শাশ্বত বোস
চৈত্র শেষের গুমোট ভাবটা থেকে থেকে যেন ফুলে ফুলে উঠছে, ঠিক উলু ঘাসের ঝোপে ফোটা ভাট ফুলের বেগুনী রঙের গোড়াটার মত। পাড়াগেঁয়ে পার্বণের গন্ধটা ধানজমির ধারের মেঠো ইঁদুরের গর্ত হয়ে, বাওড়ের পাঁকে ডুবে থাকা শাঁপলার আলগা ভিজে শরীরটা বেয়ে, লৌকিক অলৌকিকের বিশ্বাসের মাঝে সিন্দুরমতি তিলক টেনে ছড়িয়ে পড়ছে, গাজন সন্ন্যাসীর দু আঁজলা ভিক্ষের মাঝে। বাংলা বছরের শেষ উৎসবে গাজনে, চড়কে মেতে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এই নয়ানপোঁতা গ্রাম, ফেরা আর না ফেরার মাঝখানের ধূসর জায়গাটুকুতে দাঁড়িয়ে মাটির সঙ্গে শিকড়ের গভীর সংযোগ আর সরলতার আঘ্রাণে, সর্বক্ষণ যেন পরম আশ্রয়ের নিশ্চিন্তপুর খুঁজে চলেছে। কখনো কোন হিন্দুবাড়ির নিকোনো উঠোন আর তুলসীমঞ্চ জুড়ে আবার কখনো কোন নামাজী মুসলমানের মুখনিঃসৃত কলমার বিড়বিড়ানিতে।
🍂
কাঁসরের সাথে ঢাকের বাজনাটা ক্ষেতের ভেতর থেকে এগিয়ে আসছে ডোবাটার দিকে। ওতে একটা নির্দিষ্ট ছন্দ আছে। সাথে অহরহ স্ত্রীলোকদের উলুধ্বনি আর তাল কাটা সানাইয়ের মত “শিব, শিব, মহাদেব” শব্দের সমবেত গর্জন যেন স্যাঙাতের কাজ করছে। আকাশ বাতাস ফুঁড়ে সেই ধ্বনি তরঙ্গই যেন কোন অজানা লোক হতে অনিমিখ ঈশ্বর সাধনার বিরতিহীন ধোয়াঁটে এক বিস্তার বুনেছে দিক চক্রবাল জুড়ে। লাল বসন পরিহিত হাড় গিলগিলে চেহারার কিছু পুরুষ আর সাথে লাল শাড়ী পরিহিত রুক্ষ্ম চুলের কিছু নারী শরীর, যেন ঈশ্বরী নিমগ্নতায় চুর হয়ে টলমল পায়ে, মাথায় একটা বিশাল কাঠের পাটাকে আপাদমস্তক লাল সিঁদুরে চর্চ্চিত করে এগিয়ে চলেছে এক উগ্র আত্মাহুতির সাক্ষ্মী হতে। এদিকটায় তখন মেয়ে বৌদের ভিড় লেগে গেছে। কৌতূহলী চোখ গুলোতে তখন বিস্ময় আর বিশ্বাস মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে, যেন প্রকৃতির মায়ায় জমাট বেঁধেছে নীলকণ্ঠের গাঢ় রং! অনেকগুলো অভুক্ত অমাবস্যা পূর্ণিমা পার করে এক আশ্চর্য্য ব্যালেন্সে আস্ত মহাদেব কে মাথায় তুলে নিয়েছে ওরা। তাঁর পরনে রক্তাম্বর, মাথার গোড়ায় একটা ছোট ত্রিশূল পোঁতা। সন্ন্যাসীদের ভাষায় এঁকে ‘দেল’ বলে। আসলে একটা হাত সাতেকের পাটা, দেখতে অনেকটা ছোট ছিপ নৌকার মত। তার গায়ে শঙ্খ চক্রসহ আরো অন্যান্য প্রতীক খোদিত। ত্যাগ, ভক্তি আর বিশ্বাসের দোলায় চড়ে, প্রায় গোটা চৈত্র মাস জুড়ে দেল সন্ন্যাসীদের মাথায় চড়ে বাড়ি বাড়ি