জ্বলদর্চি

রা ম ধ নু / অংশু পাণিগ্রাহী

চিত্র- অর্ণব মিত্র 

রা ম ধ নু
অংশু পাণিগ্রাহী


মাথা ঝুঁকিয়ে বারান্দার এক কোণে বসে আছে সুবীর।
“এখন কেমন?” চায়ে চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করে পবনদা।
“ওই আর কী!”
 সুবীরের স্বর মৃদু। মাথা তোলেনি এখনও। ও জানে আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছি ওরই দিকে। আমার চোখে চোখ রাখার সাহস নেই।
“তাহলে বাড়িতে বসে আছিস কেন? হপ্তা পার হয়ে গেল। মেয়েটার পড়াশোনা লাটে উঠেছে। বউ বলছিল। আমাদের কথা তো শোনে না মেয়েটা!” 
সুবীর বলে, “হ্যাঁ, যাব দু’-একদিনের মধ্যেই।”
বৃষ্টি হয়ে গেছে এক পশলা। এখন অল্প রোদ। শেষ বিকেলের রোদ উঁচু গাছগুলোর মাথায় লেগে রয়েছে। পুব আকাশে একটা রামধনু। রামধনু দেখেই সর্বাঙ্গ জ্বলে ওঠে আমার। সুবীরকে শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন। কঠিন শাস্তি। 
বলি, “পবনদা, আমার শোওয়ার ঘরে চলো। নতুন শাড়িটা দেখাব। আমি অনলাইনে অর্ডার করে আনিয়েছি।”
পবনদা চমকে ওঠে। এতটা সে আশা করেনি। এ যে মেঘ না-চাইতেই জল! গলাটা একবার খাঁকরে নিয়ে বলে, “এখানেই দেখালে হত না?”
“এখানে মশা খুব... এই এই, নড়বে না... তোমার বাহুতে একটা বসে রয়েছে,” বলে আমি পবনদার বাহুতে আলতো চাপড় দিই। আড়চোখে তাকাই সুবীরের দিকে। সুবীর মাথা তুলেছে। তার চোখ এখন পুব আকাশে নিবদ্ধ। রামধনুতে। বাইরে চেষ্টা করছে নিস্পৃহ থাকার, অন্তত পবনদার সামনে, আমার সামনে। কিন্তু অন্তরটা দাউ-দাউ করে জ্বলছে না ওর? চরম অসহায়তা গ্রাস করছে না ওকে? এসব না-হলে আমার যাবতীয় প্রচেষ্টা যে ব্যর্থ! 
পবনদার চোখ জ্বলজ্বল করছে। লোকটা ইশারা বোঝে। আমার পিছন-পিছন শোওয়ার ঘরে ঢোকে সে। 
সুবীরের সঙ্গে দাম্পত্য যাপনের এক বছর পূর্ণ হয়েছে কিছুদিন আগেই। পবনদা সুবীরের বাল্যবন্ধু। এই মফসসলেই থাকে। আমাদের বিয়ের পর থেকে নিয়মিত যাতায়াত এ বাড়িতে। সপ্তাহে দু’বার আসা চাই। কোনো সপ্তাহে তিনবারও। হাজিরার উদ্দেশ্য বন্ধুর সঙ্গে মোলাকাত বা নিছক আড্ডা নয়।
পবনদার সেই দুর্বলতাই এখন আমার কাঁচামাল। সুবীর দেখুক বউ কীভাবে প্রশ্রয় দিচ্ছে বাল্যবন্ধুকে। দীর্ঘদিনের তঞ্চকতার জন্য এটুকু শাস্তি প্রাপ্য ওর। আসলে সুবীরকে গাছে বেঁধে পেটানো উচিত। হাটের মাঝে মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে, জুতোর মালা পরিয়ে পুরো এলাকা ঘোরানো উচিত। 
হয়তো এই চিন্তা-ভাবনায় নৃশংসতা আছে। কিন্তু সুবীরের মতো বিকৃত রুচির একটা মানুষের জন্য হয়তো এও বুঝি যথেষ্ট নয়! ওকে মানুষ বলে ভাবতেই ঘেন্না হয়। 
সে-রাতে আমি যখন বমি চাপতে-চাপতে কোনোরকমে দৌড়ে এসে বিছানায় বসেছি, হাঁফাচ্ছি, সুবীরও এসে ঢুকেছিল ঘরে। ওকে দেখেই আমি চিৎকার করে উঠেছিলাম, “মানুষ এতটাও নিচে নামতে পারে? এতটা নোংরা হয়? তোমার সঙ্গে আমি ঘর করেছি একটা বছর, কিছুক্ষণ আগে এই বিছানায় তোমার সঙ্গে সেক্স করেছি... ভাবতেই ঘেন্না হচ্ছে আমার। তুমি এক্ষুণি বেরোও ঘর থেকে।”
“আমি... মানে...” আত্মপক্ষ সমর্থনে সুবীর কিছু বলার চেষ্টা করছিল।
“চুপ করো! চুপ করো! তোমার কোনো কথা আমি শুনব না। তোমার মতো লোকের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। গণধোলাই হওয়া উচিত তোমার। কাল... কালই আমি সবাইকে জানিয়ে দেব। সবাই দেখুক সুবীরমাস্টার আসলে কী? তুমি এখন যে অবস্থায় আছো সেভাবেই হাঁটানো হবে রাস্তা দিয়ে। লোকে থুতু দেবে, আবর্জনা ছুঁড়বে তোমার গায়ে।” আমার উত্তেজনা বেড়ে যাচ্ছিল ক্রমশ। কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। 
সুবীর হাঁটু ভেঙে বসে পড়েছিল। পা জড়িয়ে ধরেছিল আমার। সন্ত্রস্ত মুখ নিয়ে উদ্বিগ্ন গলায় বলছিল, “কেউ যেন জানতে না পারে, এসব! তুমি যা শাস্তি দেবে আমি মাথা পেতে নেব।”
“ছাড়ো আমার পা। তোমার স্পর্শে গা ঘিনঘিন করছে আমার।”
জোর করে পা ছাড়িয়ে নিয়েছিলাম।
“আমি হাত জোড় করছি। বিয়েটা আমি করতে চাই নি। মা-ই জোর করে...” 
