কা লু মা স্টা র ধো লা ই শি ল্পী
অংশু পাণিগ্রাহী
ঝিংচ্যাক মোটোরবাইকটা ঘ্যাঁচ করে থামে উঠোনে। বাইক থেকে নেমে পড়ে দুই ছোকরা। ছেঁড়া-ফাটা জিন্স, গোলগলা গেঞ্জি, গগলস, সবুজ চুল।
কৃষ্ণবিলাস মণ্ডল ওরফে কালু দাওয়ায় বসে বাতাসা দিয়ে শুকনো মুড়ি চিবোচ্ছিল।
"রেডি হয়ে নিন। অনেকটা রাস্তা যেতে হবে তো!" তাড়া দেয় সেই ছোকরাদের একজন।
ভোরের দিকে কালুর মোবাইলে ফোন এসেছিল। জননেতা অর্জুনের নম্বর দেখে কালু ফোন ধরে বলেছিল, "অদ্দিনে মনে পড়লা? ভোটে জিতিকি আমার কথা ত একদম ভুলিচু!"
"ভুলে গেলে কি ফোন করতাম? আরে শোন, বিরাট খবর আছে! অনেকদিন পর আমার নিজের গাঁয়ে এরকম কিছু হচ্ছে। তোর পছন্দের কেস। চলে আয় ভাই।" বলেছিল অর্জুন।
"তোর গাঁ কম করিকি পঞ্চাশ মাইল। ওউ গরমে অদ্দুর যাবা?"
"চিন্তা করছিস কেন? আমি লোক পাঠিয়ে দিচ্ছি। বাইক নিয়ে যাবে। হুশ করে চলে আসবি। খাসির মাংসও আছে। কাজ সেরে খেয়ে-দেয়ে ফিরবি।"
এরপর আর 'না' করতে পারেনি কালু।
গরমের দিন। এর মধ্যেই রোদ যথেষ্ট চড়েছে। মুড়ির বাটি ধুয়ে রেখে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নেয় সে।
রাস্তা অত্যন্ত খারাপ। মাঝে-মধ্যে গর্তে পড়ে যাচ্ছে বাইকের চাকা। শরীর ঝনঝনিয়ে উঠছে কালুর। বয়স হচ্ছে বোধহয়। আজকাল আর খুব বেশি ধকল সহ্য হয় না। চুলে পাক ধরেছে। গায়ে-গতরেও আগের মতো জোর নেই। অবশ্য কালুর যে কাজ, তাতে গায়ের জোরের তেমন ভূমিকা নেই।
গতকাল একটা কেস ছিল। নিজের গাঁয়েই। বছর পঁচিশের এক ছোকরা। টিউশন-মাস্টার। পঞ্চায়েত অফিসে নাকি কী একটা চাকরি নিয়ে ঝামেলা। পঞ্চায়েত প্রধান ঘুষ খেয়ে অন্য একজনকে চাকরিটা দিয়ে ফেলেছে। তাতে টিউশন-মাস্টারের কী রাগ! এই চাকরি নাকি তার ন্যায্য পাওনা! শুধু ঘুষ দিতে পারেনি বলে তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। খুব হম্বিতম্বি করছিল। প্রধানকে 'চোর', 'চিটিংবাজ', 'ছ্যাঁচ্চোড়' বলে গালাগাল করছিল। প্রধান সম্মাননীয় ব্যক্তি, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। সে এসব সহ্য করবে কেন? চট করে সালিশি বসিয়ে ফেলল। তারপর যা হয় আরকী! মাস্টারকে গাছে বাঁধা হল। গন্ধে-গন্ধে কালুও হাজির। তারপর প্রাণটা কোনোরকম রেখে সবাই মিলে আগাপাশতলা ঝাড়াই। কাজ মিটিয়ে, মুরগির মাংস সাঁটানোর পর প্রধান এসে পকেটে পাঁচশো টাকা গুঁজে দেয়। ভরপেট খ্যাটন, তার ওপর পকেটে গরম নোট! কালুকে আর ধরে কে! তারপর আজ আবার এই ফোন। একটার পর একটা কেস! লোকজনের রাগ-হতাশা দিন-দিন যেভাবে বাড়ছে বলবার নয়। কালু বেজায় খুশি। এই না-হলে জীবন! একটাই দুঃখ। নিজের বউটাই তাকে বুঝল না।
ঠিক এক বছর কালুর সঙ্গে ঘর করেছিল প্রতিমা। তারপর ছত্তিসগঢ় না রাজস্থান কোথায় যেন গিয়ে নতুন সংসার পেতেছে। যাওয়ার আগে আঙুল তুলে সে বলেছিল, "অসহায় মানুষগুলাকে মারিকি বীর সাজা হয়েটে? ভেড়ুয়া শালা!"
