জ্বলদর্চি

রাহগুজর /পুলককান্তি কর

চিত্র-শুভম দাস 

রাহগুজর
পুলককান্তি কর

কর্মজীবনের মধ্যভাগে পুরুলিয়ায় এসে ঘর বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন পল্বল। কতকটা যে এখানকার প্রকৃতির প্রেমে - একথা যেমন অস্বীকার করা যায় না, তেমনি অন্য কারণ হলো তাঁর কোথাও তেমন কোনও পিছুটান ছিল না। যখন পূর্ব বাংলা থেকে এদেশে এসেছিলেন, তখন ওঁর বয়স তিন কি চার। মাধ্যমিক পাস করার আগেই বাবা-মা দুজনেরই স্বর্গবাস, সুতরাং তিনি কতকটা সেল্ফ মেড ম্যান। চেয়েচিন্তে, শিক্ষকদের সাহায্যে পড়াশোনাটা শেষ করেছিলেন। ভালো চাকরিও জুটে গিয়েছিল সরকারি দপ্তরে। বদলির চাকরি। চল্লিশের পর পুরুলিয়ায় এসেই বিয়ে হল তাঁর, পুরোটাই সহকর্মীদের উৎসাহে। নিজের যে খুব আগ্রহ ছিল তা নয়; তবে কখনো কখনো দৌড়াতে দৌড়োতে পথের পাশে শান্ত নির্জন কুটির দেখলে যেমন দুদন্ড জিরোতে ইচ্ছে করে, এটাও অনেকটাই তেমনি। গৃহিনী যখন এল গৃহও চাই, অতএব পুরুলিয়া। জেলা শহরেই একটা জায়গা কিনে বাড়ি বানালেন তিনি। তবে তাঁর অনেক দিনের শখ ছিল একটা পাহাড় কিনবেন তিনি, অথবা একটা দ্বীপ। এখনকার দিনে সরকারি চাকরি করে কোনওটাই সম্ভব নয় বুঝে ‘পারা’র কাছাকাছি একটা ছোট্ট টিলা মত জায়গার পাশে মস্ত পুকুরওয়ালা দু-তিন বিঘা জমি কিনে রেখেছিলেন এখানে এসে এসেই। ছেলে যখন একটু বড় হয়ে মাধ্যমিক দিল, এইখানে একটা বেশ বাংলো টাইপের বাড়ি বানালেন তিনি। মাঝে মাঝেই এসে থাকেন এখানে। বিশেষ করে রিটায়ার্ড হওয়ার পর মাসের মধ্যে কুড়ি দিন এখানে থাকেন পল্বল।
সবে শীত আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে; বসন্তের সাজগোজ শুরু হচ্ছে জোর কদমে।চারপাশে শুধু লাল লাল কৃষ্ণচূড়া, পল্বলের বাড়ির জানালা দিয়ে দেখা যায় টিলার উপরটা। সকালে যেন পুরো টিলাটাই লাল হয়ে থাকে ঝরে পড়া ফুলদের বানানো বিছানায়। এখানে সব ঋতুরই দাপট বেশি, বর্ষা ছাড়া। গরমের দিনে রাতের দিকেও লু বয়, শীতে তাপমাত্রা পাঁচ ডিগ্রির নীচে। অভ্যাস হয়ে গেছে পল্বলের। মানুষের স্বভাবই তো তাই, অভ্যাস করতে চাইলে সবকিছুই অভ্যাস হয়ে যায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে চা বানিয়ে বারান্দায় বসে ছিলেন তিনি। সামনের পুকুরটায় এখনও দু-একটা পদ্ম ফুটে আছে। সময় চলে গেছে যদিও, তবু এটা উপরি।পদ্ম পাতার ওপর জলফড়িংয়ের টুপটাপ ওড়াওড়ি দেখতে বেশ ভালো লাগে তাঁর। মোবাইলে ছেলে সাম্যর ফোন বেজে উঠলো হঠাৎ।ব্যাঙ্গালোরের চাকরি করে সে, ‘হ্যালো বাবা?’ 
-কি খবর তোর! 
-এইতো ভালোই, তুমি কোথায়? 
-পারা।
🍂
ad