সুবীরের শেষ কথাগুলো আর শোনা হয়নি। আমি ততক্ষণে বাথরুমে। পাগলের মতো জল ঢালছি আদুড় গায়ে। সুবীরের স্পর্শের মাধ্যমে সঞ্চারিত যাবতীয় মালিন্য ধুয়ে ফেলতে হবে। তার আগে শান্ত হতে পারব না। 
সাতদিন কেটেছে তার পর। উত্তপ্ত মাথা এখনও শীতল হয়নি। আমি চাই আমার আর পবনদার ঘনিষ্ঠতা দেখে উদ্বেগ বাড়ুক সুবীরের। 

🍂
ad

 সেই ঘটনার পর প্রথম যেদিন পবনদা এল আমাদের বাড়ি, আমি চায়ের কাপ এগিয়ে দেওয়ার সময় ইচ্ছে করেই পবনদার আঙুল ছুঁয়ে দিয়েছিলাম। দু’দিন পরে আরও একবার। পবনদা ইঙ্গিত বুঝল। রোজ শুরু হল তার আনাগোনা। 
এখন পবনদাকে নিয়ে শোওয়ার ঘরে ঢুকেই দরজাটা ভেজিয়ে দিয়েছি। এলোমেলো কথা বলতে-বলতে আলমারি খুলে হিজিবিজি কয়েকটা শাড়ি বের করে পবনদার সামনে মেলে দিয়েছি। গভীর মনোযোগ সহকারে শাড়ি দেখছে সে।
“আজ তোমার শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কথা ছিল না?” রাস্তার দিকের জানালাটার দিকে চোখ রেখে বলি।
“বউ আর মেয়ে যাবে। আমার ওসব পোষায় না। সন্ধেয় একটা মিটিংও আছে পার্টির,” বলে পবনদা। 
আমি মুচকি হাসলাম। কীসের মিটিং আমি ভালোই বুঝেছি! পবনদার বউটাও আচ্ছা গবেট! নীলিমা না কী যেন নাম! কিছুই কি বোঝে না? 
রাস্তার দিকে তাকিয়েই আছি। হঠাৎ দেখি সুবীর। ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে রেললাইনের দিকে। বাতাসে উড়ছে ওর কাঁধ ছাপানো চুল। সামনের দিকে একটু ঝুঁকে হাঁটছে সুবীর। চোয়াল শক্ত হয় আমার। মনে বিজয়ীর আনন্দ।
আজকের নাটক এখানেই শেষ করা যাক। বলি, “পবনদা, এবার এসো তুমি।”
“অ্যাঁ!” পবনদা কেমন থতমত খায়। 

নীলিমা

চন্দ্রাবলীকে নিয়ে বেরিয়েছি।
পবন আমাদের সঙ্গে নেই। যাওয়া ঠিক ছিল। হঠাৎই কাল রাতে জানাল, পার্টির গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে। মিটিং-এ ওর উপস্থিতি একান্ত জরুরি। অগত্যা মেয়েকে নিয়ে আমিই চলেছি জন্মাষ্টমীর মেলা দেখাতে। বাবার বাড়ির কাছে মেলা। আজ রাতটা ওখানেই কাটবে। সকালে মেয়ের স্কুল। ওর স্কুলের ড্রেস, বই-খাতা ইত্যাদি সঙ্গে নিয়েছি। সরাসরি মেয়েকে স্কুলে দিয়ে বাড়ি ফিরে আসব। 
বৃষ্টি হয়েছিল বিকালে। রাস্তাঘাট ভেজা। কোথাও-বা গর্ত হয়ে জল জমে আছে। মেয়ের হাত ধরে একটা গর্ত পার করালাম। ভীষণ দস্যি মেয়ে। ক্লাস থ্রি চলছে ওর। 
আকাশ এখন মেঘমুক্ত। যা কিছু আবর্জনা ছিল সব ধুয়ে মুছে সাফ। সামান্য আলো আছে। সন্ধে নামছে দ্রুত। পবন বলেছিল ওর মোটরবাইকে আমাদের এগিয়ে দিয়ে যাবে বাসস্ট্যান্ড অবধি। আমি বারণ করেছি। কী দরকার! এটুকুই তো পথ। রেললাইনটা পেরোলে মাঠের মধ্য দিয়ে খানিকটা এগোলেই বাসস্ট্যান্ড। পবনের সাহায্য ছাড়াই বেশ পারব।
পবনের সঙ্গে ভালোবাসার বিয়ে। উচ্চমাধ্যমিকের পরে পড়াশোনা হয়নি আমার। টেনেটুনে পাস করেছিলাম। হয়তো পাসকোর্স নিয়ে ভর্তি হতাম কলেজে। সেই সময়েই পবনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক। কলেজে পড়ার যেটুকু আগ্রহ ছিল তাও ভেসে গেল উথালপাথাল প্রেমের জোয়ারে। পবনের সঙ্গে সংসার করার বাসনায় আর সবকিছু চাপা পড়ে গেল। বাবা-মা-দাদারও অমত ছিল না। হয়ে গেল বিয়ে। 