কালু তখন জোর গলায় বলেছিল, "অসহায় কাকে কউ? সবগুলা ক্রিমিনাল। পাপী। পুলিশ-কেস-কাছারি করলে নামমাত্র শাস্তি হয়। আমি যা করিটি, সেটাই আসল শাস্তি, ওউভাবেই সমাজ ঠিক পথে আগিবে।"
"নির্লজ্জ! ছিঃ!" বলে উঠোনে থুতু ফেলেছিল প্রতিমা, "তুমার মত অমানুষের সাথে আমি রইতে পারবানি। চললি। কওয়া যায় নি, কুনদিন কী অপরাধ করি বুসি! তুমি আমাকে বি গাছে বাঁধিকি… "
এক কাপড়েই হনহন করে হাঁটা লাগিয়েছিল প্রতিমা। আর ফেরেনি।
অভাবের যাপনে সামান্য বিনোদনটুকুও থাকবে না? সবাই তো সমান হয় না। কালু না-হয় তার মতো করে আনন্দ খুঁজে নিয়েছে। তাছাড়া কাজটার মধ্যে গৌরবেরও ব্যাপার আছে। এই সহজ ব্যাপারখানা গাড়ল মেয়েমানুষটার মোটা মাথায় সেঁধোলে তো?
আবার একটা গর্তে পড়েছে চাকা। নিচে খানাখন্দে ভরা বেহাল রাস্তা। ওপরে চাঁদিফাটা রোদ। কালু একটু অধৈর্য হয়েই জিজ্ঞেস করে, "আর কদ্দূর, ভাই!"
চালক ছোকরাটি বলে, "এই তো, চলে এসেছি প্রায়। সাউন্ড-বক্সের গুম-গুম শব্দ শুনতে পাচ্ছেন? ওটা আমাদেরই। দেখবেন শুধু, কী আয়োজন করেছি! মায়ের দিব্যি, এদিকে আগে এরকম বড় করে উৎসব হয়নি।"
"বাবা গো!" কালু অবাক হয়।
"হ্যাঁ, কাকা। জননেতা অর্জুনদাই তো আজকের সব খরচ দিচ্ছেন! অর্জুনদার সাফ কথা, খরচা হোক, মানুষ যেন আনন্দ পায় আর পুলিশের ফালতু ক্যাচাল যেন না-হয়!"
কালু এখন দাঁড়িয়ে আছে গেটের সামনে। ঘাড় তুলে হাঁ করে দেখছে।
"কী হল কাকা? ব্যোমকে গেলেন তো! চলুন, চলুন… ভিতরে চলুন।" ছোকরাদের দলের অনেকেই কালুকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য হাজির।
এ যে বাড়াবাড়ি আয়োজন! নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারে না কালু।
বিশাল আকৃতির গেট তৈরি করা হয়েছে মূল জায়গায় ঢোকার মুখেই। ফ্লেক্স দিয়ে মুড়ে ফেলা হয়েছে সেই গেট।
'স্বাগতম! স্বাগতম! স্বাগতম!