ঘোরেন মহাদেব। এই ভিক্ষান্নই দিনে মোট দুবার হবিষ্য করে গ্রহণ করতে পারেন সন্ন্যাসীরা। একবার ভোর তিনটের সময় আরেকবার রাত আটটায়, মহাদেবকে ভোগ চড়ানোর পর। ডোবাটার দক্ষিণদিকে জোড়া খেঁজুর গাছ। সেখানে তখন লাল বসন পরিহিত আরেক সন্ন্যাসী হাতের মুঠোতে ধুনো ভোরে ধুনুচিতে ছুড়ে দিচ্ছেন আর সেই ধুনোর ধোঁয়া মস্ত অজগর সাপের মত কুন্ডলী পাকিয়ে আশপাশ ঢেকে ফেলছে যেন! অমরত্ত্বের আশায় পেয়ে বসা উড়নচন্ডী কোন এক সন্ন্যাসী তার ঝাঁকড়া চুল এলো করে প্রচন্ড জোরে মাথা দুলিয়ে মন্ত্র পড়ছেন আর হাতে মুঠো করে ধুনো নিয়ে নিভু নিভু জ্বলতে থাকা ধুনুচিতে ছুঁড়ে মারছেন,
“এর ধূপ সের ধূপ কালা ধূপ,
এই চার ধূপ পড়িয়া করলাম চুপ।
এই ধূপের গন্ধ যাবে শ্রী কৈলাশ পুর।
এই ধূপের গন্ধে নাচে আপাল আর গোপাল।
এই ধূপের গন্ধে নাচে বারো ফাল্গুনী,
এই ধুপের গন্ধে নাচে ঢাকি ও সন্ন্যাসী।
এই ধূপের গন্ধে নাচে কার্তিক গণপতি,
এই ধূপের গন্ধে নাচে লক্ষ্মী সরস্বতী,
এই ধূপের গন্ধে নাচে শিব ও পার্বতী।।”
গোটা মাস জুড়েই প্রায় দেল সন্ন্যাসীদের ব্রত পালন চলেছে। গেলো চোদ্দ দিন এক কাপড়ে আছেন ওঁরা। খেঁজুর সন্ন্যাস সহ মোট ষোল রকমের সন্ন্যাস ওরা করে থাকেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আট সন্ন্যাস, ঘাট সন্ন্যাস, জল সন্ন্যাস, আগুন সন্ন্যাস, তাল সন্ন্যাস। দেহ সাধনার আড়ালে এসবই মুগ্ধ সুগন্ধময় মাটির বুকে, ধীর, শান্ত, নিরুদ্বিগ্ন এক আলোকবর্তীকায় তৈরী করে গাজন সন্ন্যাসীদের কৃচ্ছসাধনের এক কঠিন বোহেমিয়ান চালচিত্র। এই নয়ানপোঁতার চড়কের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। এখানকার চড়কে সন্ন্যাসীদের সকলেই প্রায় মুসলিম। গাজী পীরের দরগা যেখানে এই চড়ক ভাঙা উৎসব হয়, সেটা আসলে গাজী মৈনুদ্দিনের কবর। তবু এই চড়কের দিনে হিন্দু মুসলিম মিলে মিশে এক হয়ে যায়। এই গাজী পীর কোন এক জীবনে হিন্দু ছিলেন। হয়তো বা ছিলেন নিম্ন বর্গ জাত। হয়তো বা ব্রাহ্মণ্যবাদের নিপীড়নে কোনঠাসা হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে বাংলায় বখতিয়ার খলজি অধ্যায়ে ইসলাম ভাবাবেগে তাড়িত হয়ে ধর্মান্তরিত হন। তবু তাঁর প্রেরণায় এবং স্থানীয় বিশ্বাসের জোরে গাজন সন্ন্যাস, চড়ক কিংবা খেঁজুর ঝাঁপ বন্ধ হয়নি আজও। ভাঙা ভাঙা স্বরে মেঠো ফরিয়াদী সুরের মত সেই ট্র্যাডিশন আজও সমানে চলছে!