তবে সপ্তাহে দু’বার লুকিয়ে দেখা করা, দু’-চারটে চুমু খাওয়া, প্রেমিকের বাহু জড়িয়ে বসে ভবিষ্যতের স্বপ্ন বোনা এক জিনিস আর বিয়ের পরে এক ছাদের তলায়, একই ঘরে সংসার ভাগাভাগি করে নেওয়া অর্থাৎ যৌথযাপন অন্য জিনিস। বিয়ের পর থেকেই পবনের গা ছাড়া ভাব। সংসার নিয়ে উদাসীন। বেসরকারি অফিসে চাকরি করত। সেটা ছেড়ে শুরু করল রাজনীতি। অর্থাভাব অবশ্য নেই আমাদের। পবনের বাবা ব্যবসা করে অগাধ টাকাকড়ি রেখে গিয়েছেন ছেলের নামে।
সুন্দরী মেয়েদের প্রতি পবনের দুর্বলতা আছে। হয়তো চিরকালই ছিল। প্রেমে অন্ধ আমি টের পাইনি প্রথমদিকে। হয়তো আমার প্রতি সাময়িক একটা মোহ তৈরি হয়েছিল। এক সঙ্গে থাকতে গিয়ে সেটা কেটে গেছে। আমি তো আর চোখ-ধাঁধাঁনো সুন্দরী নই! চোখ-ধাঁধাঁনো কেন! সুন্দরীর কোনো শ্রেণিতেই আমাকে ফেলা যায় না। 
সুবীরদার বউ চমৎকার দেখতে। তেমনই ফিগার। পবন প্রায়ই সুবীরদার ওখানে গিয়ে বসে থাকে। আজকাল তো রোজই যাচ্ছে। মুখে বলে, বাল্যবন্ধুর খবর নিতে যাচ্ছে। সে বলুক যা খুশি। পড়াশোনা বেশিদূর এগোয়নি বটে, তবে আমি মাথামোটা নই। 
রেললাইন পেরিয়ে মাঠের পাশ দিয়ে এগোচ্ছিলাম আমরা। মেয়ে কিচিরমিচির করছিল নিজের মতো। আমি ভাবছিলাম পবনের কথা। একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ আঁচলে টান। মেয়ে আঙুল তুলে মাঠের দিকে নির্দেশ করছে।
চাপ চাপ অন্ধকারে প্রথম কিছুই ঠাহর হল না। তার পর দেখি রাস্তা থেকে খানিকটা তফাতে ঝাঁকড়া গাছটার তলায় কেউ বসে আছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে একটানা।
“সুবীরকাকু!” মেয়ে বলল।
সুবীরদা? এখানে? এই সময়ে?
আমরা পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেলাম গাছটার দিকে। হ্যাঁ, সুবীরদাই বটে। অন্য কোন জগতে হারিয়ে গেছেন বুঝি! আমরা সামনে গিয়ে দাঁড়াতেও ভাবান্তর হল না। আকাশের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন। এ কী হাল হয়েছে সুবীরদার!
“এই যে শুনছেন?” আমি বাস্তবের মাটিতে ফিরিয়ে আনতে চাইলাম মানুষটাকে।
“ও! তোমরা!” চমকে উঠে আমাদের দিকে তাকালেন সুবীরদা। 
“অন্ধকারে এভাবে বসে আছেন কেন? শরীর কেমন?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।
মেয়ে বলল, “কাকু, আবার কবে আমাকে পড়াবে?” 
“হ্যাঁ, যাব শিগগিরই,” সুবীরদার সংক্ষিপ্ত উত্তর। 
“শরীরের কথা তো বললেন না?” আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম।
সুবীরদা হাসলেন। কষ্টের হাসি। বুকটা কেন জানি মুচড়ে উঠল আমার। গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে রয়েছেন। পা দুটো সামনের দিকে ছড়ানো। ভেজা ঘাসের উপরেই বসেছেন সুবীরদা। কাঁধ ছাপানো চুল দুলছে হাওয়ায়। গালে কয়েকদিনের বাসি দাড়ি। খোঁচা-খোঁচা, রুক্ষ। চুল বড়ই রাখেন। তবে নিয়মিত দাড়ি কামাতেন সুবীরদা। সবুজ হয়ে থাকত গালদুটো। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলাম। সুবীরদা কি খুব কষ্টে আছেন? মেয়েকে আর পড়াতে আসেন না। সপ্তাহখানেক হল। ফোনে কথা হয়েছিল একবার। বলেছিলেন, শরীরটা ভালো নেই। সেরে উঠলেই আগের মতো আসবেন। 
“আমাকে আর-এক সপ্তাহ সময় দাও, নীলিমা। আমি ঠিক যাব,” বললেন সুবীরদা।
“সন্ধে হয়ে এল। আপনি আর এখানে বসে থাকবেন না। প্লিজ বাড়ি যান। বর্ষাকাল। এই মাঠঘাট সাপের আড্ডা। আপনার শরীরটাও ভালো নেই। প্লিজ উঠুন।”
আমার কথা শুনে কেমন এক ঘোলাটে দৃষ্টিতে তাকালেন সুবীরদা। তার পর মাথা নামিয়ে নিলেন। বললেন, “তোমরা যাও। আমি ঠিক সময়ে উঠে পড়ব।”
“আচ্ছা, আসি তাহলে?” 
মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন সুবীরদা।
আমরা রাস্তায় উঠে এলাম। অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে ক্রমশ। পা চালিয়ে এগোনো উচিত। কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে শ্লথ হয়ে এল আমার গতি। অজানা একটা কষ্টের পাথর গড়াতে শুরু করল বুকের মধ্যে। এমনিতে সুবীরদাকে পেলেই অনর্গল কথা বলে যাই। তিনি অবশ্য কম বলেন, তবে মন দিয়ে শোনেন আমার সমস্ত কথা। ভাল লাগে মানুষটার সান্নিধ্য। কথা বলে তৃপ্তি হয়। তবে আজ অন্যরকম সবকিছু। আজ যেন সুবীরদা আরও বেশি চুপচাপ। আরও বেশি সংযত। 
পিছনে তাকালাম আর-একবার। অন্ধকার যথেষ্ট ঘনীভূত এখন। দূরে মাঠের মধ্যে গাছের কালো অবয়ব। তার নিচে অন্ধকারে মিশে গেছেন সুবীরদা। তাঁকে এখন আর চেনা যাচ্ছে না। 

শ্যামলী

স্কুল থেকে ফিরে সুবীর আজ টিউশনি গেছে। সেই ঘটনার পর প্রথমবার। পনেরোটা দিন কেটে গেছে এর মধ্যে। 
পবনদা যথারীতি এসেছিল। দরজা থেকেই বিদায় করে দিয়েছি। বলেছি, শরীর ভালো নেই, জ্বর বোধ হয়। 
জ্বর শুনে এগিয়ে এসেছিল পবনদা। হাত বাড়িয়েছিল। উদ্দেশ্য আমার কপালে হাত রেখে দেহের উষ্ণতা পরখ করা। আমি দু’পা পিছিয়ে এসেছিলাম। 
“তুমি যাও, পবনদা। আমাকে ছুঁয়ে দেখার দরকার নেই। মিথ্যা কথা বলছি না আমি।”
আমার কথা শুনে পবনদা যেন মাটিতে মিশে গেল প্রায়। জিভ কেটে বলল, “ছি, ছি! এসব কী বলছো? তোমাকে অবিশ্বাস করব আমি?” 
“তাহলে গায়ে হাত দিচ্ছ কেন খামোখা!” ঝাঁঝের সঙ্গে বললাম।
পবনদা হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইল। আমি ওর মুখের ওপরেই দরজা বন্ধ করে দিলাম। পবনদার দোষ কতটুকু ছিল আমি জানি না। ওকে তো আমিই প্রলুব্ধ করেছিলাম। পুরোটাই যে অভিনয়, সুবীরকে দেখানো, এ কথা পবনদাকে বোঝাতাম কী করে? 
বিয়ের পরে সুবীর একবার বলেছিল পবন তার বাল্যবন্ধু হলেও লোকটা তেমন সুবিধের নয়। নানা অছিলায় গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। ঠিকই। পবনদা সুবিধের নয়। কিন্তু সুবীর নিজে কী? 
আমি পাকা অভিনেতা নই। দিনের পর দিন পবনদার সঙ্গে মাখামাখি করার অভিনয় চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে। এতে সুবীর আদৌ জব্দ হচ্ছে কিনাও নিশ্চিত নই। 
আমার বাবা-মা জোর করে বিয়ে দিয়েছিলেন, একথা আমি বলতে পারি না। আমি নিজেই সুবীরকে পছন্দ করেছিলাম। হ্যান্ডসাম, স্বল্পভাষী মানুষটার মধ্যে অপছন্দ করবার মতো কিছু ছিল না। মা-কে নিয়ে দেখতে গিয়েছিল আমাকে। আমার বাবার কী একটা কথায় হেসেছিল সুবীর। সেই ভুবনভুলানি হাসির ফাঁদে এমন পড়লাম যে বেরোতে পারলাম না। শয়নে-সপনে-জাগরণে ঘুরে ঘুরে আসতে লাগল সেই অপূর্ব মন ভালো করা হাসি। বিয়েতে রাজি না হয়ে পারিনি। তাছাড়া সুবীর প্রাইমারি স্কুলে পড়ায়। শিক্ষক জামাই পেয়ে আমার বাবা-মা আপ্লুত। সর্বসম্মতিক্রমে বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল। সর্বসম্মতিক্রমে কথাটা অবশ্য ভুল। খোদ সুবীরের সম্মতি ছিল কি? 
বিয়ের আগে একবার দেখা করেছিলাম আমরা। একসঙ্গে পার্কে গিয়ে বসেছিলাম ঘণ্টাখানেক। সুবীর প্রথম থেকেই গুটিয়ে ছিল। এমনটা তো হতেই পারে। স্বল্প পরিচিত মেয়ের সঙ্গে এভাবে পাশাপাশি বসতে অনেক ছেলেরই অস্বস্তি হয়। তেমন দোষের কিছু নয়। 
কিন্তু বিয়ের পরেও অবস্থার উন্নতি হল না। ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করলেই ও যেন ছিটকে পালাত। খরার মরশুম শেষই হচ্ছিল না। বারবার জানতে চাইতাম। আমাকে কি তার পছন্দ নয়? অন্য কাউকে ভালবাসে? মায়ের চাপে বিয়ে করেছে?... সব প্রশ্নের জবাবেই সুবীর বলত, “ধ্যাত, ওসব কিছুই না।”
এক রাতে আমি জোর করে চুমু খেলাম সুবীরকে। সেই প্রথমবার। কাঠ হয়ে পড়ে রইল সে। আমার মাথায় খুন চেপেছিল সেদিন। ওর সমস্ত জড়তা আমি দূর করেই ছাড়ব। দেখি কতক্ষণ গুটিয়ে রাখতে পারে নিজেকে। সুবীর বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল প্রাণপণ। কিন্তু আমি সর্বশক্তি প্রয়োগ করে নগ্ন করেছিলাম ওকে। স্থাপন করেছিলাম নিজেকে ওর উপরে। আমিই পরিচালনা করেছিলাম পুরো প্রক্রিয়াটা। সুবীর পড়ে ছিল নিষ্ক্রিয় হয়ে। 
একমাত্র এই ব্যাপারটা বাদ দিলে সুবীর আমার কোনও চাহিদাই অপূর্ণ রাখেনি। যখন যা চেয়েছি এনে দিয়েছে। ঋতুর সময়ে আমার খুব সমস্যা হয়। বিছানায় পড়ে থাকি। তলপেটে অসহ্য ব্যথা হয়। ওষুধ খেয়েও সুরাহা হয় না তেমন। রাতে ঘুমোতে পারি না। সেই সব রাতগুলো আমার মাথার কাছে বসে কাটায় সুবীর। সেঁক দেওয়ার ব্যাগ তৈরি করে দেয়। 
কিন্তু সুবীর যে অত্যন্ত নোংরা! আমি কী করে ওকে মেনে নেব? স্বাভাবিকভাবে সংসার করা যায় না এমন একজন মানুষের সঙ্গে। আমি এ যুগের মেয়ে। বিজ্ঞানে স্নাতক। কিন্তু এতটা আধুনিক হতে পারব না। কিছুতেই পারব না। আমার ঘেন্না হচ্ছে, ক্রোধ হচ্ছে। সুবীরের মতো মানুষদের সঙ্গে কী ভাবে এক ছাদের তলায় কাটানো যায়, তার উপায় আমার জানা নেই। আমি সেকেলে নই― স্মার্টফোন ব্যবহার করি, ইন্টারনেটে দুনিয়ার খবর দেখি, টর্নড জিন্স পরে বেরোই, বাড়িতে শর্টসও পরি মাঝেমধ্যে। ফেসবুকে নারীর অধিকার নিয়ে পোস্ট দিই। কিন্তু পোশাকে, খাদ্যে, ভোগ্যপণ্য ব্যবহারে আধুনিকতার অনুসারী হলেও, সুবীরের ব্যাপারে প্রগতিশীল হতে চাই না!
