমার সবচেয়ে গর্বের পুতুল ছিল মানি। সোনালী চুল, বড় বড় নীল চোখ, গায়ে আকাশী রঙের ফ্রক আর পায়ে সাদা পাম-শু। তাকে শুইয়ে দিলে চোখ বুজে ফেলে আবার উঠিয়ে দিলে চোখ খোলে। মিতু আর ফুলিদের পুতুল অত ভাল না। মেলায় কেনা খুব ছোট ছোট প্লাস্টিকের পুতুল। তাদের শরীরে চাপ দিলেই প্যাক প্যাক করে আওয়াজ হত। এক ঘুষি মারলেই ত্যাবড়া। আমাদের মানির শরীর অত ঠুনকো নয়। আমরা বলতাম আলুর পুতুল। সুন্দর সফট শরীর। ঘুষি ঘাষা সহ্য করে তেবড়ে গিয়েও আবার ফুলে উঠত। হাত-পা ঘোরানো যেত। এমনকি হাত-পা টানাটানিতে খুলে বেরিয়ে এলেও আবার পরানো যেত। মানিকে নিয়ে সবাই টানাটানি করত। কালক্রমে তার চোখ কথা শুনত না। শুইয়ে দিলেও তাকিয়ে থাকত। তখন পটাপট চড় মারতাম, “ঘুমিয়ে পড় দুষ্টু মেয়ে!” আবার ঘুম থেকে উঠিয়ে পড়তে বসাতাম। রান্নাবাটির সংসারের জন্য বাজার করতে বেরনোর মধ্যেই ছিল রিয়েল অ্যাডভেঞ্চার। অনেকটা থিম পুজোর মত। কে কত ইউনিক জিনিস খুঁজে নিয়ে আসতে পারে, এটাই চ্যালেঞ্জ। খুব ছোট ছোট লাল টুকটুকে একরকম ফল হয় একটা কাঁটাওয়ালা গাছে। সেগুলো আমাদের রান্নাবাটির টমেটো। ঐ বুনো গাছের ঝোপ থেকে সেই টমেটো সংগ্রহ করা হত চাটনি তৈরির জন্য। নানা ফল-পাতা দিয়ে অনেক আইটেম রান্না হত। পায়েসও হয়ে যেত চকের গুঁড়ো দিয়ে। শুধু সত্যিকারের ভাতের মত দেখতে কিছুই বানাতে পারতাম না। সুরকি গুলে লংকার গুঁড়ো দেওয়া ঝাল ঝাল মাংসের ঝোলও হত। মাংস বলতে কোন নরম গাছের ডাল পিস করে কাটা অথবা ছোট মাপের ইটের টুকরো। রান্নাবান্না হয়ে গেলে এ-বাড়ি ও-বাড়ি পরস্পর নিমন্ত্রণের পালা। তারপর সব নোংরা করে ফেলে ছড়িয়ে ফুলি চম্পট দিত। আমি খুব রেগে যেতাম, “মনে থাকে যেন, পরের বার খেলায় নেব না,” গজগজ করতে করতে সব পরিষ্কার করতাম। বোন খুব একটা পারদর্শী ছিল না এইসব ব্যাপারে কোনকালেই। ওর উপর আশাও রাখতাম না। মিতু আমার সাথে হাত লাগাত। ওর কাজ ছিল খুব পরিচ্ছন্ন। দেখতেও ভারি লক্ষ্মীমন্ত। জানি না ও এখন কোথায় আছে, কেমন আছে। একই কোয়ার্টারে থাকা, একই প্রাইমারি স্কুলে একসাথে পড়া, একসাথে রান্নাবাটি খেলা হলেও বড় হয়ে বুঝতে পেরেছিলাম, প্রত্যেক পরিবারের স্ট্যাটাসে তফাৎ ছিল। ফুলির বাবা মারা গিয়েছিল। ওরা ছিল তিন ভাই-বোন। বিভাগ থেকে বিশেষ সুবিধা হিসেবে কোয়ার্টারে ওদের থেকে যেতে দিয়েছিল। সরকারি চাকরির নিয়ম অনুসারে হয় ফুলির মা চাকরি পাবে, নয়তো দাদা। ফুলির দাদা তারক তখন ক্লাস নাইনে পড়ছিল। শুনেছি, ও মাধ্যমিক কিম্বা হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পর বাবার চাকরিটা পেয়েছিল। যদিও তখন হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা ছিল না, প্রি-ইউ না কি যেন একটা ছিল। এইট বা নাইন থেকেই আর্টস, সায়েন্স, কমার্স ইত্যাদি স্ট্রিম ভাগ হয়ে যেত। তারপর ইলেভেন ক্লাসে প্রথম বোর্ডের পরীক্ষা হত বোধহয়। আর মিতুর বাবা কোন কাজ করত না। ওর মা ওদের তিন ভাই বোনকে নিয়ে মায়ের কাছে থাকত। এখন বুঝতে পারি, মিতু, ফুলি ওরা ছিল গরীব। খুব ছোট বয়সেই ওরা জীবনের অনেক কঠোর রূপ দেখেছিল।
