যেসব কথা লেখা হয় না
পর্ব- ১২
সুমনা সাহা
“স্মৃতির কাছে হাত পেতে পেতে বাঁচা। স্মৃতিরই আর-এক নাম জীবন। স্মৃতি নাই তো জীবনও নেই।”১
একটু একটু করে বড় হচ্ছি। সম্পর্কের সমীকরণও একটু একটু করে বদলে যেতে দেখছি। আমার রেজাল্ট আর বোনের রেজাল্টের মধ্যে বিস্তর ফারাক দেখা দিতে আরম্ভ করল আর ভালবাসার জায়গায় হিংসার বীজ একটু একটু করে গেঁথে যাচ্ছিল ওর মনে, সে ব্যাপারে মা-বাবা তখন একেবারেই আমল দেয়নি। রেজাল্ট বের হলে বাবা বোনকে ডেকে বলত, “শোন, কি করলে মাথা খুলবে, তার একটা উপায় বলে দিচ্ছি। তুই একটা কাজ করবি।” বোন সরল মনে ভাবত, বাবা একটা দরকারি কথা বলে দেবে। বাবা খুব রসিয়ে রসিয়ে বলত, “সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে একটা কাপে হাফ কাপ জল নিবি। তারপর কাপটা নিয়ে দিদির কাছে যাবি। ওর ডান পায়ের বুড়ো আঙুল ওই কাপের জলে কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখবি। তারপর ওই জল খাবি। এরকম রোজ সকালে খাবি। তাহলে তোর মাথা খুলবে।” সবাই হো হো করে হেসে উঠত। আমার লজ্জা লাগত, প্রতিবাদ করতাম, “বাবু, এসব কি বলছ?” কিন্তু মা, দাদা আর ছোট বোনদের হাসি ওকে ক্ষিপ্ত করে তুলত। চিৎকার করে ও স্থান ত্যাগ করত। বাবার এই নিতান্ত রসিকতাই ওর মনে বুনে দিচ্ছিল হিংসার বীজ, প্রতিযোগিতার মনোভাব আর আমার প্রতি অন্ধ অনুরক্তির পরিবর্তে তীব্র এক প্রতিহিংসার বোধ। আর দুই বোন খুবই ছোট, তখনও তুলনার জায়গায় আসেনি। তবে আমার সঙ্গে পিঠোপিঠি বোনের মেধার সেই তুলনা তৃতীয় মনেও যে ভীতির সঞ্চার করছিল, সেটা বোঝা গেল অনেক পরে, যখন সে বাড়িতে রেজাল্ট দেখানো বন্ধ করেছে। একদিন মা জিজ্ঞেস করল, “কিরে তোদের রেজাল্ট বেরিয়েছে না? কই দেখলাম না তো!” ও অবলীলাক্রমে মিথ্যে বলত, “বাড়িতে দেয়নি রিপোর্ট কার্ড, স্কুলেই দেখিয়ে ফেরত নিয়ে নিয়েছে।” অবশেষে একদিন স্কুলে গিয়ে ওর ক্লাস টিচারের সঙ্গে দেখা করে মা জানতে পারল, দিনের পর দিন নানা বিষয়ে খারাপ নম্বর পেয়েছে। মা বলল, “আমি তো কিছু জানি না!” “সেকি?” আকাশ থেকে পড়লেন ঐ দিদিমণি, “আমি তো রিপোর্ট কার্ড বাড়িতে দেখার জন্য পাঠিয়েছি। গার্ডিয়ানের সই করিয়ে আনতে বলেছি। হ্যাঁ, ও তো বাবাকে দিয়ে সই করিয়ে এনেই আমাকে ফেরত দিয়েছে!” তারপর মা দেখল, প্রত্যেক (কোয়ার্টার্লি) পরীক্ষার রেজাল্টের নিচে বাবার ‘নকল’ সই করেছে বোন স্বয়ং! বাড়িতে সেই ঘটনা নিয়ে হুলুস্থুল পড়ে গেল। বাবা যাচ্ছেতাই করে বলতে লাগল, “অ্যাঁ! এতবড় সাহস তোর? তুই আমার সই নকল করেছিস!” আর অপমানে সেজবোনের মুখ লাল টকটকে হয়ে উঠল। মুখ ঢেকে সে কাঁদতে লাগল। আজকাল ‘প্যারেন্টিং’ নিয়ে কত কথা বলা