স্বাগতা : ভাটপাড়া র ছেলে শুভাশিস এর শুভ দাসগুপ্ত হয়ে ওঠার যাত্রা পথটা নিশ্চয়ই "সবটাই শুভ" ?
শুভ দাসগুপ্ত : (প্রাণখোলা হাসি) ধুলো বালির সামান্য জীবন যে কখনো এত মণি মাণিক্যের ছটায় উজ্বল হয়ে উঠবে, তাই কখনো দূর কল্পনাতেও আসেনি। তবু ও এমনটাই হয়েছে। গান আর কবিতাই আমাকে নিয়ে গেছে মফঃস্বলের ডেলি প্যাসেঞ্জারী জীবন থেকে সৃজন আলোকে। কত গুণীজন কত সব বিখ্যাত শিল্পী ব্যক্তিত্বের স্পর্শে ধন্য হয়েছি। তাই আমার কাছে বলা যেতে পারে সবটাই শুভ (আবার প্রাণখোলা হাসি)
স্বাগতা : কবি হতেই চেয়েছিলেন প্রথম থেকেই ?
শুভ : একেবারেই না। গান ভালোবাসতাম। বাগবাজারের সুবিখ্যাত চলচ্চিত্র বেতার ও যাত্রার সুরস্রষ্টা দূর্গা সেন এর কাছে গান শিখেছি।
স্বাগতা : ছবি আঁকাতেও যথেষ্ট খ্যাতি আপনার।
শুভ : ছবি আমার আর একটা ভালবাসা। ছবির প্রথম উদ্ভাস কিন্তু রাজনীতি র আঙ্গিনায়। পোস্টার আঁকা দিয়ে শুরু। পরে অবশ্য রেকর্ডের ডিক্স এর কভার ডিজাইন করেছি, বই এর প্রচ্ছদ করেছি।
স্বাগতা : এই প্রসঙ্গে একটা কথা জানতে খুব ইচ্ছে করছে, সত্যজিৎ রায় এর সঙ্গে আলাপ কি ছবি আঁকা কে কেন্দ্র করেই ?
শুভ : (হাসি) সে এক গল্প (আবার হাসি) নব্বইয়ের দশকে সুকুমার রায় এর কবিতায় সুর বসিয়ে গান করবেন এক শিল্পী। আমাকে তার রেকর্ডের ডিক্স কভার ডিজাইন করে দিতে হবে, সেই জন্য আনন্দ বাজার পত্রিকার আমার এক আর্টিস্ট বন্ধু নিয়ে গেলেন বিশ্ব বরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় এর কাছে।
স্বাগতা : ওই দিন টা আপনার কাছে নিশ্চয়ই বিশেষ ভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে ?
স্বাগতা : আপনার কর্মজীবনের সূত্রপাত কোথায় ?
শুভ : কর্মজীবনের সূত্রপাত হয়েছে কিন্তু সেলসম্যান এর চাকরি দিয়ে। তারপর দিল্লি তে, তারপর ব্যাঙ্ক। কর্মজীবনের শেষ ও হয় ব্যাংক এই।
স্বাগতা : আপনার কর্মজীবন তো শুধু মাত্র ব্যাঙ্ক এর কাজে নয়, তার ব্যাপ্তি তো বিরাট। সেই কথা শুনতে চাই। কবিতা র আগে বোধহয় গান আসে। তাই গান এর কথা দিয়ে ই শুরু হোক।
শুভ : আমার তৎকালীন ব্যাঙ্কের সহকর্মী বন্ধু ও শিল্পী শক্তিব্রত দাস এর হাত ধরে প্রথম বার পা রাখা হিন্দুস্তান রেকর্ড কোম্পানির স্টুডিওতে। তার পরবর্তী সময়ে কবি রবিন সুর এর সাথে ৯/৩ টেমার লেন এ দেব কুমার বসুর বাড়িতে আসা। আর ওনার পাবলিকেশন দপ্তরের আড্ডা তে আলাপ হলো সুনীল দা, শক্তি দা, পূর্ণেন্দু দা, অমিতাভ দা, ঋত্বিক ঘটকের স্ত্রী সুরমা ঘটক ওর ছেলে ঋতবাণ ঘটকের সাথে। ১৯৮৪ সালে "ইনরেকো" থেকে প্রকাশিত হলো আমার চারখানা গানের ই পি ডিক্স "আমার প্রতিবাদের ভাষা" ।
স্বাগতা : তাহলে ৯/৩ টেমার লেন ই আজকের শুভ দাসগুপ্তের স্রষ্টা ?