আজ সুবীর নিজে রান্না করে খেয়ে স্কুলে বেরনোর পর আমি ওর ঘরে ঢুকেছিলাম। সে রাতের পর থেকে আমরা আলাদা ঘরে থাকি। পারতপক্ষে ওর ছায়াও মাড়াই না। পবনদা ছাড়া কোনও অতিথি-অভ্যাগতর বালাই নেই। পবনদা এলে সুবীর মাঝেমধ্যে বারান্দার কোণে এসে বসে। আমার দিকে তাকায় না। আমি ওকে আড়চোখে দেখি। এটুকুই। 
আজ এক অদম্য কৌতূহলের বশে সুবীরের ঘরে ঢুকে পড়েছিলাম। এটা ওর মায়ের ঘর। আমাদের বিয়ের তিনমাসের মধ্যেই মারা যান মহিলা। বন্ধই থাকত ঘরটা। সুবীর মাঝেমধ্যে খুলত। জিনিসপত্র উল্টেপাল্টে দেখত। আজ সেই ঘরে ঢুকে টেবিলের উপরে একটা ডায়েরি পড়ে থাকতে দেখলাম। সুবীর ইচ্ছা করেই ঘরে তালা দেয়নি। হয়তো ভেবেছে, আমি ওর ঘরে ঢুকব না, অথবা ওর গোপন সত্য যখন আমার সামনে প্রকাশিত হয়েই গেছে তখন আর কীসের লজ্জা! 
ডায়েরির কয়েকটা পাতা উল্টে দেখছিলাম। পাতা জুড়ে থিকথিক করছে অশ্লীল, কদর্য কথাবার্তা। ঘিনঘিন করছিল গা। একজায়গায় সুবীর লিখেছে, মনের সঙ্গে শরীরের এ কী রক্তক্ষয়ী দ্বন্দ্ব! আমার স্তন এত ছোট কেন? আমি তো এমন শরীর চাই না, আর-এক জায়গায়, আমি আয়নার সামনে দাঁড়ালেই হাত দিয়ে পুরুষাঙ্গ ঢেকে রাখি। তার পর আয়নায় তাকাই। নিজেকে দেখে তৃপ্তি হয়।
সারা শরীর রি-রি করে ওঠে আমার। আস্তাকুঁড় থেকে উঠে আসা একটা কেন্নো যেন চষে বেড়াচ্ছে সর্বাঙ্গে। ডায়েরিটা পড়ার আর রুচি হয় না। 
ঘরের দেয়ালে ছবি হয়ে ঝুলছেন সুবীরের মা। উল্টোদিকে একটা খাট। খাটের উপর ইতস্তত ছড়ানো রয়েছে সুবীরের জামা, প্যান্ট, লুঙ্গি। খাটের পাশে আলমারি। হাতল ধরে টান দিই। ডানদিকের খোপে চোখ যায়। এমন কিছুই আশা করেছিলাম। 
খোপের মধ্যে যত্ন করে সাজানো রয়েছে ব্রা, প্যান্টি, সায়া, ব্লাউজ, শাড়ি, চুড়িদার, টপ... মাথার আগুনটা দপ করে জ্বলে ওঠে আবার। চোখের সামনে ভেসে ওঠে সে-রাতের দৃশ্য। 
নিষ্ফল মিলনের পরে ঘুম আসছিল না। সুবীর বাথরুমে গিয়েছিল। এটাই ওর অভ্যাস। সঙ্গমের পরে বাথরুমে যায়। গায়ে জল ঢালে। সিগারেট খায় একটা। আমি ততক্ষণে ঘুমিয়ে যাই। সে-রাতে ঘণ্টাখানেক পরেও যখন সুবীর এল না, আমি উঠে পড়লাম। গায়ে কাপড় দিয়ে ঘরের বাইরে এসে দেখি, মায়ের ঘরের দরজায় ফাঁক দিয়ে সরু আলোকরেখা বেরিয়ে এসে বারান্দা জুড়ে পড়ে আছে। দরজা ভেজানো। কৌতূহলী হয়ে আমি এগিয়ে গিয়েছিলাম ঘরটার দিকে। দরজাটা ঠেলে দিয়েছিলাম আলতো করে। ঘরের মধ্যে যে-দৃশ্য আমার জন্য অপেক্ষা করে ছিল তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। 
আয়নার সামনে সুবীর দাঁড়িয়ে ছিল। আমার এই অতর্কিত আগমনে চমকিত, ভীত, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। পরনে তার ব্রা আর প্যান্টি। আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল নিজেকে। 
কী বীভৎস দেখাচ্ছিল সুবীরকে! বোঁ করে মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল আমার। পেটের ভিতর আলোড়ন। দরজাটা ধরে ফেলেছিলাম কোনওরকমে। সুবীর সেই অবস্থাতেই দৌড়ে এসেছিল। বলছিল, “তোমাকে সব বলতাম, সাহসে কুলোয়নি...”
