জ্বলদর্চি

কুয়াশা যখন/ পর্ব ১৫/ বাসুদেব গুপ্ত

গল্প ধারাবাহিক  
কুয়াশা যখন  
পর্ব ১৫ 

বাসুদেব গুপ্ত 

কুয়াশা যখন 

—“আমি তোমার কাছে চিরঋণী স্বপন, আমার জীবন বাঁচানোর জন্য। শুনেছি, আমার কনকাশন হয়েছিল বোমার ভাইব্রেশানে, খুব কাছে ফেটেছিল তো। আর দেখতেই পাচ্ছ এই বুকে ব্যন্ডেজ, অতটা পোড়া। কি আশ্চর্য, দেখো, আমি তোমার চাকরি বাঁচাতে পারিনি, অথচ তুমি আমার জীবন বাঁচালে। কী  পরিহস!”
স্বপন কিছু উত্তর দেয়  না। কি করে বলবে, সে-ই তো বোমা ছুঁড়েছিল! কীভাবে বলবে?
কিন্তু গৌতমের এই অবস্থা, আঙুল নেই দেখে স্বপনের খুব অস্বস্তি লাগল। তার জীবন এমনিতেই কঠিন, আবেগের বোঝা আরও বেশি। মনে হল, এখন তার চাই এক বোতল দিশি। নইলে মাথা ঠিক হবে না। 
—“আমি জানি, তুমি আমার প্রশংসায় অস্বস্তি বোধ করছ। আমি সত্যিই লজ্জিত, তোমার জন্য কিছু করতে পারিনি। আমরা বিশ বছর একসঙ্গে কাজ করেছি, তারপর…”
—“আপনারও তো চাকরি গেল স্যার। আমারও। আমরা একই নৌকায়।” স্বপন হালকা হাসল। বলল, “ভালো থাকবেন স্যার, আমি চলি। আবার খবর নেব।”
—“তোমার জন্য কিছু করতে পারি স্বপন? আর্থিক সাহায্য?”
—“কিছু লাগবে না স্যার, আমি কোনো সাহায্যের যোগ্য নই। আমি কোন কাজের নই,একেবারে লো ক্লাস মানুষ। আপনি সেরে উঠুন। আমি এবার চলি।”
কিন্তু স্বপন বেরিয়ে যাওয়ার আগেই, দরজা ঠেলে ঢুকলেন অফিসার সুবিমল পাকড়াশী। ধবধবে  সাদা ইস্ত্রি করা পোশাক, কোমরে সাঁটা রিভলভার, চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা, সঙ্গে দুজন কনস্টেবল, তাদের হাতে বন্দুক।
🍂

পুলিশকে অকর্মণ্য বলতে সবাই ভালোবাসে। কিন্তু কথাটা ঠিক না। বাস্তবে তারা কখনো হাল ছাড়ে না, কেস চলতেই থাকে, যদি না উপরমহল থেকে চাপ আসে। আসামীকে অনুসরণ করে ধরার আনন্দই আলাদা। সুবিমল অনেকদিন ধরে এই বোমা ছোঁড়া ব্যক্তিকে খুঁজছিলেন, কিন্তু কোনো ক্লু পাচ্ছিলেন  না। কবিতা পাঠের সভায় বোমা ছোঁড়ার কারণও স্পষ্ট নয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় রহস্য এক অজানা ব্যক্তি গৌতমকে হাসপাতালে নিয়ে জমা করে নিজে উধাও। লোকটা নিশ্চয়ই দেবদূত নয়।  পুলিশকে এড়াতে চাইলে, ভূয়ো নাম দিলে গোলমাল তো একটা আছেই। কিন্তু কেন? মোটিভটাই বা কি?