শুভ : (হাসি) হ্যাঁ, তা বলতে পারো।
স্বাগতা : " আমার প্রতিবাদের ভাষা" রেকর্ডের গানের কথা কি আপনার ই ছিলো ?
শুভ : হ্যাঁ আমার ই ছিলো, তবে তার সাথে ঐ সুভাষ মুখোপাধ্যায়, তপন চক্রবর্তী আর অমিতাভ দাসগুপ্তের কথা ও।
স্বাগতা : ১৯৮৪ র পর, তার পরের রেকর্ড কবে বেরোলো?
শুভ : ১৯৮৬ তে "সাউন্ড উইং" থেকে বের হয় আমার পরের ক্যাসেট "এ যে রাত্রি" । এই ক্যাসেটে অমিতাভ বাগচী ও অমিতাভ দাসগুপ্ত পাঠ ও আবৃত্তি করেছিলেন। আর আমার চারটে গান এর সুরকার ছিলেন জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। একটি গান লিখে ছিলেন মনোজ মিত্র ও তাতে সুর দিয়ে ছিলেন দেবাশীষ দাসগুপ্ত।
স্বাগতা : সলিল চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ কি ভাবে হয়েছিল ?
শুভ : ( মৃদু হেসে) হঠাৎ করেই এরপর আলাপ হয়ে গেল সলিল চৌধুরীর সঙ্গে। সলিল দার সান্নিধ্য না পেলে আমার কবিতা লেখা হয়ে উঠতো না। ঐ আশির দশকে ই আমার প্রথম গান সলিল চৌধুরীর সুরে রেকর্ড হলো।
স্বাগতা : আপনার লেখা প্রথম গান বা কবিতা র রেকর্ডের কথা বলুন।
শুভ : আমার প্রথম পূজোর গান গাইলেন হৈমন্তী শুক্লা। আমার প্রথম কবিতা রেকর্ডিং করলেন গৌরী ঘোষ। আর আমার প্রথম মঞ্চ উপস্থাপনা, পরিকল্পনা ও পরিচালনা "এক সন্ধ্যা একা ব্রততী" ।
স্বাগতা : এরপর নব্বই এর দশক মানেই তো আপনার জীবন্ত কিংবদন্তি দের সাথে কাজের ইতিহাস ? আর সেই সঙ্গে জনপ্রিয়তা র চূড়ান্তে ওঠা সব গান, "মুসকিল আসান" , "কার্পেটের গান" , "ধা- ধিনা না-তিনা" ।
শুভ : (আবার প্রাণখোলা হাসি) ঠিক তাই। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে মন্ত্রী সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর কাছ থেকে ডাক আসে। ছাত্র সমাজের কাছে নতুন করে স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা দেশাত্মবোধ এর কথা প্রচার করতে হবে। আমাকে দেওয়া হলো স্ক্রিপ্ট লেখার দায়িত্ব। এই মিটিং এ, ভি বালসারা থেকে শুরু করে শ্রীরাধা, ইন্দ্রানী, সবিতাব্রত, গৌরী দি, পার্থ দা, প্রণতি , সতীনাথ সহ আরো অনেক নামজাদা বরেণ্য শিল্পী রা উপস্থিত ছিলেন। আর এই বিশাল কর্মযজ্ঞে পরিচালনা র দায়িত্বে ছিলাম আমি, সঙ্গীত পরিচালনা র দায়িত্বে ছিলেন কল্যাণ, মানে কল্যাণ সেন বরাট।
স্বাগতা : কবির সুমন এর সঙ্গে আলাপ কি ভাবে হয়েছিল ?