  কিছুটা বিরক্তি নিয়ে সাম্য বললো, ‘কী তোমার রাখা আছে পারায়, বাবা? এই বয়সে তুমি এখানে থাকো, মা ওখানে পুরুলিয়ায় আলাদা! এইভাবে আমি বা কী করে এখানে মন স্থির করে রাখি!
    মনে মনে ছেলের উদ্দেশ্যে একটা গালি দিলেন পল্বল। মুখে কিছু বলা যায় না সব কথায়। ওখানে ছেলেকে পড়ে থাকতেই বা কে মাথার দিব্যি দিয়েছে? অথবা থাকলেও অকারণ বাবা মা নিয়ে দুশ্চিন্তায় মাথা খারাপ করতে কে বলেছে - কিছুই মাথায় আসে না তাঁর। আসলে এসব এক ধরনের ছদ্ম অন্তরঙ্গতা, একপ্রকার দেখনদারি। মুখে প্রকাশ করা - আমি কতখানি তোমাদের জন্য চিন্তিত... বা হয়তো সত্যি সত্যি চিন্তাই করে ছেলেটা। এতখানি মাথা ঘামাতে মোটেও ইচ্ছা করছে না তাঁর। ছেলে আবার বলল, ‘কদিন থাকবে এখানে?’
- দেখি। 
- তোমার তো বয়স হচ্ছে বাবা। ওখানে ডাক্তার নেই - কিছু একটা হয়ে গেলেও তো ঘরে পড়ে থাকবে, কেউ দেখবে না। কী যে একা একা ওখানে শান্তি পাও বুঝিনা! আর তাছাড়া মায়ের দিকটাও তো তোমার দেখা উচিত। মাকে নিয়ে গেলেই তো পারো। 
অসহ্য একটা বিরক্তি কাজ করেছে পল্বলের মনের ভেতর। ছেলে বলে কি সব কিছু প্রশ্ন করার অধিকার আছে? সব কথার উত্তর হয় না। বিশেষ করে এই জাতীয় প্রশ্নও নতুন নয়। কোনও না কোনওদিন এর উত্তরে তিনি কিছু বলেওছেন হয়তো, উত্তর তো কেউ মনে রাখে না; প্রশ্নগুলোই বারবার করে শুধু। প্রশ্নটা শুধু করার তাগিদেই? উত্তরটা তলিয়ে দেখার বিন্দুমাত্র ধৈর্য থাকলে তো দ্বিতীয়বার প্রশ্নটাই আর আসে না। কিছুই তো বলতেই হয় তাই বললেন, ‘মাকে বলিস কথাটা।’
- তোমাদের বাবু বুঝিনা, মার কথা তো অযৌক্তিক না! এখানে কোনও ফেসিলিটি নেই, কাছের লোকজন নেই - মা এসে এখানে তোমার হেঁসেল ঠেলবে, নাকি খিদমদগিরি করবে? 
পল্বল খুব ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘তোর কি অন্য কিছু কথা আছে?’ 
- না। বললেই ফোনটা কেটে দিল সাম্য। 
টিলাটার মাথায় চোখ গেল পল্বলের, পলাশের গালিচা এখন আর মনটাকে ছুঁলো না। মাথাটাই তেতে লাল হয়ে আছে। অনেক বিরক্তি আছে যার জন্য কাউকে সরাসরি দোষারোপ করা যায় না। অথচ পরোক্ষ একটা দায় বর্তে দেওয়া যায়। সেই রকম একটা চাপা রাগ এখন কাজ করছে পল্বলের তাঁর স্ত্রী জবার ওপর। জবা বলরামপুরের মেয়ে। কথায় বার্তায় পুরুলিয়ার টান; সাধারণ বিএ পাস।গৃহবধুর যেসব গুণ থাকা উচিত, সবই তার ছিল - কিন্তু কেন কে জানে, দুজনের মনের মিল হলো না কোনওদিন। কে যে কার গভীরতা ছুঁতে পারলেন না, তা কেউই খবর নিতে চাননি, হয়তো এখনও চাননা। স্বাভাবিক নিয়মে দিন কেটে গেছে, সন্তান হয়েছে; টুকটাক শখ আহ্লাদও যে কেউ কারো মেটান নি -এমন নয়। পল্বল যখন পারায় ঘর বানানোর প্রস্তাব দিলেন, জবা পরিষ্কার বলে দিলেন ওখানে গিয়ে গৃহস্থালি পাতানোর শখ তাঁর নেই। পল্বল চাইলে নিজে গিয়ে থাকতে পারেন, তাঁর পক্ষ থেকে কোনও বাধাও নেই, আবার আগ্রহও নেই। বিগত কুড়ি বছরে সাম্যকে নিয়ে জবা একবারই এসেছিলেন এই বাড়িতে, তাও এক বেলার জন্য। একটা পাখি পুকুরের ওপাশের দেবদারু গাছটায় বসে নানান সুরে গান গাইছে। মাহাতো সেদিন বলছিল, ‘এটা বসন্ত বাউরি বটে।’ পল্বল একদৃষ্টে পাখিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। হঠাৎ তিনি ওদের জীবন শৈলী নিয়ে কৌতুহলী হয়ে পড়লেন। ওরাও কি দাম্পত্য নিয়ে সিরিয়াস? ওদেরও কি টানাপোড়ন চলে সকাল থেকে মধ্যরাত? গুগুলটা নিয়ে 'বসন্ত বাউরি' লিখে সার্চ করলেন, তেমন মতামত কিছু পেলেন না। অন্যমনে সাপ্তাহিক একটা ম্যাগাজিন উল্টাতে শুরু করলেন। চোখে পড়লো রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা লেখা, ডব্লিউ বি ইয়েটস কে নিয়ে। যদিও সাহিত্য নিয়ে পল্বলের তেমন কোন অতিরিক্ত আগ্রহ নেই। ইংরেজি নিয়ে পড়লে চাকরির বাজার ভালো, এই কারণেই সায়েন্সের ছাত্র হয়েও তিনি বিএ তে ইংরেজি নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। নম্বরও ভালো পেয়েছেন। কিন্তু তিনি নিজে যে বিশেষ সাহিত্য পড়েন তা নয়। অন্যমনস্কভাবে পাতা উল্টাতে গিয়ে তিনি দেখলেন ইয়েটস নাকি 'মডগন ' নামের রূপসী এক নারীর প্রেমে পড়েছিলেন। দুবার তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং দুবারই প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। কিন্তু প্রেম কমলো না। লিখলেন অসামান্য এক কবিতা। আচ্ছা, মডগন যখন বৃদ্ধা হবেন, পাক ধরবে চুলে, চামড়ায় লাগবে ঝুরো, তখন কি তিনি বইয়ের আলমারি থেকে ইয়েটস এর এই কবিতাটা পড়ে অনুভব করবেন, কী পরিমাণ ভালবাসা ছিল এই পুরুষ কবিটির বুকে? When you are old and grey and full of sleep/And nodding by the fire, take down this book, and slowly read, and dream of the soft look/Your eyes had once, and their shadows deep,/How many loved your moments of glad grace,/How many loved your beauty with love false or true,/But one man loved the pilgrim soul in you and loved the sorrows of your changing face... (Byzantium রোববার ২১ মার্চ,২০২১ কড়ি দিয়ে কিনলাম সংখ্যা)সেই প্রেমিক পুরুষ একা হেঁটে চলে গেল পাহাড় পার হয়ে তারাদের ভিড়ে, নিজের মুখটি লুকিয়ে ফেলবে বলে? সত্যি কি মডগন পড়ে দেখেছিলেন তাঁর বার্ধক্য বেলার এই কবিতাটি? সত্যিই কি কেউ পড়ন্ত বিকেলে এসে মনে করে নিষ্ঠুর প্রত্যাখ্যানের কথা, অন্ততপক্ষে যাদের প্রতি মনের ছিটেফোঁটাটুকুও ছিল না? নিশ্চিত পড়ে না। নিশ্চয় মনে পড়ে না শহীদ স্মরণীতে দাঁড়িয়ে থাকা পেছনের সারির ছেলেটির নাম বা মুখ। তাও তো ইয়েটস বড় কবি, তাঁর লেখা পড়ারও একটা সুযোগ থাকতেই পারে প্রাক্তন প্রেমিকার অবসরের বই বিতানে! যাদের সেরকম কোন প্রকাশ নেই – তারা কী করে মনে করাবে একদিন সেও কত প্রেমে ডুবেছিল, সেও কত লিখেছিল মনে মনে প্রেমের আখ্যান! পল্বলের মনে পড়ল, ওদের একজন প্রিয় শিক্ষক ছিলেন এ.