গণধোলাই উৎসব
( পরকীয়ার শাস্তি )'
খাসা ব্যাপার। কালুর মনে হয়, এ জন্ম সার্থক। ধোলাইয়ের কাজ কম করেনি। কিন্তু এর আগে এরকম কিছু দেখেছে বলে মনে পড়ে না। পিলপিল করে মানুষ ঢুকছে কালুকে পাশ কাটিয়ে। কী কাণ্ডটাই না করেছে অর্জুন!
ছোকরাগুলো কালুকে হাত ধরে ভিতরে নিয়ে যায়। রীতিমতো মেলা বসে গেছে। চা, ঘুগনি, লস্যি, আইসক্রিম, মেয়েদের চুড়ি, ফিতে, ইমিটেশন গয়না, বাচ্চাদের খেলনা, মিষ্টি তুলো… হরেক রকমের দোকানপাতি। দু'জন পুলিশ কনস্টেবল একপাশে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম চুষছে। মাঠের ঠিক মধ্যিখানে ঝাঁকড়া অশ্বত্থগাছ। গাছের তলায় গোটাকতক চেয়ার। কালুকে নিয়ে গিয়ে সেই চেয়ারগুলোর একটাতে বসিয়ে দেওয়া হয়। জননেতা অর্জুনের পাশের সীটেই। ফর্সামতো একটা রোগা মেয়ে এসে রক্তচন্দনের ফোঁটা পরিয়ে দেয় কালুর কপালে। স্বয়ং অর্জুন বন্ধুর গলায় গাঁদাফুলের মালা পরিয়ে দিয়ে বলে, "স্বাগতম! তোকে পেয়ে আমরা গর্বিত।"
"আমার খুব লজ্জা করেটে রে অর্জুন।" কালু কোনোমতে বলে।
"রাখ তোর লজ্জা। তুই হলি আমার স্পেশ্যাল গেস্ট। একশোর বেশি গণধোলাই অ্যাটেন্ড করেছিস। এটা বোধহয় গিনিস বুক রেকর্ড।"
"একশ সাতচল্লিশ।"
"বাপরে! মনেও রেখেছিস? তুই সত্যিই সাধক মানুষ। শিল্পী। এত নিষ্ঠা আর ভালোবাসা দিয়ে অন্য কেউ বোধহয় গণধোলাইতে যোগ দেয় না। তুই আমাদের প্রেরণা। দাঁড়া, আমি মাইকে বলাচ্ছি।"
অর্জুনকে বাধা দেওয়ার সুযোগ পায় না কালু। এতক্ষণ আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে বক্স বাজছিল। সেই জগঝম্প বন্ধ হয়ে লাউডস্পিকারে ঘোষণা হয়, "বন্ধুগণ! আপনাদের অপেক্ষার পালা শেষ। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই গণধোলাইয়ের আসর শুরু হবে। আপনারা এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি না-করে মঞ্চের কাছাকাছি চলে আসুন। উপস্থিত আছেন বিখ্যাত ধোলাইশিল্পী, আমাদের জেলার গর্ব, কালু-উ-উ-উ-মাস্টার। তিনিই উদ্বোধন করবেন এই উৎসবের।"
হাততালিতে ফেটে পড়ে গোটা মাঠ। কৌতূহলী জনতা গোল করে ঘিরে ফেলে গাছটাকে। তীব্র গরমে ঘামতে-ঘামতে নিজের হাতে চিমটি কাটে কালু। স্বপ্ন দেখছে না তো? অর্জুন তার একটা নতুন নামই দিয়ে ফেলেছে! ধোলাইশিল্পী একেবারে? গর্বে কালুর ছাতি ছাপ্পান্ন ইঞ্চি। যদি প্রতিমা এখানে থাকত, নিজের চোখে দেখত এসব, সেও কি আর কালুর জন্য গর্বিত হত না? হায় রে, বেচারি! রত্ন চিনতে পারলি না? শিল্পীর জায়গায় কিনা খনি শ্রমিকের সংসার ঠেলছিস! দীর্ঘশ্বাস ফেলে কালু। প্রাক্তন বউয়ের জন্য তার একটু করুণাই হয়।