গৌতমের ফোন শুরু থেকেই ট্র্যাক হচ্ছিল। আজকাল বেশিরভাগ অপরাধ মোবাইল কলার আইডি আর সেল টাওয়ারের মাধ্যমেই ধরা পড়ে। প্রথমবার গৌতমের ফোন আর স্বপনের ফোন কানেক্ট হতেই খপ করে ধরলেন। আসামী একেবারে নিজে এসে ফাঁদে পড়বে এটা আশাতীত।   অপরাধী প্রায়ই ঘটনাস্থলে ফেরে, সুবিমলও সেই দিনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ওদিকে স্বপন বাড়ী থেকে কল রিসিভ করেছিল। কল ট্র্যাক করে লোকেশন পেয়েই সুবিমল ঠিক করলেন রেড করবেন গৌতমের বাড়ি। আর ঠিক একই সঙ্গে  সহকারী সাব ইন্সপেক্টর পান্ডে এই মুহূর্তে হানা দিচ্ছে স্বপনের বাড়িতে।  
পাকড়াশী স্বপনের দিকে রিভলভার উঁচিয়ে বললেন, “ একদম নড়ার চেষ্টা কোরো না। তুমি গ্রেপ্তার, হাত ওপরে তোলো।”
স্বপন বিস্ময়ে হতবাক। গৌতমের দিকে তাকাল। নিশ্চয়ই গৌতম কোন ফাঁদ পেতেছে! কিন্তু কেন? গৌতম জানবেন কীভাবে, স্বপন দায়ী? আর এটা তো দুর্ঘটনা। স্বপন তো মারতে চায়নি। কিন্তু এই কথা পুলিশ মানবে না সেটা বুঝতে দেরী হল না। নির্বিকার মুখ করে ও মাথার ওপরে হাত তুল্লো। দেখা যাক কানুদারা কি করে। 


—“এই হারামজাদা, গৌতমবাবুর দিকে ওভাবে তাকাচ্ছিস কেন? ভাবলি পালিয়ে যাবি, আমরা ধরতে পারব না?”
গৌতম প্রতিবাদ করে উঠল, “আমি কিন্তু পুলিশকে ডাকিনি। এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। ইন্সপেক্টর স্যার, লোকটা কিন্তু খুব ভালো,  ও আমাকে হাসপাতালে না নিলে আমি বাঁচতাম না।”
—“হা হা হা, ও না থাকলে আপনি হাস্পাতলেও যেতেন  না। আমরা ওকে বোমা ছোঁড়া, আর আপনাকে হত্যার চেষ্টার অভিযোগে গ্রেপ্তার করছি।” পাকড়াশী স্বপনের হাতে হাতকড়া পরিয়ে  দিয়ে কনস্টেবলদের ইশারা করল, স্বপনকে গাড়িতে তুলতে।
—“এটা কী হচ্ছে স্যার,  আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি জানলেন কীভাবে ও এখানে আসবে?” গৌতম এখনও হতবাক।
—“বিস্তারিত বলা যাবে না, তবে আপনার ফোন সবসময় আমাদের নজরদারিতে ছিল। আমাদের একটু ধন্যবাদ দিন, কে জানে আবার কী হতে পারত। ও খুব বিপজ্জনক একজন লোল, পার্টির অ্যাকশন গ্যাংয়ের লোক। ভাগ্যিস, আবার কিছু করার আগেই ধরতে পেরেছি।”
কনস্টেবলরা দুজন স্বপনকে সারচ করল, আর করতেই সেই চকচকে ছুরি বেরিয়ে এল—যেটা  দিয়ে সে গৌতমকে নিয়ে যাওয়ার সময় ভ্যানের দড়ি কেটেছিল।
—“দেখুন, ছুরি নিয়ে ঘুরছে। কে জানে আজ এর  কী প্ল্যান ছিল।” এক কনস্টেবল চিৎকার করল।
গৌতম ভয়ে ভয়ে ছুরির  দিকে তাকাল, ছ ইঞ্ছির ফলা, ঝকঝক করে উঠছে আলো পড়লে, বোঝাই যায় ভীষণ ধার। কিন্তু এটা ঠিক বে আইনীও বলা যায় না।“ গৌতম তীব্র চোখে  স্বপনের দিকে তাকাল।
—“স্বপন, এটা কী? তুমি কি আবার আমাকে মারতে এসেছিলে? আমাকে মারতে চাইছ কেন? ”

