মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৫৭
ডেবরায় (বালিচক) নিজের বাড়িতে চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে সর্পপ্রেমী দীপক কুমার সরদার। এই সাপটিই ছোবল মেরেছিল তাঁর পেটে!
দীপক কুমার সরদার (সর্পপ্রেমী, সর্পবিশেষজ্ঞ, ডেবরা)
ভাস্করব্রত পতি
কেউ একজন বলেছিলেন, 'অলৌকিক কোনো বিষয় বিশ্বাস করা দুর্বল মস্তিষ্কের পরিচয়। তবে উচিত ভালো ডাক্তার দেখানো। উপযুক্ত ফলমূল খাওয়া ও বিশ্রাম। একই কথা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বালিচকের দীপককুমার সরদারের। তাঁর কথায়, জ্যোতিষি, ওঝা, গুনিন, ঝাড়ফুঁক আসলে ভাঁওতা। কোনোও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। মানুষ ঠকানোর বিদ্যে। তবে সবচেয়ে বেশি রাগ সাপে কামড়ানো রোগীদেরকে নিয়ে যাঁরা ঝাড়ফুঁক, তুকতাক, ওঝাগিরি করেন তাঁদের ওপর।
আদি বাড়ি বারুইপুর। সেখানেই স্ত্রী, পুত্র, কন্যাসহ পরিবার থাকলেও নিজে থাকেন বালিচকে। দীপক সরদারকে এলাকার মানুষ ভালোবাসেন অন্য কারণে। নিজে সাপুড়ে নন। অথচ সাপের খেলা দেখান। সাপের সাথে রাত কাটান। কিন্তু সেটাই দীপকের প্রকৃত বলার মতো বিষয় নয়। সাপ নিয়ে মানুষের মনে যে ভয়, কুসংস্কার আর ঘৃণাবোধ রয়েছে তা দূর করার জন্য তিনি আপ্রাণভাবে চেষ্টা চালাচ্ছেন। ১৯৬২ সাল থেকে তাঁর সর্পপ্রীতি। মাকে হারাতে হয়েছিল বিষধর সাপের কামড়ে। নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ওঝার কাছে। বাঁচেনি মা। সেই থেকে শুরু সাপকে জানা, চেনা আর ভালোবাসার কাজ। মেদিনীপুরে থাকতে থাকতেই তিনি ভালোবেসে ফেলেছেন এই জেলাটিকে। আর মেদিনীপুরের মানুষও আপন করে নিয়েছে এই সর্পপ্রেমীটিকে। সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার কাজের সূত্রে তিনি হয়ে উঠেছেন মেদিনীপুরের মানুষ রতন।
পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের কর্মী ছিলেন। আসলে আজ আর তিনি সাপ নিয়ে সচেতনতা শিবির করেননা। কেননা, সম্প্রতি তাঁর মৃত্যু হয়েছে। সাপের কামড়েই প্রাণ চলে গিয়েছে তাঁর। গ্রামে গ্রামে গিয়ে দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে জ্যান্ত সাপ নিয়ে গিয়ে জনসমাজকে সচেতন করার কাজ করতেন। একাজে দারুণ ভূমিকা ছিল তাঁর। বিভিন্ন স্কুলে, মেলায়, উৎসব অনুষ্ঠানে জীবন্ত বিষধর সাপ নিয়ে গিয়ে প্রদর্শনী করতেন সাপ সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারণা দূর করতে। হলদিয়া উৎসব, কাঁকটিয়া উৎসব, মেদিনীপুর মেলা, তাম্রলিপ্ত মেলাতে দীপক সরদারের সর্প প্রদর্শনী ছিল আলাদা আকর্ষণ।
সঙ্গহীন এবং সঙ্গীহীন দীপক সরদার থাকতেন সাপ নিয়ে। ডেবরার কাছে ক্যানেলপাড়ে ছিল তাঁর আস্তানা। অত্যন্ত সাধাসিধে জীবনযাপন ছিল তাঁর। অভাব লেগেই ছিল তাঁর জীবনে। তবুও হাসিমুখে কাজ করতেন সারা জেলা জুড়ে। একসময় নিজের মেয়েকেও সাপ ধরা এবং সাপ নিয়ে অন্ধ ভয় কাটানোর কাজে যুক্ত করেছেন। তাঁর স্নেহের বাঁধনে মেয়েও তৈরি হয়েছিল সেরকমই। পরবর্তীতে তাঁর দুঃসাহসী সেই মেয়ের নাম হয়ে গিয়েছিল 'লঙ্কাবুড়ি'!