জননেতার হাতে মাইক্রোফোন যায় এবার।
"প্রিয় বন্ধুগণ, আপনাদের জন্য এই উৎসবের আয়োজন করতে পেরে আমরা ধন্য। গণধোলাই আমাদের ঐতিহ্য, জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এর চেয়ে বড় বিনোদন কী-ই বা হতে পারে! দশ বছর আগে এখানে শেষবারের মতো গণধোলাই আয়োজিত হয়েছিল। সেবার হাড্ডিসার বুড়োটা হাটুরে মার সহ্য করতে পারেনি। পুলিশের অতিসক্রিয়তায় আমরা বাধ্য হয়েছিলাম উৎসব বন্ধ রাখতে। দীর্ঘদিন পর, আজ আবার আমাদের চিরন্তন সেই ঐতিহ্যকে নবরূপে আপনাদের সামনে উপস্থাপিত করতে পেরে আমরা গর্বিত।"
জনতা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে।
জননেতা বলে চলে, "গাছে বেঁধে সবাই মিলে কাউকে ধোলাই দেওয়া সহজ কথা নয়। একটু এদিক-ওদিক হলেই গঙ্গাযাত্রা। পুলিশের ঝামেলা, ধরপাকড়। এই ভয়েই আমাদের বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যমটি প্রায় লুপ্ত হতে বসেছিল। এদিকে সাধারণ মানুষের জীবনে দুঃখ-দুর্দশা-হতাশা-ক্ষোভের শেষ নেই। আপনারা সেই ঝাল মেটাবেন কোথায়? কীভাবে?... তাই গণধোলাই ছিল, আছে, থাকবে। আপনাদের শুধু অনুরোধ, ধোলাই যেন মৃত্যুহীন হয়। অযথা উত্তেজিত হবেন না। ধীরে-সুস্থে আসুন, মারুন, অন্যদেরও সুযোগ করে দিন। আজ যদি এই আয়োজন সাফল্যমণ্ডিত হয়, আমি কথা দিয়ে যাচ্ছি, এবার থেকে প্রতিমাসেই একটা করে গণধোলাই উৎসব করা হবে… এই অশ্বত্থতলাতেই।"
আবার হাততালিতে মুখরিত হয় মাঠ। লাউডস্পিকারে জনতাকে পথ তৈরি করে দেওয়ার অনুরোধ করা হয়। কালু দেখতে পায়, মাঠের এককোণে দাঁড়িয়ে থাকা ক্লাবঘর থেকে টেনে-হিঁচড়ে ধোলাইমঞ্চের দিকে নিয়ে আসা হচ্ছে আসামিকে। একটা যুবতী বউ। ঘামে-সিঁদূরে মাখামাখি হয়ে বীভৎস দেখাচ্ছে মুখটা। বিস্রস্ত শাড়ির আঁচল লুটোচ্ছে মাটিতে। এসব দৃশ্য কালুর গা-সওয়া। আজ অন্য কারণে খানিকটা অস্বস্তি হচ্ছে। এত বড় মঞ্চে কালু তার প্রতিভা প্রদর্শনের সুযোগ পায়নি। মাইকে তার নাম আলাদা করে ঘোষিত হয়েছে। সবকিছু ঠিকমতো উৎরোবে তো?
আসামির শাড়ি খুলে নেয় কয়েকজন। শাড়িকে সরু করে পাকিয়ে দড়ির চেহারা দেওয়া হয়। গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলা হয় তাকে। জনতার সমবেত উল্লাসে চাপা পড়ে যায় আসামির গোঙানি।
ভিড়ের মধ্য থেকে একটা বউ বাম হাতে এক যুবককে বগলদাবা করে, ডান হাতের মুঠো শূন্যের দিকে ছুঁড়ে বলে, "হারামজাদি, আমার সাদাসিধা বরের সাথে ফস্টিনস্টি? আমার সরল বরটাকে ফুসলানোর চেষ্টা? কালুবাবুর হয়ে গেলেই যেন আমাকে মারতে দেওয়া হয়!"
