বন্দনা সেনগুপ্ত
আমরা “চক্রবৎ পরিবর্তন্তে দুঃখানি চ সুখানি চ” অর্থাৎ জীবনে সুখ দুঃখ দুইই চক্রবৎ পরিবর্তিত হয় শুনে শুনে বড় হয়েছি। সেদিন ফেসবুকে দেখলাম একজন কবি মানুষকে সূর্যের সঙ্গে তুলনা করে বলছেন যে মানুষ চিরদিন উঠেও থাকে না বা ডুবেও থাকে না অর্থাৎ মানুষের ভাল ও খারাপ সময় পরিবর্তনশীল, স্থায়ী নয়।
বেশ কথা।
কিন্তু, সমাজের চারদিকে তাকালে কি সর্বদা এই রকম দেখতে পাই? আমরা দেখি যে বেশির ভাগ যারা ভাল আছে, তারা ভালই আছে। যারা ভাল নেই, তাদের সংগ্রাম যেন শেষই হতে চায় না।
তাহলে কি সনাতন বাক্য সর্বদা সত্য নয়? না, তা নয়। কিন্তু, সফল হবার ও সেই সফলতা ধরে রাখার জন্য কিছু নিয়ম আছে, শর্ত আছে। সেগুলি মেনে চলতে হয়।
প্রথম কথা অবশ্যই মানসিকতা। প্রথমে জানতে হবে কি চাই। আরও ভাল হয় যদি কেন চাই সেটাও জানতে পারি। যেমন ধরা যাক, একটা বিশেষ ডিগ্রী চাই। তাহলে সেটাই কেন চাই, অন্য কিছু কেন নয়, সেটা নিজের কাছে পরিষ্কার থাকলে ভাল হয়।
উদাহরন স্বরূপ মোহাম্মদ আলীর কথা উদ্ধৃত করতে পারি
,
"I hated every minute of training but I love being a world champion." কেন কষ্ট করছেন, সেটা ওঁর কাছে পরিষ্কার ছিল।
🍂
তারপর চাই ইচ্ছাশক্তি। কি চাই জেনে নিয়ে সেটার জন্য লড়ে যাবার মত মানসিকতা ও ইচ্ছাশক্তি থাকতে হবে। কারণ, অনেক সময়েই দেখা যায় যে সাফল্য একবারে বা সহজে আসে না। যেমন, কেউ হয়ত সরকারি চাকরি করতে চায়। একবারে পেলে ভাল, না পেলে বারে বারে পরীক্ষা দিয়ে যেতে হবে। প্রোমোশনের ক্ষেত্রেও একই কথা। হাল ছেড়ে দিলে হবে না। হয়ত অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানে চেষ্টা করতে হবে। এই সবার জানা কথাগুলি শুধু উদাহরন হিসেবে বললাম। সব ক্ষেত্রেই এই নিয়ম।
কিন্তু!
মনে করুন একজন সঙ্গীত বা অঙ্কন শিল্পী বা বিজ্ঞানী রূপে প্রতিষ্ঠা পেতে চায়। প্রতিভা না থাকলে হবে কি? প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও প্রচেষ্টা অনেক দূর নিয়ে যেতে পারে। হয়ত! নিশ্চয়তা দিতে পারে না। তাই নিজের প্রতিভা ও শক্তি সম্বন্ধে সচেতন থাকুন।
এবং, নিজের দুর্বলতাগুলিকে জেনে ক্রমাগত চেষ্টা করে জয় করুন।
নিচে জোহরি উইন্ডোর একটা ছবি দিলাম। এটা আমাদের নিজেদের অ্যাট্রিবিউট বা বৈশিষ্ট্যগুলি সম্বন্ধে জানতে সাহায্য করে।
আমরা নিজেদের সম্বন্ধে অনেক কিছু নিজেরাই জানি। হয়ত অন্যেরাও জানে। আমরাও সেসব সবাইকে জানাতে কোনও বাধা দেখি না। এটা হল ওপেন এরিয়া।
আবার রাগ দুঃখ ঈর্ষা ইত্যাদি অনেক কিছু আমরা নিজেরা জানলেও অন্যকে জানাতে পছন্দ করি না। এটা হল হিডেন এরিয়া।
আমাদের পরিবার, পরিজন বা বন্ধু বান্ধবরা আমার অজানা অনেক বৈশিষ্ট্য জানে, লক্ষ্য করে, এবং জানিয়েও থাকে। অনেক সময়েই সেই জানানোটা আমাদের জন্য বেশ দুঃখের ও বেদনার হয়ে দাঁড়াতে পারে। এটা হল ব্লাইন্ড স্পট।
আবার আমাদের চরিত্রের, মানসিক গঠনের কিছু কিছু এমন অন্ধকার অংশ আছে যা আমরা নিজেরাও জানি না বা অন্যেও বুঝতে পারে নি। সেটা হল আমাদের মনের আননোন অংশ। যাঁরা ক্রাইম পেট্রোল বা ওই রকম সিরিয়াল দেখেন, তাঁরা নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন, অনেক সময়ই একজন তথাকথিত ভাল লোক একটা অপরাধ করে ফেলেছেন। এই সব রিপুর তাড়না আমাদের মনের এই অন্ধকার অংশ থেকেই আসে। আবার, সঠিক সময় ও পরিবেশ পেলে অনেক আপাতত সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হয়ে উঠতে পারে।
জোহরী উইন্ডো সম্বন্ধে এত কিছু বললাম কেন?
আমাদের নিজেদের সম্বন্ধে ভাল মন্দ সব জানতে হবে। সেই সঙ্গে ভাল বন্ধু, আত্মীয়, পরিবার চাই যারা আমাকে ঠিক ভুল ধরিয়ে দেবে। এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। সমালোচনা সবাই করতে পারে। অসুবিধা, অ-সুখ, ব্যর্থতার দিনগুলিতে যে পাশে থাকে, আত্মার আত্মীয় একমাত্র সে। কাজেই, শুধু নিজেকে জানলেই হবে না, অন্যদের সম্বন্ধেও সচেতন হতে হবে। সত্যিকারের শুভানুধ্যায়ী হয়ত সামনে ক্রমাগত বকা দেবেন, কিন্তু পিছনে কখনও সমালোচনা করবেন না। শ্রদ্ধাভরে তাঁদের আপাত নেতিবাচক কথা ও ব্যবহার থেকে শিক্ষা নিতে হবে। যাঁরা আমার অগ্রগতিতে সুখী নন এবং মৌখিক অথবা মানসিক ভাবে বাধা দিচ্ছেন, তাঁদের থেকে দূরে থাকতে শিখতে হবে। এক কথায়, নিজের সঙ্গী চয়ন সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে।
তবে, সাফল্য শুধু পেলেই হল না। তাকে ধরেও রাখতে হবে। দৃঢ়ভাবে মূল্যবোধ ধরে না থাকলে কিন্তু পতন হওয়া সহজ। যেমন ধরুন একজন উচ্চ পদস্থ কর্মচারী ঘুষ নিয়ে ধরা পড়লেন। আজকাল টিভিতে এটা খুব দেখছি। কোটি কোটি টাকা কিন্তু জেলে বসে আছে। কেন? কারণ, টাকা চাই জানত। কিন্তু, মূল্যবোধ ছিল না বলে সহজ পথে হেঁটেছিল। আর, সেপথে চালানোর জন্য কু- সঙ্গী জুটেছিল। ইচ্ছাশক্তি ছিল না বলে, যেখানে অন্যায় জেনেছে, সেখানেও প্রতিরোধ করতে পারে নি। ভাল সঙ্গী থাকলে, হয়ত, এরকম হত না। এটা শুধু একটা উদাহরন। প্রায় সব ক্ষেত্রেই পতনের মূল কারণ রিপু দমনের জন্য সদিচ্ছা এবং মূল্যবোধের অভাব।
এগুলি সাধারণ নিয়ম, সবাই জানেন। সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে আবার জানানো প্রয়োজন বোধ করলাম।
0 Comments