আমরা বিকেল বেলায় একটা হাতলওয়ালা স্টিলের কৌটো নিয়ে দুধ আনতে যেতাম হরিণঘাটার বুথে। কয়েন ফেলার জায়গায় কয়েন দিয়ে পাত্রটা নিচে বসালে ঠাণ্ডা দুধ পড়ত। শেষ বিন্দু পড়া অবধি পাত্র সরাতাম না। এক একদিন দুধ পাওয়া যেত না, ওখানে একটা দুধ-কাকু বসে থাকত, যে মেশিন চালাত। সে বলত, “আজ দুধ নষ্ট হয়ে গেছে।” ফুলি আজকে খেলতেই এল না। কে জানে মেয়েটা কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায়? আমরা যখন ঘরে যাব যাব করছি, সন্ধ্যা হয় হয়, এমন সময় একগাল হাসতে হাসতে ফুলি উদয় হল, “বাব্বা, কাকুটা ছাড়লই না। কোলে বসিয়ে একগাদা দুধ খাইয়ে দিল।” আমরা বাড়িতে গিয়ে বললাম, “আজকে আমাদের দুধ দিল না, জানো মা? বলল নষ্ট হয়ে গ্যাছে, আর ফুলিকে নাকি কোলে বসিয়ে প্রচুর দুধ খাইয়েছে।” শুনে মা-র মুখটা যন্ত্রণায় যেন কুঁচকে যেত, “আহারে! বাপ মরা মেয়েটার কি যে হবে! অতটুকু শিশু, তাকে পচা দুধ... আবার কোলে বসিয়ে খাওয়ানো! হে ভগবান। আধবুড়ো লোকটা এত বজ্জাত জানতাম না তো।” মা মাঝে মাঝেই বলত, “ওদের সাথে খেলার কি দরকার? বোনকে নিয়ে ঘরের বারান্দায় বসে খেললেই হয়!” কিন্তু সেই কথা রাখতে পারতাম না। ওরা নিচ থেকে ইশারায় ডাকত। তাতেও আমরা বাইরে না গেলে ঘরে এসে যেত, ডাইরেক্ট মা-কে আর্জি জানাত, “ও কাকিমা, ওদের খেলতে যেতে বলো না?” মা আর না করতে পারত না।
মাসে একবার থাকত চুল কাটার দিন, রবিবারই হত সেটা। পাড়ায় আসত উড়িয়া নাপিত লক্ষ্মণ। হাঁটু পর্যন্ত খাটো ধুতি, পরনে সাদা হাফ হাতা ফতুয়া, মাথার সামনের দিকে টাক আর পিছনে একটা টিকি, যার নিচে আবার গিঁট বাঁধা। চোখে সোডার বোতলের মত মোটা কাঁচের চশমা। কাছে গেলে কাঁচের পিছনের চোখদুটো অস্বাভাবিক বড় বড় দেখাত। পুরু কালো ঠোঁট। কাঁধে লম্বা ফিতেয় বাঁধা একটা কাঠের বাক্স। তাতে তার চুল কাটার যাবতীয় সরঞ্জাম। একটা বড় কাঁচির বাঁট দিয়ে ঐ বাক্সের গায়ে ঠক ঠকা ঠক আওয়াজ করত আর হেঁকে বলত, “চুল দাড়ি কাটিবঅ।” আমরা লক্ষ্য রাখতাম, কখন লক্ষ্মণ কাকুর শব্দ পাওয়া যায়। তারপর লক্ষ্মণকে ডাকিয়ে এনে সিঁড়ির নিচে বসে লাইন দিয়ে আমরা চুল কাটতাম। প্রথমে একটা ছোট কাঁঠাল কাঠের পিঁড়িতে বসে বোনের, তারপরে আমার চুল কাটা হয়ে গেলে ছোট পিঁড়ি সরিয়ে একটা বড় পিঁড়ি পাতা হত। তারপর চুল কাটত দাদা, একদম শেষে বাবা। দাদার আর বাবার বগলের চুলও লক্ষ্মণ কামিয়ে দিত। দাদা কামানো বগলে হাত ঢুকিয়ে অদ্ভুত কায়দায় ভপ ভপ করে বগল বাজাত। তাই দেখে আমরা হাসতাম। আমাদের চুলের একটাই ছাঁট—যেটাকে সেসময় ‘চাইনিজ কাট’ বলা হত। আধুনিক যুগের বব কাট বলা যেতে পারে। কপালের উপরে খানিকটা চুল রেখে সোজা করে কেটে কানের