যুবকটি মাথা নামিয়ে নেয়।
"সবাই সুযোগ পাবে, সবাই সুযোগ পাবে" বলতে-বলতে ভিড়কে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক।
কালু লক্ষ করে, আসামি একদৃষ্টে চেয়ে আছে নতমস্তক যুবকটির দিকে। সময় নষ্ট না-করে আসামির মুখোমুখি দাঁড়ায় সে। চুলের মুঠি ধরে বাঁশের ছড়ি দিয়ে সপাং করে বসিয়ে দেয় বাম ঊরুতে।
গণধোলাই শুরু। জনতার সমবেত গর্জন শোনা যায়। লাউডস্পিকারে বাজতে থাকে অ্যাকশনের মিউজিক। ঢিচকাও, ঢিচকাও…
মার দিয়েই কালু বোঝে, ব্যাপারটা জুতসই হল না। আজ কীসের যেন একটা অভাব।
সাধারণত এইসব মুহূর্তে আসামির চোখে দেখা যায় আতঙ্ক, শোনা যায় কাতর অনুরোধ। কালু তখন উৎসাহিত হয়ে ওঠে। কিন্তু আজ সবটা অন্যরকম। তার হিসাবের বাইরে। বিস্মিত কালু দেখে, আসামির মধ্যে বড়সড় একটা পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে দ্রুত। ভাঙচুর হচ্ছে তার মুখরেখায়। সে আর এখন আগের মতো গোঙাচ্ছে না। বরং ঠোঁটের কোণে ধীরে-ধীরে ফুটে উঠছে করুণা মিশ্রিত বিদ্রুপের হাসি। চোখে আতঙ্কের পরিবর্তে ঘৃণার ঝিলিক। দৃষ্টি এখনও সেই যুবকটির উপর নিবদ্ধ।
কালু বেপরোয়া হয়ে আর-এক ঘা দেয়। এবার ডান ঊরুতে।
আসামি বউটা এবার যেন একটা ঘোর ভেঙে জেগে ওঠে। কালুর দিকে তাকায়। বুক কেঁপে ওঠে কালুর। বউটার চোখের আঁচ নিজের শরীরে টের পায় সে। পিছিয়ে আসে দু'পা। ক্রুদ্ধ সাপিনির মতো ফুঁসতে-ফুঁসতে বউটা যেন বিষ ঢেলে দেয়। একদলা থুতু এসে পড়ে কালুর মুখে।
হাত-পা কাঁপছে। কুলকুল করে ঘামছে কালু। সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে। হাত থেকে ছড়ি খসে পড়ে তার। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে কালু। তার অবস্থা দেখে কয়েকজন ছুটে আসে।
"কী হল দাদা! গরমে মাথা ঘোরাচ্ছে? কেউ পাখা নিয়ে আয়, জল…"
কালু জল খায়। ফ্যালফ্যাল করে একবার তাকায় জনতার দিকে, আর-একবার গাছে বাঁধা বউটার দিকে। জনতা ফুঁসতে থাকে তীব্র আক্রোশে।
অর্জুন ছুটে আসে, "কী হল রে কালু? শরীর খারাপ লাগছে?... এই এই, তোরা কালুবাবুকে নিয়ে যা। ফ্যানের তলায় বসা। লাঞ্চটা এখনই দিয়ে দে। খাসি মাংস পেটে পড়লে শরীরে বল আসবে। আমি এদিকটা দেখছি। পাবলিক ক্ষেপে গেছে। আজ একটা খুনোখুনি না-হয়ে যায়!"