দেল সন্ন্যাসীদের প্রধান দুই পান্ডা বা ‘বালা’, যাঁরা নিজেরাও ইসলামী পয়গম্বর তারা দক্ষিণমুখী সদরের সামনে বসে মাজারের পীরের উদ্দেশ্যে পূজা নিবেদনের পর, গাজনের একখানা লম্বা ছড়া পড়েন।
“ইরুপে দ্বিজগন কোরে সৃষ্টি সম্হারন
আমি বোরো হইলো অভিচার
বৈকন্ঠে ধর্ম মনে ত পাইয়া মারমা
মায়াতে হইলো অন্ধকার
ধর্ম হোইলা যবনরূপী মাঠে তা কলো টুপি
ঘৃণা শোবে ত্রিকচ্ছ কামান
চাপিয়া উত্তম হয় ত্রিভুবনে লাগে ভয়
খোদয়ে বলিয়া এক নাম
নিরঞ্জন নিরাকার হইলো ভেস্ত অবতার
মুখেতা বোলে তা ডোম্বোদার
যতেক দেবতাগন সবে হোইয়া একমন
আনন্দেতা পোরিলো ইজার
ব্রহ্মা হোইলা মুহম্মদ বিষ্ণু হোইলা পেকাম্বর
আদমফা হইলো সুলাপানি
গণেশ হোইয়া গাজী কাত্তিক হোইলা কাজী
ফকির হইলা জোট মুনি
তেজিয়া আপন ভেক নারদ হইলা শেখ
পুরন্দর হইলো মালানা
চন্দ্র সূর্য্য আদি দেবে পদাতিক হোইয়া সেবে
সবে মিলে বাজয় বাজনা
অপুনি চন্ডিকা দেবী তিনহু হোইলা হায়া বিবি
পদ্মাবতী হইলা বিবি নূর
যতেক দেবতাগান হোইয়া সবে একমন
প্রবেশ করিলো জাজপুর
দেউল দোহারা ভাঙ্গে ফাদ্যা ফিদ্যা খায় রঙ্গে
পাখোর পাখোর বোলে বোল
ধোরিয়া ধরমের পে রামাই পণ্ডিত গে
আমি বোরো বিশম গন্ডোগল”
ঢাক ঢোল কাঁসরের উচ্চ স্বরের বাজনা আর সাথে “শিব শিব মহাদেব, দেবের দেব, মহাদেব” এই উল্লাসে সে আওয়াজ চাপা পড়ে যায়। যেন অলীক শ্রাবন মেঘে ছেয়ে যায় খটখটে চৈত্রের আকাশ! বাকি সন্ন্যাসীরা তখন ইমারতের পূর্বদিকে পশ্চিমমুখী হয়ে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। ছড়া পাঠের সাথে সাথে মূল সন্ন্যাসীদেরকে ঘিরে নানা মুদ্রা সহ মাথাচালা, বেতনাড়া ও সন্ন্যাসধর্ম অনুসারে শিবপূজার যাবতীয় রীতিনীতি পালিত হতে থাকে। গাজী পীর এই নয়ানপোঁতার দেবতা। ভক্তদের বিশ্বাসে তিনিই এখানকার ধর্মঠাকুর, সব বিপদের পরিত্রাতা। আজও গরুর প্রথম দুধ, গাছের প্রথম ফল পীরকে নিবেদন না করে কেউ ভোগ করে না এই গ্রামে। গৃহারম্ভ, গৃহপ্রবেশ, অন্নপ্রাশন, ব্যবসা-বাণিজ্যের শুভারম্ভ, বিদেশযাত্রা এমনকি স্বদেশ প্রত্যাগমনের শুভ মুহূর্তে গাজী পীরকে শিরনি দেওয়া হয়। সন্তান লাভের আশায় এই চড়কের দিনে গাজী পীরের থানে খেলনা ঘোড়া মানত করে গ্রামের মেয়ে বৌয়েরা।
