রঞ্জিত আদক
অমিয় চক্রবর্তী বলেছিলেন ‘আমার পৃথিবী এইখানে শেষ’ - এই ছিল ঘরের প্রতি তাঁর অনুভূতি। আর কবি সালেহা খাতুনের ‘ঘর’ কবিতার অনুভূতি অন্যরকম। ঘর কবিকে করেছে পর, পর করেছে আপন। তবুও কোথাও ঘরের প্রতি আছে অনুরাগ। কবি সুকান্ত বলেছিলেন ‘প্রিয়াকে আমার কেড়েছিস তোরা ভেঙেছিস ঘরবাড়ি’; আর কবি বললেন – ‘প্রিয়াকে কাড়েনি কেউ, তবে ভেঙেছে ঘরবাড়ি’। 'শাশ্বতী' কবিতায় সুধীন্দ্রনাথ প্রেমের শাশ্বত বাণী শুনিয়েছিলেন ‘সে ভুলে ভুলুক কোটি মন্বন্তরে, আমি ভুলিব না কভু ভুলিব না’। আর এই কবিতার শেষে কবি বললেন ‘সে যদি ভুলেও যায়, আমি কখনো তাকে ভুলতে পারিনা’। অর্থাৎ তিনি ঘর ছেড়ে চলে যেতে পারেন না। ঘর তো অনেকদিন ছেড়েছেন আর শৈশবের সেই ঘরে ফিরবেন কিনা ঠিক নেই! তাই বড়ো জোর হাওড়া ব্রিজ পেরিয়ে তাঁর গন্তব্য কলকাতা আবার কলকাতা থেকে মেদিনীপুর। ‘যেতে পারিনি’ কবিতায় সেই স্বীকারোক্তি রেখে গিয়েছেন তিনি । ঘর ছেড়ে কোনো তীর্থযাত্রা বা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বা কোনো বাইরের দেশে চলে যেতে পারেন না, যেতে পারেন না বলেই তাঁর উপলব্ধি ঘরকে তিনি গভীর ভালোবাসেন।
‘এ তুমি কেমন মানুষ’, ‘মানুষ’ – প্রভৃতি অনেক কবিতায় কবি মানুষকে খুঁজে বেড়িয়েছেন। এই প্রযুক্তির যুগেও মান এবং হুঁশ নিয়ে বেঁচে থাকা যথার্থ মানুষকে। যেমনভাবে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে গ্রিক দার্শনিক ডায়োজিনিস মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন তেমনি কবিও মানুষ খুঁজে চলেছেন। বেশ কিছু মানুষকে দেখেছেন তিনি; যারা নিজে অপমান সইতে পারে না, কিন্তু অন্যকে অপমান করে। পরনিন্দা করে বেড়ায় অথচ নিজের নিন্দা সইতে পারে না। তারা প্রিয়জনকে চোখ রাঙিয়ে সবার প্রিয় হতে চাইছে। আসলে তারা মনুষ্যবেশী এক একটা ফানুস; চেপে ধরলেই চুপসে যায়।
স্বর্গের দেবতারা তিল তিল সৌন্দর্য নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন তিলোত্তমাকে। সুন্দ-উপসুন্দের হাত থেকে স্বর্গরাজ্যকে বাঁচাতে দেবতাদের ছিল এই সৃষ্টি। আর কলকাতা সৃষ্টি করেছে আজকের তিলোত্তমাকে। এখনো সুন্দ-উপসুন্দের মত দস্যুদলের মুখোশ খুলে দিতে একজন তিলোত্তমাই যথেষ্ট। নবজাতকের কাছে তিলোত্তমা করেছে শপথ- মসৃণ করে যাবে তাদের চলার পথ। সম্প্রতি আর. জি. করের তিলোত্তমা স্থান করেছে বর্তমানের তিলোত্তমাসম্ভব কাব্যে। না , মাইকেলের 'তিলোত্তমাসম্ভবকাব্য' নয় ; কবি সালেহা খাতুনের কবিতা ‘তিলোত্তমাসম্ভবকাব্য’- এ।