শুভ : এই দেশাত্মবোধক অনুষ্ঠান এর আগে একদিন সুভাষ দা , মানে মন্ত্রী সুভাষ মুখোপাধ্যায় ফোন করে বললেন যে, একটি নতুন ছেলে অসাধারণ গান লেখে সুর দেয় আর গান করে, ওকে তোমার স্ক্রিপ্ট এ একটু স্পেস দিও। সমবয়সী এই তরুণ টি ই সুমন চট্টোপাধ্যায়, আজকের কবির সুমন।
স্বাগতা : ভি বালসারার সঙ্গে পরবর্তী সময়ে আপনি আরো কাজ করেছেন ?
শুভ : এই স্ক্রিপ্ট এর কাজ থেকেই শুরু হলো ভি বালসারার সঙ্গে কাজ করা। তিনি জীবন্ত কিংবদন্তি। পরবর্তী সময়ে বালসারা দা র সঙ্গে অনেক কাজ করেছি।
স্বাগতা : নব্বইয়ের দশকে আপনার কবিতা মানুষের খুব কাছে পৌঁছে গেছে, তাই তো?
শুভ : ১৯৯২ এ "বেশ করেছি" কবিতার ক্যাসেট টি জনপ্রিয়তা এনে দেয়। ততদিনে গৌরী ঘোষ এর কণ্ঠে আমার লেখা কবিতা "জন্মদিন" , প্রণতি ঠাকুর এর কণ্ঠে আমার লেখা কবিতা"শঙ্খমালা", সতীনাথ ও ব্রততী র কণ্ঠে আমার লেখা কবিতা জনপ্রিয় হয়ে গেছে।
স্বাগতা : আপনার প্রথম কবিতার বই কবে ?
শুভ : ১৯৯৬ এ আমার প্রথম কবিতার বই "শুধু তোমার জন্য" আমার প্রিয় মানুষ মন্ত্রী সুভাষ মুখোপাধ্যায় উদ্বোধন করেছেন। তারপর "বলা খুব মুস্কিল" , আরো পরে "সবটাই শুভ" , এই আর কি। এখনো পর্যন্ত আমার ৬২ টি কবিতার বই আর অন্যান্য বই সাত টি প্রকাশিত হয়েছে।
স্বাগতা : কিংবদন্তি শিল্পী মান্না দে র সাথে জুটি বেঁধে কাজ করেছেন কবে থেকে ?
শুভ : সেটা শুরু হয় ১৯৯৫ সাল থেকে।
স্বাগতা : প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে আলাপ ?
শুভ : সেটা ও শুরু হয় ১৯৯৫ সাল থেকে ই। পরে যথেষ্ট ভালো সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল ওনার সাথে।
স্বাগতা : বিখ্যাত সাঁতারু মাসদুর রহমান আপনার কবিতা খুব ভালোবাসতেন ।
শুভ : হ্যাঁ, (মৃদু হেসে) মাসদুর রহমান আমার আর আমার লেখার সত্যি ই খুব ভক্ত ছিলেন।
স্বাগতা : আপনার লেখা কবিতা আর গান রেকর্ড করেননি এমন শিল্পী বোধহয় কেউ নেই ?