দীপক সরদার সাপ নিয়েই দিন কাটাতেন, নাড়াচাড়া করতেন নিজের হাতে। ফলে সেই সাপ তাকে কিছু করবেনা, তা কি হয়? বেশ কয়েকবার বিষধর সাপের ছোবল খেয়েছেন। তবে ওঝা, গুনিন, তুকতাকের বদলে তিনি ভরসা করেছিলেন সরকারী হাসপাতালের চিকিৎসার ওপর। সাপ যে মানুষের শত্রু নয়, সাপের কামড় খেয়েও যে বেঁচে থাকা যায় তা বোঝাতে নিজেই বিষধর চন্দ্রবোড়া (ভাইপেরা রাসেলি) সাপের ছোবল খেলেন তলপেটে! অজ্ঞান হয়ে যাওয়া দীপকবাবুকে এই প্রতিবেদক সেবার নিয়ে যায় ডেবরা সদর হাসপাতালে। ২৫ টি এ ভি এস ইনজেকশান নেওয়ার পর সেযাত্রা বেঁচে যান সর্পপ্রেমী দীপক সরদার!
সাপের উৎপত্তি মেসোজোয়িক যুগে টিকটিকি থেকে। এঁরা শল্কটা। টিকটিকির সঙ্গে নানা বিষয়ে মিল থাকলেও 'এপিস্টারনাম' নেই। টেরিগয়েড অস্থি অবাধে সঞ্চালন করতে পারে। আজ থেকে ২৫০ কোটি বছর আগে সরীসৃপ পাওয়া গিয়েছে। পালিওজোয়িক যুগের শেষ দিকে সরীসৃপ শাখা খুব ভালোভাবে গড়ে ওঠে। এরপর মেসোজোইক যুগে এক অদ্ভুত ধরনের সরীসৃপের জন্ম হয়। মধ্য মেসোজোয়িক যুগে বর্তমান সরীসৃপদের পূর্বপরুষরা জন্মায়। কিন্তু ক্রিটাশিয়াস এবং সেনোজোয়িক যুগের প্রথম দিকে এঁদের অনেকেই মারা পড়ে। ট্রিয়াসিক যুগ থেকে চলে আসছে টিকটিকির বংশ। তবে এক সময় ওলিগোসিন যুগে আজকের মতো চেহারার বহু সাপ দেখা গিয়েছিল। মেসোজোয়িক যুগের সরীসৃপদের মধ্যে মাত্র ৪ টি ক্রম এখনও টিকে আছে। (ক) 'রিঙ্কোসেলাফিয়া' বা টুয়াটারা (খ) 'লোরিকাটা' বা কুমীর (গ) 'কেলোনিয়া' বা কচ্ছপ এবং (ঘ) 'শল্কটা' বা টিকটিকি ও সাপ। অর্থাৎ সাপের আর্বিভাব বহু প্রাচীন। 'মানুষ তাঁর জন্মলগ্ন থেকেই এঁদের সঙ্গে পরিচিত। তাই সাপ নিয়ে ভীতি জন্মানো স্বাভাবিক। কিন্তু মানুষের এই ভীতির পিঠে চেপে একশ্রেণীর সুবিধাবাদী মানুষ ওঝাগিরি, গুনিনগিরির মাধ্যমে করেকম্মে খাচ্ছেন। এ। এখানেই দীপক সরদারের আপত্তি, প্রতিবাদ। মানুষকে বোকা বানিয়ে জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে যাঁরা, তাঁদের মুখোশ খুলে দিতে পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের এই কর্মীটি ছিলেন সদাই সজাগ একজন সমাজসচেতন ব্যাক্তি।
এক সময় উত্তমকুমারের সিনেমায় সাপ সরবরাহ করেছেন। কিন্তু তা ছিল পেটের তাগিদে। আর মেদিনীপুরের বুকে আসার পর তিনি তাঁর মন সঁপে দেন সাপ নিয়ে কল্পকাহিনী, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য। 'বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না', 'নাগ পঞ্চমী', 'নাগরাজ', 'নাগিন', 'নাচ নাগীন নাচরে', 'রূপবান কন্যা' ইত্যাদি সিনেমায় সাপ নিয়ে কল্পনার জাল বোনা হয়েছে। এখানেও দীপকবাবুর প্রতিবাদ। সাধারণ মানুষ সিনেমায় দেখানো সাপের বিষয়কেই সত্যি বলে ভাবছে। এরফলে ভীতিজনিত কারণে মানুষ মেরে ফেলছে সাপ। কিন্তু প্রকারান্তরে 'ইকো সিস্টেম' ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এটাই প্রচার করতেন দীপকবাবু।