‘অভয়ামঙ্গল’ কাব্যে ফুল্লরা, বৈশাখ থেকে চৈত্র - বারো মাসের দুঃখ কাহিনি বর্ণনা করেছিল। ‘বারোমাস্যা’ কবিতাতে কবি প্রকাশ করেছেন সেপ্টেম্বর থেকে পরের নভেম্বর মাসের ভালোবাসার মানচিত্র। সেদিনের সেই বারোমাস্যা আর আজকের বারোমাস্যার মানচিত্র এক।
‘কবি হে’, 'কবি জন্ম’, 'নাচার’ প্রভৃতি কবিতায় আছে কবি হয়ে ওঠার কথা। ডিম্বাণু শুক্রাণু জরায়ু ছিঁড়ে ফেলে শব্দমালা সৃষ্টি করতে পারেন কবি। লিখতে পারেন একটি কবিতা। বুকের মধ্যে জমে ওঠা গভীর ক্ষত শব্দ তৈরি করবে কবিতার। গণিতের যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ, কস-থিটা সবে মত্ত কবির সহকর্মী নিবেদিতা অঙ্ক ছেড়ে হাজার কবিতা লিখে চলেছেন।
আসলে কবি হয়ে উঠতে গেলে মন ও মননের নিষেক ঘটাতে হয় মস্তিষ্কের জরায়ুতে। কবিতার ভ্রুণ আস্তে আস্তে করে জমাট বাঁধে। না শুধু সহকর্মী নন, তাঁর ছাত্ররাও কবিতায় স্থান করে নেয়। ‘ডিসেম্বরের দিনগুলি’ কবিতাতে সিলভিয়া, সোহিনী, নন্দিনী, বুরুলুকুই, শবনম সবাই উঠে এসেছে। উঠে এসেছে প্রুফ সংশোধনে মগ্ন আরেক কবির কথা। যিনি লিখে চলেছেন তাঁর ‘বারুদ বেহালা এবং বেলি’ কাব্যগ্রন্থ। 'কোনো এক কবির প্রতি' কবিতায় কবির এককালের ক্লাসরুমে বসা ছাত্র, বর্তমানের বিখ্যাত এক কবির সব রচনার কথা রয়েছে; ওয়াকিবহাল পাঠক মাত্রই তাঁকে চিনে নেবেন।
চতুরাশ্রম প্রথার বানপ্রস্থের বাঁশি প্রথম শুনতে পেয়েছেন ডিমনা লেকের ধারে। সেই বাঁশির সুর ঘর কেড়েছে তাঁর। কবির বয়স পঞ্চাশ আর কবির কাছের মানুষের বয়স বাহান্ন । অর্ধেক জীবন কেটে গেছে তাঁদের। একান্নবর্তী সংসারে কোনোদিন জোটেনি অন্ন গ্রহণের সুযোগ। যে জমিতে ফসল ফলে আছে, তার ভাগ কোনোদিন এসে পৌঁছয়নি; অবশ্য বিষয়সম্পত্তির প্রতি তাঁদের লোভও নেই। যারা ক্ষমতা দিয়ে জয় করেছে তারা করুক ভোগ। বানপ্রস্থে এসব প্রয়োজন নেই। বানপ্রস্থের বিজয়রথে পাড়ি দেবেন তাঁরা। যতদিন সেই রথ পাড়ি না দেয়,আপাতত ততদিন ফিরে যাওয়া যায় ব্রহ্মচর্যে।। কাব্যগ্রন্থের নাম তাই ‘বানপ্রস্থের বাঁশি’।
এই কাব্যগ্ৰন্থের কবিতাগুলিতে রবীন্দ্রনাথ, সুধীন্দ্রনাথ, সুকান্ত তথা সমসাময়িক অনেক কবির ভাবনাচিন্তা যেমন ছায়া ফেলেছে, তেমনি ছায়া ফেলেছে গোটা বিশ্বসাহিত্য। সাম্প্রতিক বিষয়, সহকর্মী, ছাত্র-ছাত্রী, শাশ্বত ভাবনাচিন্তা,সাম্যবাদ সবকিছু স্থান করে নিয়েছে এ কাব্যে।
এটি কবির তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। কাব্যগ্ৰন্থে মোট কবিতার সংখ্যা ৬০।
কাব্যগ্রন্থ - বানপ্রস্থের বাঁশি
কবি – সালেহা খাতুন।
প্রকাশক – জ্বলদর্চি।
প্রচ্ছদ - শুভ্রাংশু শেখর আচার্য্য
প্রথম প্রকাশ – ১৫.৪.২০২৫।
উৎসর্গ – সালাউদ্দিনকে।
মূল্য – ২৫০ টাকা।
🍂
0 Comments