শুভ : কিংবদন্তি শিল্পী লতা মঙ্গেশকর ছাড়া আর মোটামুটি প্রায় সবাই রেকর্ড করেছেন। মান্না দে, আশা ভোঁসলে, অজয় চক্রবর্তী, হৈমন্তী শুক্লা, মৃণাল চক্রবর্তী, ইন্দ্রানী সেন, অমর পাল, মনোময়, রূপঙ্কর, নির্মলা দি, বনশ্রী দি, শুভমিতা, স্বাগতা লক্ষী, শ্রীকান্ত আচার্য, শ্রাবণী সেন, আরতী দি, রাঘব, নচিকেতা, লোপামুদ্রা, সুবির সেন, মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, শ্রীরাধা, ইন্দ্রানী সেন, শম্পা, শ্রেয়া ঘোষাল সহ আরো অনেকে। সবার নাম হয়তো আমার এই সময়ে মনে এলো না। আর কবিতা প্রায় সব আবৃত্তি শিল্পী ই রেকর্ড করেছেন।
স্বাগতা : সেই দলে আমি নিজেও একজন সৌভাগ্যবান। আপনার লেখা কবিতা আপনারই পরিচালনায় আপনার ই আবহসঙ্গীত এ রেকর্ড করার সৌভাগ্য হয়েছে।
শুভ : (হাসি)
স্বাগতা : পরমপুরুষ রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ কে নিয়ে অসাধারণ কাজ করেছেন আপনি। সেই কথা এবার শুনতে চাই।
শুভ : (মৃদু হেসে) ২০১০ এ বিখ্যাত শিল্পী দের নিয়ে কাজ করেছি দুটি সিডি তে। পরমপুরুষ রামকৃষ্ণ কে নিয়ে "পরমহংস" , ও বিবেকানন্দ কে নিয়ে " আমিই বিবেকানন্দ" । এই দুটি সিডি তে কাজ করেছেন সব্যসাচী চক্রবর্তী, কৌশিক সেন, দেবরাজ রায়, দেবশঙ্কর হালদার, অরিন্দম গাঙ্গুলী, শ্রীকান্ত আচার্য্য, শ্রাবণী সেন, মনোময়, শ্রীরাধা।
স্বাগতা : শ্রীলা মজুমদার এর সঙ্গে আলাপ কোথায় ?
শুভ : শ্রীলা মজুমদার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী। আমার সঙ্গে হঠাৎ করেই আলাপ হয়েছিল একটা কবিতার অনুষ্ঠান এ। পরে সম্পর্কটা পারিবারিক হয়ে গিয়েছিল। পরে গোল্ড ডিস্ক কোম্পানি থেকে শ্রীলা, ব্রততী ও আমি "নাগরদোলা" নামে একটা অ্যালবাম করেছিলাম। রচনা, আবহ ও পরিচালনা আমার ছিলো।
স্বাগতা : কবিতা ও গানের অ্যালবাম এর সংখ্যা কত এখনো পর্যন্ত ?
শুভ : (আবার প্রাণখোলা হাসি) কবিতার অ্যালবাম ২২০ র উপর আর গানের অ্যালবাম এর সংখ্যা ৩০০০ এর ও বেশী। এখনো অনেক কাজ চলছে।
স্বাগতা : কবিতার জন্য অনেক পুরস্কার তো আছেই আর গানের জন্য ?
শুভ : (হাসি) গানের জন্যে ও অনেক পুরস্কার আছে, তবে সেরা গীতিকার পুরস্কার ৬ বার।
স্বাগতা : আপনার কর্মবহুল জীবন এর ব্যাপ্তি এত বেশি যে এই একটা সাক্ষাৎকার এ সব প্রশ্ন বা সব কথা বলা সম্ভব নয়। আপনি সত্যিই জীবন্ত কিংবদন্তি। আরো অনেক অনেক কাজ করুন আপনি। আমার ও জ্বলদর্চি র পক্ষ থেকে আপনার জন্য অনেক ধন্যবাদ, শুভ কামনা আর অভিনন্দন রইলো।
শুভ : তোমাদের ভালবাসা ই আমার কাজের আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। তোমাদের সবাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাচ্ছি।
🍂
0 Comments