পেটের সব নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসতে চাইছিল। আমি দৌড়ে গিয়ে ঢুকেছিলাম নিজের ঘরে।
সেই থেকেই দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করে চলেছে সুবীরের কদর্য মূর্তি। কাউকে বলিনি। এসব কথা কাকেই বা বলব? 
এ ক’দিন গুগলে কিছু পড়াশোনা করেছি। ইউটিউবে ভিডিও দেখেছি। কিন্তু আমি কিছুতেই সহানুভূতিশীল হতে পারছি না সুবীরের প্রতি। সুবীরের মতো লোকজনের ধোঁয়াটে মনস্তত্ত্ব বোঝা আমার সাধ্যের বাইরে। আমি শুধু জানি, সুবীর আমাকে ঠকিয়েছে। আর ও অসুস্থ, মানসিক বিকারগ্রস্ত।
আমি নিজের জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করে দিয়েছি। আজ নয় কাল আমাকে পালাতেই হবে। এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

নীলিমা

সুবীরদা মেয়েকে পড়াচ্ছেন। সেদিন গাছতলায় বসে আশ্বস্ত করেছিলেন। এক সপ্তাহ সময় চেয়েছিলেন। কথা রেখেছেন সুবীরদা। স্কুল থেকে সোজা চলে এসেছেন। নিজের মুখেই বললেন, খুব খিদে পেয়েছে। 
আহা রে! বোধ হয় সেই সকালে দুটো নাকে-মুখে গুঁজে বেরিয়েছিলেন। অনেক দিন পরে স্কুলে যাচ্ছেন। কাজ জমে গিয়েছিল নিশ্চয়ই। স্কুল থেকে বেরোতে দেরি হয়েছে। বাড়ি যাওয়ার সময় পাননি। 
আমি দ্রুতহাতে খাবার বানিয়ে পড়ার টেবিলে গেলাম। মেয়ে অনেকদিন পরে তার শিক্ষককে পেয়ে উৎফুল্ল। অঙ্ক কষতে-কষতে স্কুলের কথা বলে যাচ্ছে। সুবীরদা ‘হুঁ’ ‘হাঁ’ করছেন। অন্যমনস্ক। আগের রুক্ষভাবটা কমেছে। দাড়ি কামিয়েছেন পরিপাটি করে। গালে সেই সবুজ আভাটা ফিরে এসেছে। তবে মুখমণ্ডল বিষাদগ্রস্ত। চোয়ালের হাড় ঠেলে উঠেছে। চোখের তলায় কালির পোঁচ। অসুখটা বোধ হয় তাঁকে কাবু করে ফেলেছে। 
নিত্য নতুন পদ রান্না করতে আমার বেশ লাগে। আর খাওয়াতেও। সুবীরদাও তারিয়ে-তারিয়ে খান। রান্নার প্রশংসা করেন। খারাপ হলেও করেন। আজ খাবারটা গোগ্রাসে খেলেন। আমি অপেক্ষা করছিলাম তাঁর থেকে তারিফ শোনবার জন্য। কিন্তু খাবারের ব্যাপারে একটা শব্দও খরচ না-করে প্লেটটা একদিকে সরিয়ে রাখলেন। 
আমি বললাম, “আজ বেশিক্ষণ পড়ানোর দরকার নেই। আপনি ধীরে-সুস্থে শুরু করুন।” 
“না না, ঠিক আছে,” বলে পড়াতে শুরু করলেন সুবীরদা।
আমি আমার ঘরে ফিরে এলাম। এখান থেকে মেয়ের পড়ার টেবিল দেখা যায়। বালিকাবেলার কথা মনে পড়ে গেল। দাদা আমার থেকে পাঁচ বছরের বড়। দাদাকে একজন শিক্ষক পড়াতে আসতেন। এই সুবীরদারই মতো বয়স। আমি আমার ঘরের মধ্যে বসে লুকিয়ে-লুকিয়ে দেখতাম দাদার শিক্ষককে। 
সুবীরদা এখন মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছেন। হাত দুটো জড়ো করে কপালে ঠেকানো। বোঝা যাচ্ছে, পড়ানোয় মন নেই। সেদিনের গাছতলায় দৃশ্য মনে পড়ে গেল। সুবীরদা কি খুব কঠিন কোনো রোগে ভুগছেন? গোপন রাখতে চান? নাকি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত? 
“আজ আর পড়তে হবে না। তুমি একটু খেলে এসো,” উঠে গিয়ে বললাম মেয়েকে। সুবীরদা মাথা তুললেন। বাধা দিলেন না। 
মেয়ে বেরিয়ে গেলে আমি সুবীরদার পাশেই চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। বললাম, “আপনার কী হয়েছে?” 
আমার বলার মধ্যে এমন কিছু ছিল, যা সুবীরদাকে নাড়া দিল। চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, “আমি খুব ক্লান্ত, নীলিমা!”
“ক্লান্তি কীসের? আপনি তো এতদিন বিশ্রামে ছিলেন। অসুখটা কি সারেনি?”
সুবীরদা হেসে বললেন, “আরে না না, শারীরিকভাবে আমি ফিট।”
“তাহলে?”
“ও তুমি বুঝবে না,” সুবীরদা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। 
পবনের বাল্যবন্ধু এই মানুষটা। অনেক বছর ধরেই দেখছি। মানুষটাকে শ্রদ্ধা করি। শিক্ষক বলেই হয়তো। বা কী জানি! আজ এত কাছে বসে আশ্চর্য এক মায়ার ক্ষরণ হচ্ছে বুকের ভিতর। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। সুবীরদার বাম হাত আমার দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে বললাম, “একবার বলেই দেখুন!”