দীপকবাবুর কথায়, ভারতে ২১৬ প্রজাতির সাপ থাকলেও ৬৮ প্রজাতির সাপ বিষধর। এক নম্বরে কালচিতি বা কালাজ। পশ্চিমবাংলার ৮ টি বিষধর সাপের দেখা মিললেও শঙ্খচূড়, কিং কোবরা, ফুরসা (সসকেলস ভাইপার) এবং গেছোবোড়া (গ্রীন পিড ভাইপার) -- এই চারটি সচরাচর মানুষের কাছাকাছি আসেনা। বাকি রইল চার। এগুলি 'মহাচার' তথা গোক্ষুরা, চন্দ্রবোড়া, কালচিতি এবং শাঁখামুটি (ব্যান্ডেড ক্রেইট) এই চারটিই মারাত্মক। মানুষজন জানেনা অনেক সাপের ব্যাপারে। ফলে বিষহীন ডোমনা চিতি, লাউডোগা, দাঁড়াস, তুতুর, ধোড়া, মেটালি ইত্যাদি সাপের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটে লোকালয়ে এলে।
সাপের বিষ অ্যালবুমিন জাতীয়। এতে থাকে এন্টিফাইব্রিন, এরেপসিন, হেমোলাইসিন, হেমোরাজিন, সাইটোলাইসিন, নিউরোটক্সিন, থ্রম্বেস, এন্টিকো এগুলিন, প্রোটিয়াজ, কোলিন এস্টেরাজ, হায়ালুরোনিডাজ, লেসিথিনাজ, ফসফোডায়াস্টেজ, রাইবো নিউক্লিয়াজ, ওফিয়োঅক্সিডাজ, কোএগুলিন, নিউক্লিওটিডাস ইত্যাদি। মূলত ফসফাটিডাজ ও স্নায়ুবিষয়ক বস্তুগুলি বিষের ক্রিয়ার জন্য দায়ি। প্রজাতি অনুসারে বিষে আমিষের পরিমাণ বাড়ে কম। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার, বিষের সঙ্গে অল্প পরিমাণ প্রতিবিষ বা অ্যান্টিভেনিনও মেশানো থাকে। সাপের কামড়ে ১০ মিনিটের মধ্যে কোনও উপসর্গ দেখা যেতে পারে। তবে দীপকবাবুর অভিমত, সাপ কামড়ালে মোটেই কোনও ওঝার কাছে নয়, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
রাতে সাপের নাম করতে নেই। দুধ কলা দিয়ে সাপ পোষা যায়। গোরুর বাঁট থেকে সাপ দুধ খেতে পারে। সাপ প্রতিশোধ নিতে পারে। লাউডোগা সাপ চোখ তুলে নেয়। দাঁড়াশের লেজে বিষ থাকে। কালাজ মানুষের ঘাম খায়। সাপের মাথায় মণি থাকে। সাপ মানুষের দেহ থেকে বিষ তুলতে পারে। এরকম বহু ভ্রান্ত ধারণা গ্রাম বাংলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে। এগুলোর কোনও সত্যতা নেই। দীপকবাবুর আবেদন ছিল, রাতে আলো ব্যবহার করা উচিত। খোলা জায়গায় ঘুমানো উচিত নয়। কুসংস্কার এড়িয়ে যেতে হবে। আর নেহাতই সাপ যদি কামড়ায়, তবে ওঝা গুনিনের ভরসায় না থেকে সোজা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াই শ্রেয়। হাসপাতালকে ভরসা করে ছবার সাপের কামড় খেয়েও দিব্যি বেঁচে থাকা সর্পপ্রেমী দীপক সরদারের অবশ্য মৃত্যু হয়েছে সাপের কামড়েই। হয়তো, বয়স বাড়ার কারনে তাঁর দেহের প্রতিরোধক্ষমতা কমে গিয়েছিল। হয়তো পরিমাণমতো অ্যান্টিভেনাম সিরাম পড়েনি। যাইহোক, সাপ নিয়ে সাধারণ মানুষের সাথে থেকে মেদিনীপুরের এই মানুষ রতনটি যেভাবে কাজ করে গিয়েছিলেন, আজ তাঁর অভাব উপলব্ধি করবেই জেলাবাসী।
🍂
0 Comments