ডি– অম্বরিশ দাস। ভদ্রলোক শেক্সপিয়ার পড়াতেন। যেমন উচ্চারণ, তেমনি নাটকীয়তা। নিজে ভালো গল্প কবিতা লিখতেন, বড় বড় ম্যাগাজিনে যেসব লেখা ছাপা হতো। একদিন ওথেলো নাটকের কী একটা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘জানিস, গালিব একটা দারুন শায়েরী লিখেছিলেন – আহী জানা ওহ রাহপর গালিব/ কোই দিন অওর ভী জিয়ে হোতে ..., আমি একটা অনুবাদ করেছি এটার – ‘একদিন ঠিক চাইতে আমায় জানি/ কটা দিন যদি টিকে যেত পাগলামি...’
 বিদিশা বলল, ‘কবে করলেন স্যার?’
– এটা কি আবশ্যক প্রশ্ন? 
থতমত খেয়ে গিয়েছিল বিদিশা। এ ডি আবার প্রসঙ্গে ফিরে বললেন, ‘ইয়েটসই বা কেন বললেন, and hid his face amid a crowd of stars! প্রত্যাখ্যাত প্রেমকে কেন মুখ লুকাতে হয় 'তারার কুঞ্জে ধীরে/ দহণ ক্ষমতা ফুরিয়েই গেছে আগুনের নদীর তীরে...’
– এটাও কি আপনার লেখা স্যার? বিদিশা সভয়ে বলল। 
এ ডি কিছু বললেন না। তাঁর জলদ গম্ভীর স্বরে বলতেই থাকলেন, ‘প্রেমে প্রত্যাখাত হয়ে কেউ মরে যায় না my dear students! No one dies in the agony of non responded love, it is only due to the remembrance of her 'রাহ গুজর' – the way of living. দ্যাখো, গালিব বলছেন ‘জিন্দেগি ইউঁ ভী গুজর হী জাতি/ কিঁউ তেরা রাহু গুজার ইয়াদ আয়া?’ ‘হয়তো জীবন কেটেই যেত এমনি করে। সময় পেলে/ মনে এল তুমিই বা কী, চললে কেমন জীবন ঠেলে?’
দু দুবার পল্বলও প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলেন বিদিশাকে। প্রত্যাখাত হয়েছিলেন যথারীতি। চাল-চুলোহীন, চাকরি নেই ... চাকরির পর ভাবলেন, পায়ের তলায় জমি রয়েছে, এইবার শেষবারের মতো বলা যায়। আবির বললো, বিদিশার সাথে এ.ডি র রেজিস্ট্রি ম্যারেজ হয়ে গেছে। এ ডি অন্তত ষোল সতেরো বছরের বড় – কিন্তু ওই যে, ‘আহী যাতা ওহ্‌ রাহপর গালিব... বিদিশা অনন্ত পাগলামিটা টিকিয়ে রেখেছিল বলেই হয়তো একদিন জিততে পারল। অনন্ত পাগলামি তো পল্বলেরও ছিল, কিন্তু সবার কাছে দেখাবার মতো কীই বা ছিল তাঁর! কিছুটা ইমপ্রেস করার জন্যই বোধহয় দু-একবার কয়েক লাইন লিখেও ছিলেন তিনি, লিখেই বুঝেছিলেন এটা আর যাই হোক সাহিত্য হয়নি। তিনি যদি লিখতে পারতেন ইয়েটস এর মতো– নিদেনপক্ষে এ.ডি র মতো, হয়তো আজ বিদিশার উদ্দেশ্যে তিনিও লিখতে পারতেন এই রকমই একটি বার্ধক্য এসে ফিরে দেখা প্রেমের অস্তরাগ, নয়তো একটি নিভে যাওয়া আগুনের উপাখ্যান।
বিদিশার বয়স তো এখন তাঁরই মত হবে। হয়তো মাথায় কলপ করে লুকিয়ে রাখে পক্ককেশ। হয়তো কায়দা করে ঢেকে রাখে গলায় পড়া বয়সের দাগ। এখনও কি ভ্রু প্লাক করে দিগন্তের মতো? এখনও কি প্রেমাবিষ্ট মুগ্ধ হয় এ.ডি র শব্দে? এ.ডি ঠিকই বলেছেন, সমস্যা তো প্রত্যাখানে নয়, সমস্যাটা হলো ওই 'রাহগুজর'। বিদিশার এই অতিক্রান্ত দিনগুলোর শৈলীটাই বড় বিষন্ন করে দিল পল্বলকে। এখন চুপচাপ বসে থাকতে ইচ্ছে করছে অনেকক্ষণ। নিজের সঙ্গে, কিছু না ভেবে। 
