জ্বলদর্চি

মার্কেজের খোঁজে(নবম পর্ব)/মলয় সরকার

কার্তাহেনার সমস্ত বাড়ির জানালার ঢঙ

মার্কেজের খোঁজে
(নবম পর্ব)

মলয় সরকার


আমরা টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকলাম। ভিতরে যাওয়ার পথটি মাটি থেকে সোজা উঁচু হয়ে  উঠেছে, অর্থাৎ উপর থেকে ঢালু হয়ে নীচে নেমে এসেছে।এটি কার্তাহেনাকে অনেক যুদ্ধ (১৬৯৭ সালে ফরাসীদের আক্রমণ, ১৭৪১ সালে ব্রিটিশ আক্রমণ ইত্যাদি ছাড়াও অনেক যুদ্ধ) ও জলদস্যুদের আক্রমণ থেকে বাঁচিয়েছে। পরবর্তী কালে এই দুর্গ নানা অনুষ্ঠানের উপলক্ষ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। ১৯৯৫ সালে Non Aligned Movement সম্মেলন, ২০০০ সালে Rio Group সম্মেলন ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়। এখানে বেশ কিছু সুড়ঙ্গ পথ রয়েছে। তার মধ্যে মাত্র দু একটিই  এখন খোলা রয়েছে।আমরাও ঢুকে দেখলাম একটি সুড়ঙ্গের ভিতর।
এর উপর থেকে শহরের বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়।সামনে সমুদ্র ,দূরে বন্দর দেখা যাচ্ছে যেটি অতি প্রাচীন কাল থেকেই দেশের খুব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। আজও দেশের বাণিজ্য, যাতায়াতের থেকে আরম্ভ করে রূপা ও অন্যান্য ধাতুর ক্ষেত্রে এক বিরাট অংশই এই বন্দরের উপর নির্ভরশীল।
এখান থেকে বেরিয়ে আমরা চললাম শহরের দিকে। ফেরার পথে আমাদের বাস থামল একটা বালিয়ারীর ধারে। সেখানে দেখি একটা জায়গায় করা আছে বড় করে “ I Love Cartagena “ এই লেখাটি।অনেকেই এর সাথে ছবি তুলল। বাস চলছে যে রাস্তা দিয়ে, তার আশে পাশে দেখে কিন্তু আমাদের দেশের কিছু কিছু অংশের কথাই মনে হচ্ছিল। বার বারই মনে পড়িয়ে দিচ্ছিল, এরা আমাদের দেশের মতই গরীব দেশ।
দরজায় কাটা ছোট দরজা ও হ্যাণ্ডেলে কুমীরের মূর্তি গৃহস্বামীর সামাজিক অবস্থান বোঝাতে

শেষে আমাদের গাড়ি ফিরে এসে আমাদের সেই Walled cityর ভিতর ঢুকে আমাদের ছেড়ে দিল।তারপর আমাদের গাইড ছেলেটি আমাদের শহর দেখাতে নিয়ে চলল। যদিও শহরের  দেওয়াল ১১ মাইল লম্বা,তবু বিশেষ বিশেষ দ্রষ্টব্যগুলো প্রায়শঃ কাছাকাছিই রয়েছে।
শহরটার যা বিশেষত্ব, তার অনেক কিছুই গাইড ছাড়াই উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটলেই চোখে পড়বে। যেমন বাড়িগুলোর বেশিরভাগই নানা রঙে রঙীন। ঊজ্বল রংগুলো অবশ্যই চোখ টানে।বেশির ভাগ বাড়িতেই নীল, গোলাপী বা বেগুনী রঙ, কখনও ঊজ্বল লাল। তাতে শহরটার বৈচিত্র্য আরও সুন্দর ভাবে চোখে পড়ে। আগেই বলেছি, বাড়িগুলো সব গায়ে গায়ে লাগা, কোথাও কোন ছাড় নেই, এমনকি যে কোনো চার্চের দেওয়ালও পাশের বাড়ির সঙ্গে জোড়া। দেখে মনে হয়, তখন স্থানাভাব যথেষ্টই ছিল সেই সময়। তাই এই অবস্থা। প্রত্যেকটি বাড়িই যথেষ্ট উঁচু , দ্বিতল বা ত্রিতলের নীচে কোনো বাড়িই নয়। আর প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই রয়েছে একটি ব্যালকনি, যেটি প্রায়শঃই লতানো ফুলের গাছে ভর্তি।অনেক ব্যালকনি থেকেই বাহারী গাছ ভরে গিয়ে নীচে ঝুলছে। আর একটি কথা প্রায় সমস্ত ব্যালকনির রেলিং বা জানালার গ্রিল বলতে যা বোঝায়, বা যেখানে যত গ্রিল আছে সেগুলো সব একরকম ডিজাইন। বেশ উঁচু উঁচু সোজা আর প্রত্যেকটির গায়ে কয়েকটা করে রিং এর ডিজাইন উপর থেকে নীচ পর্যন্ত। আর গ্রিলগুলোর রড পাশাপাশি সমান্তরালভাবে নীচের সাথে এবং উপরের সাথে গাঁথা। জানালা গুলির উচ্চতা অনেক ক্ষেত্রেই দরজার সমান। 
🍂
ad