সুবীরদা ওইভাবেই কিছুক্ষণ বসে রইলেন। তার পর নিজের ডান হাত আলতো করে চেপে ধরলেন আমার হাতের উপর। বললেন, “আমি অন্যায় করেছি।” 
“অন্যায়?” ভুরু কুঁচকে গেল আমার।
সরাসরি উত্তর না-দিয়ে সুবীরদা বললেন, “তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। এক সহপাঠী মেয়ে কানে রঙিন পাথরের ঝুমকো পরে এসেছিল। সেদিন প্রথম পিরিয়ড থেকেই আমি পড়ায় মন বসাতে পারিনি। বারবার চোখ চলে যাচ্ছিল মেয়েটির কানে দুলতে থাকা ঝুমকোদুটোর দিকে। লোভ হচ্ছিল। ওরকম একটা ঝুমকো পরার প্রবল বাসনা হচ্ছিল। এর আগে এধরনের ইচ্ছে হয়নি এমনটা নয়। তবে এই প্রথম ইচ্ছেটা ছিল মারাত্মক রকমের। নিয়ন্ত্রণের অযোগ্য। কুলের আচার বা আলুকাবলির প্রতি যে তীব্র লোভ তার সঙ্গে এটাকে আলাদা করা সেই বয়সে সম্ভব ছিল না। ক্লাসের মধ্যে সহপাঠীদের থেকে এটা-ওটা কত জিনিসই তো চেয়েছি, তাহলে ঝুমকোর বেলায় দোষ কোথায়? 
“টিফিনের সময়ে সবার সামনেই তাই মেয়েটির কাছে ঝুমকো চেয়ে বসলাম। ফল হল মারাত্মক। পবনসহ কয়েকটি ছেলে আমাকে টয়লেটে নিয়ে গেল। দরজা বন্ধ করে ঘিরে ধরল চারদিক থেকে। ওদের মধ্যে কেউ একজন আমার প্যান্টটা টেনে খুলে ফেলল, কেউ জামা। ওরা একে একে আমার পুরুষাঙ্গ টিপে মতামত দিল, নাহ, এ তো ছেলেই। তাহলে এসব বেয়াড়া ইচ্ছে কেন জাগছে বাপু! আমি লজ্জায় কুঁকড়ে গেলাম। ওরা দলে ভারী। ওদের থেকে আমার কাপড় ছিনিয়ে নেওয়া কার্যত অসম্ভব। চোখে জল এসে গেল। হাত জোড় করে কান্নাকাটি করতে লাগলাম। পবন এসে আরও একবার টেনে দেখল পুরুষাঙ্গটা। তার পর জামা-প্যান্ট ফেরৎ দিয়ে আমার পুরুষ হওয়ার সার্টিফিকেট দিল।”
আমার হাত-পা কাঁপছিল। উত্তেজনাটা টের পেলেন সুবীরদা। বললেন, “কী? আমার প্রতি ঘেন্না হচ্ছে তো?” 
আমি ইন্টারনেটে এধরনের ঘটনার কথা অনেক পড়েছি। একটা মানুষের ভিতর অন্য মানুষের বাস। মনকে বন্দি রাখে শরীরের খাঁচা। উড়তে দেয় না। নিজের মতো থাকতে দেয় না। ইচ্ছেপূরণ করতে দেয় না। সুবীরদা এই লড়াই লড়ছেন? 
ক্ষণিকের জন্য অবশ হয়ে গেল আমার চেতনা। পরিচিত কোনো মানুষের থেকে এই অভিজ্ঞতার কথা শুনব, এ আমার ধারণায় ছিল না। এমন সম্ভাবনার কথা মাথায় আসেনি কখনও। কোনওমতে বললাম, “ঘেন্না করব কেন?” 
সুবীরদা অবাক চোখে তাকালেন। আমার থেকে এহেন উত্তর হয়তো আশা করেননি। তাঁর ঠোঁটের কোণে দেখা দিল একটা হাসির আভাস। সে হাসি কি স্বস্তির?
“তাহলে পরের ঘটনা শোনো,” আবার শুরু করলেন সুবীরদা, “ঝুমকোর ঘটনার পর থেকে আমি নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। বয়ঃসন্ধির সময়। যৌনচেতনা তৈরি হচ্ছে ধীরে-ধীরে। আমি বুঝতে পারলাম, বাকি ছেলেদের মতো নই আমি। পবনের মতো নই। আমার কামনা, আমার চাহিদা, জীবনযাপনের ভাবনা ওদের চেয়ে আলাদা। বছর চারেকের মধ্যে আবার একটা ঘটনা ঘটল।
“বেশ কিছুদিন ধরেই সমস্যাটা হচ্ছিল। পাড়ার একটি মেয়ের সঙ্গে ইংরেজির টিউশন পড়তে যেতাম। ওই বয়সেই মেয়েটির বুক খুব সুন্দর গড়ে উঠেছিল। বুকের দিকে বারবার চোখ চলে যেত আমার। সরাসরি নয়, আড়চোখে দেখতাম। ভীষণ হিংসে হত। অসহায় মনে হত নিজেকে। আয়নায় নিজের বুকের দিকে তাকালেই চোখ ফেটে জল আসত। 
“যাই হোক, পরীক্ষার কয়েকদিন বাকি। টিউশন পড়ে ফেরার পথে আমি আর নিজেকে আটকাতে পারলাম না। বলে ফেললাম, ‘তোর বুকটা একবার দেখাবি? এমন সুন্দর বুক অন্য কারোর নেই।’
“মেয়েটি কোনো কথা বলেনি। শুধু জুতো খুলে আমার গালে...”