ওদিকে তখন তান্ডব নাচন চলছে! মহাদেবের চেলা ভূতেদের সাজে সারা শরীর দুলিয়ে ভয়ঙ্কর সব অঙ্গভঙ্গি করে নাচ শুরু করেছে কিছু সন্ন্যাসী। এরই মধ্যে একজন বালা জোড়া খেঁজুর গাছের মধ্যে চিহ্নিত গাছটির এবড়ো খেবড়ো শরীরের আঁশ ছাড়িয়ে, তার ঋজু কান্ডটিকে নগ্ন করছে ক্রমশঃ। তারপর সেখানে দুধ ঘি মধু গঙ্গাজল মাখানো চলবে বেশ কিছুক্ষণ। দলের মেয়ে বৌয়েরা অপেক্ষা করছে হাতে ডাব দুধ গঙ্গাজল নিয়ে। ফল ভাঙা গাছটাকেপুজো করে লালচি বাঁধা হবে লাল সুতো দিয়ে। তারপর সব সন্ন্যাসীরা গাছটাকে গোল হয়ে ঘিরে বসে কিছুক্ষন মহাদেবের নাম-গান করবে আর সমানে মাটিতে মাথা কুড়বে, নাক ঘষবে। এই মাটি এখন রিক্ত-শুষ্ক-রুক্ষ্ম! আল্লাহতালা মেহেরবানী করলে, মহাদেবের কৃপা বর্ষিত হলে এই মাটির উদাস বুকে ফের আর্দ্রতা ফিরে আসবে। জলের অতলে ডুব দিয়ে এ মাটি নরম হবে। প্রতি বছর এইরকম একটা খেঁজুর গাছেই ফুটে ওঠে বিশেষ লক্ষণ। প্রধান সন্ন্যাসী ঝাপের ঠিক আগের দিন রাতে স্বপ্নাদেশ পান। আজ এই গাছ থেকেই ঝাঁপ হবে। মাথায় করে দেল নিয়ে এসে গাছের শরীরে স্পর্শ করিয়ে বিড় বিড় করে মন্ত্র পড়তে থাকেন মূল সন্ন্যাসী। এবার ঘোর লাগবে তাঁর। মুখের কাছে কান নিয়ে গেলে শোনা যাবে গ্রামের বিভিন্ন ঘরের সব না জানা গোপন কথা। মোহাব্বুল আজ এই ঝাঁপ সন্ন্যাসীদের মধ্যে অন্যতম একজন। আরো চারজনের সাথে সেও উঠে পড়বে খেঁজুর গাছের গা বেয়ে, কাঁটার কামড়কে উপেক্ষা করে। ঝাঁপ শেষে অপরিপক্ক খেঁজুর ফল এনে মাটিতে না ছুঁইয়ে ওরা এনে দেবে সেই সব মায়েদের যাঁরা সন্তান অভীষ্টে চাতক সাজেন বছর বছর ধরে, যেসব বৌয়ের সংসারে নিত্য অনটন লেগেই থাকে। পীড়িতের কষ্ট লাঘবের নিমিত্তেই তো এই সাধন ভজন। গতকাল রাতেই হাজরা চালানের সময় গুরু ওর কানে দিয়েছেন দেহ বশীকরণের মন্ত্র,
“কালী কালী বিকটে কালী।
আয়কালী জয়কালী ক্ষয়কালী।।
শ্মশানকালী মশানকালী।
অন্ধকালী নৃত্যকালী।।
জরাকালী ভদ্রকালী।
নেংটাকালী ঘুঁটেকেলী।।
দশদিকে দশকালী।
কামাখ্যা ভুবনের কালী।।
আয় কয়জন শ্মশানেতে যাই।
মরার মাংস চিবিয়ে খাই।।
খড়গহস্ত রুধীধারা মুন্ডুমালা গলে।
মুকুট ঠেকেছে মা তোর গগনমণ্ডলে।।
শত শত মুণ্ড কেটে তুমি যাও ঘর।
শত শত মুণ্ড কেটে আমায় দাও বর।।
আমার এই বালা ভক্ত ছেড়ে।
যদি অন্য দিকে যাস।।
দোহাই লাগে নেড়াকালী।
চন্ডী কাল ভৈরবের মাথা খাস।।”
তারপর হাতে উদ্ধত খড়গ নিয়ে ঢাকের তালে তালে চলেছে উদ্দাম নৃত্য। মোহাব্বুলের পাশবদ্ধ শরীরে তখন খেলা করে গিয়েছে এক নিয়ন্ত্রণহীন তামসিক উদ্বেলতা। এই মন্ত্র শরীরে প্রবেশ করলে আর কোন সার থাকে না। মহাদেবের কোলে সেঁধিয়ে যাওয়া যায় অনায়াসে। নিজের শরীর, রক্ত-চামড়া-মাংস জুড়ে লেখা হয়ে যায় ভোনাথের চরণে সমর্পিত ‘সেবা’। অবশেষে সময় আসবে, ফিরোজা রঙের আকাশটা ছিঁড়ে পরওয়ারদিগার এর ওয়াস্তে বেদ ও বিধির নীলাভ সংগীত ভেসে আসবে, নিঃসীম দিগন্তে ফুটে উঠবে পড়ন্ত সূর্য্যের রং।
গুরুর আদেশ পেয়ে বালার পা ছুঁয়ে ওরা একে একে গাছটার গা বেয়ে ওপরে উঠতে থাকে। মগডালের আগের দিকে পৌঁছে একে অন্যের পিঠে বাধা বেতের দড়ি ধরে টান দেয়। ওপরের দিকের পাতাগুলোকে জড়ো করে জড়িয়ে বেঁধে ফেলে। গাছটাকে এবারে দেখতে লাগে ঠিক জটাধারী মহেশ্বরের মত! সেই জটার চারপাশে ওরা সাড়ে সাত পাক ঘোরে নটরাজের নৃত্যের ছন্দে। এইবার মাথা নীচে পা ওপরে করে সটান দাঁড়িয়ে পরে মোহাব্বুল! দুটো চোখ তার বন্ধ। এখন ইষ্ট জপের সময়। আলোকিত উদ্ভাসে মধুকর ডিঙ্গায় ভেসে মহাদেব কিংবা গাজী পীরের নির্দেশ পাবার অপেক্ষা শুধু। প্রতিবার এই সময়টায় ও মালিকের আদেশ পায়। সেই আদেশ ও ছড়িয়ে দেয় গ্রামের জনমানসে। কয়েক পুরুষ ধরে ওরা এই খেজুর সন্ন্যাস করে আসছে। এ ওদের মাটির ফরজ!!
গাছের গোড়ার দিক থেকে ভেসে আসা বাজনাটা এতক্ষণ তলার বাতাসে ঘূর্ণীর মত ধাক্কা খেতে খেতে ওপরের দিকে ধীর লয়ে উঠে আসছিল। ক্রমশঃ মোলায়েম হয়ে আসা আওয়াজটায় মোহাব্বুলের কান যেন সয়ে গেছিল। হঠাৎ যেন ভয়ঙ্কর সুন্দর শব্দে গর্জে উঠলো সেটা। মাথার ভিতরটা যেন গুলিয়ে উঠলো ওর। মাথা ফুঁড়ে যেন বেরিয়ে আসতে চাইলো সোনালী রঙের ব্রম্ভকমল। ওর স্থির চোখের মণিবন্ধে তখন ভেসে ওঠেছে দাউদাউ আগুনের ছবি! ওর বাপ ঠাকুরদার ভিটে জ্বলছে, জ্বলছে ঘর-বাড়ি-পুকুর। এমনকি ঝাঁপের গাছটাকেও উদাসীন সে আগুন ভারসাম্যহীন লকলকে জিভ নিয়ে তলার দিক থেকে গিলে খেতে শুরু করেছে যেন। সেই বিদ্রোহী অগ্নি শিখায় সন্ন্যাসী পুঁড়ছে, গাজী পীরের মাজার পুঁড়ছে, পুঁড়ছে গ্রামের ঘরে ঘরে পূজিতা গৃহলক্ষ্মী। মোহাব্বুলের চোখজোড়া আচমকাই খুলে যায়। টাল সামলাতে না পেরে খেজুর গাছের মগডাল থেকে সজোরে নীচে পরে যায় ও। হৈহৈ ওরে ওঠে নিচে জড়ো হয়ে থাকা লোকগুলো। মোহাব্বুলের মুখ থেকে তখন গলগলিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে!
নতুন ওয়াকফ বিল পাস হয়েছে মোটে চারদিনও হয়নি। এরই মধ্যে গাছপালা মাটি আকাশ এসব জায়গা জুড়ে যেন একটা স্তব্ধ হাওয়া, নির্দিষ্ট লাগাম হারিয়ে বেসামাল হয়ে পড়ে উন্মাদনা আর উন্মাদ মুখের মুখের জ্যামিতি এঁকে দিয়েছে, নয়ানপোঁতার নিশ্চুপ জংলা শরীরটা জুড়ে! যেন একটা চাপা ক্ষোভের আগুন ফুটে উঠেছে পথে ঘাটে গোত্তা খাওয়া ঘোলাটে বাতাস বেয়ে। কেউ যেন সেই হাওয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছে নতুন আইনে গাজী সাহেবের মাজার, মুসলিমদের কবরস্থান, মাজার লাগোয়া নামাজ পড়ার জায়গা এইসব ওয়াকফ করা জমি, হিন্দুদের সরকার ক্রোক করে নেবে।
“এতদিনকার মাটি, আমাদের দাদা পরদাদার জমিন, আমাদের ইবাদতের মাটি লিয়ে লেবে? যান থাকতে তা হতি দিব নি। আমরা লড়ব! ঈমানের ফরজে আমরা লড়ব! কেয়ামতের আগে অবধি লড়ব! যান কবুল করি লড়ব!”
মসজিদের ইমাম ভরা জনসভায় প্রকাশ্য দিবালোকে যুদ্ধের কথা ঘোষণা করেন সদর্পে! কিন্তু যুদ্ধ কার বিপক্ষে? এ লড়াই হাওয়ার সাথে লড়াই বই তো কিছু নয়! এ গ্রামের ইসলামিক ধর্মীয় ভাবাবেগ আর রাষ্ট্রের ফরমানের মাঝের জটিল বর্গক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে খিদের নামাবলী গায়ে জড়িয়ে, হিন্দু-মুসলিম, বাস্তুভিটে, জমি-ঈমান, পূর্বপুরুষ এসব হিসেব কষতে থাকে ডোবার ধারের ঝাঁপের সেই নিঃসঙ্গ খেঁজুর গাছটা। গাজীপীরের চারচালা দরগা দাঙ্গার আগুনে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়! ঘর ঘর সেই আগুন ছড়াতে থাকে। ক্ষমতা ধর্মের পোশাক পরে সেই আগুনে ঘি ঢালে শুধু। হিন্দু মহিলাদের সম্ভ্রমে হাত পরে এবার!
সাজানো শস্যক্ষেত অন্ধকারের কালোর ভেতর পুড়ে মহাকরুণার মত নির্জন শ্মশান হয়ে যায়! সেই চিতার ভস্ম মেখে যেন নতুন ভাবে শুরু হয় তান্ডব, চড়ক, গাজন, ঝাঁপ। ক্রমশঃ তা থিতিয়ে গিয়ে শান্ত ধীর এক আলোকবর্তিকার রূপ নেয়। কোমর ভেঙে বিছানায় মিশে যাওয়া মোহাব্বুলের শরীরটা তখন শেষবারের মত ধুকপুকিয়ে ওঠে মাধুকরী স্বপ্নের ছন্দে। দুচোখ বুজে একটা স্নিগ্ধ দুপুরে সে দেখতে পায় মুহম্মদ আর মহাদেব যেন এক শরীরে মিলে মিশে অর্ধনারীশ্বর! পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া গাজী পীরের দরগার দুয়ারে পরে থাকা এক রাশ জমান্তরকে ছাই ভেবে ভুল করে সারা শরীরে মেখে, গাজনের দলটা বারোমাস্যা কোজাগরী চাঁদটাকে বুকে করে, একটা মুণ্ডহীন শবশরীরকে নিয়ে সমানে নেচে চলেছে। আর ওদের মাথায় শুয়ে মহাদেব দুলছেন তামাম পৃথিবীর দোলাচলের ঠিক বিপরীতে।
“হরগৌরী প্রাণনাথ, মাথার উপরে জগন্নাথ, এইবার উদ্ধার করো শিব শিব শিব হে!!”
0 Comments