আর একটা জিনিস দেখলাম, যা খুবই আকর্ষণীয়। তা হল এদের ঘরের প্রধান দরজা। এই দরজাগুলো সবই ফুটপাথের সঙ্গে লাগোয়া। আর দরজাগুলি সবই বেশ বড় বড়। এই দরজাগুলোর প্রত্যেকটাতেই একটা পাল্লায় কাটা একটা ছোট দরজা আছে।
এই ছোট দরজা ব্যবহার করত, বাড়ির চাকর-বাকর বা নিম্নশ্রেণীর যারা।আর প্রধান দরজা ব্যবহার করতেন, বাড়ির কর্তা মালিক বা সম্মানীয়রা। 
আর একটি ব্যাপার হল, প্রত্যেকটি দরজায় , কড়া নাড়ার জায়গায় একটি করে বড় পিতলের মূর্তি আছে। সেগুলি হয়ত, কোন সিংহের মুখ, বা কুমীরের বা মাছ কি কোন জলজন্তুর প্রতিমূর্তি।  এর মধ্যে, যাঁর বাড়িতে সিংহের মুখ লাগানো, বুঝতে হবে, তিনি কোন রাজকীয় উচ্চ পদে বা সেনাবাহিনীতে প্রতিষ্ঠিত, যাঁর বাড়িতে অন্য জলজন্তুর প্রতিকৃতি , তিনি অবশ্যই নৌ বিভাগ বা জলসম্পর্কীয় ব্যবসাতে যুক্ত, যাঁরা কেরাণী ধরণের কাজে যুক্ত তাঁরা লাগান হাতের ছাপ, যাঁর বাড়িতে টিকটিকি ধরণের কিছু থাকে তিনি ভাল পরিচ্ছদ পরায় আগ্রহী।এইরকম নানা প্রতিমূর্তি দিয়ে গৃহস্বামীর সামাজিক অবস্থান বোঝানো হত।এই ধরণের জিনিস, অন্য কোথাও দেখেছি বলে মনে হয় না। দরজা দিয়েই গৃহস্বামীর সামাজিক অবস্থান বোঝানোর রীতি সত্যিই চমকপ্রদ। তবে বর্তমানে নতুন যুগে এই পদ্ধতি অনেকেই পরিত্যাগ করেছেন।
কেল্লার ছাদে গোপন সুরঙ্গ

এরপর ছেলেটি আরও কিছু বোঝাতে বা দেখাতে এগোল। তবে আমরা তাকে ছেড়ে দিলাম, কারণ ওই চার্চগুলো বা রাস্তাগুলো ওর সঙ্গে দেখে আমাদের লাভ নেই। আমরা এগোলাম ভিতর দিক থেকে ঐতিহাসিক দেওয়াল দেখতে। 
দেওয়াল একেবারে কাছেই। তার পরেই চলেছে প্রধান রাস্তা এবং তার পরেই আছড়ে পড়ছে সমুদ্র।এই ১১ মাইল লম্বা দেওয়ালই আজ পৃথিবীর কাছে একে অন্যতম আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
স্থানীয় শকুন যা প্রচুর দেখা যায় কাকের মত