সুবীরদার গলা ধরে এল। আমি সময় দিলাম তাঁকে। নিজেকে সামলে নিয়ে সুবীরদা বললেন, “সেই দিন আমি বুঝে গেলাম, আমার মনোবৃত্তি বাইরের জগতে প্রকাশের উপযুক্ত নয়। যতক্ষণ আমি অন্যান্যদের সঙ্গে আছি, আমাকে অভিনয় করে যেতে হবে। আবেগকে সংযত রাখতে হবে। আমার শরীরের এই কাঠামো আমার সম্পর্কে সমাজকে বিশেষ বার্তা দেয়। আমার বাহ্যিক জীবনযাপনকে তারই অনুসারী হতে হবে। আমার ভিতরের সত্তার অনুশীলন একমাত্র সম্ভব বন্ধ দরজার নিশ্চিন্ত আড়ালে। তাই করছিলাম... কিন্তু শ্যামলী সব জেনে ফেলেছে। আমাকে মানসিক রোগী, আস্তাকুঁড়ের কীট ছাড়া কিছুই ভাবে না সে।”
এক লহমায় পরিষ্কার হয়ে গেল সবকিছু। সুবীরদার লড়াই তাহলে শুধু তাঁর নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বললাম, “বিয়ে করলেন কেন?”
“সেটাই তো অন্যায়। আসলে মা আমাকে মানসিক রোগী ভাবত। এটা-ওটা বলে বিয়ে ঠেকিয়ে রেখেছিলাম। শেষে মা আত্মহত্যার চেষ্টা করল। একদিন গলায় ওড়নার ফাঁস দিয়ে ঝুলেও পড়েছিল, অল্পের জন্য রক্ষা পায়। মায়ের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল এই সাংঘাতিক অসুখের একমাত্র প্রতিকার হল বিয়ে। একটা মেয়ের সঙ্গে এক বিছানায় রাত কাটালে, তার সন্তানের জন্মদাতা হলেই অসুখ বেপাত্তা হয়ে যাবে।
“কী হাস্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি! প্রতি রাতে শ্যামলী যখন আমাকে দাবি করত, জোর করে আমার সঙ্গে শরীর মেশাত, কী ঘেন্নাটাই না হত! আমি বলে বোঝাতে পারব না। দাঁতে-দাঁত চেপে, মানসিকভাবে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকার চেষ্টা করে কোনোরকমে প্রক্রিয়াটা পার করেই স্নানঘরে ছুটতাম। সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে দেহের প্রতিটি রোমকূপে জমে থাকা ক্লেদ, গ্লানি তুলে ফেলতে চাইতাম। শ্যামলীর স্পর্শের অণু-পরমাণুও যেন চামড়ায় থেকে না-যায়। 
“মধ্যিখানে শ্যামলীর জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেল আরকী! বিয়ের আগে আত্মহত্যাটা বোধ হয় আমারই করা উচিত ছিল। কিন্তু, কী করি বলো, সাহসে কুলোয়নি।”
আমি বললাম, “প্লিজ অমন করে বলবেন না, সুবীরদা! কারোর হাতেই কিছু ছিল না। যা ঘটার ছিল তাই ঘটেছে। এখন ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে। শ্যামলী কি আর একসঙ্গে থাকতে চায় না?”
“সেরকমই। যেকোনওদিন চলে যাবে। টাকাপয়সার সমস্যা হবে না। ও যা যা দাবি করবে, আমি দেব,” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সুবীরদা।
আমি বললাম, “এই ভালো। আর আপনি? আপনার কী হবে?”
“সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না কিছুতেই। এরকমই থেকে যাব নাকি...”
“সার্জারি?”
“হুম।”
“এটা মফসসল, সুবীরদা।” 
“তোমার আশঙ্কা বুঝতে পারছি। কিন্তু এছাড়া আর উপায় কী?... জানো তো, আমার যাবতীয় সমস্যার কথা বুঝেও মা প্রায়ই পিসেমশাইয়ের উদাহরণ দিতেন। পিসেমশাই নাকি কবিতা লিখতেন এককালে। কিন্তু সংসারের আগুনে তিনি তাঁর কাব্যচর্চার আহূতি দিতে বাধ্য হন। পিসেমশাই যদি পেরে থাকেন, তাহলে সুস্থভাবে বাঁচার স্বার্থে, আমিই বা কেন আমার নারীসত্তার বিসর্জন দিতে পারব না! এই ছিল মায়ের যুক্তি।” হাসলেন সুবীরদা। 
বৃষ্টি হচ্ছিল একটু আগে। এই থেমেছে। শ্যামল মেঘ সরিয়ে নরম রোদ মিশে যাচ্ছে আকাশের নীলিমায়। পুব আকাশে রামধনু গজাচ্ছে একটা। সুবীরদা সেই দিকে চেয়ে রইলেন।
অপূর্ব দৃশ্য। একমাত্রিক নীল আকাশের বুকে একটুকরো রামধনু আকাশের সৌন্দর্য কতখানি বাড়িয়ে দিতে পারে, না-দেখলে বিশ্বাস হয় না।
আমি উঠে গিয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়ালাম সুবীরদার। নাহ, আর সুবীরদা নয়। সুমেধা। সুমেধাদি। শুধুমাত্র আমি ব্যবহার করব এই নাম। এটুকুই আমি করতে পারি মানুষটার জন্য। বাকি দুনিয়া এই নামের সঙ্গে পরিচিত হবে কিনা, সে সিদ্ধান্ত সুমেধাদির।
সুমেধাদির কানে ফিস ফিস করে বললাম কথাটা। 
“সুমেধা! সুমেধা!” বারকয়েক উচ্চারিত হল তাঁর মুখে। 
“খারাপ হয়েছে?” 
দু’দিকে মাথা নাড়ালেন সুমেধাদি। মুখে তাঁর মেঘভাঙা রোদের হাসি, চোখের কোণ ভেজা। রামধনুটা এখন জানালার কাছে। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। 
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments