নুড়ি পাথরের দান
চীন (এশিয়া)
চিন্ময় দাশ
অনেক অ-নে-ক দিন আগের ঘটনা। একটা সরাইখানায় বসে বসে ঝিমুচ্ছিল তার মালিক। নেহাতই গ্রাম এলাকা। সরাইখানাটাও ছোট্টই। কালে ভদ্রে দু-একজন খদ্দের এসে জোটে। সেদিন এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল।
তখন দূপুর গড়িয়ে বিকেল হয় হয়। একজন লোক এসে হাজির। রোগা লিকলিকে চেহারা। পোষাকও উলুঝুলু। বয়স নাই নাই করে তিন কুড়ি তো হবেই। মানুষটার গলা কানে যেতেই ঝিমুনি কাটল মালিকের।
--এক ঢোঁক রস হবে গো, ভালো মানুষের পো। পরাণটা আইঢাই করছে। একটু দয়া করো আমাকে। ভগবান তোমার ভালো করবেন।
দেখেই বোঝা গেছে, এ খদ্দের নয়। অভাবী মানুষ। পথ হেঁটে হেঁটে গলা শুকিয়েছে নিশ্চয়। নেহাৎ দায়ে পড়ে হাত পেতেছে অন্যের কাছে। দয়া হোল মালিকের। আঙুরের রস থাকে একটা কুঁজোয়। উঠে গিয়ে এক গ্লাশ রস গড়িয়েছে। তখনি চোখে পড়ল, কুঁজো ফাঁকা হয়ে গেল। দু-তিন ফোঁটাই আর রইল কুঁজোটায়।
পুরো এক গ্লাশ মিষ্টি আঙুরের রস। গলায় পড়তেই, চোখ মুখে আলো জ্বলে উঠল মানুষটার। আহা কী সোয়াদ! আদ্দেক গ্লাশ খাবার পর, রয়ে-সয়ে একটু একটু করে খেতে লাগল। সরাইওয়ালা দেখছে বসে বসে। যেন কতকাল এমন সুধা পান করেনি অভাবী মানুষটা। ভারি আনন্দ হোল মালিকের।
গ্লাশ শেষ করে অতিথি বলল—তোমার মুখ দেখেই বুঝেছি, নিজের গলায় দেওয়ার মতো আর রস নাই তোমার কুঁজোয়। সবটাই আমাকে দিয়ে দিয়েছ। কিন্তু তোমাকে দিয়ে যাব, এমন কিছু তো নাই আমার কাছে। তবে—
কথা থামিয়ে ঝোলা থেকে একটা পাথর বের করল মানুষটা। ছোট্ট একটা নুড়ি পাথরের মতন দেখতে। মালিকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল—অনেক মহৎ কাজ করলে তুমি আজ। ভগবান অবশ্যই ভালো করবেন তোমার। এই পাথরটা তুমি নাও।
মালিক হেসে বলল—এটা নিয়ে কী করব আমি? মুখে সামান্য হাসি।
তোমার শূণ্য কুঁজোয় ফেলে রেখো পাথরটা। তার পর নিজেই ফলাফল দেখতে পাবে। কপাল ফিরে যাবে তোমার। আমি চলি।
অতিথি চলে গেল। রসের কুঁজোটা প্রায় খালি। মালিক করল কী, পাথরটা কুঁজোর মধ্যে ফেলে দিল। দেখাই যাক না, কী হয়!
রাতের খাওয়া সেরে, কুঁজোটা তুলতে গিয়ে, অবাক কাণ্ড। কানায় কানায় ভর্তি কুঁজো। আর কী স্বাদ সেই রসের! যেমন মিষ্টি, তেমনি ঘন।
সত্যিই কপাল ফিরে গেল সরাইওয়ালার। তার দোকানের রসের স্বাদের কথা ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগল না। ভিড় বাড়তে লাগল দোকানে। যত ভীড়, তত ইউয়ান (চীন দেশের টাকা) আয় হতে থাকল। কুঁজোর রস ফুরায় না কোন দিন। ফুরিয়ে গেলে, নিজে থেকেই আবার ভর্তি হয়ে যায়।
বেশ চলছিল। একদিন হঠাৎ বিপত্তি। পাথরটা উধাও। সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাওয়া গেল না। নিশ্চয় কোনও খদ্দেরের গেলাসে চলে গিয়েছিল। সে ব্যাটা নিয়ে সরে পড়েছে। মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল মালিক।
সরাইখানায় লোকেরা আসে। আর মিষ্টি রস না পেয়ে, ব্যাজার মুখ করে ফিরে যায়। ভীড় কমতে কমতে একেবারে শূন্য হয়ে গেল ক’দিন না যেতেই। মন খারাপ করে বসে থাকে মালিক। খাওয়া-দাওয়াও করে না ভালো মতন।
বাড়িতে দুটো পোষা কুকুর আর বিড়াল ছিল মালিকের। তাদেরও খাওয়া জুটছে না ঠিকমতো। কুকুর বলল—ঘরে বসে থেকে লাভ নাই, দিদি। চলো বেরোই। দেখা যাক, কোনও বাড়িতে খোঁজ পাওয়া যায় কি না।
দুজনে ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়াত লাগলো। কুকুর বাইরে থেকে গন্ধ খুঁজে বেড়ায়। সুযোগ পেলে,বেড়াল টুক করে ঢুকেও পড়ে কোনও বাড়িতে। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। কোথাওপাথরের সন্ধান মেলে না।
দেখতে দেখতে শীতকাল এসে গেল। নদীর জল জমে বরফ। বেড়াল বলল—দাদা, চলো ওপারে যাওয়া যাক।
দুজনে ওপারে চলে গেল বরফের নদী পার হয়ে। সেখানেও ঘরে ঘরে খুঁজতে শুরু করেছে। এইভাবে কতো দিন চলে গেল।
একদিন একটা ফাঁকা ঘরে ঢুকেছে দুজনে, সেখানে দেরাজের মধ্যে চোখ পড়তেই অবাক। পাথরটা রাখা আছে। আনন্দ ধরে না। পাথর নিয়ে নদীর পাড়ে ফিরে চলল দুজনে।
তত দিনে বসন্ত শুরু হয়ে গিয়েছে। বরফ গলে, নদী আবার জলে টইটুম্বুর। কী করা যায়? কুকুর বলল—তুমি সাঁতার কাটতে জানো?