স্বপন একেবারে চুপ, কোনো অভিব্যক্তি নেই, জানালার বাইরে ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
পাকড়াশী গৌতমকে কিছু কাগজে সই করাল, তাতে তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের কথা লেখা। কনস্টেবলরা বেরিয়ে যাতে, গৌতমের কাছে এসে   গৌতমের হাতটা আলতো করে ধরে বলল,
—“গৌতম বাবু, আমিও চাই গণহত্যা বন্ধ হোক। আপনার কবিতা ‘পিপল’স সাউন্ড’ ম্যাগাজিনে পড়েছি। আপনি সুস্থ আছেন জেনে ভালো লাগল।” সুবিমল টেবিলের বইগুলো দেখল, গৌতম গতরাতে পড়ছিলেন। প্রথম কবিতায় থেমে গেলেন, ‘যদি আমি মরি আজ রাতে’।
—“রেফাতের। হুম, খুব ভালো কবিতা, খুব শক্তিশালী অনুভূতি। বিশেষ করে ওর ঐ পরিণতি হবার পর।” 
বইটা যত্ন করে টেবিলে রেখে, জানলার দিকে তাকিয়ে যেন কাউকে না শুনিয়ে স্বগতোক্তি করলেন,
“আর এক বছর পর অবসর। অবসর নেওয়ার প্র গরিব মানুষ কেন অপরাধে জড়ায়, সমাজ কীভাবে উদাসীন—এ নিয়ে বই লিখব, অনেক অভিজ্ঞতা হল আমার।“
একটু ভাবুক হয়ে জাচ্ছিলেন দেখে, নিজেকে সামলে নিল পাকড়াশী তারপর  আবার পুলিশের মত সোজা সাপটা ভাষায় বলল,
 “কেন বোমা ছুঁড়ল, খুঁজে বের করতে হবে। এখন বাইরে যাবেন না। দরকার হলে যোগাযোগ করব।”
 কনস্টেবলদের নিয়ে পুলিশের আলো লাগানো সুইফট চড়ে রওনা দিলেন, আর ঘরটা সাক্ষী হয়ে রইল অনেক নাটকীয় মুহূর্তের। 
সবকিছু কেমন আবছা অদ্ভুত লাগছিল। গৌতমের শরীরটা খারাপ লাগতে শুরু করল। প্রেসারট কি কমে যাচ্ছে? মাথা কাজ করছে না, কিছুই  বুঝতে পারছিল না। স্বপন কেন আমার গায়ে বোমা ছুঁড়ল? স্বপন কেন ছুরি নিয়ে এল দেখা করতে? চাকরি হারানোর জন্য ও কি আমাকে দায়ী করে? আমাকে?
আর এ কি রকম অদ্ভুত পুলিশ, লাঠিপেটাও করে, আবার কবিতা পড়ে, গণহত্যার প্রতিবাদকে সমর্থন করে?
রোদেলা দুপুর হঠাৎ কুয়াশায় ঢেকে গেল। কিছুই আর ব্যাখ্যা করা যায় না। কিছুই আর স্পষ্ট নয়।
মালতী বেরিয়ে গেল,   দরজা জানলা ভালোভাবে বন্ধ না করেই। বাতাসে জানলা ঠকঠক শব্দ করছে। নীলিমা এখনও আসেনি। হঠাৎ জানালা দিয়ে এক দমকা বাতাস ঢুকে বইয়ের পাতাগুলো  উল্টে দিল। গৌতম বইটার দিকে ফাঁকা চোখে তাকিয়ে রইল। শব্দগুলো পিক্সেলে ভেঙে গেল। পিক্সেল থেকে    তৈরি হল আর এক নতুন জগত। গৌতম বুঝতে পারল না, সে এখন কোন জগতে আছে।
ওদিকে পুলিশ পৌঁছে গেল গ্রীনওয়ারের অফিসে। ডেকে ডেকে জেরা করল, স্বপনের অতীত নিয়ে খোঁজ করল। 
পৃথা, সুমন, চন্দন স্বপনের এই পরিণতি দেখে এক গলায় বলল, “ এমন হবারই কথা। লো ক্লাসের লোক কতদিন আর ভালো থাকবে। তবে হিকোমাকে এসব কিছু বলব না। ও আবার পুলিশ শুনে ভয় পেয়ে যাবে” তারা ঠিক করল, স্বপনের কাহিনী ওদের তিনজনের মধ্যেই গোপন থাকবে।

-শেষ-
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

5 Comments

  1. 🙁😞😭

    ReplyDelete
  2. আচ্ছা, মালতীও পুলিশের লোক,তার হাতেও Ak47?🤔

    ReplyDelete
  3. খেয়াল করিনি এটা শেষ পর্ব ছিল।রোজ রোজ
    অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল।
    খুব ভালো লাগছিল।
    নতুন ধারাবাহিকের অপেক্ষায় থাকলাম।🙏

    ReplyDelete