বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৭১
গাব (কেঁদ)
ভাস্করব্রত পতি
'গাব খাবোনা খাবো কি
গাবের তুলা আছে কি'!
যখন গাবের বীজ গলায় আটকে যায়, তখন বলা হয় - আর গাব খাবোনা। গাব গাছের তলায় যাবোনা। আর যেমনি সেই বীজ গলা থেকে নেমে গেল, তখনই আবার সেই গাবতলায় চলে যায়। অর্থাৎ কোনও ব্যাপারে কোনও ব্যক্তি ফেঁসে যাওয়ার পর সে আকুতি মিনতি করে। আবার সেই কার্যোদ্ধার হয়ে গেলে আর কিছু মনে থাকে না -- এটা বোঝাতে এই লোকছড়া ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ 'কাজের সময় কাজী, কাজ ফুরালেই পাজী'।
মার্কণ্ডপুর গ্রামের ধনঞ্জয় ভুঁইয়ার গাব গাছ
গাব সংস্কৃতে তিন্দুক এবং গালব নামে পরিচিত। চরক সূত্রস্থানের ৪ অধ্যায়ে ৪৩ গুচ্ছে এই 'তিন্দুক' সম্পর্কে লেখা আছে 'তিন্দুক পিয়াল বদর খদির ইতি'। সুশ্রুতের সূত্রস্থানের ২৩ গুচ্ছতে আছে 'কদম্ব বদর তিন্দুক'। সংস্কৃতে কঠিন দ্রব্যকে 'গালব' বলে। দেবী ভগবতে গালব মুনির নাম পাওয়া যায়। সেই 'গালব' থেকেই কি 'গাব' শব্দের উৎপত্তি? গাবকে 'নীলসার'ও বলা হয়। এছাড়াও বলে 'কালস্কন্ধ'। আসলে গাছের ডাল ও ছালের রঙ কালো বলেই এহেন নামকরণ। যা চলতি কথায় 'গাব'। তবে যেসব বনৌষধির গ্রন্থে উল্লিখিত রয়েছে 'বিষতিন্দুক', সেটি অবশ্য গাব নয়। তা হল কুঁচেলা ফল (Strychnos nux vomica)।
গাব ফল
গাবকে হিন্দিতে গাব, তেন্দু, ওড়িয়াতে মাকড়কেন্দ এবং ইংরেজিতে Date Plum, Malabar Ebony, Black And White Ebony, Pale Moon Ebony, Royal White Ebony বলে। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Diospyros embryopteris Pers। এটি Ebenaceae পরিবারের অন্তর্গত। অন্যান্য যেসব প্রজাতি রয়েছে, সেগুলি হল --
Diospyros biflora Blanco
Diospyros citrifolia
Diospyros embryopteris Pers
Diospyros glutinifera (Roxb)
Diospyros glutinosa
Diospyros malabarica var. siamensis
Diospyros peregrina (Gaertn)
Diospyros peregrina f. javanica
Diospyros siamensis
Embryopteris gelatinifera
Embryopteris glutinifera Roxb
Embryopteris glutinifolia Link
পাকা ও কাঁচা গাব ফল
এটি ঘন শ্যামল পাতাযুক্ত। গাছটি প্রায় ৩৫ ফুট লম্বা হয়।কাঁচা ফল সবুজ এবং পেকে গেলে পীতাভ হলুদ রঙের হয়। আঠালো এবং সুমিষ্ট। এই মিষ্টি ও কষা সুস্বাদু ফলটি ফাল্গুন থেকে জ্যেষ্ঠ মাস পর্যন্ত পাওয়া যায়। গাবকে কেন্দ বা কেঁদ বলা হয় বিভিন্ন এলাকায়। কথ্য ভাষায় বলে কেঁউ। সেই কেঁদ গাছের নামে অনেক উদ্ভিদবাচক গ্রামনাম রয়েছে এই বঙ্গে। যেমন - কেন্দুডহরী, কেঁদবণী, কেঁদডু্ংরি, কেন্দুয়াডি, কেন্দুয়া, কেঁদডাঙ্গা, কেঁদিশোল, কেঁদডুবি, কেঁদকানালি ইত্যাদি। ইদানিং এই গাছ ক্রমশঃ হারিয়ে যাচ্ছে। অস্তিত্বের সংকটে নিমজ্জিত। ছোটবেলায় ছেলেমেয়েদের কাছে অন্যতম প্রিয় ফল ছিল এই গাব। এখনকার প্রজন্ম এই ফল খাওয়া তো দূরের কথা নামটুকুও শোনেনি। এই ফলের দেখা পাওয়াও খুব ভাগ্যের ব্যাপার। গ্রামাঞ্চল থেকে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে বলা যায়।
গাছে ঝুলছে কাঁচা গাব
থাইল্যান্ডের আঙ থঙ প্রদেশের সরকারি বৃক্ষ এই গাবগাছ। ভারতের মালাবার উপকূলে প্রচুর পাওয়া যায়। এই গাছের আধপাকা ফলের আঠা নৌকার তক্তা জুড়বার জন্য ব্যবহৃত হয়। একে বলা হয় 'গাব ঘেস' দেওয়া। গ্রামের মানুষ মাছ ধরার জালের সূতা শক্তপোক্ত করার জন্য গাবের রস লাগায়। এতে নাকি সূতার আয়ু বাড়ে। গাবের ফল থেকে 'ট্যানিন' জাতীয় আঠা হয়। উত্তর পূর্ব বাংলার লোকজন কচি গাবের পাতা সরু সরু করে কেটে সেদ্ধ করে নারকেল কোরা দিয়ে মোচার ঘন্টের মতো রান্না করে। খুব সুস্বাদু। কালো রঙের এই কাঠ দিয়ে গীটার তৈরি হয়।
পাকা শুকনো কেঁদ ফল ঢেঁকিতে কূটে কেঁদ কুড়া তৈরি হয়। যা ছোটদের প্রিয় খাবার। গাবের ছাল আগুনে পুড়িয়ে গুঁড়ো করে রাখলে কাঁকড়াবিছা কামড়ের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিষেধক। এটি বিষ নষ্ট করে এবং জ্বালার উপশম করে। লোকসমাজে প্রেতাত্মা তাড়াতে ঝাঁটার সাথে কেঁদ জুমড়া দেওয়ার সংস্কার রয়েছে। দীর্ঘ দিনের আমাশয়, ডায়াবেটিস, সর্দি কাশি, উচ্চ রক্তচাপ, মুখের এবং গলার ক্যান্সারের লালাস্রাবে, ঋতুস্রাবাধিক্যে গাবের ব্যবহার করা হয়ে থাকে। গাবের মধ্যে প্রচুর আঁশ আছে। যা অন্ত্রের বিভিন্ন রোগ এবং কোলন ক্যানসারের হাত থেকে বাঁচায়। এছাড়াও উচ্চমাত্রায় খাদ্যশক্তি রয়েছে এতে। তাই গাব ফল খেলে শারীরিক দুর্বলতা কমাতে সাহায্য করে। গাবের মধ্যে থাকা ক্যালসিয়াম হাড়কে মজবুত করে।
🍂
0 Comments