হয়। এখন মনে হয়, সেসময় ওইরকম একে অপরের সঙ্গে তুলনা করা বাবার একদম উচিৎ হয়নি। তাঁরা তো চলে গেছেন। কিন্তু কয়েকটি শিশুমনের মধ্যে দুর্লঙ্ঘ্য পাঁচিল তুলে দিয়ে গেছেন, অবচেতনে যা ক্রমশ হয়ে উঠেছে আরও উঁচু, আরও মজবুত। আমার একটিই সন্তান। নিজের জীবনের শিক্ষা থেকেই কখনও তার সঙ্গে ঘুণাক্ষরেও অন্য কারো তুলনা করিনি। সবসময় বলেছি, ‘তুমি পারবে, এই তো দারুণ হয়েছে!’ উৎসাহ আর আশা দিয়ে বড় করে তুলেছি। তবে এটাও ঠিক, প্রত্যেক মানব-মন আলাদা। কে যে উৎসাহে ভাল ফল করবে, আর কে-ই বা তুলনায় উদ্দীপিত হয়ে উঠবে, বলা সহজ নয়।
এই যে রেষারেষি, ঝগড়াঝাঁটি, এসব কিছুই কিন্তু বেশিক্ষণ স্থায়ী হত না, যেন জলের দাগ। মুহূর্তে মিলিয়ে যেত, আবার গলাগলি ভাব, ছোটবেলার ধর্মই এমন! হয়তো দুজনের তুমুল ঝগড়ার মাঝখানে শোনপাপড়িওয়ালার ডাক শোনা গেল—“শোনপাপড়ি সন্দেই... চন্দপুলি ক্ষীরের সন্দেই...,” ব্যাস আমরাও সব ভুলে ছুটতাম। ছোটবেলার ফেরিওয়ালাদের ডাক বোধহয় মনের মধ্যে সংস্কারের দাগের মত বসে গেছে, এ-জীবনে আর ভুলব না। আর আসত প্রচুর ভিখারি। এখন নানা মঠে-মিশনে-আশ্রমে সদাব্রত হয়েছে, পাড়ায় পাড়ায় ভিক্ষা মেগে ফেরা ভিখারির বলতে গেলে দেখাই মেলে না। আমাদের পাড়ায় কিন্তু নানা বৈচিত্র্যময় ভিখারি আসত। বোষ্টুম ভিখারির কাপড়ের ঝোলায় মা চাল, আলু, কাঁচকলা ঢেলে দিত। তাঁরা খঞ্জনী বাজিয়ে গানও শোনাতেন। একজন বোষ্টম আমাকে বলেছিল, “চালুনিতে যেভাবে চাল বাছে, তেমন করে মানুষ বাছতে হয়, কাঁকড়গুলো ফেলে দিতে হয়!” সেকথা তখন আমার দুর্বোধ্য মনে হয়েছিল, বড় হয়ে সেকথার মর্মার্থ বুঝেছি বটে, কিন্তু এখনও কি মানুষ বেছে নিতে শিখেছি? শ্রীশ্রীসারদা মায়ের বাণী ‘যেখানে যেমন সেখানে তেমন, যাকে যেমন তাকে তেমন’, তার প্রয়োগও তো জানি না! কোথায় কেমন আচরণ করব? কাকে কেমন দেব? জিতলে জিতলাম, মায়ের কৃপা, ঠকলে ঠকলাম, সেও মায়ের ইচ্ছা! এইটুকুই বুঝি। এক ভিখারিণী আসত মাসে একবার। পাড়া ফাটিয়ে হাঁক দিত—“ওমা ছেঁড়া কাপড় দে মা! ছেলেপুলে ল্যাংটা রে মা!” নিজে পরে আসত একখানা শতচ্ছিন্ন কাপড়। প্রত্যেক মাসেই মা তাকে নিজের একখানা সুতি কাপড় দিত। একবার মা বলল, “তোমাকে যে এত কাপড় দিই, সেসব কি করো? বিক্রি করো, তাই না? আজ কাপড় দেব না। ভাত খাবে?” সে রাগ করে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকল। মা বারবার বলল, “এত চিৎকার করতেও তো শক্তি লাগে? কখন বেরিয়েছ ঘর থেকে? আমি বলছি আজ তুমি দুটো খাও। বেশ, কাপড়ও দেব।” এইবার হাসি ফুটল তার মুখে। দরজার সামনে সিঁড়িতে খেতে বসল। প্রথমে এক থালা ভাত কেবল নুন দিয়েই খেয়ে ফেলল। আমাদের তো চোখ কপালে উঠেছে। মা ওখান থেকে আমাদের সরে যেতে বলল, নাহলে সে অস্বস্তি বোধ করছে। পেট ভরে খাবে না হয়তো, মা-র এই চিন্তা। আমরা তবুও আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছি। প্রত্যেক তরকারির সঙ্গে সে এক এক থালা ভাত সাবাড় করছিল। উচ্ছে ভাজা দিয়ে এক থালা, ডাল দিয়ে এক থালা, শাক দিয়ে আরেক থালা, মাছ দিয়ে আরও এক থালা। আমরা বললাম, “যাহ! সব ভাত খেয়ে ফেলল যে!” মা ঝুলন মাসিকে আবার ভাত বসাতে বলল। সে তখন মায়ের দেওয়া কাপড়খানা বগলে চেপে সিঁড়িতে গড়িয়ে পড়ল। তার ভাত ঠুসে ফুলে ওঠা পেটটা নাসিকা গর্জনের তালে তালে ওঠানামা করতে লাগল। অনেকক্ষণ বাদে ঘুম ভাঙতে মুখের সামনে আমাদের দেখে সে বিকট এক তাড়া দিয়ে চলে গেল। এইরকম বিচিত্র সব চরিত্রদের আনাগোনা লেগে থাকত দেখেছি।
আর শীতের দুপুরে আসত সাপের খেলা দেখাতে, বাঁদর আর ভাল্লুকের খেলা দেখাতে, আর দড়ির সার্কাস দেখাতে। একটা প্যাঁটরায় কুণ্ডলী পাকানো সাপ রাখা থাকত। সেটাকে প্রথমেই বের করত না। নানা কথা বলে, হুম হাম হুঙ্কার ছেড়ে সে সাপটাকে ডাকত, “অ্যাই ব্যাটা কেউটে, ভাল চাস তো পিটারা থেকে বেরিয়ে আয় বলছি! শালার ঘুম বড্ড বেড়েছে গো! নে নে ওঠ ওঠ, বাচ্চালোগ খেলা দেখবে, দাদা দিদি পয়সা দিবে, তুকে হামি ব্যাং খাওয়াব, ইন্দুর খাওয়াব, ওঠ রে আমার রাজা বেটা!” এইসব বকবকর করত, আর বাচ্চাদের মধ্যে হাসির হুল্লোড় পড়ে যেত। তারপর ঝুড়ির মুখে পাগড়ির মত পেঁচিয়ে রাখা কাপড়ের আস্তরণ খুব ধীরে ধীরে সাসপেন্স রেখে সরাত, আর বীণ বাজাত। বীণের কাঠি দিয়ে খোঁচাও দিত। এবার ভিতর থেকে কালো কুচকুচে একটা সাপ বেরিয়ে ফনা দোলাতে আরম্ভ করত। আর ভীড়ের মধ্যে ‘চিয়ার’ ধ্বনি উঠত। লোকটা আবার ভয় দেখাত, “এ বহুত হারামি আছে, কাট লেঙ্গে, সব দূর হঠ যাও!” আরেকটা থুত্থুরে বুড়ো আসত একটা বিরাট অজগর সাপ গলায় পেঁচিয়ে, হাঁক দিত, “ফোঁড় কে লেঙ্গে ফোঁড় কে!” আমাদের পিসতুতো ভাইয়ের সবচেয়ে ফেভারিট ছিল ওই বুড়ো, আমাদের রান্নাবাটির আসরে এসে তার ছেলেমানুষি উচ্চারণে ঘোষণা করত, “চলে আয়রে, ভুড় গ্যালেঙ্গে আইলো!” কচি ছেলেপিলের দল বুড়োকে ঘিরে ধরত, নানা প্রশ্ন, “এর বয়স কত? এ কি খায়?” বুড়ো বলত, “এ হামার ছেলে আছে। আভি তো এ বাচ্চা আছে, খালি দুধ উধ খায়, তিন মাস বয়স আছে। আউর বড় হোবে, তখন গরু ছাগল সব খাবে।” আমরা আতংকিত চোখে একে অপরের দিকে তাকাতাম। পয়সা কালেক্ট করে বুড়ো দুপুরের রোদের তাপ এড়িয়ে ফলসা গাছের নিচে শুয়ে পড়ত তার ছেলেকে ঝুড়িতে ভরে, তার উপর মাথা রেখে। হাঁ মুখে মাছি ভন ভন করত, লুঙ্গি উঠত মাথায়। কেউ কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলেই বুড়ো প্রচুর চোটপাট করত, “আমার ছেলেকে বের করব পিটারা থেকে?” আর বাচ্চারা ছুট দিত। শীতের মরসুমে দড়ির সার্কাস দেখাতে আসত একটি পরিবার। স্বামী, স্ত্রী আর তাদের তিনটে ছেলেমেয়ে। ছোটটা একেবারেই ছোট্টটি। মা তাকে কোলে নিয়ে বসত, বাবা রাস্তার দুধারে দুটি বাঁশ অস্থায়ী ভাবে দাঁড় করিয়ে তার উপরে দড়ি টাঙিয়ে দিত। বড়-মেজ বাচ্চাদুটো ঐ দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে যেত শূন্যে। একেবারে খোলা রাস্তায়, খটখটে দিনের আলোয়, কোন আলোছায়ার কারসাজি নয়, স্টেজের আলোর সাজসজ্জা নয়, নির্জলা ট্যালেন্ট। সবশেষে ঐ ঘুমন্ত কচি ছানাটাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে বীভৎস বেগে বনবন করে ঘোরাত। দেখে সবার গা শিরশির করত। বড়রা বারণ করলে বলত, “বাবু পেট চালাতে হবে!”
বাবার যখন দূরে দূরে ডিউটি পড়ত, আমরা অনেকদিন দেখাই পেতাম না। হয়তো অনেক রাত্রে আসত, আবার ভোর হতে না হতেই বেরিয়ে যেত। বর্ষার কয়েকটি সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে। বাবা এসেছে ইলিশ মাছ নিয়ে। বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি। সন্ধ্যা থেকেই কারেন্ট নেই। কেরোসিনের লণ্ঠন জ্বলছে। বাবা বলত, “এমন বৃষ্টির দিন, আজ খিচুড়ি করো, আর ইলিশ মাছ ভাজো।” অন্ধকারে সেদিন পড়াশুনো বন্ধ। মা মাসিকে নিয়ে রান্নাঘরে রাতের খাওয়ার তোড়জোড় করতে ব্যস্ত, আমরা বাবাকে ধরে বসতাম, “বাবু সেই মেছোভূতের গল্প বলো না?” বাবু হাসত, “সেই গল্প আবার? কতবার শুনবি?” এখন মনে হয়, ছোটরা বোধহয় একই গল্প বারবার শুনতে ভালবাসে। আমাদের সমবেত আবদারে বাবা শুরু করত দাদুর মেছোভূতের পাল্লায় পড়ার গল্প।
“একবার হয়েছে কি, বাবা হাট থেকে একটা বিরাট ইলিশ মাছ কিনেছে। কচুপাতায় মুড়ে সেই মাছ নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিয়েছে। যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বিকেল থেকেই মেঘ জমেছিল আকাশ কালো করে। বাবা হাট পেরিয়ে যেই মাঠের মধ্যে দিয়ে গ্রামে যাবার মেঠো আলপথ ধরেছে, অমনি আরম্ভ হয়ে গেল মুষল ধারে বৃষ্টি। ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। কিচ্ছু দেখা যায় না। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকে উঠছে, সেই আলোয় পথ দেখে পা টিপে টিপে বাবা যাচ্ছে। এমন সময়...,” ব্যাস, এই পর্যন্ত বলার পরেই বোন লাফিয়ে উঠে যেত বাবার কোলে। যে কিনা ঠিক করেছিল রেজাল্ট বেরনোর পর ও-হেন অপমানের পর বাবার সঙ্গে এ-জীবনে আর বাক্যালাপ করবে না, সেসব সে একেবারেই ভুলে যেত। আর সেজটা আমার কোলে লেপ্টে বসে থাকত। ছোটটা বেশিরভাগ সময়েই মা-র পিছন পিছন ঘুরঘুর করত। তবে গল্প শুনতে সেও উপস্থিত থাকত মনে হয়। তারপর বাবা বলে চলত, “বাবার মনে হল, কে যেন পিছন পিছন আসছে। কড়া গলায় বাবা জিজ্ঞেস করল, ‘কেরে তুই? কি চাস?’ খোনা গলায় একজন বলল, ‘মাঁছটা দিঁবিঁ?’ বাবা তখন বাঁ হাতে মাছটা নিয়ে ডান হাতে পৈতেটা জড়িয়ে ‘রাম রাম’ জপতে আরম্ভ করল আর জোরে জোরে হাঁটা দিল। পিছন থেকে সেই খোনা সুর বলেই চলল, ‘মাঁছটা দেঁ নাঁ রে? বড্ড লোঁভ লাঁগছে!’ বাবা বাড়ি পৌঁছে মাছটা উঠোনে রেখে মা-কে ডেকে বলল, ‘মাছটা রান্না কোরো না, ওতে ভূতে লোভ দিয়েছে। তুমি ওটা লবণ হলুদ মাখিয়ে ভাল করে ভেজে ফেলো।’ ঠাকুমা নাকি দাদুর কথামত মাছ ভেজে কলাপাতায় ঢেলে উঠোনে রেখে দিয়েছিল। দাদু তখন চেঁচিয়ে বলল, ‘নে এবার যত প্রাণ চায় খা। কিন্তু খেয়ে ভদ্রভাবে চলে যাবি। যাওয়ার আগে প্রমাণ দিয়ে যাবি যে তুই চলে যাচ্ছিস। আর আসবি না, মনে থাকে যেন। আমি ব্রাহ্মণ সন্তান। নাহলে কিন্তু তোকে বেলগাছে ব্রহ্মদত্যি করে আটকে রাখব।” তারপর সব মাছের টুকরো এক এক করে শূন্যে মিলিয়ে গেল আর একটু পরে উঠোনের বেল গাছের একটা ডাল মড় মড় করে ভেঙে পড়ল। বাবা বলল, ‘আপদ বিদায় হল। এবার আমাকে চারটি ভাত দাও, লবণ লংকা দিয়ে খেয়ে ফেলি’।”
বাইরে বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ব্যাঙের ডাক আর ক্রি রি রি রি করে একটানা ঝিঁঝিঁর ডাক। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা খিচুড়ি আর মাছ ভাজার গন্ধে আমাদের খিদেও রি রি করে উঠত। মা ডাকত, “সবাই খেতে এসো,” আর আমরা এক লাফে খাওয়ার ঘরে। চারদিকে গোল করে ঘিরে পিঁড়ি পেতে, মাঝখানে খিচুড়ির হাঁড়ি নিয়ে অন্নপূর্ণার মত হাতা হাতে নিয়ে মা রেডি, বাবা বলল, ‘গন্ধরাজ লেবু আছে না?’ সেই আবদারও রাখা হত। গরম গরম ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি, ইলিশ মাছ ভাজা, বেগুনী, সঙ্গে গন্ধরাজ লেবু। আহ, স্বাদ আর গন্ধের রায়ট যাকে বলে। আমি কত কিছু ভুলে যাই। কিন্তু কেন জানি না, রাত্রে কখনও ঘুমের ঘোরে ঘন বৃষ্টির শব্দ শুনলেই সেই ভূতের গল্পের সন্ধ্যাগুলো স্পষ্ট অনুভব করি আজও।
জীবনের রস জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। একেবারে কাঁচা তরল খেজুর-রস গাঢ় হতে হতে গুড় প্রস্তুতির নানা পর্যায়ে যেমন এক একরকম স্বাদ, তেমনই জীবনেরও নানা স্বাদের স্মৃতি—নিজের স্মৃতির ভীড়ে যোগ দিয়েছে অন্যের স্মৃতি, অন্যের স্মৃতির অন্য মুখে কথনের স্মৃতি, আমার ভুলে যাওয়া দিনের ভিন্ন মুখে ভিন্ন চর্চার ভিন্ন স্বাদের পরিবেশনার স্মৃতি, কত বেদনার স্মৃতি, সুখের স্মৃতি, আনমোল রতনের মতো বুকের গভীরে আগলে রাখা ভালোবাসার