পল্বলের বাড়ির সীমানাটার সামনে দিয়েই মোরামের একটা রাস্তা গিয়েছে গ্রামের দিকে। ক্রমশ রোদ চড়া হচ্ছে। তীব্র একটা রোদের প্রহার যেন হঠাৎ করে প্রকট হয়ে মিলিয়ে গেল মেঘে। দূরে একটা সাইকেলে মাহাতোকে দেখতে পেলেন পল্বল। আজ সকালেই এসে বাগানটা পরিচর্যা করার কথা ছিল তার। একটু বাজারহাট করানোও দরকার। আজ একটা বনমোরগ আনবে – এমনটাই বলে গেছে কাল। বিদিশা জানে বনমোরগ কেমন করে রাঁধতে হয়? জানে কি, একটু ঝাল ঝাল করে তেলেই রাঁধতে হয় পুরোটা? অবশ্য এ. ডি র এখন অনেক বয়স, আশি হয়ে গেছে বোধ হয়। সহ্য হবে না পেটে ! ভদ্রলোকের লেখা এখন খুব অল্প প্রকাশ হয় এখানে ওখানে। বেশি লিখতে পারেন না, নাকি কদর কমেছে – কে জানে? তার জন্য বিদিশার মোহ কমেছে কি? নিজেকে তিরস্কৃত করলেন পল্বল। এমনটা তো নয় এ.ডি’র প্রতি মোহ কমলে তাঁর কথা মনে পড়বে বিদিশার। আর মনে পড়লেই বা কি? যে পলতেটা পাকানোই হয়নি কোনওদিন, তার শিখার ওম নেবার স্বপ্ন দেখে কি লাভ?
ফোন বাজছে, অজানা নম্বর। পাশের বাড়ির অঞ্জু, ‘মেসোমশাই, মাসিমাকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, শিগগিরই আসুন।’ 
– কেন কি হয়েছে? 
– শরীরটা যেন কেমন করছিল ওঁর। মাকে ডাকলেন ফোন করে, বাপি গিয়ে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে।
বড় একটা দীর্ঘশ্বাস পরলো পল্বলের। বেরোনো দরকার। প্রতিটা জীবনেই সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব থাকে। পল্বল জীবনে সে দায়িত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি, সেটা সমাজের হোক অথবা দাম্পত্যের। এক্ষুনি ছেলের ফোন এসে যাবে, নানা রকম উপদেশের মধ্যে লুকানো থাকবে তিরস্কার। ভবিষ্যতে পারার বাড়িতে এসে দিন না কাটানোর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপরোধও থাকবে তাতে। পল্বল নিজের কাছে পরিষ্কার, বিদিশার প্রতি তাঁর প্রেমাকাঙ্ক্ষা কোনওদিন মুহূর্তের জন্যও জবা এবং তাঁর দাম্পত্যের মধ্যে এসে দাঁড়ায়নি। তিনি মিলন মুহূর্তে বা অবসরে একবারও বিদিশার সাথে জবার প্রতিতুলনা করেননি। তিনি জবাকে জবার মতোই মেনে নিয়েছেন, বিদিশার প্রত্যাখানকে কোনও দিন তিনি মাথায় করে রাখেননি। জীবনের স্বাভাবিক অঙ্গ বলেই মেনে এসেছেন এতদিন। আজ সকালে ইয়েটস এর এই কবিতার অনুষঙ্গেই মনে এসেছিলেন পুরনো কথা, হয়তো বা বসন্তের হাওয়াতেও। মাহাতোকে ডেকে কর্তব্যকর্ম বুঝিয়ে দিলেন তিনি, কবে ফেরা হবে ঠিক নেই। জবা এখন কেমন আছে কে জানে? খুব সিরিয়াস কিছু নয় নিশ্চয়ই। আজ বিদিশার স্মৃতির ঘোরে বেশ কিছুক্ষণ থাকার ইচ্ছা ছিল পল্বলের। হলো না। স্মৃতিরা সব অপেক্ষা করে থাকো, যদি কোনওদিন আবার এমন ঋতু আসে! এ.ডি’র লেখা একটা কবিতা মনে পড়ল পল্বলের – একলা জীবন কাটিয়ে দেওয়াই যেত /দায়িত্ব সব পাহাড় হয়ে ঘেরা,/ হয়তো ছিলে, চোখের আড়াল বাঁকে /সময় হলে পাহাড় থেকে ফেরার।

Post a Comment

1 Comments

  1. কমলিকা ভট্টাচার্যMay 11, 2025

    ভালো লাগলো

    ReplyDelete