দুপাশ থেকে ঘাড়ের পিছনে গোল করে ছেঁটে দেওয়া হত। আসলে সেটাকে বাটি ছাঁট বলাই যুক্তিসঙ্গত। মানে মাথার উপরে একটা বড়সড় বাটি বসিয়ে তার বর্ডার বরাবর ছেঁটে দিলেই ঐ হেয়ার কাট উৎপন্ন হবে। চুল কাটা হয়ে গেলে লক্ষ্মণ কাকু আমার গাল দুটো টিপে ধরে মুখের দিকে তাকিয়ে দেখত, সমান করে কাটা হয়েছে কি না। গালটা খুব জোরে টিপে ধরত। আমি কিছু বলতে পারতাম না। শেষে সন্তুষ্ট হয়ে দুই গালে চকাস চকাস করে দুটো চুমু খেয়ে ছেড়ে দিত। বিচ্ছিরি লাগত। হাতের উলটো পিঠে গাল মুছে এক ছুটে ঘরে ঢুকে যেতাম। কোনদিন কাউকে কিচ্ছু বলিনি। বলার কথা মনেও আসেনি। চার-পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা কিই বা বলবে? কিন্তু একদিন মা-র চোখে পড়ে গেল, “কিরে তুই গাল মুছছিস কেন?” সেদিন মা-কে বলেছিলাম লক্ষ্মণ কাকুর চুমু খাওয়ার কথাটা। মা বলল বাবাকে। ব্যাস। বাবা রেগে আগুন হয়ে গেল। “ব্যাটা তোর এতবড় সাহস?” তারপরেই সেই বিখ্যাত ডায়লগ—“কার সামনে দাঁড়িয়ে আছিস জানিস? এক আছাড়ে ব্যাং বানিয়ে দেব!” লক্ষ্মণ কাচুমাচু মুখে বারবার বলছিল, আমার মুখটা নাকি ওর ভাইঝির মত। ভাইঝিকে ও খুব ভালবাসে, কলকাতায় থাকতে হয় বলে ওদের গঞ্জামের দেশের বাড়ি খুব মিস করে। আমাকে দেখলেই ওর ভাইঝির কথা মনে পড়ে। তাই আমাকে খুব ভালবাসে ইত্যাদি ইত্যাদি। বাবার রাগ কমল না তাতে। বলল, “এদিকে আবার যদি দেখি, ঠ্যাং ভেঙে দেব!” লক্ষ্মণ আর আসেনি। আমি মা-র পিছনে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। লক্ষ্মণের নিরীহ কাচুমাচু মুখটা দেখে বোঝার চেষ্টা করছিলাম, ও কি সত্যি কথা বলছে, নাকি ধরা পড়ে গিয়ে অজুহাত দিচ্ছে? সেই সময়ের বুদ্ধি অনুসারে এরকমই কিছু একটা ভাবছিলাম হয়তো। হয়তো খুঁটিয়ে লক্ষ্য করে বোঝার চেষ্টা করছিলাম, বকুনি খাওয়ার পরে লক্ষ্মণের মুখের এক্সপ্রেশন সত্যি, নাকি অভিনয়? আজও যখন সাইকো-থ্রিলার দেখি, ঠাণ্ডা মাথায় অপরাধ করতে দেখি, ধরা পড়ে গিয়ে সব অস্বীকার করতে দেখি, লক্ষণের মুখটা মনে ভেসে ওঠে। যাইহোক, সব ঘটনারই ভাল-মন্দ দুটো দিক থাকে। লক্ষ্মণকে বাতিল করার ফলস্বরূপ পরের মাসে আমাদের চুল কাটাতে বাবা বড় রাস্তার ওপাড়ের সেলুনে নিয়ে গেল। চারদিকে বিরাট বিরাট আয়না লাগানো, উঁচু উঁচু চেয়ার, আর গমগম করে রেডিওতে গান বাজছে। আহা! যেন স্বর্গ! বাবা কোলে করে চেয়ারে বসিয়ে দিল আমাদের দুই বোনকে। বোন ভয় পাচ্ছিল বলে বাবা পিছনে দাঁড়িয়ে থাকল, বোন বাবার পকেট খামচে ধরে রেখে চেয়ারে কাঁটা হয়ে বসেছিল। আমার কিন্তু দারুণ ভাল লাগছিল, বিশেষ করে একের পর এক বিবিধভারতীতে বেজে চলা সেইসময়কার হিট গানগুলো—“ও হংসিনী, মেরি হংসিনী, কাহাঁ উড় চলি, মেরে আরমানোঁ পে, পঙ্খ লাগাকে, কাহাঁ উড় চলি”, “ওয়াদা করলে সাজনা, তেরে বিনা ম্যায় না রহুঁ মেরে বিনা তু না রহে না হোঙ্গে জুদা ইয়ে ওয়াদা রাহা!”
(ক্রমশ)
0 Comments