স্মৃতি, অপমান-প্রশংসা-স্বীকৃতি-সাফল্য-ব্যর্থতার অনুপম সব স্মৃতির অজস্র গাথা, প্রথম দেখা ম্যাজিক শো-এর স্মৃতি, মনে মনে প্রেমে পড়ার ও নিঃশব্দে সেই প্রেম নিভে যাওয়ার স্মৃতি, বিরহের জ্বালাপোড়ার স্মৃতি, বেড়ানোর নানা অভিজ্ঞতার সাদাকালো স্মৃতি, মেলায় প্রথম নাগোরদোলায় চড়ার স্মৃতি, ঝড়ের গঙ্গায় উথালপাথাল নৌকাযাত্রার স্মৃতি, প্রথম চুম্বনের স্মৃতি, মুর্শিদাবাদে মামাবাড়ির বিরাট ছাদে শুয়ে অন্ধকার রাতে আকাশ ভরা নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে কিশোরী মনে প্রথম ব্রহ্মাণ্ডের ধারণা উপলব্ধির স্মৃতি, বিয়ে হয়ে গেলে মেয়েদের গোত্রান্তর হয়, পিতৃকুল থেকে সে হয়ে যায় শ্বশ্রূকুলের একজন, সেটি কেবল মন্ত্রে নয়, বাস্তবে কিভাবে বিনা মন্ত্রপাঠেও হয়ে যায়, তার প্রথম অনুভবে যন্ত্রণার স্মৃতি, বিশ্ব চলচ্চিত্রের ভুবনে প্রবেশের আনন্দের স্মৃতি ও নিজেকে অনন্ত ভুবন মাঝে বিস্তারিত করে দেওয়ার মানস অনুভবে তৃপ্তির স্মৃতি, মা হওয়া এবং ক্রমে মা হয়ে ওঠার বিবর্তনের রূপরেখার স্মৃতি—অগণ্য স্মৃতি নক্ষত্রের মতো ফুটে আছে মনের আকাশে। তারপর একদিন জীবনের রস আরও গাঢ় হলে সব স্মৃতি পাটালির মতো সঞ্চিত হয়ে পড়ে থাকবে। জানি না, কারও কোন কাজে লাগবে কি না! কিম্বা সভ্যতার ধ্বংসস্তুপের মধ্যে থেকে নতুন আবিষ্কারের আলোয় একটি ভাঙা আয়না, চিরুণি কিম্বা হাত ছেঁড়া পুতুলের মতো কেউ কেউ ঘুম ভাঙা চোখে বিব্রত চেয়ে থাকবে! আমার স্মৃতিচারণের মন অ-মন হয়ে মিলাবে শূন্যে—‘কোন অনেক দূরে, উদাস সুরে, আভাস যে কার পাই রে!’ যুগ যুগান্তের সঞ্চিত স্মৃতির কণা আলোর ফুলকির মতো জুড়ে যাবে আরও অগণ্য স্মৃতির মণিমাণিক্যের সঙ্গে। আমি তখন ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে’ ধাইব আমার পরিচয়হীন সত্তা নিয়ে, ‘বিনারেখার পথ’ ধরে।
(আপাতত সমাপ্ত)
[পাদটীকা-১ স্মৃতি, না কি জীবন?, পবিত্র সরকার (১৯৩৭); জ্বলদর্চি ২৩ বর্ষ, নবম সংখ্যা]।
[স্বীকারোক্তি- গত পর্বে (পর্ব-১১) ‘বালানন্দ মন্দির’ তৈরি হওয়ার কথা বলেছি। সেটি আসলে ওঙ্কারনাথ মন্দির। বি টি রোড, ডানলপের মোড়ে যে রাস্তাটা দক্ষিণেশ্বরের দিকে গেছে, সেই রাস্তায় কিছুদূর এগিয়ে গেলেই সীতারাম দাস ওঙ্কারনাথ মন্দির। সেটির নির্মাণ ও পরিবর্ধনের একটি স্তর চাক্ষুষ করেছিলাম। অসাবধানতাবশত মন্দিরের নাম ভুল লেখার জন্য পাঠকের কাছে ক্ষমা চাইছি। ছোটবেলার চোখে, ছোটবেলার মন নিয়ে দেখা সময়ের একটি খণ্ডচিত্র ‘যেসব কথা লেখা হয় না’। রাতের স্বপ্ন যেমন সকাল হলেই মিলিয়ে যায়, স্মৃতিও তেমন—এর অস্তিত্ব কেবল মনে, বাস্তবে তাকে খুঁজে বেড়ানো অর্থহীন।]
0 Comments