--নাগো, দাদা। জলে আমার ভীষণ ভয়।
--তাহলে এক কাজ করো। পাথরখানা মুখে নিয়ে, তুমি আমার পিঠে চেপে বসো। আমি সাঁতরে তোমাকেও নিয়ে চলে যাব।
সেইমতো দুজনে চলেছে। খানিকটা গিয়ে কুকুর জিজ্ঞেস করল—বেড়াল দিদি, পাথরটা ঠিক আছে তো?
মুখে পাথর ধরা। জবার দেবে কী করে? বেড়াল চুপ করে রইল। খানিক দূর গিয়েছে, আবার প্রশ্ন কুকুরের। বেড়াল আবারও চুপ। বেড়াল কথা বলছে না দেখে, কুকুর বিরক্ত।
পাড়ের কাছাকাছি এসেছে, কুকুর আবার বলল—পাথর ঠিক আছে তো?
মাথা গরম হয়ে গেল বেড়ালের। বিরক্ত হয়ে বলে উঠল—হ্যাঁগো, হ্যাঁ। ঠিকই আছে। বকর বকর করো না তো।
যেই না মুখ খুলেছে বেড়াল, অমনি টুপ করে পাথরটা পড়ে গেল জলে। ততক্ষণে পাড়ে উঠে পড়েছে দুজনে। কুকুর বলল—কই, পাথর দেখি?
বিড়াল বলল—তোমার জবাব দিতে গেলাম। তাতেই তো পাথরটা পড়ে গেল। আমি কী করব?
কুকুর গেল ক্ষেপে। --তবে রে হতচ্ছাড়ি। এত কষ্ট করে পাওয়া গেল, আর তুই কি না। ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দেব আজ তোকে।
গায়ের জোরে বা দৌড়ে কুকুরের সাথে পারবে কেন বিড়াল। তবে, কপাল ভালো তার। একটা গাছ ছিল নদীর পাড়েই। তর তর করে গাছে উঠে, প্রাণ বাঁচল বিড়ালের। কিছুক্ষণ হম্বি-তম্বি করে কুকুর বাড়ির পথ ধরল।
গাছেই বসেছিল বিড়াল। সেসময় এক জেলে মাছ ধরছিল নদীতে। একবার জাল গুটিয়েছে। একটা মাছের পেট বেশ ফোলা ফোলা। পেটে অনেক ডিম হলে যেমনটা হয়। বিড়াল নেমে এসে, টুক করে মাছটা তুলে নিয়ে লম্বা ছুট। ছুটতে ছুটতে সোজা মালিকের সরাইখানায় এসে হাজির।
বিড়ালকে দেখে কুকুর তেড়ে আসছিল। কিন্তু মুখে একখানা মাছ দেখে, সে চুপ করে গেল। মালিকও খুশি। ভালো করে খাওয়া-দাওয়া হয়নি অনেক দিন। বিড়ালটাও ফিরে এসেছে অনেক দিন পরে। রাতের খাওয়ার জন্য মাছ কাটতে বসল মালিক।
তখনই অবাক কাণ্ড। হারাণো মাণিক বেরিয়ে এল মাছের পেট থেকে। আর পায় কে? আনন্দে নাচানাচি করতে লাগল তিন জনে।
আবার কুঁজো ভরে উঠতে লাগল মিষ্টি স্বাদের রসে। আবার খদ্দেরের ভীড় জমতে লাগল সরাইখানায়। অবস্থা ফিরে গেল মালিকের।
সেদিন থেকেই ঘরে ঘরে আদর যত্ন বেড়ে গেল কুকুর আর বিড়ালের। আজও পৃথিবীর ঘরে ঘরে কুকুর আর বিড়ালই হোল সব চেয়ে প্রিয় জীব। সবার চেয়ে আদরের।
0 Comments