প্রায় ৪১০ বছরের পুরানো এই দেওয়াল অনেক যুদ্ধবিগ্রহের সাক্ষী। ৮ই সেপ্টেম্বর ১৬১৪ সালে শুরু হয়ে এটি সম্পূর্ণ তৈরী হতে  প্রায় ২০০ বছর লেগেছিল। এর তৈরীর আদেশ দেন রাজা তৃতীয় ফিলিপ। প্রথম ধাপে এটির নির্মাণকার্য পরিচালনা করেন ইটালিয়ান স্থপতি Carlos de Roda Antonelli । এটি যথেষ্ট চওড়া। এর উপর দিয়ে বেশ ভালই হেঁটে যাওয়া যায়। হয়ত আগে এর মাঝে এত কাটা জায়গা ছিল না,যেখান দিয়ে বাইরে আসা যাওয়া করা যায়। পরে যুগের প্রয়োজনে হয়ত এটা হয়েছে।এর মাঝে মাঝে নীচের দিকে অনেক জায়গাই রয়েছে যা জানালার মত। হয়ত এগুলো বাইরের দিকে নজর রাখার জন্য বা প্রয়োজনে কামান বা অন্য কিছু অস্ত্রের জন্য।এই জানালা মত জায়গাটায় অন্ততঃ একজন বসে থাকতে পারবেই। আমরা এখানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে এখান থেকে সাগরের উপর সূর্যাস্ত দেখলাম।দেওয়ালের ভিতর দিকে এর সামনে দিয়ে দেওয়াল বরাবর চলে গেছে রাস্তা। বহু মানুষ বিকাল বেলা এই দেওয়ালের ধারে বা এর উপর হেঁটে বেড়িয়ে বিকালটা উপভোগ করেন।
পরদিন আমরা বেরিয়ে সকালে গেলাম প্লাজা বলিভারের উলটো দিকে একটি ছোট মিউজিয়ামে, নাম Museo del oro Zenu । এটি আসলে ১৯৮২ সালে স্থাপিত হওয়া একটি সোনার জিনিসপত্রের মিউজিয়াম।এই Zenu হল প্রাক-কলম্বিয়া যুগের মানুষ বা তাদের ভাষা।এরা বাস করত উত্তর কলম্বিয়ার মররস্কিলো উপসাগরের চারপাশে বা ক্যারিবিয়ান উপকূলে।এরা কথা বলত Sinufana ভাষায়।এটি কলম্বিয়ার প্রাচীন ভাষা। আজ খুব কম লোকই এই ভাষা বলতে পারে। এই ‘জেনু’ শব্দের অর্থ হল প্রফুল্ল এবং হাসিখুশি , পরোপকারী। এরা বিশ্বাস করত, সম্পদ নিজের জন্য নয় , সকলের সাথে ভাগ করে নেওয়ার জন্য।এরা সোনা রূপোর সুন্দর কাজ করতে পারত। চাষবাসেও বেশ উন্নত ছিল।তাদের তৈরী এবং ব্যবহার করা জিনিসপত্র , যা মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে, তাই নিয়েই এই মিউজিয়াম। 
ক্রমশঃ-
আজকের মত চলি বন্ধুরা। বিশ্রাম নিই। চলতে হবে আরও দীর্ঘ পথ। তাই তাড়াহুড়ো না করে রসিয়ে রসিয়ে পথের সৌন্দর্য রস পান করাই ভাল। পরের দিন দেখা যাবে মিউজিয়ামের আশ্চর্য সম্পদ।দেখা হবে পরের পর্বে, আগামী সপ্তাহে।

Post a Comment

0 Comments