মাঠ থেকে ক্লাবঘরে এনে কালুকে চেয়ারে বসিয়ে দেওয়া হয়। টেবিলে সাজিয়ে দেওয়া হয় ভাত, স্যালাড, চিংড়ির মালাইকারি, খাসির ঝোল। এক গ্রাস মুখে দেয় কালু। গিলতে পারে না। তার আগেই হড়হড় করে বমি। মাথার উপর ফুলস্পিডে পাখা ঘুরছে। তবু দরদর করে ঘামছে সে। বুকে একটা চিনচিনে ব্যথা। সবাই মিলে মেঝেতে চাটাই পেতে শুইয়ে দেয় তাকে।
কালু এখন ক্লাবঘরের মেঝেতে শুয়ে। শরীর কিছুটা সুস্থিত। জানালা দিয়ে শেষ বিকেলের আলো এসে মুখে পড়ছে। কালু একদৃষ্টে চেয়ে আছে ঘুরন্ত পাখার দিকে। চোখের সামনে বারবার ভেসে আসছে প্রতিমার মুখ। কিছুতেই মুছে ফেলা যাচ্ছে না। কানে বারবার ধ্বনিত হচ্ছে প্রতিমার শেষ কথাগুলো।
শেষের দিনগুলোয় প্রতিমা প্রায়ই বলত, "অসহায় লোকগুলা ঘুরিকি মারতে পারেনি। ভয়ে গুটি যায়। একদিন দেখব, মানুষগুলা সাহসী হবে। থুতু দিবে তোমার মুহে। সেদিন… সেদিন তুমার সুইসাইড করতে ইচ্ছা হবে।"
প্রতিমার কথাগুলো চাবুকের মতো বারবার আছড়ে পড়ে কালুর গায়ে। বুক ফাটিয়ে একটা অস্ফুট গোঙানি বেরিয়ে আসতে চাইছে। দমচাপা একটা অস্থিরতা তিলে-তিলে জাপটে ধরছে তাকে। এতটা অসহায়তা এর আগে কখনও অনুভব করেনি কালু। প্রতিমার গৃহত্যাগের পরও নয়। মনে হয়েছিল, বউ গেল তো কী হয়েছে! তার প্রিয় নেশা তো রইল। কিন্তু আজ যেন সব অর্থহীন মনে হয়। একটাই প্রশ্ন মাথায় ধাক্কা দিচ্ছে বারবার, প্রতিমা কথাই কি তাহলে ঠিক? সত্যিই সে ভেড়ুয়া? হ্যাঁ, তাই হবে। সত্যিই তো আজ সে দাঁড়াতে পারেনি বউটার দুর্জয় সাহস আর তীব্র ঘৃণার সামনে। অসহায়-নিরস্ত্র বউটা তাকে একেবারে জব্দ করে দিয়েছে।
উঠে পড়ে কালু। ক্লাবঘরে কেউ নেই। মাঠের দিক থেকে হইহল্লার শব্দ ভেসে আসছে। চেয়ারের নিচে একগোছা দড়ি। নির্ভীক বউটাকে সম্ভবত এই দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল। দড়ির গোছাটা হাতে তুলে নেয় কালু। নিশ্চল হয়ে বসে থাকে খানিকক্ষণ। তারপর দৌড়… দে দৌড়...
কালু দৌড়চ্ছে। ঝোপ-ঝাড় ভেঙে, খানা-খন্দ ডিঙিয়ে। এই মাঠ, গণধোলাইয়ের আয়োজন থেকে দূরে, বহুদূরে। পিছনে অর্জুন। তার পিছনে পুলিশ দু'জন। তারও পিছনে জনতা। কালু ওরফে কৃষ্ণবিলাস মণ্ডল, এদের হাতে ধরা দিতে চায় না। তার এখন দরকার একটা নিভৃত জায়গা, আর-একটা জুতসই গাছ।
🍂
1 Comments
অনন্নসাধারন ভাবনার গল্প
ReplyDelete